সত্তরের দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলন পুরা ভারতবর্ষের বুকে একটি ভিন্ন ঘরানার রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে তার অভিঘাত প্রবলভাবে অনুভূত হয়েছিল, যার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল আলোচ্য বইটি। শিরোনাম নকশালবাড়িনামা। আর এটি লিখেছেন নান-আদার-দ্যান অসীম চট্টোপাধ্যায়।
যে-ঝোড়ো সময়ের অভিজ্ঞতা এখানে বর্ণিত হয়েছে, সেই সময়ে তার আঁচ কম-বেশি আমাদের সকলকেই নানাভাবে স্পর্শ করেছিল। তখনকার আমাদের অঞ্চলেও অভিঘাত পড়েছিল। সবিস্তার পাওয়া যায় সেইসময়ের ইন্ডিয়ার পশ্চিমবাংলা রাজ্য।
পঁয়ত্রিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বইয়ের তাৎপর্য দ্বিবিধ। এক, নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ অসীম চট্টোপাধ্যায় ওরফে কাকা এই ধারাটির অভ্যন্তরস্থ বহু খুঁটিনাটি এবং অজানা তথ্য পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। আর দুই, নির্মোহ দৃষ্টিতে এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও পরিণতি আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিপ্ত হয়েছেন এক কঠোর আত্মসমালোচনায়, যা বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেক প্রশ্ন উস্কে দেয়।
এই বইয়ের পাতায় পাতায় লেখক বলেছেন গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মগমা, পাঁচরা ও সিউড়িতে কাটানো তাঁর বাল্য-কৈশোর, পরিবার ও স্কুলজীবনের কথা। আর আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক ইতিহাসচরিত্রের স্বজবানে এই বই রিডিং ম্যাটিরিয়্যাল হিশেবে এককথায় জীবন্ত।
সহজসাধ্য নয়, এক কঠিন ও জটিল সময়ের চিত্রায়ণ করেছেন অসীম চট্টোপাধ্যায় ভীষণ সশ্রম ও সপ্রেম। ‘নকশালবাড়িনামা’ নকশাল আন্দোলনের শুধুমাত্র ইতিহাস নয়; নকশাল আন্দোলনের বিভিন্ন ধারার উৎপত্তি, বিকাশ ও বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম করে এই রচনা লেখকের ছয় দশকের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন, ইডেন হিন্দু-হোস্টেল আন্দোলন, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে বাংলা-বিহার-ওড়িশার সীমান্ত অঞ্চলের গোপীবল্লভপুর, বহড়াগোড়া-ডেবরা কৃষক আন্দোলনের সূচনা ও বিকাশকে বর্ণিত করেছে।
অসীম চট্টোপাধ্যায় প্রাথমিকভাবে কমরেড চারু মজুমদারের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার কট্টর সমর্থক হলেও, পরবর্তীকালে নিজেদের অভিজ্ঞতাজাত শিক্ষায় ও চিনের পার্টির পরামর্শ অনুসরণ করে ‘শ্রেণীশত্রু খতম’-এর লাইনের বিপরীতে গণসংগঠন, গণ-আন্দোলনকে জনযুদ্ধ বিকাশের প্রয়াস রূপে তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে। জনগণ, একমাত্র জনগণই ইতিহাসের প্রকৃত নির্মাতা। এবং সেই শিক্ষা অনুসরণ করে তিনি ‘গণতান্ত্রিক বাম’-এর রাজনীতিকে গ্রহণ করেন, সেই ইতিহাসও এখানে বর্ণিত। অসীম চট্টোপাধ্যায় নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, সাম্যবাদী আন্দোলনে গণতন্ত্র ও কেন্দ্রিকতার বিষয়টি বারবার আলোচিত হয়েছে। দলের সমস্ত শক্তিকে সংহত করার জন্য কেন্দ্রিকতা যেমন জরুরি তেমনই জনগণের সক্রিয়তা, উদ্যোগ ও সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য গণতন্ত্র সমান গুরুত্ব দাবি করে।
ছয় দশকব্যাপী দীর্ঘ পদযাত্রার, আশ্চর্য ভ্রমণের পরিসমাপ্তিতে লেখক অবশেষে এই মহাসত্যে পৌঁছেছেন, পার্টি বা নেতারা নন একমাত্র জনগণই ইতিহাসের প্রকৃত নির্মাতা। ‘নকশালবাড়িনামা’ এই সত্যকেই তুলে ধরেছে। এই বই প্রকাশ করেছে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স।
বইনিউজ ডেস্ক
গানপার বইরিভিয়্যু
- একটি ইতিহাসের অটোবায়োগ্রাফি - October 21, 2025
- কিনব্রিজ সংলগ্ন কোজাগরী মিউজিক নাইট - October 17, 2025
- রিপন মিয়ার জীবন ও সাহিত্য || কাজল দাস - October 14, 2025
COMMENTS