একটা জিনিস খেয়াল করলাম, বাংলাদেশে সিনেমা কিন্তু খুব কমই বানানো হইছে। যদিও ১৯৫৬ সালে একটা সিনেমা বানানো হইছিল (মুখ ও মুখোশ), এর পরে ১৯৫৯-এ ৪টা সিনেমা রিলিজ হয়। ১৯৬৫-৬৬ সালের দিকে একটা ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে তৈরি হইতে থাকে আসলে, তারপরও বছরে গড়ে ২০/২২টা সিনেমাই রিলিজ হইছে। গত পনের-বিশ বছরে মেবি গড়ে ৪০/৫০টা কইরা হবে। মানে, মোট সিনেমা দুই বা আড়াই হাজারের বেশি মনেহয় হওয়ার কথা না। আমি উইকিপিডিয়ার হিসাব দেইখা বলতেছি। যদিও একটু সন্দেহই হইতেছে, লিস্টটা মনেহয় কমপ্লিট কোনো জিনিস না, কারণ ১৯৯০-এর দিকের ‘অশ্লীল’ ছবিগুলা মনেহয় অইখানে ইনক্লুড করা হয় নাই।
তো, উইকিপিডিয়াতে সিনেমার নামটাম বাদে আর কোনো ইনফরমেশনও নাই। কত টাকা বাজেট ছিল, কত টাকা ইনকাম হইছে, কয়টা হলে চলছে, কাহিনি কি ছিল বা ইম্প্যাক্ট কি রকম… এই টাইপের তেমন কিছুই নাই। মানে, বাংলা সিনেমা নিয়া কাঁচা, আধাপাকা, পাকা বা রটেন লেখাপত্র কিছু চোখে পড়ছে, কিন্তু ইনফরমেশন যেহেতু ‘জ্ঞান’ না, এই কারণে কেউ একসাথে করার বা রাখার কথা ভাবেন নাই মনেহয়। 📷 🙁 (এইখানে বইলা রাখতে চাইতেছি, কারো যদি বাংলা সিনেমার ডাটাবেইজের খবর জানা থাকে, জানাইয়েন; তাইলে হয়তো আমার পয়েন্টগুলা আমি আরো জোর দিয়া বলতে পারব বা রিভিউ করার চান্স পাবো।) কিন্তু ‘জ্ঞান’-এর আলাপ করতে গেলেও ইনফরমেশন কম-বেশি তো লাগে আসলে।… তো, এই কম ইনফরমেশনের বেসিসেই কিছু কথা বলতে চাইতেছি।
মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬) আসলে আবদুল জব্বার খানের পারসোনাল ইনিশিয়েটিভই ছিল, এরপরে উনি আরো পাঁচটা সিনেমা বানাইলেও, এর মধ্যে ‘কাচ কাটা হীরা’ (১৯৭০) মনেহয় হিট হইছিল।
এরপরে ১৯৫৯ সালের ৪টা ছবিই ক্রুশিয়াল মনেহয় আমার কাছে, বাংলাদেশি সিনেমার হিস্ট্রি বুঝার লাইগা। ৪টা আলাদা আলাদা ট্রেন্ডরে লোকেট করা যায় এখন, এই ২০২০ সালে বইসা।
এই বছরের যেই ছবিটার নাম বেশি শোনা যায় সেইটা হইতেছে — ‘জাগো হুয়া সাভেরা’, ডিরেক্টর আছিলেন আখতার জং কারদার, উনি অ্যাসিসেন্ট হিসাবে নিছিলেন জহির রায়হানরে, আর সিনেমার কাহিনি লিখছিলেন পাকিস্তানের উর্দু ভাষার কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির একটা অ্যাডাপ্টেশন। ইন্টারেস্টিং জিনিস হইলো, এই সিনেমা পাকিস্তানের সিনেমাহলগুলাতে ‘মুক্তি’ পায় নাই, পলিটিক্যাল ঝামেলার কারণে, কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ পাইছিলো, মস্কোতে। ইন্টারেস্টিং না ব্যাপারটা! 📷 🙂 এখনো অনেক সিনেমাই, মানে ‘আর্ট-ফিল্ম’ কিন্তু বাংলাদেশে বানানো হয় প্রাইজটাইজ পাওয়ার লাইগা, সিনেমাহলে চললে ভালো, না চললেও কোনো সমস্যা নাই; বা আর্ট-কালচারের লোকজন যদি বুঝে, কথাবার্তা কয়, তাইলেই এনাফ। যেই পাবলিক ‘আর্ট’ বুঝে না — তাদের লাইগা আমরা সিনেমা বানানো নাকি! এইরকম যেই ধারা, সেইটার শুরু হিসাবে এই সিনেমাটারে দেখতে পারেন। দুসরা ঘটনা হইলো, তখন সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার, এই কারণে মার্কসিস্ট ঘরানার জিনিস প্রাইজটাইজ পাইতো; আর এখন দেখবেন, লিবারাল ইস্যুগুলা নিয়া অনেক হাতিঘোড়া মারা হয়। কারণ আপনি যদি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ পাইতে চান, সো-কল্ড ইন্টারন্যাশনাল ইস্যুগুলার লগে আপনারে কানেক্ট করতে পারতে হবে তো! তো, এই ধারাতে এরপরে আরো অনেক ডিরেক্টর, সিনেমা পাইছি আমরা। আমার ধারণা, কিছু কিছু নাম মনেহয় মনে করতে পারবেন আপনারা।
সেকেন্ড সিনেমাটার নাম হইতেছে, ‘আকাশ আর মাটি’, ডিরেক্টর আছিলেন ফতেহ লোহানী। ফতেহ লোহানী পরে ‘আসিয়া’ (১৯৬০) আর ‘সাত রং’ (উর্দু, ১৯৬৫) বানাইছেন, কিন্তু কোনোটাই এই সিনেমার মতোই তেমন কোনো ব্যবসা করতে পারে নাই মনেহয়। এই সিনেমাটা নিয়া তেমন কোনো ইনফরমেশন নাই; তবে যট্টুক ধারণা করা যায়, এক রকমের কলকাতার আর্ট-কালচারের একটা টোন মেবি থাকার কথা, যেইটা একদিক দিয়া পাবলিক যেমন খায় নাই, ডিরেক্টরও এন্টারটেইনমেন্ট সার্ভ করতে চাইছেন এক রকমের ‘শিক্ষিত মিডলক্লাসের’ জন্য যারা তখনো সিনেমাহলে যাইতে শুরু করে নাই, বা পরে টিভিনাটকের কনজ্যুমার হইতে পারছেন। এই ধারাতেও সিনেমা হইছে কিছু বাংলাদেশে, এখনো হয়; কিন্তু ডিরেক্টররা পাবলিক খাইলে চিন্তায় পইড়া যান, কী ভুল উনি করলেন! 📷 🙂 এইরকম।
থার্ড সিনেমাটা ইম্পর্টেন্ট। নাম — ‘মাটির পাহাড়’। ডিরেক্টর মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। উনারে চিনবেন উনার আরেকটা সিনেমার নাম দিয়া — ‘বড় ভালো লোক ছিল’ (১৯৮২), এইটারও ডিরেক্টর উনি। ১৯৭৪ সালে ‘ঈশা খাঁ’ নামেও একটা সিনেমা বানাইছিলেন। (মোট ৯টা সিনেমা বানাইছেন উনি।) মাটির পাহাড় সিনেমার কাহিনি, সংলাপ সৈয়দ শামসুল হকের। (সৈয়দ শামসুল হক নিজেও কিন্তু একটা উর্দু সিনেমা বানাইছিলেন ১৯৬৬ সালে ‘ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো’ নামে।) এফডিসি থিকা মুক্তি-পাওয়া প্রথম সিনেমা এইটা। এইটা নিয়াও তেমন কোনো ইনফরমেশন নাই, কিন্তু যদ্দূর ধারণা করতে পারি, এই সিনেমাও খুব-একটা চলে নাই। নায়ক মেবি পশ্চিম পাকিস্তানের ছিলেন, আর হইলে এইটা তখন একটা কারণ হইতে পারে কি না, আমি শিওর না। কিন্তু আমার ধারণা, এইটা একটা ‘গুড ট্রাই’ ছিল। হইতে পারে আইডিয়ালিস্টিক জায়গা থিকা ডিল করছেন বেশি (উনার ‘বড় ভালো লোক ছিল’ মাথায় রাইখা বলতেছি, যেইটারে বাংলাদেশি আর্ট-ফিল্ম মনেহয় আমার), কিন্তু এখন যেইটারে ‘বাংলাদেশি’ সিনেমা বলতে চাই আমরা, সেইটারও কোনো টোন হয়তো থাকার কথা।
লাস্ট, আর সবচে হিট সিনেমা হইতেছে, এহতেশামের, ‘এ দেশ তোমার আমার’। জহির রায়হান এই সিনেমাতেও অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর ছিলেন। কাহিনিটা তো দুর্দান্ত, খুবই কনটেম্পরারি। কাহিনিটাও এতহেশাম সাহেবের লেখা, কিন্তু ইন্টারেস্টিং হইলো সংলাপ আর মিউজিক করছিলেন খান আতাউর রহমান, যিনি পরে এতহেশাম সাহেবের পপুলার ধারাটারে অনেক দূর পর্যন্ত সাবস্ক্রাইব করতে পারছিলেন। এই সিনেমা নিয়াও জানি না তেমন কিছু। কিন্তু এতহেশাম সাহেব জীবনে কোনোদিন হিট সিনেমা ছাড়া কোনো সিনেমা বানান নাই, আর কেন উনি হিট সিনেমা বানাইতে পারতেন, সিনেমার কাহিনি দিয়াই টের পাওয়া যায় কিছুটা। উনি ১৩টা সিনেমা বানাইছেন। উনি পপুলার সিনেমা বানাইছেন, এন্টারটেইনমেন্ট দিতে পারছেন, আর এই কারণে উনি ‘বাজে’ ফিল্মমেকার না মনেহয়।
মানে, এই ৪টা সিনেমা, পুরাপুরি আলাদা রকম না হইলেও, চার রকমের ট্রেন্ড বা ধারারে ইন্ডিকেট করতে পারে মনেহয়। কিন্তু বাংলাদেশের সিনেমায় আসল ঘটনাটা আসলে ঘটে, ১৯৬৫ সালে, সালাউদ্দিন সাহেব যখন রূপবান সিনেমা বানান। বাংলাদেশি সিনেমার শুরু হিসাবে এই সিনেমাটারে নানান কারণেই মার্ক করা দরকার ।
১.২
রূপবান সিনেমা নিয়া বলার আগে ১৯৫৬ টু ১৯৬৫ সালের বাংলা সিনেমার কয়েকটা জিনিস বলা দরকার মনেহয়। এই টাইমটারে প্রি-রূপবানটাইম বলতে চাই আমি, যেইটা মোস্টলি অ্যামেচার সিনেমা বানানোর যুগ। যদিও ১৯৫৭ সালে এফডিসি বানানো হইছে, সরকারি অনুদান দেয়া শুরু হইছে, দুই/চাইরটা সিনেমা হিটও হইছে, কিন্তু এন্টারটেইনমেন্ট বিজনেস হিসাবে (বা আর্টফর্ম হিসাবেও) পুরাপুরি শুরু হইতে পারে নাই।
এই সময়ের অ্যাটলিস্ট তিনটা ফিচার হাইলাইট করা যায়।
এক হইলো, সিনেমা খুবই আর্বান এন্টারটেইনমেন্টের ঘটনা ছিল, গ্রামেগঞ্জে, মফস্বলে সিনেমাহল তো ছিলই না, ঢাকা বা বড় কয়েকটা শহরেও খুব বেশি সিনেমাহল থাকার কথা না, আর টোটাল সিনেমাহলের সংখ্যা ৮/১০টা ছিল মেবি। (যদিও কোনো ডাটা নাই আমার কাছে। কিন্তু ধারণা থিকাই বলতেছি।) তো, সিনেমার পাবলিক রিচ যে কম ছিল — এই বাস্তবতাটা মনে রাখলে মনেহয় বেটার। মানে, চাইলেও হাজার হাজর মানুষের সিনেমা দেখার কোনো উপায় ছিল না। এর আউটকাম হিসাবে তখনকার সিনেমার ডিরেক্টরদের ভাবতে পারার কথা, হাজার হাজার লোকের জন্য উনারা সিনেমা বানাইবেন কি না। সন্দেহ নাই, ব্যাপারটা খুব স্ট্যাটিক ছিল না, ব্যবসায় লাভ হইতে থাকলে, সিনেমাহলের সংখ্যাও বাড়তে থাকার কথা ধীরে ধীরে। কিন্তু সিনেমা জিনিসটা যে সিনেমাহলের লগে রিলিটেড একটা ঘটনা, এইটা মাথায় রাখাটা মনেহয় দরকারি। এখনকার টিভি-মোবাইল স্ট্রিমিংয়ের যুগে সিনেমাহলের নাম্বারটা এতটা রিলিভেন্ট না, এ কারণে পয়েন্টা মিস কইরা যাইতে পারি হয়তো আমরা।
(১৯৯০ এর দিকে হয়তো হায়েস্ট ৪০০র উপরে সিনেমাহল ছিল বাংলাদেশে, মানে প্রতিটা থানা শহর বা উপজেলা সদরে গড়ে একটা সিনেমাহল। কিন্তু এখন ২০২০ সালে ৬০/৭০টার মতন সিনেমাহল আছে, পত্রিকার নিউজে এইরকম দেখা যায়। বাংলাদেশের সবচে বড় পর্দার সিনেমাহল ছিল যশোরে মণিহার নামে, ১৯৮৩ সালে শুরু হইছিল, আর বন্ধ হয় ২০০২ সালে। মানে, সিনেমাহলের ব্যবসা ১৯৬৫-৭০ এর দিকে শুরু হয়া ২০০০ এর দিকে পড়তির দিকে চইলা যাওয়ার কথা।)
দুসরা ব্যাপারটা হইতেছে, ১৯৫৬ থিকা ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত টোটাল ৪৮টা সিনেমা রিলিজ হইছিল (ইনক্লুডিং রূপবান), এর মধ্যে ২০টাই ছিল উর্দু ভাষার সিনেমা। ১৯৬৪ সালের ২০টা ছবির মধ্যে ৯টা আর ১৯৬৫ সালের ১১টা সিনেমার মধ্যে ৬টাই ছিল উর্দু ভাষার, বাংলাদেশি ডিরেক্টররাই বানাইছিলেন। বাংলাদেশে সিনেমাহল যেহেতু খুববেশি ছিল না, একটা সিনেমা বানাইলে সেইটা যাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সিনেমাহলেও চালানো যাইতে পারে, এইজন্য উর্দুতে বানাইলে একটা ব্যবসায়িক সুবিধা থাকার কথা। আর বাংলাদেশের সিনেমাহলে যেইরকম হিন্দি আর উর্দু সিনেমা দেখানোর রেওয়াজ ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা সিনেমা মার্কেট একদমই থাকার কথা না। (আবারও বলি, কিছু ডাটা থাকলে এই জিনিসটা হয়তো আরো শিওর হয়া বলা যাইতো; কিন্তু হিস্ট্রিক্যাল পার্সপেক্টিভ থিকা এইভাবে দেখাটা ভুল হবে না মনেহয়।) এখন যারা উর্দু সিনেমা বানাইতেন (ইনক্লুডিং জহির রায়হান), তাদেরকে ‘গাদ্দার’ (মানে, দেশদ্রোহী) ভাবলে ভুলই হওয়ার কথা, বরং সিচুয়েশনটা উল্টাই ছিল, একটা ‘দেশ’ বা রাষ্ট্ররে আপহোল্ড করতেন উনারা। কিন্তু যতই একটা রাষ্ট্র হোক, উর্দু তো হিন্দির মতোই, বাংলা তো আর না! যার ফলে একদিকে যেমন সিনেমাহল ছিল না বইলা বাংলা সিনেমা বানানো রিস্কি ছিল, আরেক দিকে বাংলা সিনেমা চলতো না বইলা সিনেমা হলের নাম্বার বাড়তেছিল না। ডিম আগে না মুর্গি আগে অবস্থা!
লাস্টলি, সিনেমা তো একটা টেকনিক্যাল ব্যাপার; হিন্দি সিনেমার যেই টেকনিক্যাল সুপিয়রিটি, অভারঅল যেই ভিজ্যুয়াল এক্সপেরিয়েন্স, সেইটা বাংলাদেশে বানানো সিনেমাতে থাকার কথা না। মানে, টেকনিক্যাল জায়গা থিকা ১৯৬১ সালের হিন্দি ‘মুঘল-ই-আজম’ আর বাংলা ‘কখনো আসেনি’-র যদি কম্পেয়ার করেন ভিউয়ার এক্সপেরিয়েন্সের জায়গা থিকা, বুঝতে পারার কথা বাংলাদেশের সিনেমা তখনো অ্যামেচার ঘটনাই। এমন না যে, ‘কখনো আসেনি’ খুব বাজে সিনেমা বা ‘মুঘল-ই-আজম’ ভালো; বরং ব্যাপারটারে আর্টফিল্ম বা কমার্শিয়াল ফিল্মের জায়গা থিকা দেখার অভ্যাসের কারণেই বাংলা সিনেমার হিস্ট্রিটারে দেখতে গিয়া ভুল করতেছি আমরা। ‘ভালো’ সিনেমা বানাইতে হইলে ‘পপুলার’ হওয়া যাবে না, বা ‘পুপলার’ সিনেমা বানাইতে গেলে নাচাগানা থাকতে হবে, ‘আর্ট’ করা যাবে না — ব্যাপারগুলা এইরকম লিনিয়ার না। যে-কোনো আর্টের মতোই সিনেমারও ভ্যারিয়েশন আছে, নানান রকমের লেয়ার আছে, ফাংশন আছে, কোনো-একটা এক্সপেক্টশনের জায়গা থিকা দেখতে গেলে পুরা জিনিসটারেই মিস কইরা যাওয়া হবে।
তো, আমার পয়েন্ট হইলো, এই তিনটা কারণে — সিনেমাহলের সংখ্যা কম হওয়া, উর্দু ভাষার সিনেমা বানাইতে যাওয়া আর অ্যামেচার অ্যাপ্রোচের কারণে বাংলা সিনেমা ১৯৬৫ সাল পর্যন্তও ‘বাংলা সিনেমা’ হয়া উঠতে পারে নাই। যেই কয়টা সিনেমাহলই ছিল, হিন্দি আর উর্দু সিনেমা দখলেই থাকার কথা। (অ্যাগেইন, ডেটা দরকার!) খেয়াল কইরা দেখবেন, আবদুল জব্বার খান যে বাংলা সিনেমা বানাইলেন (মুখ ও মুখোশ) সেইটা লাহোরের একজনের উপ্রে রাগ কইরাই। কিন্তু ‘কলকাতা’-র হিন্দি সিনেমার উপ্রে আমরা ‘রাগ’ করতে পারি নাই, বরং ১৯৬৫ সালের যুদ্ধটা লাইগা সিনেমা আমদানিটা বন্ধ হয়।
তরে এর মধ্যে, যেই ২৮টা বাংলা সিনেমা বানানো হইছিল, সেইগুলার যে কোনো সিগনিফিকেন্স নাই — তা না। ১৯৬০ সালে এহতেশামের ‘রাজধানীর বুকে’ (দেখেন, শহর…) হিট ছিল। অই সিনেমা একটা গান “তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো / চাঁদ বুঝি তা জানে” তো এখনো মনে করা যায়। ১৯৬১ সালে ‘হারানো দিন’-ও সিনেমাহলগুলাতে চলতে পারছিল। রহমান আর শবনমরে নায়ক-নায়িকা হিসাবে নেয়া গেছিল। এই সিনেমারও হিট একটা গান আছে, ফেরদৌসি রহমানের গাওয়া — “আমি রূপনগরের রাজকন্যা / রূপের যাদু এনেছি”। ১৯৬১ সালের আরেকটা ক্রিটিক্যাল মুভি হইতেছে জহির রায়হানের ‘কখনো আসেনি’। উনি যদিও পরে সিনেমাটারে নিয়া রিগ্রেট করছেন এইভাবে যে, সিনেমাটা উনি “২০ বছর আগে বানায়া ফেলছেন”; মানে, ২০২০ সালে বানাইলেও ব্যাপারটা একই রকম থাকতো মনেহয়, মানে, সিনেমাটা সবসময় ২০ বছর ‘আগায়া’ ছিল বা আছে। (এইটা নিয়া আলাদা কইরা বলবো আবার, জহির রায়হানরে নিয়া আলাপে গিয়া।…) তো, এইরকমের ‘নাক-উঁচা’ জায়গা থিকা ‘আমরা’ বাইর না হয়া আসতে পারলেও জহির রায়হান বাইর হয়া আসতে খুববেশি সময় নেন নাই, ১৯৬৩তে ‘কাচের দেয়াল’-এ ‘আর্টিস্টিক বাস্তবতা’ থিকা ‘সামাজিক বাস্তবতা’-তে ফিরা আসতে পারছিলেন, এমনকি পরের বছর ‘সঙ্গম’ সিনেমা (পাকিস্তানে প্রথম রঙিন সিনেমা, কোরবানি ঈদের দিন রিলিজ হওয়া) দিয়া ‘সিনেমাটিক বাস্তবতা’-র দুনিয়ায় একরকমের ঢুইকা পড়তে চাইছিলেন; পরে সেইটারে ‘উর্দু বাস্তবতা’ বইলা হেইট করছিলেন কি না… মানে, উনার সার্কেলটারে এইভাবে দেখতে পারেন। ১৯৬২ সালের ‘সূর্যস্নান’, ১৯৬৪ সালের ‘সুতরাং’ (ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজও পাইছিল একটা)-এর কথাও বলেন অনেকে, কিন্তু এইগুলারে “গ্রেট ফিল্ম”-ই বলেন আর “বাংলাদেশি সিনেমা”-ই বলেন, যে-কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলতে গেলে আসলে ভুলই হবে। মানে, প্রি-রূপবানপিরিয়ডের যে তিনটা ঘটনার কথা কইলাম, এইগুলারে মাইনা নিয়াই অপারেট করে আসলে। এইগুলা ‘ভালো’ সিনেমার এগেনেস্টে ‘খারাপ’ সিনেমা — এইরকম না, বরং বলতে পারেন, অ-দরকারি সিনেমা। যা-ই হোক…
২.
রূ প বা ন
তো, এইরকম একটা টাইমে রিলিজ হয় রূপবান সিনেমাটা। বাংলা সিনেমা যেই অডিয়েন্সরে টার্গেট করতো (১৯৫৬-১৯৬৫ পিরিয়ডে) সেই লিমিটেশনগুলার ভিতর দিয়া এই সিনেমা অপারেট করে নাই।
একটা জিনিস খেয়াল করবেন, সালাউদ্দিন সাহেবই কিন্তু ‘সূর্যস্নান’ (১৯৬২) ‘ধারাপাত’ (১৯৬৩) বানাইছিলেন যেইটার টার্গেট অডিয়েন্স ছিল ‘আর্বান মিডলক্লাস’ বা বাংলার ‘শিক্ষিত সমাজ’। কিন্তু আমার ধারণা, এখন যেমন আমরা হলিউডি বা ফরেন আর্টফিল্ম দেখি, তখনকার ‘শিক্ষিত সমাজের’-ও একই রকমের খাসলত থাকার কথা। এলিজাবেথ টেলর আর কেরি গ্রান্টরেই ভাল্লাগার কথা। শবনম/সুজাতা আর রহমান/রাজ্জাকরে উনাদের ততটুকই ‘ভালো’ লাগার কথা, যতটুক উনারা এলিজাবেথ টেলর আর কেরি গ্রান্টের ছায়া। এই ‘শিক্ষিত সমাজ’-রে এইভাবে দেখতে পারাটা দরকার, যারা ইউরোপিয়ান একটা কালচারেরই কনজ্যুমার হইতে চায়, একটা ইউরোপিয়ান সমাজই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর উনাদের চাওয়াটা হঠাৎ কইরা গজাইছে এইরকম না; এখন যেমন আছে, আগেও কম-বেশি একইরকম থাকারই কথা।
মানে, এইটারে ‘শিক্ষিত সমাজের’ দোষ বইলা দেখলে ভুল হবে, কারণ ‘শিক্ষিত সমাজ’-এর ফর্মেশনটাই এইরকম! ব্যাপারটা তৈরি হইছে আর সাসটেইন করতেছে এইরকম ইউরোপিয়ান টেস্ট, রুচি-বোধ আর চিন্তা-পদ্ধতির ভিতর দিয়াই! আপনি নিজে যদি এইরকম টেস্টের জায়গাতে সাবস্ক্রাইব না করেন, আপনার নিজেরে ‘শিক্ষিত’ দাবি করাটাই পসিবল না! বাংলা সিনেমাও এইরকম ‘শিক্ষিত’ হওয়ার দিকেই মনোযোগী ছিল, বা এখনো এইরকমের আহাজারি করতে পারি তো আমরা যে, এই এত বছর পরেও বাংলা সিনেমা ‘শিক্ষিত’ হইতে পারলো না! তো, এই ‘শিক্ষিত’ জিনিসটারে খেয়াল করার দরকার আছে।…
রূপবান সিনেমাটাতে এই ‘শিক্ষিত সমাজ’-রে অডিয়েন্স হিসাবে ভাবা হয় নাই। উনারা তো সিনেমা দেখেনই, কিন্তু সো-কল্ড ‘গ্রামের মানুষ’ যারা, উনারাও যে ‘দর্শক’ হইতে পারেন, সেইটারে ‘বাস্তব’ হিসাবে নেয়া হইছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হইতেছে, সালাউদ্দিন সাহেব নিজেও নাকি খুব একটা রাজি ছিলেন না; উনি সিনেমা বানাইতে চাইতেছিলেন, কিন্তু টাকা উইঠা আসতেছিল না, তখন উনারে এফডিসির দুইজন লোক (সফদার আলী ভূঁইয়া ও সিরাজুল ইসলাম ভুঁইয়া। সফদার আলী ভূঁইয়া পরের বছর নিজেও ‘রহিম বাদশা ও রূপবান’ সিনেমা বানাইছিলেন।) এই বুদ্ধি আর সাহস দেয় : “১৯৬৫ সালে তিনি তৈরী করেন প্রথম লোককাহিনী ভিত্তিক সিনেমা ‘রূপবান’। সালাহউদ্দিন এই সিনেমার নির্মাতা হলেও এর মুল কারিগর ছিলেন সিনেমাকর্মী সফদর আলী ভুঁইয়া ও তার ভাই সিরাজুল ইসলাম ভুঁইয়া। তাদের দীর্ঘদিনের উৎসাহ উদ্দিপনায় সালাহউদ্দিন ‘রূপবান’ সিনেমা বানান।” (https://bmdb.co/বাংলা-চলচ্চিত্রের-উত্থান/)
শেভিং ব্লেড বানানোতে দুনিয়ার যেই বিখ্যাত কোম্পানি জিলেট, অইখানে এইরকমের একটা কাহিনি আছে। এক লেবার নাকি মালিকরে বুদ্ধি দিছিলো যে, এক ব্লেডের জায়গায় দুই/তিন/চাইর ব্লেড লাগান! শেভিংয়ের এক্সপেরিয়েন্সটা আরো বেটার হইতে পারবে তখন। এর পরেরটা তো ইতিহাস!… তো, গ্রামশি কইছিলেন, ইন্টেলেকচুয়াল উইঠা আসবে ওয়ার্কিং ক্লাস থিকা, প্রাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্সের জায়গাগুলা থিকা; তো সেইটা না হইলেও ইন্টেলেকচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংগুলা প্রফেশনের সাথে রিলেটেড লোকজনই আগেভাগে রিকগনাইজ করতে পারার কথা। এর একটা উদাহারণ হিসাবে এই ঘটনাটারে দেখা যাইতে পারে।
তো, ব্যাপারটা খালি এইরকম না যে, রূপবান ‘গ্রামের মানুষদের’ লাইগা বানানো হইছে, বরং গ্রামের মানুষ যে সিনেমা দেখতে পারে — এই জায়গাটাতে বিশ্বাস রাখা হইছে আসলে। এইটা সবচে ক্রুশিয়াল পয়েন্ট।
আর সিনেমা রিলিজ হওয়ার পরে দেখা গেল, আরে, এইটা তো আসলেই ‘বাস্তব’! ‘শিক্ষিত লোকদের’ বাইরেও তো বাংলাদেশে আরো লোকজন আছে, যারা সিনেমা দেখতে পারে! এমনকি পর্দার ভিতরে লোকজন ঘুরাফিরা করে দেইখা ডরায় না! এমনো কাহিনি আছে যে, গ্রাম থিকা লোকজন শহরে আসছে খালি সিনেমাহল খুঁজতে, যে রূপবান কই দেখানো হইতেছে; আর সিনেমাহলের সামনে কাঁথাবালিশ নিয়া ঘুমায়া সিনেমার টিকিটের লাইগা লাইন দিতেছে। মানে, সিনেমা যে খালি সেলিব্রেশনের ঘটনা না, বরং একটা ওয়ে অফ লাইফ, সেই রিয়ালিটিতে ইনক্লুড করার একটা ঘটনা ঘটতেছিল। সিনেমাটা যে কী রকমের ক্রেইজ ছিল সেইটার একটু ঝলক এই নিউজে পাইবেন, বাঁশের কাহিনিটাতে : https://bit.ly/2AH9rRi
রূপবান সিনেমা রিলিজ হওয়ার কারণেই, এই সিনেমা দেখানোর লাইগাই বাংলাদেশে সিনেমাহল বানানি শুরু হওয়ার কথা। মানে দেখেন, ‘সিনেমাহল নাই বইলা সিনেমা বানানো হয় নাই’ থিকা সিচুয়েশনটা পুরা ঘুইরা গিয়া হইছে যে, ‘সিনেমা দেখানোর লাইগা সিনেমাহল বানানো দরকার’! রূপবান সিনেমার পরে ১৯৬৫-১৯৭০ এই সময়টা হইতেছে বাংলা সিনেমা তৈরি হওয়ার সময়।
আমার এই কথাটারে জাস্টিফাই করার লাইগা নায়িকা সুজাতার একটা কমেন্ট পাইলাম : “এদেশে রূপবান সিনেমার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। অথচ ‘রূপবান’ এদেশ থেকে উর্দু সিনেমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। ‘রূপবান’ হিট হওয়ার পর এদেশে বাংলা সিনেমা নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়।” (https://bit.ly/2VXBgwh) যদিও উনি এই সিনেমার নায়িকা বইলা বাড়ায়া বইলা থাকতে পারেন, কিন্তু সিনেমার নাম্বার উনার কথার পক্ষে যায়। সিনেমা রিলিজ হওয়ার নাম্বারটা এইরকম :
১৯৬৫ : ১১
১৯৬৬ : ২৫ (এর মধ্যে ৩টা আবার নতুন রূপবান । জহির রায়হানও বানান বেহুলা, ইবনে মিজান বানান জরিনা সুন্দরী, গুনাই বিবিরে নিয়া দুইটা সিনেমা, মহুয়া নিয়াও একটা সিনেমা হয়।)
১৯৬৭ : ২৪
১৯৬৮ : ৩৪
১৯৬৯ : ৩১
১৯৭০ : ৪৩
তো, গ্রামের লোকজনের পছন্দের কাহিনি নিয়া বানানো হইছিল বইলাই রূপবান হিট হইছিল, এইরকম না; লোকজন আরেকটা রিজনের কথা বলেন, সেইটা হইতেছে ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে কলকাতা থিকা হিন্দি সিনেমা আমদানি করা বন্ধ হয়া গেছিল বইলা এগজিসটিং সিনেমাহলগুলাও নিজেদের ব্যবসা বাঁচানোর লাইগা রূপবানরে প্রমোট করার কথা। কিন্তু এইটাই যদি ঘটনা হইতো, তাইলে ‘সাত রং’ (মে, ১৯৬৫), ‘নদী ও নারী’ (জুলাই, ১৯৬৫)-ও হিট হওয়ার কথা। যুদ্ধটা একটা ফ্যাক্টর অবশ্যই, কিন্তু এইটারে মেইন ফ্যাক্টর হিসাবে হাজির করলে সেইটা এক-রকমের ইন্টেলেকচুয়াল জাউরামিই হবে আসলে।…
আরেকটা জিনিস হইতেছে, যাত্রাপালার কাহিনি বইলা হিট হইছিল। কিন্তু ঘটনাটারে খালি এর ভিতরে রিডিউস করলেও ভুলই হবে। বরং রূপবান সিনেমার পরে ‘লোককাহিনি’ (খুবই ফানি একটা টার্ম) নিয়া সিনেমা বানানির একটা ট্রেন্ড শুরু হইছিল, যেইটা এখনো চালু আছে। ১৯৬০/৬৫ সালে বাংলাদেশের কালচারাল সিনারিওতে যাত্রা অবশ্যই একটা পপুলার ভিজ্যুয়াল ফর্ম হওয়ার কথা, টিভি তখনো চালু হয় নাই অইভাবে, আর বিফোর ’৮০/’৯০ মাসলেভেলে পৌঁছাইতে পারার কথা না। এখন যাত্রাতে যেই কাহিনি আপনি দেখতেছেন, সেইটা অবভিয়াসলি সিনেমার পর্দা আরো রিয়েল লাগার কথা। কিন্তু ঘটনাটা এইটা না যে, আসেন একটা ‘উন্নতমানের যাত্রা’ দেইখা যান! বরং আপনার যারা যাত্রা দেখেন, সিনেমাও দেখতে পারেন তো! — এইরকম ব্যাপারটারেই আমি হাইলাইট করতে চাই। মানে, এইটা রূপবান যাত্রারে সিনেমার পর্দায় নিয়া আসার ঘটনাই খালি না, যাত্রার দর্শকরে সিনেমার দর্শক হিসাবে মাইনা নেয়ার ঘটনা।
আর এইরকম একটা ধারণা চালু আছে যে, পাবলিকের লাইগা সিনেমা বানাইতে হইলে সহজ-সরল প্রেমের কাহিনি, নাচাগানা, ‘বুদ্ধিহীন’ ‘কম আর্টের’ সিনেমা বানাইতে হবে। অথচ রূপবানের কাহিনিটা দেখেন, কী রকমে সমাজবাস্তবতাহীন, ফ্যান্টাসির একটা গল্প। বারো দিনের বাচ্চার লগে বারো বছরের মেয়ের বিয়া! তারপরে বারো বছরের একটা মেয়ের বারো বছরের স্ট্রাগল। মেইনলি দুঃখ-দুর্দশারই কাহিনি। বানানো একটা দুঃখ-দুর্দশার লগে যেইখানে আমাদের লাইফের স্ট্রাগল, বিপদআপদ আর দুঃখ-দুর্দশাগুলারে ফিল করা যায়। ব্যাপারটা এইরকম না যে, লোকজন খালি মজা পাওয়ার লাইগা সিনেমা দেখতে আসে বা কষা ‘জীবনের মানে’ বুঝতে আসে; বরং একটা রিয়ালিটিরেই নিতে আসে যারে সে নিজের লাইফের সাথে কোনো-না-কোনোভাবে কানেক্ট করতে পারে। রূপবান সিনেমার কাহিনি যতই ফ্যান্টাসি হোক, এর ফিলিংগুলা খুববেশি আননোন ছিল না মনেহয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে। রূপবান সিনেমার সাকসেসের জায়গাটাতে এই কানেকশনের জায়গাটা গ্রসলি ইগনোর করা হয় বইলাই আমার মনেহয়।
তো, রূপবানরে নিয়া কথাবার্তা নাই কেন? পপুলার অ্যাভারেজ সিনেমা বইলা? বা ছোটলোকের আর্ট বইলা? এইগুলা পুরান আমলের মার্কসিস্ট কথাবার্তা। আমি বরং বলবো, ক্লাস-হেইট্রেডটারে অন্য একটা জায়গা থিকা দেখেন। ক্লাস বা কালচার বেশিরভাগ সময় অ্যাকসেস বা অ্যাফোর্ড করতে পারার ঘটনা; টাকা তো দরকারই, কিন্তু টাকা থাকলেই আপনি সেই কালচারে সবসময় অ্যাকসেস পাইবেন না। যেমন ধরেন, ফাইভস্টার হোটেলের রেস্টুরেন্টগুলাতে চা-র দাম ৫০০ টাকা কেন রাখা হয়? খালি এস্টাবলিশমেন্ট খরচ বেশি বইলা? তা তো না, একটা কারণ এইটাও যে, চা-র দাম যদি ৫০ টাকাও হয়, আমরার মতন মিডলক্লাস লোকরাও মাসে একবার কইরা যে যাওয়া শুরু কইরা দিবো, এইটারে ঠেকানোটা তো দরকার! এইরকমভাবে, সিনেমা যদি গরিব আর গ্রামের লোকেরা বুইঝা ফেলে এইটা আর্ট হিসাবে কি এতটা দামি থাকতে পারবো আর? মানে, পয়েন্টটা এইটা না যে, গ্রামের লোকেরা, গরিব লোকেরা সিনেমা দেখতে পারবে না বা অদের জন্য সিনেমা বানানো যাবে না, বরং অরা তো আসলে ‘সিনেমা বুঝে না!’ — এই জায়গাটা এস্টাবলিশড করাটা হইতেছে ক্লাস-হেইট্রেডের ঘটনা। সুজাতা যে বলতেছেন, উর্দু সিনেমারে ঢাকা থিকা হটায়া দিছিলো, এইটা প্রমাণ করার মতো ডেটা বা ইনফরমেশন কি থাকার কথা না, কোথাও-না-কোথাও? কিন্তু এই নিয়া যে কোনো আলাপ পাইবেন না, এর কারণ ‘এইগুলা হইতেছে গ্রামের লোকদের লাইগা বানানো সিনেমা, আসল সিনেমা না’।
বাংলা সিনেমা নিয়া ‘শিক্ষিত সমাজের’ এই ক্লাস-হেইট্রেড এখনো চালু আছে বইলাই ‘রূপবান’ সিনেমার সিগনিফিকেন্সরে কখনোই স্বীকার করা হয় নাই, বরং রূপবানের দেখাদেখি বানানো জহির রায়হানের বেহুলারে নিয়া মাতামাতি আছে। এমনো দেখছি একলগে বলা হয় যে, “তখন ‘লোককাহিনি’ নিয়া বানানো সিনেমা যেমন, বেহুলা, রূপবান, গুনাইবিবির কারণে বাংলা সিনেমা ঘুরে দাঁড়ায়”। আরে বাল! এর আগে বাংলা সিনেমা ছিলোটা কই? রূপবান দিয়াই তো শুরু! রূপবান যদি বানানো না হইতো জহির রায়হানের বেহুলা বানানোর কোনো কারণই নাই! (এই হিস্ট্রিক্যাল সত্যিটার আরো কতদিন যে আমরা লুকায়া রাখতে চাইবো, আল্লা মালুম!)
মানে, এই রূপবান সিনেমার অডিয়েন্সের উপ্রে বেইজ কইরা মিডলক্লাসের বাংলা সিনেমা বানানি শুরু হয়। বাংলা সিনেমা দেখার দর্শকও যে আছে এই ‘সত্য’ হঠাৎ কইরা সামনে চইলা আসে। আর যেহেতু নতুন নতুন সিনেমাহল বানানো হইতেছে নতুন সিনেমা বানানোর একটা ডিমান্ডও তৈরি হওয়ার কথা। স্টিভ জবসের একটা প্রেসনোট আছে অ্যাপেলের আইপড লঞ্চ করার সময়, অইখানে বলা হইতেছিল, মেশিন কিভাবে ডিমান্ড জেনারেট করে। এখন মোবাইল আছে বইলাই মোবাইল কনটেন্টের দরকার পড়তেছে তো আমরার, এইরকম।…
কিন্তু রূপবানরে একটা জনরা হিসাবেই রিড করা হয়, একটা রিডিউসড মিনিংয়ের ভিতর দিয়া যে, ‘গ্রামের মানুষদের’ লাইগা ‘লোককাহিনি’-র সিনেমা বানানো যাইতে পারে। আর এইরকমের আন্দাজটাই এখনো চালু আছে।
রূপবানরে নিয়া আরো ৬টা সিনেমা বানানো হয়; এর পরের বছরগুলাতেই ৪টা : রহিম বাদশা ও রূপবান (১৯৬৬), আবার বনবাসে রূপবান (১৯৬৬), রূপবান (১৯৬৬), রূপবানের রূপকথা (১৯৬৮); পরে আরো ২টা : রঙিন রূপবান (১৯৮৪/৮৫), আজকের রূপবান (২০০৫)। এর বেশিও হইতে পারে। আমি এই কয়টাই পাইলাম। কলকাতাতেও একটা সিনেমা হইছিল ‘রূপবান কন্যা’ নামে। এইগুলার কোনোটাই অইরকম হিট না হইলেও, ফ্লপও হয় নাই মনেহয়।
রূপবানের পরে সালাউদ্দিন সাহেব বানান ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ (১৯৬৬), যেইটা মেবি ঢাকা শহরের ‘কমন’ পিপলের শুরুর দিকের একটা ডেপিক্টেশন। যেইটা সেভেনটিইজ, এইটিইসে গিয়া ধীরে ধীরে হয়া উঠতে থাকে ‘বাংলা সিনেমা’।…
… …
- এন্ড্রু কিশোর আর ক্যাসেটে বন্দী আমাদের গানের জীবন || ইমরুল হাসান - July 22, 2020
- বাংলাদেশি সিনেমা : অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি ১ || ইমরুল হাসান - July 15, 2020
- আবারও কবিতার নয়া বই || ইমরুল হাসান - September 14, 2019
COMMENTS