একুশে আইন || আহমদ মিনহাজ

একুশে আইন || আহমদ মিনহাজ

বাংলা একাডেমির সৃষ্টিছাড়া কীর্তিকলাপের ইতিহাস সুদীর্ঘ। হীরক রাজার দেশে  বুঝ হওয়ার পর থেকে উদভুট্টি কাণ্ডই অধিক ঘটতে দেখেছি। এখন তার হিসাব কষতে বসলে মাথাব্যথায় পেরেশান হতে হবে। নিজের জানকে জেনেবুঝে খতরায় ফেলে একমাত্র বেওকুফ! বেকুব বনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, সুতরাং মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন-এ জারি থাকাটাই আপাতত সহি মনে হচ্ছে।

দেশ রূপান্তর-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে বোঝা গেল ফাহাম আব্দুস সালাম, জিয়া হাসান ও ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের বই প্রকাশের অপরাধে প্রকাশনা সংস্থা আদর্শ  বইমেলায় স্টল পাচ্ছে না। বাংলা একাডেমি মনে করছেন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিকাশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তার রাজনৈতিক আবর্তন ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন আর গদিনসীন সরকার বাহাদুরের সমালোচনায় একাট্টা ত্রি মাস্কেটিয়ার্সের বই তাদের নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। বইয়ে উনারা সত্যি কী কথা লিখেছেন সে-বিষয়ে আমার ধারণা পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। ফাহাম আব্দুস সালামের কথা বাদ দিলে বাকি দুজনের নামধাম ও অনলাইনে কী করে বেড়ান তার বিন্দুবিসর্গ এতদিন জানা ছিল না। সে যাই হোক, আমার জানা বা না জানায় কারো কিছু যাবে আসবে না। তবে হ্যাঁ দেশ রূপান্তর-র প্রতিবেদন পাঠের ক্ষণে কবীর সুমনের গানের কলি মনে ঢেউ তুলছিল। বিরোধীকে কথা বলতে দেওয়ার আর্জি ছিল তাঁর সেই গানে। আর্জির মাহাত্ম্য ও যৌক্তিকতা অকাট্য হলেও হীরক রাজার দেশে  এর মূল্য কখনো দুআনির বেশি ছিল কি? মন খুলে কথা বলা ও বলতে দেওয়ার সংস্কৃতিকে আমরা এত বেশি ঘোলাটে আর উদ্দেশ্যমূলক করে তুলেছি যে সুমনের গানের কলিতে ছলকে-ওঠা আর্জিকে দুর্গম দ্বীপে নির্বাসিতা ভাবতে মন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এখন।

নদীমেঘমেখলা শ্যামাঙ্গিনী দেশটির ঐতিহাসিক বিবর্তনে বাকরোধ ও বাকসংযমের সমস্যা বোধ করি গোড়া থেকেই মৌলিক ছিল। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশমুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত থাকার দিনগুলোয় তাদেরকে নিয়ামকের ভূমিকা নিতে আমরা দেখেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাকরোধ করার উৎপাত ঠেকাতে সকলে মিলে বাকসংযমের চর্চায় কুশলী হওয়ার বিকল্প ছিল না। কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশকে পাল্টানোর ওটাই হচ্ছে মূল মন্ত্র। পরীক্ষায় যদিও শুরুর দিন থেকে সকলে ডাহা ফেল মেরে বসে আছি! জাতীয় এই ব্যর্থতা যে-ধারাবাহিক অধঃপাত ডেকে এনেছিল তার প্রভাবে হয়তো গায়ক সুমনের আর্জিকে আজকাল কানে হাস্যকর শোনায়। মহাত্মা ভলতেয়ারের উক্তিখানাও সে’রম বটে! দেখো ভাই বিরোধী, তোমার মতের সঙ্গে অমিল থাকতে পারে কিন্তু তুমি যেন মন খুলে কথা বলতে পারো তার জন্য বান্দা জান দিতেও রাজি আছি;—সাক্ষাৎ গণতন্ত্রের স্বরূপ খোলাসা করতে ফরাসি দার্শনিক উক্তিটি করেছিলেন জানি। আমজনতা থেকে রাঘববোয়ালের সব্বাই মওকা পেলে ওটা কপচিয়ে থাকেন। বিরোধীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিজের জান কোরবানের এই অঙ্গীকারনামা বালেগ হওয়ার দিন থেকে শুনতে-শুনতে কান পচে গেল! হীরক রাজাদের মন তাতে করে থোড়াই গলেছে আজ অবধি!

মহাকবি মিল্টন আবার ওদিকে অ্যারিওপ্যাজিটিকায় মন খুলে কথা বলার অধিকার নিয়ে কত না ওকালতি করে গেলেন! মত প্রকাশের সীমা-সরহদ্দ যদিও বইটি লেখার সময় তাঁর পিত্তশূলের কারণ হয়েছিল বলে ইতিহাসে লেখে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি জাতীয় জীবনে অনর্থ ডেকে আনে সেক্ষেত্রে একে সামালানোর ভাবনা রাজকবির তকমাধারী কবির মনকে বাদী-বিবাদী বিসংবাদে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। অধিকারকে নিখাদ ছাড়পত্র দিতে বসে রাজভক্ত কবি নিজ দেশের হীরক রাজার সুরক্ষা বিষয়ে গুরুতর গাড্ডায় পতিত হয়েছিলেন। তাঁকে সম্ভবত হাত-পা বেঁধে জলে নামতে বলা হয়েছিল সেই সময়। বাকস্বাধীনতার মহিমা গাইতে বসে বেফাঁস কথা বলার অপরাধে জান খোয়া যেতে পারে;—শঙ্কাটি মরমে পুষে কবি মিল্টন অ্যারিওপ্যাজিটিকা লিখতে বসেছিলেন ধারণা করি। বইটি পড়তে বসে বাকরোধ ও বাকসংযমের সীমানা নিয়ে তাঁকে নাজেহাল দেখে পাঠক। বাকরোধ না করার দিকে মন ঝুঁকে আছে অথচ বাকসংযমে মাত্রাজ্ঞান বজায় রাখার বিষয়ে অনবরত সাফাই গাইতে হচ্ছিল তাঁকে! রাষ্ট্রসংঘ থেকে ধর্মসংঘের সকল ব্যাপারে খোলাখুলি মত প্রকাশে বাধা নেই তবে কতিপয় শর্ত মেনে চলার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন কবি! আজব এই ভজকট বোধ করি অ্যারিওপ্যাজিটিকা-র সারকথা! আমার অন্তত সেরকম মনে হয়।


মানবগ্রহে কালে-কালে সংঘটিত এরকম অজস্র দুর্ঘট স্মরণ করলে কথা বলার স্বাধীনতা থুড়ি মত প্রকাশের স্বাধিকারকে ক্যারিকেচার ভাবতে মন আগে সম্মতি জানায়। ব্যাপারখানা ভীষণ আপেক্ষিক বৈকি! পৃথিবী জুড়ে সচল হীরক রাজত্বের কাছে বাকস্বাধীনতার মানে হচ্ছে জি হুজুর জো হুকুম  টাইপের কথাবার্তায় ভরা মোসাহেবির পাহাড়। ঢাক গুড়গুড় না করে সত্যি কথা বলাটা সেখানে বারণ। সত্য ফাঁস করার মতো নিরুপায় পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় সেক্ষেত্রে তখতে তাউসকে বিপন্ন না করে কথাটি বলাই রীতি সেখানে। গদিনসীন রাজা-রানীর যেন কভু মনে না হয় তার স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে দিতে সত্যটি ফাঁস করা হচ্ছে এইবেলা! নিরেট সত্যকে ঘোলাটে করতে তার মধ্যে অগত্যা গোচনা মেশানোর কারিকুরি নিয়মমাফিক অমোঘ করে তোলা হয়। এর ফলে সত্য স্বয়ং ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে ওঠেন। সত্য রূপে প্রতিভাত হওয়া সত্ত্বেও একটা কিন্তু ভাব মানুষকে তখন খোঁচায়। বিভ্রান্তির ধূম্রজাল রচনার মধ্য দিয়ে হীরক রাজত্বে সক্রিয় ক্ষমতার কলকব্জারা এভাবেই বেনিফিট অভ ডাউট বোধহয় হাসিল করে নেয়! রাজা-রানী-পর্ষদরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন তখন। ভিনদেশ আক্রমণ, নিজ দেশে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাঁধানো, গদি দখল বা সেখানে কায়েমি থাকার লড়াই এমতো কারিকুরির ওপর ভর দিয়ে পৃথিবীতে আজো টিকে আছে। হীরকশাসিত রাজপাট খেলাটিকে সচরাচর বিরোধীকে বলতে দাও নামে প্রচার করে থাকে। অরাজকতা বাদ দিয়ে রাজশাসনের গঠনমূলক সমালোচনা হোক;—এরকম গালভরা আবেদন জনতার কাছে সে রাখে বৈকি! গঠনমূলক সমালোচনা এখন আদৌ ওরকম বস্তু কী করে হয় সেটা একমাত্র খেলার কুশীলব ও এজেন্টরাই ভালো বলতে পারবেন!

অন্যদিকে হীরক রাজত্ব যাদের নাপসন্দ তাদেরকে নদীমেখলা বাংলাদেশের নিরিখে সত্যনিষ্ঠ ভাবা কঠিন। তারা মোটেও সেকালের রুশো, ভলতেয়ার অথবা একালের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নন। চাণক্য বা মেকিয়াভেলিও না যে তাদের হক কথা বলার ধরনকে বিচক্ষণ কূটাভাসের স্মারক ভেবে লোকে পিঠ চাপড়ে বাহবা জানাবে। স্বাধীন মত প্রকাশের ছলে বহু বাক্য তারা কপচিয়ে থাকেন যেগুলোর মধ্যে মতলবি বুদ্ধির প্রাধান্য চোখে পড়ে। হীরক রাজার ক্ষমতা আগলানোর পন্থাকে জুতাপেটা করা এইসব মতলবি কথার মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও সেখানে আবার সত্যমিথ্যার হাজারটা গিট্টু উনারা বেঁধে দেন। একটি গিট্টু সমাজে ঘৃণা ছড়ায় তো অন্যটি গুজব আর হুজুগে জাতিকে চেতিয়ে তোলার কাজে লাগে। পিনাকী ভটচাযের পিনিক  থেকে শুরু করে ফাহাম আব্দুস সালামের মধ্যমেধার বাঙালিয়ানা বিষয়ক বাতচিতের সবটাই এরকম অর্ধ সত্য অর্ধ মিথ্যা, দেশ-জাতি-সম্প্রদায় বিদ্বেষ আর ঘৃণা ছড়ানোর রংদার সুতোয় বোনা। বাকপটু ফাহাম সুনির্বাচিত বাক্যচয়নের মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াতে সুদক্ষ! প্রথম-প্রথম ধরতে বেশ বেগ পেতে হয়। খেয়াল করলে আড়ালের অভিসন্ধি না বোঝার মতো জটিল থাকে না। উনার গালভরা একরৈখিক বাকওয়াজি নিয়ে গানপার-এ আগে দু-কলম লিখেছি, কাজেই এখন আর কথা না বাড়াই। জিয়া হাসান ও তৈয়্যবের ব্যাপারে আমার ধারণা নেই। মন্তব্যে বিরত থাকা যে-কারণে উত্তম মনে করছি।


হীরক রাজত্বের দুনিয়ায় কোনো কর্ম যদি জনস্বার্থে নেওয়া হয়ে থাকে তাহলে তার আগাপাশতলা জানার হক ও তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার জনতার ক্ষেত্রে মৌলিক
;—রাষ্ট্রের গোপন নথিপত্র কেন ফাঁস করছেন তার জবাব জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ অনেকটা এভাবে আদালতকে দিয়েছিলেন। পশ্চিম গেলার্ধে ক্ষমতাকেন্দ্রের মূল স্রোত তাঁকে পচানোর সবরকম চেষ্টাই করেছিল। বই লিখে, ছবি বানিয়ে, মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে, দূতাবাসে বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েও সফলকাম হতে পারেনি। উইকিলিকস-র দার্শনিক মনোবীজ এতে আরো পরিপুষ্টি ও বেগবান হয়েছিল। এর বড়ো কারণ, যাদের জন্য তিনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন সেই বিপুল আমজনতা তাঁকে চিনতে ভুল করেনি। ঘটনাবহুল বাংলাদেশে হীরক রাজত্বের ইতিহাসে একজন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের দেখা আজ অবধি পাওয়া ভার! এখানে সবটাই কানার হাটবাজার। গদিনসীন যেমন বাকস্বাধীনতা নিয়ে কথার খেলা খেলে, তার চামড়া ছিলে নিতে ব্যস্ত গদিহীন ও সমব্যথীরা অনুরূপ খেলাটাই খেলেন আপামর জনতার সঙ্গে।

বাংলা একাডেমি তাহলে কী? সে এই খেলার এজেন্ট বৈ কিছু নয়। অভিসন্ধিভরা উদভুট্টি কাণ্ডের বাকশো থেকে ফি বছর বইমেলায় পছন্দের মারণাস্ত্র বের করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা  ওইসব মারণাস্ত্রের মধ্যে অন্যতম! এর দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে তর্কে জড়াতে চাই না। কালের ধারায় চেতনা  ব্যাপারখানা অসৎ রাজনীতির পরিপোষক ও মতলব হাসিলের খেলায় পরিণত হয়েছে সে আর না বললেও চলে। সমস্যা হলো মতলবি খেলায় চেতনার পক্ষ-বিপক্ষে ঠাঁই পাওয়া লোকজনের সিংহভাগ সমান ভয়ংকর। ধুরন্ধরও বটে! চেতনা নামক ডিসকোর্সের পুরোটাই নির্জলা সত্যের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নিখাদ রাজনীতির স্মারক এখানে। টু পাইস কামিয়ে নেওয়া ও গদি আঁকড়ে থাকার মারণাস্ত্র হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হয়। ফাহামদের জব্দ করতে গদিনসীন হীরক রাজত্বের পর্ষদ-চাটুকার একে এখন কাজে লাগাচ্ছেন। ফাহামরা ওদিকে তাদের নিজস্ব রাজনীতির ছকে মারণাস্ত্রটি ব্যবহারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন।

সে যাকগে, বর্তমান হীরক রাজত্বের চাটুকারদের সঙ্গে প্যানিক ছড়ানো পিনাকী আর ফাহাম আব্দুস সালামের ইতরবিশেষ তফাত থাকলেও দুই পক্ষই সমান অসৎ। তারা খল ও চতুর। এইসব কথার ব্যাপারি যতটা না সত্যনিষ্ঠ দিবাকর তার অধিক নিজ পছন্দের হীরক রাজাকে গদিতে বসাতে আকুল। এটাই তাদের একমাত্র রাজনীতি। এক হীরক রাজত্বকে আরেক হীরক রাজত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্য বুকে পুষে তারা লিখছেন মনে হয়। অনলাইনে তাদের বাকোয়াজির ষোল আনাই সন্দেহজনক। পক্ষপাতদুষ্ট ও একরৈখিক তো বটেই! এই ভজকটের কারণে মত প্রকাশের ভলতেয়ারউক্তির সার জনবহুল বাংলাদেশে বিটকেল দেখায়। হীরক রাজার গদিতে এখন যারা রাজত্ব করছে অথবা সামনে যারা করবে, তাদের হয়ে কথার খেলায় লিপ্ত ব্যাপারিদের যমজ লাগে নিজের কাছে। দুই পক্ষের বাইরে তৃতীয় পক্ষ বা সেরকম কথার দিবাকর কি সত্যি দেশে রাজ করে এখন? প্রশ্নটি তুলে রাখছি এইবেলা।


বাংলাদেশের বর্তমান হীরকশাসন অবশ্য একাধিক কার্যকারণ দোষে অনন্য। চেতনাকে রাজনীতির গুটি রূপে ব্যবহার তার একটি ধরা যায়। বিভাজকরেখা টেনে দিয়ে প্রতিপক্ষ শনাক্ত ও দমনের খেলাটি তারা ফাহাম আব্দুস সালাম যাদের পক্ষে সচরাচর ওকালতি করতে ব্যস্ত তাদের নিকট থেকে বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছে। এ তো মিথ্যে নয় বাকশাল িআওয়ামীতন্ত্রের পাল্টি হিসেবে জিয়াউর রহমান যে-পলিটিক্সের জন্ম দিয়েছিলেন সেটা ওই বিভাজকরেখার শাণিত রূপ ছিল মাত্র।

হালের হীরকশাসন আরেক দিক থেকেও কূটজ্ঞ বটে! তথ্য-প্রযুক্তির নবতর বিস্ফোরণে গণসংযোগের মাহাত্ম্য বহুরৈখিক চরিত্র ধারণ করায় বিরোধীকে সে কথা বলতে দিচ্ছে না এই দাবি শতভাগ ধোপে টিকে না। সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচারযন্ত্রের বাইরে হাজারো গিট্টুঠাসা পিনিক দেশের আমজনতা অন্তর্জালে রাতদিন গিলছে ও সাদা মনে বিশ্বাস যেতে আপত্তি করছে না। ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার নামে হীরক রাজার চাটুকার পরিবেষ্টিত পর্ষদের উদভুট্টি কাণ্ডকারখানায় বিরক্ত হওয়ার কারণে বোধহয় আমজনতা এইসব পিনিককে অকাতরে সত্য বলে নমো-নমো করে।

আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে;—অন্নদামঙ্গলের সারোক্তি এই জনপদে আজোবধি সত্য হয়ে ওঠেনি। দুধেভাতে থাকার নিশ্চয়তা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে অধরা! রাজাবদলের খেলায় তারা ঘণ্টাই পেয়েছে শুধু! দেশজনতা অগত্যা রাজা ও তার পর্ষদকে মজাকের খাদ্য ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না। পিনাকী ও ফাহামের মতো কথার খেলোয়াড় সেই মজাকে ঘি ঢালতে পটু হওয়ার কারণে মানুষ তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরছে। মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে গদিনসীনের মতো খতরনাক পন্থায় কথার খেলা খেলছেন জেনেও মানুষের এই বিনোদিত হওয়ার ধরন হীরক রাজত্বের জন্য সুখকর সংবাদ নয়। অশুভ সংকেত দিচ্ছে ওটা। বাংলা একাডেমির উদভুট্টি কাণ্ড সংকেতকে আরো নগ্ন করে তুলেছে এই যা। নগর পুড়তে শুরু করলে দেবালয় বাদ যায় না;—সরল এই সারসত্য কেন জানি ক্ষমতাসীন হীরক রাজারা ধরতে পারে না আর পতন তখনই ঘটে যায়। এমনটাই ধারণা আমার।


স্মার্ট বাংলাদেশের চালিয়াতিভরা হীরকশাসনের মঞ্চ আজ নয় কাল ভেঙে পড়বে। নতুন মঞ্চে উঠবে নতুন হীরক রাজা ও তার চাটুকারগণ। রাজাদের এই আসা-যাওয়ার ছকে জাতির মনন গঠনে নিবেদিত বাংলা একাডেমির ভিন্ন ভূমিকায় মঞ্চে নামার সুযোগ নেই। সে হচ্ছে সঙ। ওই সাজ পরে তাকে জোকারের ভূমিকায় পার্ট দিয়ে যেতে হবে। রাজা যেমন সে তেমন;—এই ছকেই তার সিদ্ধি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, বিরোধীকে বলতে দাও…এইসব কথার মাহাত্ম্য আজো অটুট হলেও দিনের শেষে তার সবটা জনবহুল বাংলাদেশে অচল দুআনির শামিল!

চর্যাপদের যুগ থেকে এখনাবধি অরাজক এইসব কালের বিবরণে বাংলাদেশটা বোঝাই হয়ে আছে। মত প্রকাশের শত অন্তরায়ের মধ্যে ওগুলো যুগ-যুগ ধরে নীরবে বহন করছে নীল আসমানে ঘেরা ভূমিতে একের-পর-এক হীরক রাজাদের দুঃসহ দুঃশাসনের স্মৃতি। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরকে দেখি সেকালে বসে লিখছেন :—

একি ভূতগত দেশে রে। না জানি কি হবে
শেষে রে।। উত্তম অধম, না হয় নিয়ম,
কেহ নাহি ধৰ্ম্ম লেশে রে। দাতা ছিল
যারা, ভিক্ষা মাগে তারা, চোর ফিরে সাধু
বেশে রে।। যবনে ব্রাহ্মণে, সমভাবে গণে
তুল্য মূল্য গজ মেষে রে। ভারতের মন,
দেখি উচাটন, না দেখিয়া হৃষীকেশে রে।।

ভারতচন্দ্রের যুগবিশ্ব থেকে কি অধিক আগাতে পেরেছে দেশ? সুকুমার রায়ের ‘একুশে আইন’টাই আমাদের সংবিধানের সারকথা। আবোলতাবোল-র রচয়িতা তাঁর রসবোধের খনি থেকে একমুঠো পরিহাস সেদিন তুলে এনেছিলেন। বাকস্বাধীনতার সীমা-সরহদ্দের সবটা ওই একমুঠো পরিহাস থেকে সম্যক ঠাহর করে নিতে কষ্ট হয় না। স্বাধীনতার সমূহ আপদকে সীমায় আটকানোর মধ্যেই হীরক রাজত্ব চিরকাল নিজের চরিতার্থ খোঁজে;—সুকুমার রায় বিরচিত ‘একুশে আইন’-র এটাই হচ্ছে সারকথা। ক্ষমতা ও প্রজাপালন এতেই স্থায়িত্ব পায় ও সিদ্ধিলাভ ঘটে বলে হীরক রাজাদের ধারণা। বাংলা একাডেমির কাণ্ডকে ওই জায়গা থেকে পাঠ করাই উত্তম। কাজেই কথা আর না বাড়িয়ে সুকুমার রায়ের ননসেন্স রাইম জপতে-জপতে বিদায় নেই এখন :—

শিব ঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে
প্যায়দা এসে পাক্‌ড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার
একুশ টাকা দণ্ড তার।।

সেথায় সন্ধ্যে ছ’টার আগে,
হাঁচতে হ’লে টিকিট লাগে;
হাঁচ্‌লে পরে বিন্‌টিকিটে
দম্‌দমাদম্ লাগায় পিঠে,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে
একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে।।

কারুর যদি দাঁতটি নড়ে,
চারটি টাকা মাশুল ধরে,
কারুর যদি গোঁফ গজায়,
একশো আনা ট্যাক্‌স চায়
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,
সেলাম ঠোকায় একুশ বার।।

চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়,
এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়
একুশ হাতা জল গেলায়।।

যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধ’রে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান্ সুরে,
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদীর খাতা
হিসেব কষায় একুশ পাতা।।

হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে,
নাক ডাকলে ঘুমের ঘোরে,
অম্‌নি তেড়ে মাথায় ঘষে,
গোবর গুলে বেলের কষে,
একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে
একুশ ঘন্টা ঝুলিয়ে রাখে।।


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

পরের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you