পূর্ব পরিচ্ছেদ / লোক দশকতামামি ২ : বাংলাদেশের কবিতার সন্ধান ও প্রশ্নজট
ওপরে লিপিবদ্ধ প্রশ্নগুলোর সারার্থ ভাবতে বসে রোলাঁ বার্থের উক্তি (*সমকালীন সাহিত্যে নতুনত্বের নামে যা চলছিল তাকে বাণ মারতে গিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন যদিও।) মনে পড়ে গেল। মুক্তক্রীড়ার পক্ষে ওকালতির ক্ষণে বার্থ বলেছিলেন জনসংস্কৃতির বৃত্তে উৎপাদিত রচনা অর্থাৎ টেক্সট নতুন অর্থ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে না। লেখক নতুন কিছু রচনা করে না। সে যা লেখে তার আদ্যোপান্ত দূরাতীত কাল থেকে একই অর্থ বারংবার জন্ম দেওয়ার প্রয়োজনে লিখিত হয়ে আসছে। নতুন অর্থ সৃষ্টির প্রেরণা থেকে যে-রচনা মাত্র জন্ম নিলো ভাষাশৈলীর কারিকুরি বাদ দিলে উক্ত রচনায় ছলকে-ওঠা অর্থস্তরের সঙ্গে দূর অতীতে জন্ম নেওয়া রচনার অর্থস্তরের বিশেষ পার্থক্য নেই; আর অদূর ভবিষ্যতের গর্ভে শায়িত যেসব রচনা জন্মের দিনক্ষণ গুনছে তারাও অতীত অর্থের পুনরাবৃত্তি বৈ অন্য কিছু নয়। অতএব টেক্সটকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট মিনিং বা অর্থস্তর অন্তহীন পুনরাবৃত্তির খেলাকে নবীকরণ করে যায় মাত্র :—
The bastard form of mass culture is humiliated repetition…always new books, new programs, new films, news items, but always the same meaning. (দ্রষ্টব্য A Lover’s Discourse: Fragments By Roland Barthes, 1977)
বার্থের বক্তব্যে জনসংস্কৃতিচর্চিত ভাষায় অর্থস্তর উৎপাদনের পদ্ধতি নিয়ে ছুপা বিদ্রুপ থাকলেও কথাখান সম্ভবত আমলে নেওয়া প্রয়োজন। পুরাতন বোতলে নতুন মদ ভরে দেওয়ার খেলা থেকে রেহাই পেতে রচয়িতার সংজ্ঞাকে তিনি পাঠকের মুক্তক্রীড়ার স্বেচ্ছাচার দিয়ে বিলোপের আওয়াজ তুলেছিলেন। এই ভাবনার প্রভাবে হবে হয়তো ময়মনসিংহ থেকে নয়ের দশকের মধ্য বা অন্তিম পর্বে এসে একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে একখানা ছোটকাগজ বেরিয়েছিল মনে পড়ে। সে-কাগজের নামধাম এখন মনে নেই। বার্থ সাহেব কোন ফাঁপরে পড়ে অর্থের পুনরাবৃত্তি নিয়ে কামান দেগেছিলেন অথবা রচনার শরীর থেকে রচয়িতাকে বিলোপের নিদান হাঁকছিলেন সেটি বোঝার বয়স কাগজের তরুণ উদ্যোক্তাদের ছিল না। রচয়িতার নাম বিলোপের ঘটনাকে আক্ষরিক ধরে নিয়ে তাঁরা কাগজখানা বের করেছিলেন। কবুল করা প্রয়োজন, সংকলিত সেই কবিতাপাঠে সমস্যা ঘটেনি, তবে পুরাতন অভ্যাসের দোষে কবিগণের নামধাম জানতে না পারায় মনে খানিক অস্বস্তি জেগেছিল বৈকি!
রচয়িতার পরোয়া না করে ভাষায় বিরচিত লেখা পাঠ ও উপলব্ধিতে বড়ো উৎপাত কিন্তু সত্যি ঘটে না! লোকে যেমন আজো ধ্রুপদি ও লোকসাহিত্যের ষোলোআনা নামের মারকাটকাট ওজনের পরোয়া না-করে দিব্যি পাঠ যায়। এই জায়গা থেকে যদি ভাবি তাহলে দশক-যুগ-প্রজন্ম কিংবা শতাব্দীর শ্রেণিবিন্যাসে বন্দি কাব্যধারা ভাষা ও অর্থ পরম্পরায় পৃথক হওয়া সত্ত্বেও যমজ;— ভাবনাটি একবার দিমাগে ঢুকিয়ে নিতে পারলে দশক নিয়ে সরবতা কিংবা নীরবতা টেক্সটের কেন্দ্রবস্তু রূপে নিজের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। বার্থ সাহেবের উক্তির সারার্থে দার্শনিক ভাবনার বীজ ও সারবস্তু থাকলেও এ-কথা সত্য দশকভেদে ভাষার অর্থস্তরে যেসব সংকেতের তরঙ্গ বহে সেগুলোর মূল্য (*সে তিনি স্বীকার করুন বা না-ই করুন) নিছক নগণ্য নয়। অর্থস্তর সৃষ্টিতে সময়ের স্বকীয় চরিত্র ধারণের ঘটনা তাঁর ব্যাখ্যায় কেন যেন উহ্যই থেকে যায়!
সে যা-হোক, যথেষ্ট সারবত্তা থাকা সত্ত্বেও বার্থের উক্তিকে আপাতত উপেক্ষা করা যেতেই পারে; তবে সেক্ষেত্রে এ-কথা বলা প্রয়োজন, — ত্রিশ পরবর্তী সময়ে জন্ম নেওয়া কবিরা সেই কবিতাগুলো রচনায় বাধ্য ছিলেন যা আশি বা নব্বইয়ের কালপর্বে প্রাসঙ্গিক ছিল না। চল্লিশ যেমন অগ্রজ ত্রিশ ও অনুজ পঞ্চাশ বা ষাট থেকে পৃথক পথে গমনে বাধ্য ছিল, কারণ সময়ের নাটকীয়তা অন্যস্বরে কথা বলার জন্য তখন চাপ সৃষ্টি করছিল। ষাট থেকে সত্তুরের সময়বৃত্ত অনুরূপভাবে ত্রিশের ছায়া থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে না পারায় গতানুগতিকে ফকির মনে হলেও সময়ের বিবিধ বৈপরীত্যকে নিজের অঙ্গে ঠিক জড়িয়ে নিচ্ছিল। শামসুর রাহমান ‘পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ’ যেমন লিখেছেন, একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে ‘আসাদের শার্ট’ না লিখে তাঁর উপায় ছিল না। অর্থাৎ সময় কবিকে ভাষার শরীর থেকে নতুন অর্থস্তর নিষ্কাশনে বাধ্য করে। এখন বার্থের উক্তি অনুসারে তাকে পুনরাবৃত্তি মনে হলেও এর মূল্য নিছক সাময়িক নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে দূরবিস্তারী বটে, যেখানে একটি দশকি ভাষার শরীরে সৃষ্ট অর্থস্তর পরবর্তী কোনো দশকে হয়তো ভিন্ন মাত্রায় পঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রেখে যায় অথবা নবায়নের মধ্য দিয়ে নতুন অর্থস্তর সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। নব্বইয়ের কবিতায় অগ্রজ দশক কর্তৃক সৃষ্ট অর্থস্তরের এমনধারা প্রবাহ নিরলে বহে কি-না সে-বিষয়টি বোধহয় যাচাই করা উচিত। ‘লোক’-র ‘গতানুগতিক ধারাবাহিকতা’ বিষয়ক বক্তব্যে এই ভাবনার অনুপস্থিতি তাই পীড়াদায়ক ঠেকে।
গানপার ম্যাগাজিনরিভিয়্যু
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS