সজল কান্তি সরকারের ‘ভাট কবিতা : হাওর কাহন’ পড়লাম। ১৬ পৃষ্ঠার ছোট্ট বই। বইটা উলটিয়ে মনে হলো ভাটির ময়ালের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ-রূপান্তরকে ছন্দে ছন্দে প্রকাশ করেছেন কবি। গ্রন্থের ভূমিকায় কবি লিখেছেন : “ভাটির পদকর্তা সুরে সুরে বান্দে ভাট কবিতা। ভাট কবিতাকে অঞ্চলভেদে হাটুরে কবিতাও বলা হয়। প্রবীণদের ভাষ্যমতে ভাটির কবিদের রচিত বলে ‘ভাট কবিতা’ কিংবা হাট থেকে কিনে আনা বলে ‘হাটুরে কবিতা’ নামকরণ হয়। সমকালীন বিষয় নিয়ে রচিত কাহিনী নির্ভর কবিতা ভাটি ময়ালে বা লোকসাহিত্যে ভাট কবিতা হিসেবেই সমাদৃত।”
বাল্যকালে আমিও শুনেছি ভাট কবিতা। আমাদের দুগিয়া, কোনাপাড়া, আমতলা বাজারে ৯০ দশকেও ভাট কবিতার চল ছিল। গীতিকবিতার আদলে গ্রামের বাজারে কবিরা এসে কাহিনি শুনাতেন। রোমাঞ্চকর সেই কাহিনিই শ্রোতারা কিনে নিয়ে যেতেন। দুইশ কিংবা আড়াইশ কিংবা আরও বেশি লাইনে ছন্দে-ছন্দে অন্তমিলে লেখা হতো সাম্প্রতিক কিংবা পুরান কাহিনি। কাহিনিনির্ভর এইসব কবিতা পড়ার সময় রচয়িতারা এক ধরনের গভীর আবেগে ডুবে যেতেন। উপস্থিত শ্রোতারাও আত্মমগ্ন হয়ে শুনতে শুনতে সেসব কাহিনিতেই মিশে যেতেন।
সাম্প্রতিককালে ভাট কবিতা কিংবা হাটুরে কবিতা বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায়। কিন্তু এক সময় হাটে-ঘাটে উঠানে-মাঠে কিংবা ট্রেনযাত্রাতেও এই ভাট কবিতার শ্রোতা ও গায়ক ছিল। মানুষ কবিতা শুনত। কবিতা মনে রাখত। কবিতা কিনে বাড়ি নিয়ে যেত। পয়ার, ত্রিপদী ও ধুয়োর ছন্দে লেখা কবিতার মধ্যে থাকত বিভিন্ন উপমা যা শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করত।
এই সময়ে ফেসবুকের কল্যাণে প্রতিনিয়তই প্রচুর ঘটনা ভাইরাল হচ্ছে কিন্তু সেইসব ঘটনা মানুষের মনে তেমন রেখাপাত করছে না। মানুষ এইসব ঘটনার সত্যাসত্য হয়তো ধারণা করতে পারছে কিন্তু পাচ্ছে না কোনো সাহিত্যরস। কিন্তু একসময় গ্রামবাংলার এই রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলো নিয়ে হাটুরে কবিরা এমন অসাধারণ সব আখ্যান রচনা করতেন যা সময়ের শ্রোতা এবং পাঠককে মুগ্ধ করত। ভাট কবিরা স্বল্প খরচে ১৬ অথবা ২৪ পৃষ্ঠার মাধ্যমে এই সাহিত্যমাখা মধুর আখ্যানগুলো প্রচার করতেন।
এখন চাঞ্চল্য শব্দটাই হারিয়ে গেছে। সমাজ থেকে চাঞ্চল্য মরে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ভাট কবিতার উপর। এখন প্রত্যেকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা টেলিভিশনে লাইভে দেখানো হয়। সব ঘটনাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় কিংবা ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তবে সাহিত্যরসটা আর পাওয়া যায় না। পুঁথিসাহিত্য এবং পালাগানের পরে ভাট কবিতাও মরে গেছে। অথচ সাধারণ মানুষের কাছে এই সহজ সরল কাহিনিনির্ভর কবিতাগুলো ছিল রহস্যময় ও আনন্দের জায়গা। গ্রামীণ কবি এবং শ্রোতা — দুজনেই ছিলেন সুশিক্ষিত। এসব কবিতায় রোমাঞ্চকর কিংবা লোমহর্ষক ঘটনাকে কবিরা অত্যন্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণনা করতেন। রহস্যময় ভাষায় সহজ বর্ণনার ভেতরে থাকত সমকাল ও জীবনের প্রতিচ্ছবি।
ভাট কবিতাকে কিংবা কবিকে হাটুরে কবিতা বা হাটুরে কবি বলা হলেও এর লেখকগণ ছন্দের ব্যাপারে ছিলেন যথেষ্ট আন্তরিক এবং পারঙ্গম। কবিগণ ছন্দ না শিখে কেউ কবিতা লিখতেন না। তারা প্রত্যেকেই ওস্তাদের কাছে ছন্দ শিখতেন, ভাষা শিখতেন, পরিবেশন শিখতেন, শিখতেন লেখার করণকৌশল। এজন্যই কবিদেরও ওস্তাদের আস্তানায় শিক্ষাগ্রহণ করতে হতো। ভাট কবিতাগুলো হাটে-বাজারে, বাসে, লঞ্চে ও ট্রেনে বিক্রি হতো। বিক্রেতারা কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ থেকে পাঠ করে পাঠকহৃদয়ের তৃষিত চাতককে আকৃষ্ট করে ভাট কবিতা বিক্রি করতেন।
গ্রামের জনপদের মানুষ ভাট কবিদেরকে কবি বলে সম্বোধন করত। এই সম্বোধন ছিল সম্মানের। সত্যি সত্যি কবি পরিচয়টার একটা মূল্য এবং অহম ছিল। ধীরে ধীরে সেই পরিচয় ও অহম সমাজ থেকে মুছে গেছে। প্রতিটি হাটে হাটে কিংবা মেলায় কবিতা নিয়ে কবি উপস্থিত হতেন। কবির কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে থাকত কবিতার বই। সেই ব্যাগ থেকে বই হাতে নিয়ে কবি পুরো বা অংশবিশেষ কবিতা পাঠ করতেন। সঙ্গে সঙ্গে বিক্রিও করতেন। লঞ্চঘাটে, বাজারে, মজমায়, মচ্ছবে, স্টেশনে, ট্রেনে বাসে লঞ্চে স্টিমারে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে কবিতার বই রেখে কবিরা পরিভ্রমণ করতেন, কবিতা শুনাতেন। আবার হাটবাজারে চট বিছিয়ে তার উপর বিভিন্ন ভাট কবিতার পসরা সাজিয়েও অনেকে বিক্রি করতেন।
নব্বইয়ের দর্শক পর্যন্ত এক টাকা, দুই টাকা, চার টাকায় একখানা ভাট কবিতা বিক্রি হতো। এর আগে এক পয়সা, দুই পয়সা, চার আনা, আট আনায় এসব কবিতা বিক্রি হতো। দাওমারির কালে গ্রামের কামলারা উঠানের কিংবা দাওয়ায় কিংবা হাওরের উন্মুক্ত প্রান্তরে ভাট কবিতার আসর বসাতেন। একজন পড়তেন সবাই মিলে শুনতেন। এ যেন পড়াশোনার সম্মিলিত কবিতা। পঞ্চাশের মন্বন্তর, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ — কী নিয়ে রচিত হয়নি এই গণমানুষবান্ধব ভাট কবিতা!
আসুন সজল কান্তি সরকারের বন্দনা অংশের কয়েকটি পঙক্তি পড়ি :
প্রথমে গুরুর নামটি (২) জানি খাঁটি অন্তরে আমার,
মাতা-পিতার চরণবন্দী আমি গুনাগার।
জেলা সুনামগঞ্জেতে (২) আছে তাতে নগদাপাড়া গ্রাম,
সেই গ্রামেতে বসত করি সজল আমার নাম।
আমার মনের আশা (২) ভালোবাসা খাল-বিল-হাওর,
লিখতে চাই মনের কথা কবিতার ভিতর।
আমি নই পদকর্তা (২) লিখতে বার্তা মনের পিয়াস,
লিখলাম কিছু মনোবাঞ্ছা কবিতার দাস।
বলি বিনয় করি (২) মান্য ধরি শোনেন দিয়া মন
কালিদহ সাগর ছিল এই হাওর তখন৷৷
পাশে গারো পাহাড় (২) উত্তর কিনার আরও হিমালয়,
ভৈশালে কালিদহ হাওর-বাওড় হয়।
তাহার পরের কথা (২) ভিন্ন বার্তা কি বলিব আর,
পলি জমে ভরে ওঠে হাওরের পাড়॥
বইয়ের নাম / ভাট কবিতা : হাওর কাহন; বইয়ের লেখক : সজল কান্তি সরকার; বইয়ের প্রচ্ছদ : সজল কান্তি সরকার; প্রকাশক : অসীম সরকার, গাঙুড় প্রকাশনী, সিলেট
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
সজল কান্তি সরকার রচনারাশি
- ভাট কবিতার দিনলিপি || সরোজ মোস্তফা - June 1, 2025
- ফকিরের রত্নরাজি || সরোজ মোস্তফা - May 21, 2025
- মুস্তাফা জামান আব্বাসী : অবদান তাঁর অবিনাশী - May 14, 2025
COMMENTS