গ্রামীণ মানুষের কাছে বাংলা লোকগানের কদর অনেককাল আগে থেকেই ছিল। তবে শহুরে মানুষেরা এসব গানকে ‘গ্রাম্যগান’ অভিধায় ‘অচ্ছুৎ’ মনে করে বরাবরই এড়িয়ে চলতেন। পঞ্চাশের দশকে এসে এ ব্যবধান কিছুটা ঘুচতে শুরু করে। এ সময়টাতেই শহুরে মানুষেরা লোকগানের বৈচিত্র্যময় সুর ও প্রাণবান আদলটির রূপ টের পান।
লোকগানের মায়াবি সুরের আকর্ষণ অনুভব করার ফলেই গ্রামের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মতন শহুরে মানুষেরা লোকগানে মোহাবিষ্ট হন। লোকগানে শহুরে-নাগরিকদের আবিষ্টতা তৈরির পেছনে যে-কয়েকজন পথিকৃৎতুল্য ব্যক্তি রয়েছেন তাদের মধ্যে বিদিতলাল দাস (১৯৩৮-২০১২) অন্যতম। তাঁর আগে-পরেও অনেক সংগীতগুণী লোকগানকে নাগরিক শ্রোতাদের কাছে পরিচিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
বাংলা লোকগানের আকর বা খনি হিসেবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে যে সিলেট অঞ্চলকে সেখানেই বিদিতলাল দাসের জন্ম ও বেড়ে-ওঠা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে অখণ্ড ভারতবর্ষের করিমগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ মহকুমার সমন্বয়ে ছিল এই সিলেট অঞ্চল। একদিকে পাহাড়-চাবাগান আর অন্যদিকে হাওরের অবারিত জলরাশি — ভৌগোলিক-ভিন্নতার পাশাপাশি দিনের পর দিন অদ্ভূত সৌন্দর্য ছড়িয়ে আসছে এখানকার প্রকৃতি। ছয় ঋতুতে ক্ষণে ক্ষণে বদলানো প্রকৃতির অপার হাতছানিতে বিমুগ্ধ এখানকার মানুষ।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল সিলেটের দুই মেরুতে পাহাড়-হাওরের অবস্থান। এখানকার পাহাড়ে যেমন জুমচাষ হয়, যেমনভাবে চা-গাছ রোপিত হয়, তেমনিভাবে হাওরে কৃষি চাষ হয়, মাছ চাষ হয়। তবে আরও একটা জিনিস এখানে চাষবাস হয়ে গাছের লতার মতো দিনে দিনে বেড়ে উঠেছে। কোনও পৃষ্ঠপোষকতা না-পেয়েও কেবল মনের আনন্দে পাহাড়-হাওর অধ্যুষিত অঞ্চলের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী নীরবে-নির্ভৃতে ‘গান’ সৃজন করে আসছেন।
গ্রাম্য নিরক্ষর পুরুষ মানুষদের কেউ হয়তো কৃষক, কেউ জেলে, কেউ দিনমজুর আবার কেউ চা-শ্রমিক অথবা কুলি। নারীদের মধ্যে প্রায় সবাই গৃহিণী। দিনমান কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে যখন এরা একটু অবসর পান তখন বিনোদনের জন্য গান রচনা করেন, সেগুলো অপরদের গেয়ে শোনান এবং অন্যদের রচিত গানও শোনেন। আবার কেউ কেউ পৌরাণিক, সামাজিক কিংবা ঐতিহাসিক কোনও ঘটনার আদলে নাটক রচনার পরে সেখানে অভিনয় করে বিমল আনন্দ পেয়ে থাকেন।
সে-সময়টাতে গ্রাম্য মানুষদের প্রায় নিরানব্বই ভাগ নিরক্ষর হলেও এঁরা প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠতেন। মুখে মুখে রচনা করতেন গান। সেসব গান গ্রামে-গ্রামে বিভিন্ন গানের জলসায় মুখে মুখেই ফিরত। এভাবেই প্রায় গানের পঙক্তি রচয়িতা ও শ্রোতাদের কাছে মুখস্থ হয়ে যেত। তবে কারা এসব গানের স্রষ্টা সেটা অনেকক্ষেত্রে শ্রোতাদের অজানাই থেকে যেত। মুখে মুখে বহুল-শ্রুত এসব গান লোকগান হিসেবে জনসমাজে স্বীকৃতি পায়। যদিও লোকগানের সুর এবং ধরন বিবেচনায় নিয়ে চল্লিশের দশক থেকে বেশ গান রচিত হয়েছে। এসব গানের রচয়িতাদের পরিচয় জানা থাকলেও সেসব লোকগান হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। বিমুগ্ধ মানুষের অন্তরাত্মায় এভাবেই গান চাষবাস হয়ে এখন সমৃদ্ধ একটি ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে লোকগানের একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার তৈরি হলেও সেগুলো যথাযথভাবে নাগরিক সমাজে পরিবেশিত বা উপস্থাপিত হয়নি। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, গুরুসদয় দত্ত, আবদুল গফফার দত্তচৌধুরী প্রমুখ লোকগানের লিখিত-রূপ আদি ও অকৃত্রিমভাবে সংগ্রহ করেছিলেন। এর বাইরে আব্বাস উদ্দীন, জসীমউদ্দীন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, খালেদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু ভৌমিক, দিনেন্দ্র চৌধুরী, অমর পালদের প্রচেষ্টায় লোকগান শহুরে নাগরিকদের কাছে গান হিসেবে নতুন মাত্রা পায়। একই ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকে বিদিতলাল দাস লোকগানের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারকে পরিচিত করতে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা করতে থাকেন। তিনি একের পর এক বিলুপ্তপ্রায় লোকগানে সুরারোপ করতে থাকেন। তাঁর শ্রম ও মেধায় হারিয়ে-যেতে-বসা অসংখ্য লোকগানের স্বরলিপিও প্রস্তুত হয়। এসব গান তিনি প্রতিষ্ঠিত ও অপ্রতিষ্ঠিত অনেক শিল্পীকে দিয়ে গাইয়ে বাংলা লোকগানে নতুন মাত্রা যোগ করেন।
বিদিতলাল দাস কেবল সুদক্ষ সুরকারই ছিলেন না, তিনি একাধারে লোকগানের শিল্পী এবং সংগ্রাহকও ছিলেন। প্রাচীন লোকগান সংগ্রহ করে সেগুলোতে সুর দিয়ে বিভিন্ন শিল্পীদের গাইতে দিতেন। এসব গানের প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নীলম সংগীতালয়’। এতে লোকগানে আগ্রহী নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের বিনামূল্যে গান শেখাতেন। বিভিন্ন প্রাচীন পদকর্তাদের রচিত গান নিয়ে ‘সুরমাপারের গান’ শীর্ষক একটি সুবৃহৎ গানের সংকলনও প্রকাশ করেছিলেন। লোকগানে মানুষটির এতই আগ্রহ ছিল — তিনি পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত বিত্তবৈভবের বলয়ে আবদ্ধ না-থেকে লোকগানের পেছনে আজীবন সময় ব্যয় করেছিলেন।
লোকগানকে বলা হয়ে থাকে ‘মাটির সুর, মোঠোপথের সুর’। হাঁটতে-ফিরতে, চলতি পথে, কায়িক পরিশ্রমের ফাঁকে কিংবা অখণ্ড অবসরে এ গানের উদ্ভব বলেই বোধহয় এমনটি বলা হয়ে থাকে। গ্রামীণ মানুষের জীবনে আনন্দ-দুঃখ কিংবা জীবনবোধের পথচলতি যে রূপ, সেটাই যেন লোকগানের সুরে ঢেউ খেলে গেছে। সুরের সাবলীলতা ও গ্রামীণ ভাষাবিন্যাসের কারণে লোকগান গ্রামীণ মানুষের জীবনে একটি সর্বজনীন রূপ পেয়েছে। সেটি ভালোভাবেই বিদিতলাল দাস অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এ কারণেই বোধহয় তাঁর সুরকৃত গানগুলোতেও প্রাচীন সুরের আবহ পাওয়া যায়।
প্রাচীন সুরকে মূল রেখে বিদিতলাল সেখানে কেবল সামান্য তারতম্য ও ঘষামাজা করে একটু শহুরে-ঢং জুড়ে দিয়ে নতুনত্ব তৈরি করেছিলেন। নদীর পানি যেভাবে কুলকুল শব্দে স্রোতের তোড়ে ভেসে চলে, সেভাবেই বিদিতলাল তাঁর গানে ললিত সুর তৈরি করে নিয়েছেন। এ সুর কখনও স্রোতের তোড়ে উত্তাল তরঙ্গায়িত পানির মতো আবার কখনও শান্ত-সুমন্ত নদীর জলধারাস্বরূপ। গানের পঙক্তি গাওয়ার সময় যেখানে সুরের ওঠা-নামা প্রয়োজন, সেখানেই সঠিক তাল-লয়-সুর বসিয়ে বিদিতলাল দাস তাঁর সুদক্ষতার ছাপ রেখেছেন। এর ফলে তাঁর সুরারোপকৃত গানগুলো নাগরিক সমাজে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
বিদিতলাল দাস অজ্ঞাত গীতিকারদের রচিত প্রাচীন সব লোকগানে সুরারোপের পাশাপাশি দীন ভবানন্দ, রাধারমণ, হাসন রাজা, আরকুম শাহ, একলিমুর রাজা, ফকির ভেলা শাহ সহ হালের গিয়াসউদ্দিন আহমদের গানে সুর দিয়েছেন। তাঁর সুরকৃত গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তো বিদিতলাল দাসের সুর-করা একটি গানে আমৃত্যু মজে ছিলেন। গিয়াসউদ্দিন আহমদের লেখা ওই গানটি ছিল — ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’। এ গান প্রসঙ্গে হুমায়ূন বলেছিলেন, “গানটি শোনার সময় আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ঘোর তৈরি হয়”। লোকগায়ক বিদিতলাল দাস এমনই, তাঁর সুরকৃত গান এমনই — যা শোনামাত্র ‘ঘোর তৈরি’ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাঁর সুরের এমনই মায়া, এমনই জাদু।
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS