বব ডিলানের বহুশ্রুত গান আ হার্ড রেইন ইজ গনা ফল-র (A Hard Rain’s A-Gonna Fall) মরহুম হওয়ার সুযোগ নেই যতদিন জিমি ক্লিফ, প্যাটি স্মিথ, এডি ব্রিকেল-র মতো শিল্পীর কণ্ঠ ধরায় বেঁচে থাকবে। গানটি অবিনশ্বর যখন স্টিভ হ্যাকম্যানের মতো সংগীত সঞ্চালকের পরিবেশনা একে নতুন আঙ্গিকে শোনার সুযোগ করে দেয়। হ্যারিকেন সহ একাধিক গানে ডিলানের গায়কি অপ্রতিরোধ্য হলেও তাঁর শ্রোতাপ্রিয় গানগুলোর সিংহভাগ প্রতিষ্ঠিত নয়তো নবিশ শিল্পীর কণ্ঠে যেন অধিক প্রাণ খুঁজে নিচ্ছে। হার্ড রেইন ব্যতিক্রম নয়। জিমি, স্মিথ ও ব্রিকেল যেভাবে গানটি গেয়েছেন তাতে মূল গানের ভাবরস কোথাও বিঘ্নিত হয়েছে বলে মনে হয়নি। গানের দেহে তরঙ্গিত বিষাদে ডুবে যাওয়ার ক্ষণে সময়চেতনা ও স্বকীয় সংগীতবোধকে সকলে প্রাধান্য দিয়েছেন। আদি গায়নভঙ্গিকে নিজের ওপর চাপ হয়ে বসতে দেননি। ডিলানের গায়কির সঙ্গে বিচ্ছেদরেখা টেনে তবেই গানের দেহে তাঁরা প্রবেশ করেছেন। শ্লীল এই সচেতনার কারণে হার্ড রেইন অন্য শিল্পীর কণ্ঠে শুনতে ভালোই লাগে। কবিতারঞ্জক বিভূতির পরাকাষ্ঠা গানটির প্রতি পরতে সংগোপন মর্মবেদনা কানে প্রশান্তি বহায়। কথার সত্যমিথ্যা যাচাইয়ে অন্তর্জালে সুলভ নমুনাগুলোয় শ্রোতারা কান পাততে পারেন। অভিজ্ঞতা সেক্ষেত্রে মন্দ হওয়ার কথা নয়।
অন্য শিল্পীর কণ্ঠে গানটি শ্রবণের অভিজ্ঞতা গুনতে বসলে জোয়ান বায়েজ-র কথা উঠবে জানি।১ দুনিয়া মাতানো বিটলস-র চার সেনাপতি ছাড়াও ডিলান-সমসাময়িক নমস্য শিল্পীর অনেকেই মি. ট্যাম্বুরিনম্যানের গান ভালোবেসে গেয়েছেন। উনাদের কামিয়াবির কথা স্মরণে রেখে জিমি ক্লিফের নামখানা সর্বাগ্রে নিতে হচ্ছে। বব মার্লের দেশিভাই জিমির কণ্ঠে এর পরিবেশনা শ্রোতাকে পৃথক আবেশে জব্দ রাখে। মনে হবে মার্কিন ভূমিতে কালো আদমির বিষাদে মোড়ানো ইতিহাসকে গায়ক এইবেলা স্মরণ করছেন। মার্কিন দেশে নিগ্রহের শিকার বনিআদম যেমন করে গাইলে একে তাদের জীবনবেদের স্মারক মনে হয় শ্রোতার, জিমি ক্লিফের গায়কিতে তার কোনো খামতি ঘটেনি।
গানভাণ্ডারী ডিলানের স্মরণীয় কম্পোজিশনের মধ্যে হার্ড রেইন অন্যতম। গানটির আবেদন অনিঃশেষ। এর প্রতি অঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত তিক্ত বিষাদ নির্বেদঘন সম্মোহনের সামনে শ্রোতাকে দাঁড় করিয়ে রাখে। সার্থক কবিতায় যেসব রূপালঙ্কারের দেখা মিলবে তার সবখানি গানের দেহে দ্যুতি হয়ে ঝরে। সময়প্রাসঙ্গিক আবেদনের জায়গা থেকেও হার্ড রেইন অনন্য। এরকম একটি বহুস্বরিক গানে প্রফেটিক স্পিচ-র অনুরণন শ্রোতার টের পাওয়া উচিত;—গানের উচিতমূল্য বিচার করতে বসে কথাটি ইদানীং অনেকে বলাবলি করেন। জিমি ক্লিফের পরিবেশনায় যদিও এমতো আবেশ শ্রোতার কানে পশে না। তাঁর পরিবেশনা, আগেই বলেছি, মরমি বা আধ্যাত্মিক সমবেদনায় গুম হওয়ার পরিবর্তে নিপীড়িতের নির্বেদকে প্রকটিত করে। ব্লুজ (Blues) থেকে চুইয়ে নামা বিপন্নতা টের পেতে শ্রোতাকে সাহায্য করেন জিমি। জ্যামাইক্যান রেগে (Reggae) সংগীতের ধাঁচে গানটি গাইছেন ভেবে তারা খানিক ভ্রমাবিষ্ট হয়। এরিক ক্ল্যাপটন ও গানস-র সঙ্গে জুড়ি বেঁধে বব মার্লে যেমন ডিলানের নকিং অন হ্যাভেন’স ডোর-এ (Knocking on Heavens Door) সক্রিয় মানবিক আর্তিকে রেগের আদলে গেয়েছিলেন, জিমি ক্লিফের কণ্ঠে হার্ড রেইন হয়তো সেই স্মৃতিকে ক্ষণিক ফিরিয়ে আনে।
সে যা-ই হোক, ডিলানের ম্যামথতুল্য গানের ভাণ্ডারে পলকাটা হীরে নামে খ্যাত গানটির দেহে প্রফেটিক স্পিচ-র আবেশ খানিক স্পষ্ট হয় প্যাটি স্মিথ শোনার পর। হোর্সেস (Horses) অ্যালবামের কেশর ফোলানো গানগুলো দিয়ে পাঙ্করক ঘরানার গায়কিতে কবিতার সুতীক্ষ্ণ চাবুক হেনেছিলেন স্মিথ। পাঙ্করক গানের সাইকেডেলিক ট্রমা বা মাদকাবেশ-এ বিহ্বল স্বেচ্ছাচারিতায় শামানিক বিভূতি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এই তরুণী। বব ডিলানের কন্সার্টগ্রাফ-এ ব্যতিক্রম ও ঘটনাবহুল হিসেবে গণ্য দ্য রোলিং থান্ডার রেভিউ ট্যুর-এ (The Rolling Thunder Revue) শামিল ছিলেন তিনি। সময়ের সঙ্গে মুখের রেখায় বয়সের দাগ প্রকট হলেও কবিত্ব আর গায়কির তীক্ষ্ণতা হ্রাস পায়নি। ডিলানের গলায় নোবেলের মেডেল পরানোর আনুষ্ঠানিকতায় গান করতে নোবেল কমিটি তাঁকেই বেছে নিয়েছিলেন।
স্মরণ রাখা ভালো, পদক বিতরণের অনুষ্ঠানে বব ডিলানকে পাওয়া যায়নি। একজন সঙরাইটার ওরফে গীতরচিয়তার গলায় নোবেলের চাকতি ঝোলানোর ঘোষণা নাটকীয় বিড়ম্বনার জন্ম দিয়েছিল সেই বছর। হারুকি মুরাকামি, মার্গারেট অ্যাটউডের মতো লেখক থাকতে ডিলানকে নোবেল দানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন পাঁড় সাহিত্যভক্তরা। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো নোবেলের বেল মাথায় পড়তে যাচ্ছে দেখে গায়ক স্বয়ং হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন। পদক গ্রহণ নাকি প্রত্যাখ্যান করবেন এই দুটানা তাঁকে জ্বালিয়ে মারছিল। একটা এসপার ওসপার করতে হয়তো সাময়িক গা ঢাকা দিয়েছিলেন গীতিকবি! ভজকট এই অবস্থার মধ্যে পদক বিতরণের অনুষ্ঠানে হাজির ডাকাবুকো অতিথিদের সামনে হার্ড রেইন পরিবেশনের ভার চেপেছিল প্যাটি স্মিথের ঘাড়ে!
নোবেল কমিটি যখন ববের তালাশে হয়রান তখন গিটার ও মাউথ অর্গানে অকাট্য গায়ক মনে-মনে ভাবছিলেন : কবিতার ভারে টলমল ও প্রথাবন্দি ঐতিহ্যের আগল ভেঙে নতুন পথের যাত্রী হওয়ার ছুতোয় কোনো গায়কের গলায় নোবেলের মেডেল ঝুলানোয় কেয়া ফায়দা? গান হচ্ছে শোনার জিনিস। কথা ও ভাববস্তুর সবটাই সেখানে সুর আর গায়কির নফর খাটে। শ্রোতার কানে গুঞ্জন তুলতে পারার মধ্যে গীতিকবি নিজের পরিতৃপ্তি খুঁজে মরে। তার জীবনে এর মূল্য বলে বোঝানোর নয়! নোবেলের মতো পদক দিয়ে কি সেটি মাপা সম্ভব? নোবেল কমিটির কাছে প্রেরিত বক্তৃতায় প্রসঙ্গটি ডিলান ছুঁয়ে গিয়েছিলেন বৈকি।
গীতরচনায় সুতীব্র কাব্যগুণের সঙ্গে যুগের গতিকে নতুন ভাষা ও গায়কি দিয়ে প্রভাবিত করেছেন এমন শিল্পীর তালিকা বেশ হৃষ্টপুষ্ট। ডিলানকে সেখানে অদ্বিতীয় ভাবার সুযোগ নেই। তাঁর নিকট সমসাময়িক লিওনার্ড কোহেনের নাম আপনা থেকে লোকের মনে জাগবে। উডি গাথরি, কিথ রিচার্ডস বা ব্রায়ান উইলসনের নাম নেবেন অনেকে। বব মার্লে, জন লেলন, পল ম্যাককার্টনি, ব্রুস স্প্রিংস্টিন, মিক জ্যাগার, রজার ওয়াটার্স, নিক ম্যাসন, জিম মরিসন কিংবা পপ গানে নতুন তরঙ্গভঙ্গের বার্তা নিয়ে হাজির মাইকেল জ্যাকসনকে কামিয়াব গীতরচয়িতার তালিকা থেকে ছাটাইয়ের জো নেই। নোবেলের মেডেল পাচ্ছেন জেনে ডিলান যারপরনাই বিব্রত বোধ করছিলেন। পুরস্কারটি নতুন প্রতিমা গড়ার পথ চওড়া করতে যাচ্ছে বুঝে নিজের সংগোপন স্বকীয়তা হারানোর শঙ্কায় তাঁকে পেয়ে বসেছিল। আত্মদ্বন্দ্বে পীড়িত গায়ক সাতপাঁচ ভেবে চুপিসারে পুরস্কার গ্রহণের সিদ্ধান্তে মত দিয়েছিলেন। লোকচক্ষের আড়ালে সোনার চাকতি গলায় পরলেন গায়ক। তাঁর এই ছুপা রুস্তমের মতো পদক গ্রহণের বিড়ম্বনা আঁচ করে বোধহয় লিওনার্ড কোহেন এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন : এ তো দেখছি সর্বোচ্চ পর্বতের খেতাবে ভূষিত মাউন্ট এভারেস্টের গায়ে পিন দিয়ে একখানা মেডেল আটকানোর চেষ্টা চলছে। গানের জগতে এভারেস্টতুল্য ডিলানের বিড়ম্বনার কারণ আর কেউ না বুঝুক কোহেন কিন্তু সেটি ধরতে পেরেছিলেন।
নোবেলের পদক গলায় ঝোলানোকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট হল্লাকে স্তিমিত করার উপায় ডিলান বেশ খুঁজে নিলেও প্যাটি স্মিথের পক্ষে একে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। স্নায়ুর চাপ সহ্য করে হার্ড রেইন গানটি তাঁকে সেদিন গাইতে হয়েছিল। সংগীতের মঞ্চে তেজি কদম ফেলে ছুটতে অভ্যস্ত স্মিথ এই প্রথম খেইতাল হারিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন। ডিলানের বিখ্যাত গানের কলি স্মৃতি থেকে গাইতে তাঁর সমস্যা হচ্ছিল। শ্রোতারা সরব করতালির মাধ্যমে উৎসাহ না দিলে নিজেকে সামলে গানটি গাওয়া সম্ভব হতো না। খেইতাল হারালেও অপূর্ব গেয়েছিলেন সেদিন। প্রার্থনা সংগীতের আদলে গীত গানটি শ্রবণের ক্ষণে প্রশান্তির সুরায় মন ডুবতে বসে!
প্যাটি স্মিথের কথা থাক, স্টিভ হ্যাকম্যানের নামখানা স্মরি এখন। হার্ড রেইন-এ বহতা পঙক্তিস্রোতকে চার্চসংগীতের আদলে পরিবেশন সম্ভব;—অন্তর্জালের সুবাদে স্টিভের সঞ্চালনার সঙ্গে পরিচয় না ঘটলে এই দাবিকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবা শক্ত হতো। গোড়ার দিন থেকে বব ডিলান অপেরা ও গসপেলের ধাঁচে পরিবেশিত সংগীতের ভক্ত নামে বিদিত। মার্কিন সংগীতের বিচিত্র উৎস থেকে তাঁর যত ঋণ সেখানে লোকগানের সঙ্গে চার্চসংগীতকে জায়গা দিতে কৃপণতা করেননি। স্টিভ হ্যাকম্যানের সঞ্চালনায় এর ছাপ পরিস্কার চোখে পড়ে। এ যেন খোদ ডিলানকে তাঁর গায়কসত্তার বিবর্তনের দিকে ফিরে তাকাতে বলছে! সময়ের সংক্ষুব্ধ পরিধিতে বসে হার্ড রেইন গানটি তিনি লিখেছিলেন। মর্মন্তুদ এক মাহাকাব্যিক নৈরাশ্য তার প্রতি অঙ্গে বইছে। প্রফেটিক জীবনবেদে নিমজ্জিত প্রার্থনা রূপে গানটি গাইতে পারার মধ্যে প্রচুর ঝুঁকি ছিল। হ্যাকম্যানকে সেখানে সফল ভাবা উচিত। ব্যাখ্যাতীত সমবেদনায় নিমগ্ন থাকার আবেশ শ্রোতাকে তিনি উপহার দিতে পেরেছেন। শুনতে বসে মনে হয় সেমিটিক বাইবেল আর ভারতীয় সামবেদ থেকে মন্ত্র পড়ছেন পুরোহিত!
স্টিভ হ্যাকম্যানের পরিবেশনার বড়ো গুণ বোধ করি এই, গানটির প্রতি পরতে অক্ষয় লিপির মতো মুদ্রিত বিষাদ ও নিরাশা ছাপিয়ে এক ফালি শান্ত উজ্জীবন সেখানে ক্রমশ মাথা তোলে। গতাসু বিংশ শতকের ছয় ও সাতের দশক জুড়ে মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো ছোকরা ডিলানকে মাটিতে গোর দিয়ে তার ওপর নতুন এক ডিলানকে জীবিত করে এই পরিবেশনা। রক গানের মঞ্চ থেকে নামিয়ে গীতিকবিকে যেন-বা গির্জায় ঢুকতে বাধ্য করেন স্টিভ। ডিলান এখন থেকে আর যৌবনভারে টালমাটাল রকবাজ গায়কটি নন। মহামহিম ঈশ্বরের হয়ে মন্ত্র পড়ার দায় তাঁর ঘাড়ে চাপিয়েছেন ধ্রুপদি সংগীতে ঐকতান জুড়তে পটু স্টিভ হ্যাকম্যান। রকার ডিলান তাহলে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর সহোদর! হার্ড রেইন গানটিকে সেক্ষেত্রে প্রফেটিক স্পিচ ভাবতে শ্রোতার আপত্তি থাকে না।
ক্রুশ কাঠে পেরেকবিদ্ধ যিশুর হয়ে ডিলানকে সমবেত কণ্ঠে গাইছেন স্টিভ হ্যাকম্যান আর তাতেই ধুয়েমুছে যাচ্ছে গানের প্রতিটি অক্ষরে লেগে থাকা নির্বেদের ভার। বিষাদ ছাপিয়ে মানবিক সমবেদনায় আতুর হাওয়া ঢং ঢং শব্দ তুলে র্গিজার চূড়ায় ঝরে। সমবেত কণ্ঠের প্রলম্বিত ও উচ্চকিত নাদ ক্রমশ দখলে নেয় শ্রোতার কর্ণকুহর! অন্তর্জাল ঘেঁটে যতটুকু খবর করা গেল তাতে এই বিশ্বাস পোক্ত হয়েছে, স্টিভের পরিবেশনা হার্ড রেইন গানে সীমাবদ্ধ থাকছে না। ডিলানের একাধিক কালজয়ী গানকে মহাকাব্যিক আয়োজনে পরিবেশনের যজ্ঞ ভদ্রলোক সেরে ফেলেছেন। দ্য টাইমস, দ্য আর চেঞ্জিং (The Times, They Are A-Changin’) এর মধ্যে অন্যতম। কম্পোজিশন যথাবিহিত হার্ড রেইন-র অনুরূপ শ্রবণসুখকর ও মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় রঙিন।
এইবেলা মনে পড়ছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-র হয়ে ডিলানের ফরএভার ইয়াং (Forver Young) স্বকণ্ঠে ধারণ করেছিলেন পিট সিগার। জনি ক্যাশ, ব্রুস স্প্রিংস্টিন, রজার ওয়াটার্স, নিল ইয়াং, নোরা জোন্সের মতো শিল্পী চমৎকার গাইলেও পিট সিগারের কণ্ঠে গানটি নতুন প্রভায় দিব্য হয়ে উঠেছিল। খসখসে গলায় ডিলানের চিরযুবা থাকার আহবানকে নম্র কণ্ঠস্বরে বদলে দিয়েছিলেন বয়োবৃদ্ধ গায়ক। যুবা থাকার দিনে হার্ড রেইন গানটিও এভাবে তাঁর কণ্ঠে পৃথক মাত্রায় কথা বলে উঠেছিল। রাজনীতি সচেতন পিট সিগার গানের বিষাদঘন নির্বেদকে বিপ্লবী অঙ্গিকার ও আসন্ন পালাবদলের সতর্কসংকেত রূপে বুঝে নিয়েছিলেন। গিটার হাতে গানটি গেয়েছেন ওই আবহে নিজেকে দাঁড় করিয়ে। শ্রেণিবৈষম্যে আবিল বিশ্বে সমাজ পাল্টানোর মন্ত্রে দীপ্ত উডি গাথরি যেরকম গাইতেন সচরাচর, সিগার যেন একই পথে ডিলানের গান কণ্ঠে তুলতে অটল ছিলেন।
যা-ই হোক, ফরএভার ইয়াং-এ ফেরত যাই। ডিলান ও অন্য শিল্পীদের সংস্করণে নিহিত তেজ পিট সিগারের পরিবেশনায় ম্রিয়মান হয়ে পড়লেও গানের দেহে ছলকে ওঠা স্বপ্ন ভারাতুর জীবনবেদকে দিব্য ভাবতে শ্রোতা বিপাকে পড়ে না। চিরযুবা থাকার আহবানকে কোমল করে গাইছেন বয়সের ভারে জীর্ণ গায়ক আর সেখানে তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছে কলকাকলিমুখর একঝাঁক শিশু;—দৃশ্যটি স্বর্গীয় বৈকি! পিট সিগারের সংস্করণে ফরএভার ইয়াং একাদিক্রমে শ্রবণ, বীক্ষণ ও অনুভবের অভিজ্ঞতায় শ্রোতাকে মেদুর করে। নশ্বর মানুষের চিরযুবা থাকার অবিনশ্বর আকাঙ্ক্ষা ওইসব কোমলমতি শিশুর রাতুল চরণে নিবেদন করছেন গায়ক। উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রার মধ্যে দেহখাঁচার রূপান্তর পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তিনি। চিরযুবা থাকার রসদ খুঁজে নিচ্ছেন স্বর্ণঈগলের মতো রাজসিক যৌবনভারে কম্পিত শিশু ও যুবাদের মিলনমোহনায় গলেমিশে। নিজের ছোট্ট সন্তানকে ভেবে ঘুমপাড়ানিয়া গানটিতে একদিন কণ্ঠ দিয়েছিলেন ডিলান। রেড ইন্ডিয়ান শামানের তেজ ভর করেছিল সেই কণ্ঠে। গানে লিপিবদ্ধ পঙক্তিকে জগতের সকল শিশু ও যুবার উদ্দেশে নিবেদনের আকুলতা ভর করেছিল দেহে। সংঘাতমুখর বিশ্বে যারা ক্রমশ শিশু থেকে যুবা আর যুবা থেকে বয়স্ক হচ্ছে তাদের এই বয়স্ক হওয়ার নিয়মকে চিরযুবার ঘরে থমকে দিতে ওঝার মতো মন্ত্র পড়ছিলেন এইবেলা।
গানটি মার্কিন লোকসংগীত ও গসপেলের সঙ্গে বব ডিলানের সুদীর্ঘ সান্নিধ্যের স্মৃতিকে জীবিত করায়। হার্ড রেইন ধাঁচের গানগুলো যেমন কোলরিজের কবিতায় তাঁর বিচরণের স্মৃতি ফেরত আনে। বিপজ্জনক খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা বিটনিক কবি গিনসবার্গ ও কথাকার জ্যাক কেরোয়াকের আজব দুনিয়ায় মুসাফির রূপে পরিভ্রমণের মুহূর্তগুলো শ্রোতার মনে জাগতে শুরু করে। গানভাণ্ডারী ডিলান গানের রচনা ও পরিবেশনায় আগাগোড়া বৈপরীত্যসূচক। লোকসংগীত, গসপেল, রক, পাঙ্ক কিংবা বিটনিকের ছাপ্পায় তাঁকে পরিমাপের সুযোগ শ্রোতাকে দিতে অনিচ্ছুক। স্ববিরোধী সংঘাতকে সঙ্গী করে তিনি পথ হাঁটেন। রকমারি দ্বিরুক্তি ও বৈপরীত্যে বোঝাই গানের তরী ছয় দশকের প্রতিকূল স্রোত ঠেলে এক-একটি বন্দরে এসে থামে এবং সেখান থেকে নোঙর তুলে অন্য বন্দর পানে ধায়। অকাট্য মার্কায় নিজেকে বন্দি করার চেয়ে জীবনের বিচিত্র স্রোতে তরী ভাসানোকে বব ডিলান তাঁর গান রচনার চাবি বুঝে নিতে মরিয়া ছিলেন সবসময়।
ট্রেন্ডসেটার অথবা শ্রোতাপসন্দ ট্রেডমার্কের অভয়ারণ্যে বিচরণ এই শিল্পীকে কখনো পেয়ে বসেনি। অকাট্য যে-লক্ষণ সাইকেডেলিক রক গানের কুল পুরোহিত জিম মরিসন কিংবা কুইন ব্যান্ডের আদিচলক ফারুখ বুলসারা ওরফে ফ্রেডি মার্কারির জাত চিনতে সাহায্য করে, বব ডিলানকে সের’ম ছকে ফেলে গড় করা স্বয়ং শ্রোতার কাছেই অপ্রাসঙ্গিক বোধ হতে থাকে। শ্বেতাঙ্গশাসিত সমাজে ধলা-কালোর লড়াই যাকে কভু তাতিয়ে তোলেনি সেই ডিলানভক্ত জিমি হেনড্রিক্স মার্কামারা বিশেষণে নিজের প্রতিভার সলিল সমাধি দেখছিলেন। জীবনের ভালোমন্দে সমান নিরাশ-নির্বিকার হেনড্রিক্সের গিটারবাদনকে Devil’s play-র উপমায় বন্দনা করা ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প শ্রোতারা তাঁর জন্য রাখেনি। পরিণতি বলাবাহুল্য মর্মান্তিক ছিল। টুয়েনটি সেভেন ক্লাব-র (27 Club) লিস্টে আরো একটি অকালপ্রয়াত প্রতিভার নাম সেদিন যুক্ত হয়েছিল কেবল!
অল অ্যালং দ্য ওয়াচটাওয়ার (All Along the Watchtower) ডিলান গেয়ে শোনালেও জিমির কণ্ঠে অমরত্ব পাওয়ার নিয়তি মেনে বোধহয় গানটি লিখেছিলেন! এটি নির্ধারিত ছিল, শ্রোতার রোমকূপে কাঁপন তুলতে জিমি ওটা গাইবে এবং তারপর থেকে এর স্বত্বে ভাগ বসানোর রাস্তা খোদ রচয়িতার জন্য খোলা থাকবে না! গানটি যেখানে বাজুক, ডিলানকে ভুলে শ্রোতাকুল জিমি হেনড্রিক্সের নামখানা সবার আগে জপবেই জপবে। বব ডিলানের ছয় দশক বিস্তৃত সংগীতগ্রাফে যে-কারণে কোনো অভয়ারণ্য আজো নেই। তাঁর গায়কজীবন শুরু থেকে বিপৎসংকুল পথে গমন করতে মুখিয়ে থেকেছে। লোকগানের নতুন রাজা;—এই মুকুট যখন শিরে উঠতে যাবে ঠিক তখন খসখসে কণ্ঠস্বর চিরে লাইক অ্যা রোলিং স্টোন-র (Like A Rolling Stone) চিৎকার শ্রোতার কর্ণকুহরকে প্রকম্পিত করেছিল। রকারের ছাপ্পা পিঠে পড়তেই ফের ইউ টার্ন নিতে দেরি করেননি! মি. ট্যাম্বুরিনম্যানকে নিয়ে বিপত্তির শেষ নেই। নিরাপদ ট্রেন্ডসেটার বা এমতো সিগনেচার মার্ক-এ শ্রোতারা তাঁকে আজো দাগাতে পারেনি।
কথাটি বলা বোধ করি অসংগত নয়, নিজের কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে গভীর আস্থা ডিলানের কদাপি ছিলই না। মঞ্চে তাঁকে গাইতে দেখার ক্ষণে মনে হবে ঠেকায় পড়ে গাইছেন। গায়নভঙ্গিটি সেক্ষেত্রে ইঙ্গিতসূচক! এর অর্থ হচ্ছে তিনি কীভাবে গান করছেন সেটি নিয়ে শ্রোতার মাথা ঘামানো জরুরি নয়। গানের দেহে যেসব কাহিনি, কথামালা ও বিবৃতি একে-একে ঠেসে দিলেন সেদিকপানে বরং কর্ণপাত করা উচিত। বব ডিলানকে কানধাঁধানো গায়ক রূপে কুর্নিশ ঠোকার পরিবর্তে সর্বকালের সেরা গীতরচিয়তা নামে ডাকার চল মনে হয় এখান থেকে শ্রোতামনে তীব্র হয়েছে। শ্রোতাদের পক্ষ থেকে এটি হলো ববকে উপহার। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গীতরচয়িতার সিলমোহর অবশেষে তাঁর পিঠে তারা বসিয়ে দিতে পেরেছেন। এর সঙ্গে লড়াই করার দম বলাবাহুল্য বুড়ো ববের মধ্যে এখন আর অবশিষ্ট নেই!
বব ডিলানের গায়নভঙ্গির ফিলসফি মোটের ওপর সাদাসিধে। ট্রেন্ড, টেড্রমার্ক জাতীয় ছাপ্পা তাঁর পোষায় না। বিচিত্র পথে গমনের মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিপক্ক করে তোলার পন্থাকে বরং সংগীতের সারকথা ঠাউরে নিয়েছেন তিনি। কারণ আন্দাজ করতে দুনিয়া কাঁপানো বিটলসতরঙ্গের ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য এই ফাঁকে পড়ে নেওয়া যেতে পারে। বব সেখানে বলছেন :
ওরা তো রক নয়! রক-র চাইতে অধিক কিছু ভাবা যাইতে পারে। রক হইসে পোলাপানদের জিনিস। যৌবনের প্রাণবন্যা হইতে নির্গত ও সেখানে তার সমাধি। বিটলসকে এই ছকে অধিক নিরিখ করার উপায় নাই। রক-এ থাকার বাহানায় বিচিত্র উপায়ে নিজেকে তারা এর বাইরে নিয়া গেছে। একটা মার্কায় শহিদ হইতে চায় নাই।
মিতব্যয়ী মন্তব্যে ডিলান বুঝিয়ে দিচ্ছেন মার্কায় শহিদ হওয়ার ইচ্ছে তাঁর নেই। না থাকাটা এক্ষেত্রে একজন গায়ককে অনির্দিষ্ট ও অনিশ্চিত করে তোলে। তাঁর Expertise বা বিশেষত্বের হদিশ পেতে শ্রোতাকে বিপাকে পড়তে হয়। ভুলভাল বিশেষণে গায়ককে মাথায় তুলে তারা নাচে নয়তো মুখ ফিরিয়ে নেয়। ক্যারিয়ারকে নিরাপদ ও প্রলম্বিত করতে গায়ক মাত্রই এরকম অভয়ারণ্যে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে মরিয়া থাকেন। ডিলানের বেলায় সবই উল্টো! অভয়ারণ্য থেকে কী করে পালানো যায় সেই উপায় খোঁজেন ফাঁকতালে। তাঁর গান কণ্ঠে তুলতে আগ্রহী শিল্পীদের জন্য অবশ্য এটি আশীর্বাদ হয়ে আসে। তারা দেখে এই লোকের গানে গায়কের স্বাধিকার বেশ অবারিত। বিষয়টি বুঝতে নকিং অন হেভেন’স ডোর-র (Knockin’ On Heaven’s Door) উদাহরণ টানতে হচ্ছে এইবেলা। গানস অ্যান্ রোজেস-র (Guns N’ Roses) মতো উচ্চনাদের বাদ্যবাজনায় কামিয়াব দলের হাতে পড়ে ডিলানের গানখানা সমগ্র যাত্রাপথে শ্রোতাকে রক গানের চূড়ায় আরোহনের শিহরন দিয়ে যায়, ওদিকে রজার ওয়াটার্সের কণ্ঠে একই গান অন্য বন্দরে নোঙর খুঁজে ফিরে। সমাহিত নৈরাশ্যে নিজেকে বন্দি বলে ভাবা পিঙ্ক ফ্লয়েড-র গীতরচিয়তা রজারের কুললক্ষণ। সংগীতধর্মী পিঙ্ক ফ্লয়েড : দ্য ওয়াল (Pink Floyd: The Wall) ছবিটি যারা দেখেছেন তাদের সেটি না বোঝার কারণ নেই। ডিলানের গান পরিবেশনের সময় রজার সেটি কাজে লাগিয়েছেন। গায়নভঙ্গি যেখানে শ্রোতার কর্ণকুহরে বিনীত প্রশান্তি বহায়।
তো এইসব সাত প্যাঁচের কথা ভেবে ডিলান তাঁর গানের মেধাস্বত্ব সম্প্রতি সনি মিউজিক-র কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। মেধাস্বত্ব বিক্রি পশ্চিমা বিশ্বে নতুন ঘটনা না হলেও ডিলানের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য অপার। সনি-র হাতে স্বত্ব জিম্মা করায় তাঁর গানের মূল অনুলিপি ও গায়নভঙ্গিকে কোম্পানি নিজ দায়িত্বে সংরক্ষণ করবে। অন্যদিকে আদি গানগুলোকে নতুন পথে পরখ করার সুযোগ ভবিষ্যতে বাড়বে বৈকি। অনাসৃষ্টি ও অনাকাঙ্ক্ষিত বাণিজ্যের ঝুঁকি কতখানি এড়ানো সম্ভব সেটি পৃথক প্রশ্ন হলেও ডিলানের গানকে যুগাবর্তে প্রাসঙ্গিক রাখতে মেধাস্বত্ব বিক্রির চুক্তি কাজে দেবে মনে হয়।
…
স্টিভ হ্যাকম্যানের প্রসঙ্গে আরেকবার ফেরত যাই। হার্ড রেইনকে চার্চসংগীতের পেটে ঢুকিয়ে স্টিভ এইবেলা পিট সিগার বা রজার ওয়াটার্সের সমতুল কাণ্ড ঘটিয়েছেন বলা যায়। এতে হয়তো আদি গানের ইতিহাসবোধ ক্ষুণ্ন হয়েছে কিন্তু এরকম গাইতে পারাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। ডিলানের গানে আধ্যাত্মিক সমবেদনা চোরাই স্রোতের মতো বইছে। লিওনার্ড কোহেনের মতো যদিও সেটি প্রত্যক্ষ নয়। খালি চোখে অনেক সময় দেখা যায় না। হালেলুইয়া সহ (Hallelujah) কোহেনের চমৎকার সব গানে সমবেদনাকে সরাসরি অনুভব করা যায় কিন্তু ডিলানে সেটি সহজে ঘটে না। গুরুতর কোহেনভক্ত হলেও ওই ধাঁচে শ্রোতারা তাঁকে কদাপি গাইতেও দেখেনি। স্বরচিত গানের দেহে জবরদস্ত এক কথকঠাকুরের ভেক ধরে ঘুরে বেড়াতে স্বস্তি বোধ করেন বব। গানের ভিতর দিয়ে গল্প বলা যাঁর আজন্মনেশা। সময়ের মোচড়গুলো বাকপ্রতিমায় সিদ্ধ গীতমালায় এভাবে প্রায় ছয় দশক ধরে চিরস্থায়ী আকৃতি দিয়েছেন এই গায়ক। হ্যারিকেন (Hurricane), ট্যাঙ্গেলড আপ ইন ব্লু (Tangled up in Blue) কিংবা সিম্পল টুইস্ট অভ ফেইথ-র (Simple Twist Of Fate) মতো গানের কলিতে কথকঠাকুরের ভূমিকায় তাঁর সিদ্ধি মরমি, ঐশ্বরিক সমবেদনা ছাড়াই শ্রোতাকে অভিভূত রাখে।
কাহিনি বয়নের এই খেলা এমন এক পরিসরকে তাঁর গানে অনিবার্য করে, যেখানে পা দিয়ে মি. ট্যাম্বুরিনম্যান অনন্য হয়ে উঠেন। ইংরেজি ভাষায় দারুণ গীতরচয়িতা জন্ম নিলেও গানের কথায় ঠাসবুনোট গল্প ও চরিত্রাঙ্কনের ক্ষমতায় বব ডিলান অনন্য। তাঁর সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন! সংগীতে ডিটেলিং সহজ কাজ নয়। ডিলানের সিদ্ধিকে অগত্যা অতিমানবীয় ভেবে কুর্নিশ ঠুকতে শ্রোতা আপত্তি করে না। আধুনিক বাংলা গানের জগতে কবীর সুমনের কিছু গানে কারুকাজটি চোখে পড়ে। এর নেপথ্যে ডিলানের অবদান থাকলেও থাকতে পারে। চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো বিচিত্র ঘটনা, চরিত্র ও অনুষঙ্গকে গানে প্রাসঙ্গিক করার ক্ষণে সুমন অবশ্য রোমন্থনে ডুবে থাকতে ভালোবাসেন। ডিলানে এর উল্টোটা অধিক চোখে পড়ে। স্মৃতিভারাতুর রোমন্থন বা নস্টালজিয়ার প্রকোপ তাঁর গানে অবধারিত নয়। তিনি চাক্ষিক। বাজপাখির মতো শাণিত চোখে সবকিছু নজরে আনার কাজ শেষ হলে নিরাবেগ বয়ানের ভিতর তাঁকে ঢুকে পড়তে দেখা যায়। স্টোরি টেলিং অর্থাৎ গল্পবলা ও চরিত্রবীক্ষণ এভাবে ধনাঢ্য এক কবির সঙ্গে প্রবল শক্তিমান কথাশিল্পীর ছায়াকে তাঁর গানে সমানে জিইয়ে রাখে।
অর্থ উৎপাদন বা মিনিং মেকিং-র জায়গা থেকে বিবেচনা করলে ববের সকল গান দ্ব্যর্থক উপমায় রঙিন। সায়েব ডিলানের পোয়েটিক মেটাফোর বাঙাল কবীর সুমনের আবেগসিক্ত আতিশয্যে বিহ্বল সুন্দরের উপমায় রঙিন নয়। গানে সুমন যে-বিবরণ নিয়ে হাজির থাকেন তারা বাংলার জলহাওয়া গায়ে মেখে সমতল। বিশেষ চড়াই-উৎরাই সেখানে ধরা পড়ে না। তাঁর গানের কথামালা বড়ো দাগে ফ্ল্যাট ন্যারেটিভ-র উপমা। ওখানে থিতু থাকতেই সুমনের যত আনন্দ! বব ডিলানের কথা ও ভাবরসে ঘটনাটি কদাচিৎ দৃষ্ট হয়। তাঁর সকল বিবরণ ও কবিতারঙিন বয়ান মোটা দাগে কূটাভাসে বোঝাই থাকে সারাখন। একটা দ্বৈততা বা আরো পরিষ্কার করে বললে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড গানে জীবিত রাখেন তিনি। যেসব প্রতিচ্ছবি শ্রোতার সামনে অমোঘ করা হয় তার মধ্য দিয়ে জোকারম্যান-র যাত্রা সেখানে জারি থাকে। সময় ও পরিপার্শ্ব বিষয়ক অনুধ্যানকে শ্রোতার কর্ণকুহরে ওই পথ ধরে প্রবেশ নিতে বাধ্য করেন বব। তাঁর গানে অন্য শিল্পীদের স্বেচ্ছাবিহারকে বোধ করি এই জায়গা থেকে পাঠ করার প্রয়োজন রয়েছে।
বব ডিলানের মহাফেজখানায় মজুত টেক্সটের বিচিত্র আঙ্গিকে পরিবেশনের সম্ভাবনা নিয়ে বাতচিত যে-কারণে অদ্য জোরালো হয়েছে। তাঁর টেক্সট বদ্ধ ও একরৈখিক নয়, তারা আগাগোড়া উন্মুক্ত এবং নতুন ঢংয়ে পরিবেশনের উপযুক্ত;—এই মতের সপক্ষে আওয়াজ তোলা লোকজনের সংখ্যা অদ্য আর নগণ্য নয়। টেক্সটকে কণ্ঠে ধারণ ও পরিবেশনের প্রশ্নে শিল্পীর স্বাধিকারকে ছাড়পত্র দানে ডিলানের গানকে উদার মানতে হয়। তিনি স্বয়ং যাঁর কণ্ঠ ও গায়নভঙ্গির ভক্ত সেই এলভিস প্রেসলি খেলাচ্ছলে তাঁর কিছু গান স্বকণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। রকারদের খুনে মেজাজকে বিষাদঘন কোমলতার আরকে চুবিয়ে মারতে ওস্তাদ প্রেসলি ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড (Blowin’ In The Wind), টুমরো ইজ আ লং টাইম (Tomorrow Is A Long Time) ও ডোন্ট থিংক টুআইস, ইট’স অল রাইট (Don’t Think Twice, It’s All Right ) গানগুলো নিজের স্বভাবসুলভ স্বরগ্রাম ও গায়কি অটুট রেখে মঞ্চে গেয়েছিলেন। প্রেসলির গায়কির ভালোমন্দ ছাপিয়ে যে-বিষয়টি এখানে মুখ্য সেটি হচ্ছে টেক্সটকে নিয়ে খেলা করার স্বেচ্ছাচার। ভক্তরা তাতে নাখোশ হলেও মনে রাখা প্রয়োজন,—ডিলানের গান লেখার ধাঁচটা এমন যে রক্ষণশীল প্রাচীর তুলে টেক্সটের বিচিত্র পরিবেশনরীতিকে রুদ্ধ করা স্বয়ং তাঁর পক্ষেও সম্ভব নয়। মুক্তক্রীড়াটি যারপরনাই সংস্কারমুক্তির প্রশান্তি মনে জাগিয়ে তোলে। প্রেসলি যেমন ডিলানের গানগুলোকে নিজ মেধাস্বত্বের দাস করে তুলেছিলেন। শুনে মনেই হয় না বব ডিলান নামের এক যুবার কলম ও কণ্ঠ থেকে গানগুলো একদিন ধরায় জন্ম নিয়েছিল।
গত ছয় দশকে নামকরা ও বেনামী শিল্পীর কণ্ঠে ডিলানের গান গীত হওয়ার পাল্লা বেশ ভারী বলা চলে। উত্থানের দশক থেকে লম্বা সময় জুড়ে একবগগা তালে যেসব গান তিনি বেঁধেছেন তার উল্লেখযোগ্য অংশে ভাগ বসাতে শিল্পীরা নিলাজ ও নির্দয়। এর সূত্রপাত তাঁর হাতেই ঘটেছিল একদিন। জীবনভোর অগুন্তি কন্সার্টে মাউথ অর্গান ও গিটার হাতে মঞ্চে খাড়া গায়কের জীবনে বিগত শতকের মধ্য ছয় থেকে মধ্য সাতের কালপর্বটি অঘটন আর উত্তেজনায় ঘোলাটে ছিল। বব ডিলানকে ধারণ করতে তৈরি একাধিক তথ্যচিত্রে মার্টিন স্কোরসেজি এর তত্ত্বতালাশ করেছিলেন এক সময়। রোলিং থান্ডার রিভিউ : আ বব ডিলান স্টোরি (Rolling Thunder Revue: A Bob Dylan Story) ও পরে নো ডিরেকশন হোম-র (No Direction Home) সিনেভাষা অস্থিরচিত্ত এক যুবাকে তুলে ধরে। ডিলানের কন্সার্ট ও খোলস পাল্টানোর কারবার ধারণ করতে নির্মিত তথ্যচিত্র বস্তুনিষ্ঠ হলেও গায়কের বহুগামী বৈপরীত্য ও স্ববিরোধ সেখানে অচিহ্নিত ছিল। টড হেইন্স-র ডকুড্রামা আই অ্যাম নট দেয়ার (I’m not there) পরে সেই অভাব ভালোভাবে মিটিয়েছে বলা যায়।
মার্টিন স্কোরসেজির তথ্যচিত্র আর ওদিকে টড হেইন্স-র ডকুড্রামা থেকে ধারণা অসংগত নয়, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজের সংবেদন তুলে ধরার আদিবীজ ঘটনাবহুল কালপর্বে ডিলানের দেহমনে গজিয়ে উঠতে শুরু করেছিল। কবিতার চমকদার বাকপ্রতিমায় ঠাসা গানের কলির সঙ্গে ব্যক্তিসত্তাকে যেন কেউ গুলিয়ে বসতে না পারে তার প্রযত্নে মনোযোগী হলেন গায়ক। হিসাবী ব্যক্তিসত্তাকে মুখোশে ঢেকে মঞ্চে গান করার পালা শুরু হলো। দ্য রোলিং থান্ডার রেভিউ কন্সার্টকে বলাবাহুল্য এর সূত্রপাত গণ্য করা যায়।
ববের এই মুখোশধারণ তাঁর গায়কসত্তা থেকে ব্যক্তিসত্তাকে পৃথক রাখতে বেশ কাজে দিয়েছিল। মঞ্চে তাঁকে গান গাইতে দেখার ক্ষণে শ্রোতা ভাবে ছদ্মবেশী অজ্ঞাতনামা বুঝি গানগুলো গাইছে! মুখের রেখায় আবেগ, নিরাবেগ ও অনুভূতির বিস্ফার টের পাওয়ার উপায় নেই। সন্তসুলভ নিস্পৃহতায় গিটারের স্ট্রিংয়ে আঙুল আর মাউথ অর্গানের সরু ছিদ্রগুলোয় অধর ঘষেন ডিলান। ভাবলেশহীন কণ্ঠে সুতীব্র জীবনবেদকে গানের কলিতে নিংড়ানো ভীষণ শক্ত কাজ! বব ডিলান বিস্ময়করভাবে সেখানে কামিয়াব! গানের কলি আওরানোর মুহূর্তে মুখের রেখাকে অকম্পিত রাখতে পারার ক্ষমতা তাঁর গানের শক্তি। শ্রোতাকে এটি বাধ্য করে গায়কের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পরিবর্তে গানের কলিতে ব্যক্ত জীবনবেদে কান খাড়া রাখতে।
পয়লা শ্রবণদারি, তারপর দেখনদারি;—গানের কলি শ্রবণের ক্ষণে ক্যাথারসিস বা আবেগ-মোক্ষণের অমোঘ বচন ডিলানকে কীভাবে পেয়ে বসেছিল তার দিশা জীবনকাহিনির ছায়ায় নির্মিত চলচ্চিত্র মাস্কড এন্ড অ্যানোনিমাস-এ (Masked and Anonymous) কিঞ্চিৎ পাওয়া যায়। ল্যারি চার্লসের হাতে নির্মিত ছবিতে দর্শক ডিলানকে অনেক দিন বাদে অভিনয়ে নামতে দেখেছিল। অভিনেতা রূপে নিজেকে পরখ করার ঝোঁকে একদা দু-একটি কাউবয় মুভিতে পার্ট নিয়েছিলেন। ল্যারির ছবিতে তাঁর আবির্ভাব সেই ছক মেনে ঘটেছে। ছবিতে ডিলানের চাপা ও জটিল ব্যক্তিসত্তা কতটা মুকুরিত হলো এই প্রশ্নটি অবশ্য ছবিমুক্তির দিন থেকে সুধীমহলে তীব্র ছিল। আত্মগর্বে স্ফিত অসার এক সিনেবয়ান;—ল্যারির ছবিখানাকে সিনেআলোচক রজার ইবার্ট অনেকটা এই ভাষায় খারিজ করেছিলেন তাৎক্ষণিক। ডিলান-বন্দনার নামে প্রতিমা উপাসনায় হলিউডের নামজাদা লোকজনের প্রায় বিনা খর্চায় শামিল হওয়ার বাতিক নিয়ে মস্করা করতেও ছাড়েননি। ছবি হিসেবে ওঁচা হলেও স্বভাবসুলভ মিতবাক ডিলানকে রাখালিয়া গীতিকবির বেশভূষায় নির্লিপ্ত নয়নে দর্শক ঘুরঘুর করতে দেখে। নিজের গান ও ব্যক্তিসত্তাকে রহসময় প্রহেলিকায় ঢেকে রাখার কুখ্যাত চাতুরী যেখানে মওকা বুঝে ঝিলিক দিয়েছে বৈকি।
জগৎ-সংসারে সক্রিয়ভাবে যুক্ত কিন্তু সকল ব্যাপারে মিতবাক ও নির্লিপ্ত থাকার মেজাজ বোধ করি ডিলানের মজ্জাগত। হতে পারে ওটাই তাঁর ভান অথবা মুখোশ। গণ্ডির মধ্যে তাঁকে দাগানোর জঞ্জাট এড়াতে মুখোশ পরে তিনি মঞ্চে গান করেন। বিশৃঙ্খল বিশ্বে তাঁর একমাত্র কাজ হচ্ছে গানের কলি লেখা ও গাইতে থাকা। রচনাপ্রক্রিয়া বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তার ষোলআনা ব্যক্তিগত এবং সে-কারণে শ্রোতা-দর্শকের কৌতূহলের সামগ্রী হওয়ার পক্ষে অনুপযুক্ত। ল্যারির গড়পড়তা ছবির অন্তে পৌঁছে ডিলান ক্লিয়ার করেন,—তাঁর গানে মর্মরিত জীবনবেদ যেসব সমস্যাকে তুলে ধরে সেগুলোর সমাধান কোন পথে হওয়া উচিত এই ব্যাপারে তাঁর কোনো বক্তব্য নেই। আশা-নিরাশার দোলাচলে আবিল সংসারে কোন পথে আগানো গেলে মানবপ্রগতি স্বস্তির নিশান খুঁজে পাবে সেটি তাঁর নিজের কাছেও ধাঁধার সমতুল। উডি গাথরি তাঁকে ভীষণ প্রভাবিত করলেও তাঁর মতো Committed Soul রূপে মঞ্চে ওঠা তাঁকে দিয়ে হবে না। বিশৃঙ্খল বিশ্বে ঠিক-বেঠিক সম্পর্কে রায় ঠোকা যে-কারণে অবান্তর ভাবেন তিনি। ছবিতে দর্শক তাঁকে বলতে শুনে, ‘সকল ব্যাপারে মতামত ও নিজের ছকে মাপজোঁক করা অনেকদিন আগে আমি ছেড়ে দিয়েছি।’
মাপজোক ও বুলি কপচানোর দায় থেকে নিজেকে মুক্ত বলে জাহির করাটা ববের ভান হলেও হতে পারে। যদি তাই হয় তবু এ-কথা কবুল করতে বাধা নেই, বব ডিলানের গান ও যাপিত জীবন জুড়ে পরিব্যপ্ত নির্লিপ্তিকে মাঝেমধ্যে ঐশ্বরিক ভাবার ভ্রম খোদ শ্রোতার মনে জাগে। নির্বিকার, নিরাবেগ, নিরাসক্ত গায়কি যেখানে অন্যদের থেকে তাঁকে পৃথক ভাবতে প্ররোচনা যোগায়। মার্কিন সংগীতের বিচিত্র প্রবাহে গমন ও সেখানে ডুব দিয়ে জরুরি রসদ তুলে আনার পালা সাঙ্গ হলে ওইসব প্রবাহে নিজের বিচ্ছেদকে তিনি অমোঘ করেন। ঐতিহ্য নয় বরং পরিবর্তনের চাপে গতিশীল সময় ও সংস্কৃতির দেহে ডুবুরি হওয়া শিল্পীর নিয়তি;—গান রচনার ঘটনায় এরকম এক বোধি ডিলানকে আজীবন ত্যক্ত করেছে। হার্ড রেইন গানে যে-কারণে শ্রোতা তাঁকে বলতে শুনেছিল : Then I’ll stand on the ocean until I start sinkin’/But I’ll know my song well before I start singin’। দৈবজ্ঞ ওরাকলের ধাঁচে নিবেদিত বিবৃতি ধাঁধার চেয়েও জটিল হয়ে শ্রোতার কানে আঘাত হানে। নিজের ভাবনা ও জীবন-দর্শনকে হেঁয়ালিতে আড়াল করার খেলা আশি ঊর্ধ্ব জীবনে আজো সুনিপুণ ধরে রেখেছেন ডিলান!
…
তিনি হচ্ছেন একালের ত্রুবাদুর;—এই বিশেষণের চাপ বব ডিলান বলা যায় গানের জগতে পা রাখার দিন থেকে কাঁধে বইছেন। এর নাগপাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করেছেন জীবনভোর। সেইসঙ্গে তাঁকে নীরবে তাড়া করে ফিরেছে উডি গাথরি ও জনি ক্যাশের গায়কি। পিছু নিয়েছে অঢেল বৈচিত্র্যের সমাহারে রঙিন মার্কিন দেশের পাহাড়, খেতখামার, বনভূমি ও লোকালয়। লোকসংগীত আর রকগানের আদি বিবর্তনের পদচ্ছাপগুলো এমন করেই কুড়িয়ে নিয়েছিলেন তিনি। টুয়েন্টি সেভেন ক্লাব-এ (27 Club 27) নাম লিখিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানানো রবার্ট জনসনের মতো গায়ক প্রেত হয়ে তাঁর দেহে রাজ করেছেন গোড়ার দিনকালে। এইসব বিচিত্র রসদ মিলেঝুলে যে-গায়কটি জন্ম নিলেন তাঁকে অচিহ্নিত ভাবাই সংগত মনে হচ্ছে। সংগীতের সকল মার্গে গমনাগমন শেষে সেগুলোর ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসার প্রাণান্ত কসরতকে ডিলানগীত নামে ডাকা যায় হয়তো-বা। গান হচ্ছে যাপিত সময়ের বিবৃতি;—অকাট্য এই বচনে বব নিজের সিদ্ধি খুঁজেছেন। এর গহিনে কোনো মরমি জীবনবেদ যদি থাকেও তার পরোয়া কি করেছেন সেভাবে? মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, গানগুলো ক্রমশ নিজের এখতিয়ার থেকে বেরিয়ে অন্যদের গায়কিতে নতুন ভাষা ও স্ফুরণ পাবে সেটি বুঝতে পারছেন। নিজের গানের মেধাস্বত্ব বিক্রয়ের ভাবনা এখান থেকে তীব্র হয়েছে মনে।
মেধাস্বত্ব বিক্রির ঘটনা নিয়ে শ্রোতা সাধারণের মধ্যে জল্পনার শেষ নেই! অনেকের ধারণা বুড়ো ডিলানের আয়রোজগার আগের মতো নেই দেখে মেধাস্বত্ব বিক্রি করে দিয়েছে লোকটা। সত্য বটে, ছেলেমেয়ে নাতিপুতি নিয়ে তাঁর বিরাট সংসার। হাতির মতো বৃহৎ সংসারের ঝক্কি সামলাতে স্বত্ব বিক্রি করে থাকতেও পারেন। জল্পনার গাছপাথর যেহেতু নেই এ-নিয়ে মাথা ঘামানো অপচয়ের নামান্তর। বরং এইটে ভাবা সহজ,—বুড়ো ডিলান ক্রমশ ভাটার দিকে চলেছেন, এই যাত্রা একবার শুরু হলে সকল অর্জন গৌণ হয়ে পড়ে। মেধাস্বত্ব থেকে জন্ম নেওয়া বিপুল সংগীতের প্রতি মায়া থাকলেও সেগুলোর দেখভাল নিজের কাছে বোঝাতুল্য মনে হয়। দেহের শিরা-উপশিরায় তিক্ত বৈরাগ্য জন্ম নেয়। বুড়ো ডিলানের কাছে আপন মেধাস্বত্ব থেকে সৃষ্ট বিপুল সংগীতের ভারটাই এখন সংগোপন নীরবতায় দিন যাপনের পথে বড়ো বাধা। এগুলোকে না পারবেন ছাড়তে, না পারবেন ধরে রাখতে। উদ্বেগ থেকে মুক্তির স্বাদ নিতে হয়তো গানের স্বত্ব মোটা অঙ্কে সনি মিউজিকের জিম্মা করলেন গায়ক!
বব মনে হয় আন্দাজ করতে পারছেন আজ ও আগামী দিনের শিল্পীরা তাঁর গানের প্রাসঙ্গিকতাকে নবীকরণের মাঝে পরখ করার সুখ নিতে মরিয়া হবে। মূলরসে হানি না ঘটিয়ে নতুন আয়োজনে গানগুলোর পরিবেশনাকে অমোঘ করার ব্যবস্থা অগত্যা থাকা প্রয়োজন। নিজের সৃষ্টিসম্ভারে নতুন কিছু যোগ করা স্বয়ং তাঁর জন্য কঠিন। মটর সাইকেল দুর্ঘটনার চক্করে খোয়া যাওয়া প্রায় শতাধিক গানের পাণ্ডুলিপি বছর দশেক আগে খুঁজে পাওয়া গেলেও সেগুলোয় নিজেকে সক্রিয় করার তাড়া যে-কারণে তাঁকে উতলা করেনি!
হারিয়ে যাওয়া গানগুলো আদতে ডিলান ও তার ব্যান্ড-র (Bob Dylan and The Band) হয়ে মধ্য সাতের দশকে প্রকাশিত বেজমেন্ট টেপস অ্যালবামের জন্য রচিত গানমালার অংশ ছিল। বাড়ির সর্বনিম্ন কক্ষ বা গ্রাউন্ড ফ্লোরকে স্টুডিও বানিয়ে প্রায় বছর খানেক বব ও দোস্তরা মিলে গানগুলো লিখছিলেন। মটরসাইকেল দুর্ঘটনার জের ধরে তার কিছু অংশ খোয়া যায়। যারা সেটি খুঁজে বের করেছে অদ্য তাদের ঘাড়ে এর ভবিতব্য স্থির করার দায়িত্ব চাপিয়েছেন বব। সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য,—গানগুলো নিয়ে তোমরা যদি কিছু করতে চাও তো করো। আমার আপত্তি নেই। যুবারা বলাবাহুল্য ডিলানের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু গানে সুর বসানোর কর্ম সেরে ফেলেছেন। লস্ট সঙ : দ্য বেজমেন্ট টেপস কন্টিনিউড (Lost Songs: The Basement Tapes Continued) শিরোনামে ডিলানের পাণ্ডুলিপির ব্যবচ্ছেদ, গান বাছাই, কিছু অংশের পুনর্লিখন ও সুর বসানোর যজ্ঞ স্যাম জোনস ধারণ করেছেন ক্যামেরায়। তথ্যচিত্র ও সংগীতের সবটাই নেটে সুলভ। শ্রোতা-দর্শক চাইলে ঢুঁ মারতে পারেন।
ষোলআনা স্বাধিকার বজায় রেখে মার্কাস মামফোর্ড ও তাঁর দলবল গানগুলোয় কণ্ঠ দিয়েছেন। স্যাম জোনসের তথ্যচিত্রে ক্যানসাস সিটি গানের কম্পোজিশনে ক্যারাবিয়ান জলদস্যু জনি ডোপকে গিটার হাতে হাজির দেখতে পাওয়াটা চমক বটে! বৈপরীত্যভরা কিংবদন্তিকে আবিষ্কার ও নবায়নের রোমাঞ্চ গানগুলো শুনতে বসে শ্রোতা টের পায়। স্প্যানিশ মেরি (Spanish Mary), ক্যানসাস সিটি (Kansas City), ডাউন অন দ্য বটম (Down on the bottom), হোয়েন আই গেট মাই হ্যান্ডস অন ইউ (When I Get My Hands On You) গানগুলো ডিলানকে যতটা উহ্য করে ঠিক ততটাই আবছায়ার মতো তাঁকে বাঁচিয়েও রাখে। যুগাবর্তে এভাবে তিনি বিনির্মিত হচ্ছেন স্টিভ হ্যাকম্যান, মার্কাস মামফোর্ড, রায়ানন গিডেন্স-র মতো নতুন যুগের সংগীতকারের হাতে। এখনো জীবিত কিংবদন্তির এখানে করণীয় সামান্য। অজানায় নিরুদ্দেশ হওয়ার প্রতীক্ষায় দিন কাটানো সার এখন। ওদিকে সময়ের অমোঘ পরাকলায় রায়ানন-র তেজি কণ্ঠে ঝিলিক দিচ্ছে স্প্যানিশ মেরির বিষাদমথিত সংবেদ :
Beggar man, beggar man
Tell me no lie
Is it a mystery to live?
Or is it a mystery to die?
জিজ্ঞাসাটি ডিলানময় বটে! সময় পাল্টাচ্ছের বার্তা নিয়ে মঞ্চে দেখা দিয়েছিলেন একদিন। সংগ্রামে বিদীর্ণ সব দিন পেরিয়ে কথকঠাকুর বয়োবৃদ্ধ। তাতে কি! টগবগে ঘোড়ার মতো কদম ফেলে তাঁকে অবিরল গাইছে রায়ানন গিডেন্সের মতো শিল্পী। মার্কিন লোকসংগীতে যাঁকে চোখ বুজে একালের জোয়ান বায়েজ ডাকা যেতে পারে। ডাউন অন দ্য বটম গানের কথায় নীলকণ্ঠি পাখিকে আকাশের অনেক উঁচুতে উড়ান নিতে বলেছিলেন বব। তাঁর জন্য ভালোবাসার মানুষটি খুঁজে দিতে বলেছিলেন পাখিকে। উড়ান নেওয়ার পর থেকে সে আর ফিরেনি। এতদিন বাদে পাখি ফিরেছে রায়ানন-র কণ্ঠে শিস তুলবে বলে। ডিলান শিস শুনতে পাচ্ছেন আর মনে-মনে ভাবছেন পাখিটি তাঁর জন্মের চেনা। মানুষকে চিনতে শেখার আগে থেকে সে তাঁর পরিচিত। গান রচনায় মগ্ন হওয়ার আগে থেকে যেমন জানা ছিল গায়ক হচ্ছে অভিশপ্ত দৈবজ্ঞ! দৈবজ্ঞ ওরাকল জানত সে কী লিখতে চলেছে আর ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য!
…
সংযুক্তি
১. গেল ছয় দশকে মার্কিন লোকসংগীতের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী জোয়ান বায়েজ ছাড়াও বহু শিল্পী ভালোবেসে ডিলানের গান গলায় তুলেছেন। বায়েজের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে গান করার দিনগুলো তাঁর জীবনে চিরস্মরণীয় ঘটনার কাতারে পড়ে। গণমানুষের জন্য নিবেদিত প্রতিবাদী গানে স্বচ্ছন্দ বায়েজের কণ্ঠে নতুন প্রাণ সঞ্চারের ত্বরা থেকে একসময় স্রোতের মতো গান লিখেছেন ডিলান। দুই শিল্পীর বন্ধুতা, ইশক ও জুদা আর লম্বা সময় বাদে নিজের ভুলের জন্য শরমিন্দা গীতিকবির বায়েজ সমীপে মাফি মাঙ্গার ঘটনা নিয়ে ইতিউতি কানাঘুষা কম হয়নি। হার্ড রেইন-র মতো নির্বেদঘন যত গান তিনি লিখেছেন তার নেপথ্যে ব্যক্তিজীবনের জটিল চোরাবালিতে ধসে যাওয়ার শঙ্কা বেশ প্রবল হয়ে উঠেছিল। ডাউন অন দ্য বটম গানে ডিলান তাই স্বগোক্তি করছেন : Always been in trouble / Nearly all my life / Always been in trouble / Struggle, scorn and strife. গানে মর্মরিত দাগ, জখম, সংগ্রাম ছিল আদি প্রাণবীজ। হার্ড রেইন-র মতো স্মরণীয় বিবৃতি সেখান থেকে আকাশপানে মাথা তুলেছিল। ওদিকে ব্যক্তি ডিলানের নিরাসক্ত দর্শক ও নৈর্ব্যক্তিক এক ধারাভাষ্যকারে নিজেকে পাল্টে ফেলার সূত্রপাতও সেখানেই নিহিত।
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
গানপারে বব ডিলান
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS