এন্ড্রু কিশোর আর ক্যাসেটে বন্দী আমাদের গানের জীবন || ইমরুল হাসান

এন্ড্রু কিশোর আর ক্যাসেটে বন্দী আমাদের গানের জীবন || ইমরুল হাসান

এই কথা স্বীকার করতে হয়তো এখন অনেকে হেসিটেটই করবেন যে ১৯৮০-র দশকে ক্যাসেটপ্লেয়ারে গান শোনাটা যখন মিউজিক কনজামশনের মেইন সোর্স ছিল শহরে-মফস্বলে মিডল ক্লাসের কাছে, তখন এন্ড্রু কিশোরের গানের ক্যাসেট আমরা শুনতামই না বলা যায়। ইংলিশ গান শোনাটা যদ্দিন ‘শিখতে’ পারি নাই, বাংলা ব্যান্ডের গান বা ‘আধুনিক’ গানই শুনতাম। এন্ড্রু কিশোরের দুয়েকটা ক্যাসেট যে শুনি নাই — তা না; কিন্তু এন্ড্রু কিশোরের গান আমরা যা শুনছি সিনেমাহলেই, বা রাস্তাঘাটে, পাড়ার দোকানে। ইন্টারেস্টিং শুনাইতে পারে, কিন্তু পাড়ার দোকানগুলাতে হিন্দিগানই বাজতো না খালি, বাংলা সিনেমার গানের ক্যাসেটও শোনা যাইতো, কম হইলেও। টিভিতে এন্ড্রু কিশোর কোনো হিট গায়ক ছিলেন না, যতদিন-না হানিফ সংকেত উনারে ইত্যাদিতে নিয়া আসছেন। মানে, এন্ড্রু কিশোর মিডলক্লাসের গান গান নাই — তা না; কিন্তু মিডলক্লাসের কালচারে অ্যাক্সেপ্টেড হওয়ার লাইগা উনারে স্ট্রাগল করা লাগছে অনেক। আর শেষমেশ উনি মিডলক্লাসের কালচারের লোক না-ও।

সোসাইটিরে যদি আমরা ক্লাসের বেসিসেই দেখি, কালচারাল জিনিসগুলারেও অই ক্লাসের বেসিসেই লোকেট করতে পারাটা দরকার আসলে। মানে, এইখানে মিডলক্লাসের, লোয়ারক্লাসের, আপারক্লাসের কালচার আছে … গান আছে, কবিতা আছে, অন্য অনেককিছুই। তার মানে এইটা না যে, একটা ক্লাসের জিনিস আরেকটা ক্লাসের কাছে পৌঁছাইতে পারে না বা অ্যাক্রস দ্য ক্লাস অ্যাক্সেপ্টেড হইতে পারে না। কিন্তু ক্লাসের একটা ব্যাপারই থাকে। ধরেন, মনির খানের গান কি আপারক্লাসের কারো ভাল্লাগতে পারে না? কিন্তু ভাল্লাগলেই সেইটা ধরেন মনির খানরে আপারক্লাসের কালচারাল প্রডাক্ট কইরা তুলতে পারে না, বরং যার ভাল্লাগলো তারেই কিছুটা লোয়ারক্লাস মনে হইতে পারে কালচারালি; যে, টাকাপয়সা আছে ঠিকই, কিন্তু রুচি নাই কোনো, এইরকম।  একইভাবে দেখবেন, কোনো রিকশাঅলা যদি পিঙ্ক-ফ্লয়েড  বাজায় তার মোবাইলে, তারে তো কারো কারো পায়ে ধইরা সালাম করতে ইচ্ছা করবে; কারণ এই রকম একটা ‘দিন আনে দিন খায়’ ইকোনমিক অবস্থাতে থাইকাও সে পিঙ্ক-ফ্লয়েডরে বুঝতেছে! দুনিয়াতে এইরকম ‘মিরাকল’ দেখলে তব্দা খায়া যাইতে হবে না আমাদের!

তো, এখন এন্ড্রু কিশোররে যে নিতে পারতেছি এইখানে ‘স্মৃতি রোমন্থনের’ ঘটনা তো আছেই যে, আমাদের ছোটবেলার, টিনএইজের গান; কিন্তু এইসব ‘স্মৃতি রোমন্থন’ যে মেমোরি ক্রিয়েশনেরও একটা ঘটনা, এইটাও যে থাকতেছে না, তা-ও না আর কি! মানে, এন্ড্রু কিশোর যেইভাবে ছিলেন, আর এখন যেইভাবে হাজির হইতে পারতেছেন, দুইটা একই ঘটনা না। (এইরকম চেইঞ্জটা যে বাজে ব্যাপার — তা না, কালচারাল হিস্ট্রিতে আর্টের, চিন্তার রিলিভেন্স নানান সময়েই চেইঞ্জ হয়া যাওয়ার কথা।) ব্যাপারটা এইরকম না যে, উনি গণমানুষের শিল্পী বা লোয়ারক্লাসের কালচারাল প্রডাক্ট, বরং এন্ড্রু কিশোর বাংলা সিনেমার গায়ক, যেই সিনেমার একটা চেষ্টা সবসময় ছিল, এখনো আছে মিডলক্লাসের কাছে কালচারাল প্রডাক্ট হিসাবে অ্যাক্সেপ্টেড হওয়ার। কিন্তু মুশকিল হইলো, বাংলাদেশে মিডলক্লাসের কালচার বইলাই কিছু তৈরি হইতে পারে নাই। এই কারণে এন্ড্রু কিশোররে অনেকটা ‘গণমানুষের শিল্পী’ বইলা যে লোকেট করা লাগতেছে এইটারে আমাদের একটা না-পারা হিসাবেই রিকগনাইজ করতে পারা দরকার।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you