বিদায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান || রবি কিরণ সিংহ

বিদায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান || রবি কিরণ সিংহ

শেয়ার করুন:

পথিক আমি, পথেই বাসা
আমার যেমন যাওয়া তেমনি  আসা

বর্ষার যুঁথি-কদমে সিক্ত গহন রাতে শেষগানের রেশ নিয়ে নীরবে নিভৃতে চলে গেলেন আতাউর রহমান—আমাদের সবার আপন আতাভাই।

আতা ভাইয়ের সাথে সরাসরি পরিচয় গানের ক্লাসে। ‘আনন্দলোক’-এ প্রতি সপ্তাহে গানের সাথে আমরা মিলিত হতাম। নগরজীবনের ইটকংক্রিটের দেয়ালে আটকে পড়া ঘোড়দৌড় জীবনকে ‘গানের জোয়ারে, ভাসাব দোঁহারে’ বলে আমরা মিলিত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শিখতাম-গাইতাম। জগলুভাই, জাভেদভাই, শৈলেনদা, বিজয়দা, শেখরদা, বিমান, অজয়, জয়, জয়ন্ত, সুকান্ত, সুমন্ত, মিঠু সহ আমাদের গানের দলটি ছিল জমজমাট। সাথে ছিল রবীন্দ্রসাহিত্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা তর্কবিতর্ক।

আতাভাইয়ের সাথে কত স্মৃতি—পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান আয়োজন, রির্হাসেল, স্ক্রিপ্ট তৈরি। এসব অনুষ্ঠানে আতাভাইয়ের আর্থিক সহযোগিতা থাকত নিশ্চিত—বিশেষ করে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। মনে পড়ে ২০০৬/০৭ সালের দিকে আমাদের সংগীতগুরু রানা কুমার ‍সিনহার সুবর্ণ জন্মজয়ন্তীতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম জেলা পরিষদ হলে। এ-সময় একটি ছোট স্মারক সংকলন ‘যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি’ প্রকাশ সহ যাবতীয় অনুষ্ঠানের অন্যতম কারিগর ছিল আতাভাই। সিলেটের অনেক সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আমাদের আতাভাই।  একজীবনে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে পড়িয়েছেন বিনা পারিশ্রমিকে। আর শোকে দুখে কতজনের পাশে যে তিনি দাঁড়িয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সব প্রোগ্রামে আতাভাই তার সুন্দর হাতের লেখা গান লিখে নিয়ে আসত। আমরা সেটা ফটোকপি করে গীতবিতানের ভারমুক্ত হতাম। আর আতাভাইয়ের লেখা ছাড়া পূর্ণতা পেত না আমাদের স্মারক প্রকাশনা ‘কালের মন্দিরা’।

বর্তমান  সময়ে অনেক সংগীতশিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখি—কিছু শেখামাত্র মঞ্চে একক গাইবার মনোবাসনা। আতাভাই ছিলেন এ-ব্যাপারে একেবারে উল্টোটি। সাদামাটা নিরাভরণ কণ্ঠের অধিকারী আতাভাই কোনোদিন মঞ্চে একক গান গাইবার জন্য আগ্রহী ছিলেন না। একবার জেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত এক বর্ষাবরণে আমাদের জোরাজুরিতে গেয়েছিল। গায়ক শিল্পী হবার জন্য নয়, শুধু নিখাদ গানের টানে ভালোবেসে রবীন্দ্রসংগীত শেখা এ জগতে কে আছে, আমি জানি না।

সিলেটে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার শাখা গঠনে তাঁর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ।

সিলেটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আতাভাই ছিলেন এক নিয়মিত দর্শক। আর শ্রোতা হিসেবে ছিলেন অনন্য উঁচুদরের। আনন্দলোকের অনুষ্ঠানে তাঁর নিয়মিত উপস্থিতি এবং আমাদের শিক্ষার্থীদের পারফরমেন্স সহ সামগ্রিক গঠনমূলক সমালোচনা আমরা অভাববোধ করব নিঃসন্দেহে।

আপাদমস্তক সরল সহজ ধার্মিক মানুষটি যে কতটুকু প্রগতিশীল, সংস্কৃতিবান ছিলেন তা সংস্পর্শে না এলে বোঝা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকুরিসূত্রে আতাভাই সিলেটে আসেন। তখন থেকেই এ মাটির টানে প্রেমে থেকে গেলেন এখানে আমৃত্যু।

চোখে ভাসছে ১৪০২ বাংলা সনে শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজ প্রাঙ্গণে আনন্দলোকের বর্ষবরণে সম্মেলক কণ্ঠে আতাভাই গাইছে আর ১৪৩২ বাংলা সনে এসে শ্রোতার সারিতে বসে সেই আতাভাই কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে—আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ…

গতকাল বুধবার সকাল ১১ টার দিকে অনুজ বিমানের ফেবুপোস্টে যখন আতাভাইয়ের প্রয়াণে খবর পেলাম তখন ভেতর থেকে এক বোবা চাপাকান্না ডুকরে উঠল। ততক্ষণে তাঁর লাশবাহী গাড়িটি ছুটে চলেছে জন্মভিটা মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে।  শেষ দেখা আর হলো না।

আতাভাই, বারেক তোমায় শুধাবারে চাই / বিদায়কালে কী বলো নাই / সে কি রয়ে গেল গো সিক্ত যুঁথির গন্ধবেদনে…


গানপারে ট্রিবিউট রচনারাশি 

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you