বাউলিয়ানা সহজ পাঠ ২ || মাকসুদুল হক

বাউলিয়ানা সহজ পাঠ ২ || মাকসুদুল হক

বাউলিয়ানা সহজ পাঠ ২ || প্রসঙ্গ : বুদ্ধদেব ও শাক্যমুনি


“কেউ-বা বলে ভন্ড ফকির, কেউ-বা ব্যবসা কয়
কেউ-বা বলে আল্লাহ্ রসুল
কইরাছে সে জয় রে, কইরাছে সে জয়
কেউ-বা বলে গুপ্তচর, কেউ বা বলে জাদুকর
কেউ-বা আবার ভেদ বুঝিয়া,
পিছন পিছন ঘুরতাসে”

গৌতম বুদ্ধ নিজেকে ঈশ্বর এমনকি নবি বলেও কখনো দাবি করেন নাই। বৌদ্ধ ‘ধর্ম’ যদিও আমরা বলি — আদতে এ কোনো ধর্ম নয়। এ এক জীবনব্যবস্থা, যাপিত জীবনের এক সত্তা।

গৌতম বুদ্ধই যে একমাত্র ‘বৌদ্ধ’ ছিলেন তা নয়। যে-কোনো মানুষ সাধনা দ্বারা বৌদ্ধত্ব লাভ করতে পারেন। অনেকেই বলেন গৌতম বুদ্ধ, নবান্ন বা নির্বানা ‘অর্জন’ করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে উনি কিছুই অর্জন করেননি।

নির্বানা হলো স্থূলদেশ, প্রবর্তদেশ, সাধকদেশ পাড়ি দিয়ে সিদ্ধিদেশের পরিভ্রমণ। কেবল শুদ্ধজন সিদ্ধিদেশে যেতে পারেন। তাসাওউফ জ্ঞানদীক্ষার ভাষায় উনি কামালিয়াত ও ওয়ালিওতের বিরল জীবিত অস্তিত্বে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন।

নির্বানাতে পৌঁছানোর পর তিনি “ইউরেকা” বা “আমি পেয়েছি” বলেননি — বলেছিলেন, “আমায় ছেড়েছে, আমায় ছেড়েছে”।

পৃথিবীর সাথে যত রকম সম্বন্ধ : যথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য সব ত্যাগ করে উনি মহামানব, মহাত্মা ও সম্যক গুরু হয়ে ওঠেন — তারপর “শাক্যমুনি” বা নীরবতার ব্রততে ডুবে গেলেন।

অতঃপর যখনই উনি কথা বলতেন প্রতিটি কথা হয়ে উঠেছিল স্রষ্টার বাণী। অর্থাৎ বুদ্ধদেবের মস্তিষ্কে ঈশ্বরের ছাপ পড়ল; — এরপর উনি যা বলতেন, যেভাবে চলতেন, হাঁটতেন, আহার গ্রহণ করতেন, নিদ্রাযাপন করতেন, ধ্যান করতেন — তা সবই ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত — উনি ঈশ্বরের সঙ্গে ছিলেন সম্পূর্ণ “সংযুক্ত” বা “ইয়োগা” বা যোগ-এ । “যোগ” হলো “বিয়োগের” বিপরীত শব্দ।

বহু বছর, বহু দেশ-দেশান্তরে ঘুরে, ওনার বাণী জনে জনে প্রচার করে, যে-ফল উনি পেয়েছিলেন — তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ফল পেয়েছিলেন যে-বছরগুলোতে উনি নীরব ছিলেন। যেখানে ওনার ভক্ত অনুসারী ছিলেন হাজারে — তা লক্ষতে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগেনি।

যেখানে উনি নীরবে হেঁটে যেতেন, সে-দেশের সকল রাজারা বা বিত্তবান ব্যক্তিগণ তাদের দরজা উন্মুক্ত করে দিতেন এবং উনি সবাইকে নিয়ে নীরব ধ্যানে বসে থাকতেন। মাঝেমধ্যে কিছু বাক্য ব্যয় যা করতেন তা শোনার জন্য হাজারো লোক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন।

আবার হঠাৎ উঠে হাঁটা শুরু করতেন — ওনাকে কেউই হাজার কাকুতিমিনতি করেও একজায়গায় দুই বা তিন মাসের বেশি রাখতে পারত না।

একদা ভক্তকুলের “ঈশ্বরের অস্তিত্ব” নিয়ে ব্যাপক তর্কবিতর্কের ফলশ্রুতিতে ওনাকে যখন প্রশ্ন করা হলো “হে মহান, আপনি কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কিছু বলবেন”?

বুদ্ধদেব দীর্ঘক্ষণ নীরব থেকে — চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলেন, “এত ছোট মুখে এত বিশাল অস্তিত্বের কথা আমি তোমাদের কী করে বলি?”

ঈশ্বরের রূপ যখন মানুষ দেখতে পায়, যেদিন ভাবের উদয় হবে — সে-মুহূর্ত থেকে কিছু শব্দ, কিছু অভিব্যক্তি, শুধুই ঝাঁঝালো কথা দ্বারা প্রকাশ করা আর সম্ভব হয় না। তাই স্রষ্টার আরাধনা ও সাধনা কে কীভাবে করছেন তা নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গলজনক।

সঠিক নাকি বেঠিক হচ্ছে সাধনা — তার উত্তর নীরবতাই দিয়ে দেবে, কারণ নীরবতা নিজেই একটা ভাষা। একটু চর্চা করলে অনেককিছু মন থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, কোনো বাহাস্ বা তর্কের তখন আর প্রয়োজন পড়ে না।

ঈশ্বরকে দেখতে, শুনতে, খেতে আমরা পারব না৷ শুধুমাত্র যদি ঈশ্বর-এ চিনির ন্যায় দ্রবীভূত হওয়া যায়, তবেই তাকে কেবল “অনুভব” করতে পারব৷

অনুভবে ভাব — ভাবে অনুভব, এর ব্যতিরেকে যে-কোনো সাধনাই অসম্ভব৷

ওঁম বোধিসত্ত্ব
ওঁম শাক্যমুনি
ওঁম মানি পদ্মা হাম
জয় গুরু আলেক সাঁই

সিটাডেল বাউলিয়ানা / পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা / ২৮ জুন ২০২১


বাউলিয়ানা সহজ পাঠ ১
মাকসুদুল হক রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you