বাউল আব্দুল হাকিম আর তাঁর একজীবনের সারাৎসার || সরোজ মোস্তফা  

বাউল আব্দুল হাকিম আর তাঁর একজীবনের সারাৎসার || সরোজ মোস্তফা  

বাউল আব্দুল হাকিম পঞ্চাশ বছর ধরে সাধনার পথে আছেন। গৃহী বাউলের পঁচাত্তর পেরোনো চেহারা; উনার সাথে নেত্রকোণার কোর্টস্টেশনে আলাপ। কৃষিজীবী মানুষের চেহারায় একটা অকৃত্রিম রঙ থাকে। দীপ্তি থাকে। সাধুদের হাঁটার মধ্যেও আলো থাকে। সেই আলো নিয়ে হাঁটছেন এই বাউল। দীর্ঘজীবন তিনি একটা পথের পথিক; গুরুর দেখানো পথে তিনি ক্রমাগত হাঁটছেন। নিরালা পথের এই পরম মনের সাথে কথা বলেছেন কবি সরোজ মোস্তফা এবং গায়ক রেজাউল করিম। সাক্ষাৎকার গ্রহণকাল সেপ্টেম্বর ২০২০।

বাউল আব্দুল হাকিম

সাধনার পথে কীভাবে আসলেন? আপনার পরিবারে এই ধারায় আরো কেউ ছিলেন কি না?
আমার পরিবারে আমিই বাউল। গানবাজনার লাইনে আছি পঞ্চাশ-ষাইট হইবো। আগে গ্রাম্য কালচারে ছিলাম। গ্রামে গ্রামে তামশা গান করতাম। নেত্রকোণার বাউলরা ভাবসমুদ্রের সম্পদ। বাউললাইনে আইছি, কমছে-কম চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর। বাউলগান শুনতে শুনতে, বাউলদের দেখতে দেখতে উনাদের ভাবের সমুদ্রে ডুবে গেলাম। তামশাগান ছাইড়া বাউলগানে যোগ দিলাম। আমার গুরু সুরুজ মিয়া সাহেবের কাছে দীক্ষা নিলাম। গুরুসঙ্গ ছাড়া বাউল শিক্ষা হয় না।

বাউলচর্চা কতদিন ধরে করছেন? আপনার ওস্তাদ সুরুজ মিয়ার সন্ধান পেলেন কীভাবে?
এখন আমার বয়স পঁচাত্তর। মনে হয়, ষোলো-সতেরো বছর বয়সে গানবাজনায় ঢুকেছি। এই গানবাজনায় মন ভিজাইতে ভিজাইতে আমি বাউল হইছি। বাউল হওয়া, বাউলচর্চা খুব কঠিন পথ। আমার বাড়ি থেকে আমার গুরুর বাড়ি চার-পাঁচ মাইলের পথ। সকাল সকাল কৃষি আর বাড়িঘরের কাজ শেষ করে গুরুর বাড়িতে গেছি। আমি কৃষকের ছেলে। আমি সংসারী লোক। নিজেকেই দিতে হয়েছে নিজের ভাতের যোগান। বাউলধর্মে, বাউলগানে যার নেক আছে তারা প্রত্যেকেই আমার গুরুকে চিনেন। গুরু ছাড়া বাউলদীক্ষা হয় না। বাউলগান হলো সাধুর উচ্চারণ। বাউলগান হলো পরমকে চাওয়া-পাওয়া, মিলন ও বিচ্ছেদের সুর। পরমকে পাইতে হলে পাওয়ার নিয়মকানুন জানতে হয়। গুরুসঙ্গ ছাড়া পরমজ্ঞান অসম্ভব। আপনি জিজ্ঞাস করছেন না, গুরুকে কেমনে পাইলাম? আল্লায় মিলায়া দিছে। ভাবের পথে নামছি বলেই হয়তো আল্লায় মিলায়া দিছিলেন। পরমের ডাকে দিল্ দিয়া ভাবের পথে নামাটা সহজ না। প্রকৃত গুরু হাত ধরে সাধনার দিনলিপি লিখে দেন। বুঝিয়ে দেন গন্তব্য। কোন দিকে যাইবেন, এটা নির্ধারণ না করে হাঁটার কোনো মানে হয় না। গুরুর চরণ ছুঁয়ে জেনে নিতে হয় পথের প্রতিজ্ঞা। গানের আসরে আসরে ঘুরতাম। সেখানেই আমি গুরুকে পাই।

baul abdul hakim

গুরুসঙ্গে কতদিন ছিলেন? কেমন ছিল গুরুসঙ্গের দিনগুলো? কীভাবে শেখাতেন গুরু?
গুরুর সান্নিধ্যে এক নাগাড়ে প্রায় পাঁচ বছর ছিলাম। গুরুর সাথে আসরে আসরে ঘুরতাম। উনার গানের মায়াতেই আমি বাউলে আসি। গুরুর সাথে থাকতে থাকতে ভাবের মহলে ঢুকছি। গুরু দায়াময়। জায়গা দিয়েছেন। পথের দিশা দিয়েছেন। আমার সৌভাগ্য, গুরুর চরণে জায়গা পাইছি। এই যে রেলস্টেশনে বসে আপনার সাথে কথা বলছি, সে গুরুর কৃপাতেই। গুরুই পাড়ে নিয়ে যাবেন। মুর্শিদ ছাড়া কেউ নিজের আত্মা পাড়ে ভিড়াতে পারবেন না। সারাজীবন সাধনেই ছিলাম। দীক্ষার কয়েক বছর পরে গুরুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছি। আমার গুরুর গুরু সাধক-বাউল তৈয়ব আলী। তাকেও নিজের বাড়িতে মাঝে মাঝে নিয়ে এসেছি। উনাদের চরণের কাছে বসে শুনেছি মারফতি কথা। বাউলের জ্ঞান মুখে মুখে থাকে। আত্মা থেকে আত্মায় ছড়াতে থাকে এই জ্ঞান। এই জ্ঞান একার না; অনেক মহতের একটা বড় মহাল। গুরুর সেবা করতে করতে, উনার পাশে থাকতে থাকতে আমি বাউল হয়েছি। দরদ দিয়ে উনি সৃষ্টিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, নুরতত্ত্ব, নবি-রাসুলের জীবনী, আদমের জীবনী, খাজা সাইবের জীবনী, সুফিদের জীবনীর পাঠ নিয়েছেন। ভাবের সমুদ্রে আমি একটা ফড়িং। আপনার রূপ দেখতে ঘুরতাছি।

উনাদের সাথে কি আপনি গাইছেন? কেমন ছিলেন উনারা? কাদের সাথে আপনি গাইছেন?
উনাদের সাথেই আমি গাওয়া শুরু করছি। পাল্লাগানে উনারাই নামিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্নোত্তর গান কীভাবে করব উনারাই হাতে ধরে শিখিয়ে দিছেন। দুইটা লাইন দুজন গায়কের কাছে থাকে। হাশর-কিয়ামত কিংবা দেহতত্ত্ব কিংবা সৃষ্টিতত্ত্ব কিংবা নবিতত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন ও জবাব। পরে অনেক স্টেইজপ্রোগ্রামও করছি। এই গানকে কেউ বলে বাউলের পাল্লা, কেউ বলে মালজোড়া। একেক দেশে একেকরকম বলে। আমি বাউলসম্রাট ইদ্রিস মিয়ার সাথে গান করছি, আলী হোসেন সরকারের সাথে গান করছি, কিতাব আলীর সাথে গান করছি, সুনীলের সাথে গান করছি, সিরাজের সাথে করছি, আজাদের সাথে করছি।

বাউল আব্দুল হাকিম

বাউল গানের আগে এই অঞ্চলের গানের ধারাটা কেমন ছিল? মানে কোন ধরনের গান প্রচলিত ছিল?
কবিগান এই অঞ্চলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তারও আগে এই অঞ্চলে সুফিরা আসছেন। সুফি-সাধকেরা গান পছন্দ করতেন। পির সাহেবরা হালকা জিকিরের মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে সৃষ্টি ও আল্লাহর গুণগান করতেন। পির সাহেবদের আসরে আসরে গান চলত। এই গান ও জিকিরের মাধ্যমে দিলের ময়লা সাফ হয়ে যেত। মানুষ গান শুনে কাঁদে কেন? গান আসলে প্রশ্ন; নিজেরে জিগানো। সুফিরা জিকিরে জিকিরে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন। গানের মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলন ঘটিয়েছেন। পির-ফকিরেরাও এই অঞ্চলের বাউলগানকে ভাসাইছেন।

এই যে সংসারের ভেতর থেকে বাউল হইতে চাইছেন, বাউল কি হইতে পারছেন? মন কি সংসারের মায়া-মোহ ত্যাগ করতে পারছে? এই যে আপনি বাউল সমিতি করেন, বাউলদের কি সমাজ নেবে কোনোদিন? আপনার কাছে যারা আসেন তারা কি বাউল হতে আসেন, না শুধু গান শিখতে আসেন?
পরমকে পাওয়ার এই সাধনা মোটেও সহজ না। সাধু জালাল খাঁ সাহেব বলেছেন, “ভাবের কথা কইতে গেলে না আছে তার শেষ / পুত্র-কন্যার মাঝেই থাকো হইয়্যা নিরুদ্দেশ”। পুত্র-কন্যার মাঝে আমি নিরুদ্দেশ হয়েই ছিলাম। গৃহী বাউলরা হইলেন পরমহংস। সংসারে সাঁতরাইলেও শরীর ভেজান না। সংসারের চাওয়া-পাওয়া-মায়া থেকে নিজেরে মুক্ত করা কঠিন। আমি চেষ্টা করে গেছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুরোপুরি পারছি, এই কথা বলার শক্তি আমার নাই। পুরোপুরি পারছি, এই কথা বললে মিথ্যে বলা হবে। আমি তো গরিব মানুষ; জমিতে কাম করতে হইছে। ঘরে ভাত না থাকলে, মানুষের কাছে হাত পাতলে মানুষ টিটকারি মারতো। আমার কাছে ঘর ‘দহনদয়িতা’। বাউল হইলে আপনেরে কত কথা শুনতে হইবো! বাউলজ্ঞানে নিজেরে শুদ্ধ করতে পারছি কি না ঠিক কইতে পারবো না। চেষ্টা করে গেছি। কতটা পারছি, এইটার কোনো হিসাবের খাতা নাই। বাউলের তত্ত¡জ্ঞান যার উপরেই বসছে, সে-ই আলোকিত হয়ে গেছে। তার কোনো অহঙ্কার নাই, হিংসা নাই, লোভ নাই। সীমার মাঝে, সংসারের মাঝে সে কমপক্ষে একজন নিখুঁত বাবুই হইতে পারছে। আমার বাউল সমিতিও বাউলের প্রচার। এই যে লেভেল ক্রসিং বাজারে সমিতির ঘর করছি এইটাও সহজ ছিল না। আমি লালন, হাসন রাজা কিংবা জালাল খাঁ না। আমার এত ক্ষমতা নাই। আমি একটা জেনারেশনের কানে-মনে ভাবের কথা পৌঁছে দিতে চাইছি। কিন্তু পারছি কই? কেউ বাউল হইতে চায় না। বাউলের গানটা গাইতে চায়। গানটা বুঝতে চায় না, মনে বসাইতে চায় না, শুধু গানটা গাইতে চায়। এই জীবনে কমপক্ষে হাজারখানেক ছাত্র আমার কাছে আইছে। কিন্তু সবাই ছাত্রই থাকল। কেউ বাউল হইলো না। সবাই গানের উপরের সুরটায় ভাসে গেল। ভেতরের সুরটার সন্ধান করল না। এখনকার শিল্পীরা গানের তালিম নিয়েই টেলিভিশনের বাকশের ভেতরে ঢুকে চায়। আমি প্রত্যেকের মনটা বুঝি। গান শিখাই। শিখাতে শিখাতে কিছু কথা তাদের দিলে রাখতে চাই। দিল্ থেকে ওরা যদি একদিন বাউল হইতে চায়, তবেই আমার শান্তি।

baul abdul hakim

জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে? আছে কি কোনো অপ্রাপ্তি?
বাউলের কোনো আক্ষেপ থাকে না। আক্ষেপ নিয়ে বাউল হওয়া যায় না। বাউলরে আপনারা একা ভাবেন। বাউল একা না। সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়েই আমি হাঁটছি। আমার হাঁটায় ভুল নাই। আমার বুকে আমার মুর্শিদ। যার মুর্শিদ আছে তার আক্ষেপ নাই। লালনের গানটা শুনে থাকবেন,  “পারে কে যাবি নবির নৌকাতে আয়”। আমি কোনো পাপে লিপ্ত নাই। বাটাবাটি-লাভালাভিতে নাই। গানের মানুষ হয়ে আমি সহজ পথে আছি। এই পথ ভুল হতে পারে না। যিনি মুর্শিদের চরণ ছুঁয়েছেন, তিনিই বাউল হয়েছেন। আমি চেষ্টা করে গেছি। প্রতিদিন বাউল হতে চেষ্টা করেছি। আক্ষেপ করি না।


ব্যবহৃত স্থিরচিত্র লেখকের সৌজন্যে পাওয়া — গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you