বাউল শাহ আবদুল করিমের আদর্শিক উত্তরসূরি, তাঁর ভাগ্নে, বাউল শাহ্ আবদুল তোয়াহেদ। একহারা গড়নের এই বাউল স্বভাবেও দৃঢ়, চরিত্রেও অটল। এক নির্লোভ সাধক হিসেবে নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন এক অনন্য উঁচু জায়গায়। দারিদ্র্য তাকে কখনো দমাতে পারেনি। মাথা উঁচু করে তিনি সৃষ্টিকে শান দিয়ে গেছেন আপন মনে, নিরন্তর।
জীবন ও জগৎকে তিনি ধরেছেন গানের বহুরূপী আয়নায়। তার গানে প্রেমের আবেশ যেমন আছে, তেমনি আছে দ্রোহের ঝাঁজ। ভাব ও বস্তু একসঙ্গে চলে, দ্বন্দ্বহীন। মানুষকে তিনি দেখেছেন মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। মানুষই তার সাধনা, তার আরাধ্য। শেষ পর্যন্ত, মানুষের জয়গানই গেয়ে গেছেন তিনি উচ্চকণ্ঠে। তার কণ্ঠ আজো উচ্চকিত। অসুস্থতা দমাতে পারছে না তার মানবিক অফুরান শক্তিকে।
আজ এই মহাজনের গীতসমগ্র প্রকাশ করেছে বন্ধু রাজীব চৌধুরীর প্রকাশনী ‘চৈতন্য’। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয়েছে এ গীতসংকলন। সুনামগঞ্জের সংস্কৃতিবান্ধব জেলাপ্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া এবং দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জীব সরকারকে এ কাজে সহায়তা করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো যেতেই পারে।
বাউলের দেশ সুনামগঞ্জ। এখানকার উজ্জ্বল পরম্পরায় যুক্ত হলেন মহাজন শাহ আবদুল তোয়াহেদ। তার সৃষ্টি রক্ষায় এই গীতসংকলন এক মূল্যবান প্রয়াস। গানগুলো অন্তত কিছুটা রসদ পেলো টিকে থাকার, হারিয়ে যাওয়ার পথ থেকে ফিরে আসার একটি সুযোগ তৈরি হলো।
এর আগে বহুবার চেষ্টা করেও তার গান সংকলিত করতে পারিনি আমরা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, প্রতিশ্রুতির খেল, সাহায্যের আশ্বাসের ফাঁকা বুলি সবই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এমনই অভিজ্ঞতা। কয়েক মাস আগে অসুস্থ হয়ে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। বারান্দায়-পড়ে-থাকা এক শক্তিমান গীতিকবিকে দেখে হৃদয় ভারী হয়ে আসে। কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে হাসপাতাল ছেড়ে যান অভিমানী বাউল, ভর্তি হন ডায়াবেটিক হাসপাতালে। মাসখানেকের চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরলেও আজও তিনি অসুস্থ। প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। অথচ ওষুধের ব্যবস্থাও নেই নিয়মিত। গানকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা এই অকৃতদার দীনহীন বাউলের দিনকাল চলছে চরম অনিশ্চয়তায়। নুন পান্তা—কোনোটারই নিশ্চিত সংস্থান নেই তার।
অসুস্থকালে বাউলের অসুস্থতার কথা জেলা প্রশাসকের কানে তোলা হলে তিনি কিছুটা আর্থিক সহায়তা দেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন গানগুলো সংকলনের। তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। নিভৃতে দেওয়া কথা রেখেছেন সরবে। প্রায় সাত শতাধিক গানের সংকলন প্রকাশ করে দিয়েছেন। সংকলন দেখে অসুস্থ বাউলের মুখে ফুটে উঠেছে প্রশান্তির হাসি। তিনি নিজের সৃষ্টিসন্তানের মুখ দেখে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তার অবয়ব জুড়ে ছিল প্রশান্তির ছায়া।
এবার নিশ্চিন্তে বাকি জীবন কাটাতে চান এই ভূমিহীন বাউল। কিন্তু যার নিজের একটি ঘর নেই, সে কোথায় কাটাবে জীবন? এই প্রশ্ন উঠলে, জেলা প্রশাসক আবারও সহানুভূতির পরিচয় দেন। ভূমি সহ ঘরের ব্যবস্থার আশ্বাস দেন ভূমিহীন বাউলকে। অচিরেই এই আশ্বাসও বাস্তবায়িত হবে বলে বিশ্বাস করি।
গানের গতি হলো, এবার একখণ্ড ঘরে দেহযানের গতি হোক—এই আশাবাদেই আমরা বিশ্বাস রাখি।
শেষ করছি লোকশিক্ষক বাউল শাহ্ আবদুল তোয়াহেদের একটি গান দিয়ে—যেখানে তিনি নিজেই বলে গেছেন তার জীবনের সারকথা :
আমি একদিন থাকব না, থাকবে আমার গান,
গানের মাঝে খুঁজলে পাবে প্রাণেরই সন্ধান।
সুর-তাল-ছন্দে গানে করে গেলাম ওয়াজ,
মানবসেবায় মানুষ হবে, করো ভালো কাজ,
কাল নয় করো আজ, ঠিক রাখো ইমান।
লোকশিক্ষার উদ্দেশ্যে গান লিখি আমি,
কি করলে তোমাকে ভালোবাসবে জগৎস্বামী?
অন্তরে রয় অন্তর্যামী, বিপদে করবে ত্রাণ।
তোমাকে সৃষ্টি করে স্রষ্টা তোমার মাঝে,
মক্কা কাশী যেয়ো না তাহাকে খুঁজে,
নিজেকে লও বুঝে—কয় তোয়াহেদ অজ্ঞান।
১৬ অগাস্ট ২০২৫
শামস শামীম রচনারাশি
- লোকশিক্ষক শাহ্ আবদুল তোয়াহেদ : গানের গতি হলো, এবার হোক দেহযানের গতি || শামস শামীম - August 17, 2025
- বিরোধের দিন বিষাদের রাত || শামস শামীম - June 12, 2025
- শফিকুন্নূর স্মরণানুষ্ঠানে সতীর্থ সাধক ও সময় নিয়া ভাবনা || শামস শামীম - January 4, 2025
COMMENTS