এইটা বাংলা ভাষায় লেখা একটা বইয়ের নাম, ‘মহামহিম রবীন্দ্রনাথ’, রবীন্দ্রনাথবিষয়ে লেখকের বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধের সংকলন, লিখেছেন আবদুশ শাকুর।
বইয়ের নাম শুনেই বোঝা যায় যে এই বইয়ের কন্টেন্ট যত বিচিত্রগামী বিষয়বিস্তারীই হোক সমস্তকিছু রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। যত উপভোগ্যই হোক শেষমেশ এইটা ঠাকুরপ্রশস্তি বা রবীন্দ্রজয়গাথা। নামেই চিন মেলে অবশ্য, মহামহিম তিনি। ইত্যাদি।
কিন্তু বইটা আবদুশ শাকুর লিখেছেন যেহেতু, পড়তে যেয়ে কেউ অন্তত প্রভাষকদের কাষ্ঠবৎ গদ্যের অপবাদ এই বইয়েরে দেবেন না। ছাত্রছাত্রীদের সমীহ কুড়াইবার দায় শাকুরের কোনোদিনই ছিল না, কাজকামের সূত্রে লেখক ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ সচিব। অথচ সারাজীবনই তিনি সাহিত্য করে গেছেন, সচিবসাহিত্য নয় সেসবের একটা পাতাও। রসরচনাকার বা যারে আমরা সাধারণ্যে বলি রম্য রচয়িতা, আবদুশ শাকুর এই জায়গায় একটা পার্থক্যদর্শী নিজস্ব শৈলী ক্রিয়েইট করে নিয়েছিলেন গোড়া থেকেই। এবং পুষ্পবিশারদ, রবীন্দ্রগবেষক, সংগীতবীক্ষক, ছোটগল্পকার, রম্যরচনাকার প্রভৃতি বিবিধ পরিচয়ের যে-কোনো একটা দিয়াও উনারে শ্রেয়তার আসনে বসানো যায়। কিছু বছর আগে প্রয়াত আবদুশ শাকুর শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, বুনো তেঁতুল বা বাঘা ওল যা-কিছু লইয়াই লিখুন অন্তিমে তা আবদুশ শাকুরেরই রচনা হয়ে ওঠে। এতটাই ডিস্টিংক্ট তিনি।
আবদুশ শাকুরের জীবনযাপনে একটা বড় অংশ জুড়েই ছিল সংগীতপ্রীতি। ভীষণ সংগীতরসজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন তিনি। নিশ্চয় এখনও থাকতেন তা-ই, লিখে যেতেন এখনও, মৃত্যু যদি-না তারে অ্যাবসেন্ট না করত। সংগীত উনার জীবনের একমাত্র না-হলেও প্রধান একটি বিষয় যে এতে সন্দেহ নাই। ঠিক যেমন আরেকটা পার্ট তার লাইফে এবং লিভিঙে ফুলচর্যা বা পুষ্পবিদ্যায় আন্তরিক অভিনিবেশন। গোলাপ বিষয়ে লেখকের একটি অন্তত গুরুত্বপূর্ণ বই বাংলাভাষিক মানুষেরা আরও অনেকদিনই ইয়াদ রাখবে।
এহেন সুরমত্ত সংগীত-অবলোকনকারী আলোচক সারাজীবনই লিখে গেছেন সংগীত নিয়ে, এবং ফিরে ফিরেই রবীন্দ্রনাথ এসেছেন তার লেখায় বিষয়বস্তু হয়ে। যা-কিছুই লিখেছেন তিনি, বিশেষত রবীন্দ্রনাথকে বিষয় কিংবা বিষয়ীর জায়গায় রেখে দেখেছেন যা-কিছুই, কিমাশ্চর্যম্ কিমিয়ায় তাতে লেখকের সাহিত্যবোধ আলো ফেলেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং পাঠকেরে করেছে আলোকিত।
উরাধুরা প্রাবন্ধিক গদ্য নয় শুধু, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে লেখকের রচনাধরনগুলি বিচিত্র। কয়েকটা লেখার শিরোনাম শুনাইলেই বোঝা যাবে এই বইটা আদৌ কৌতূহলোদ্দীপক কি না। আবদুশ শাকুর এই বইতে যে-লেখাগুলো উপস্থিত করেছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যেমন ‘মহাগদ্যকবি রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রনাথের স্থপতি কাদম্বরী দেবী’, কিংবা ‘রবীন্দ্রনাথের গ্রাম ও পরিবেশ ভাবনা’ ইত্যাদি। দিগদারির শুধু এইটাই যে সবকিছুতেই ঠাকুর মহা একটাকিছু। বিশেষণবহুলতা শাকুরের গদ্যে যেমন মজা আনে তেমনি বিরক্তিও ঘটায় নিশ্চয়।
শাকুর মনে করেন যে রবীন্দ্রনাথ হলেন প্রথমত গদ্যকার এবং দ্বিতীয়ত গীতিকার। ‘গীতবিতান’ নামক রবীন্দ্রগানপঙক্তিচয়নিকার বাইরে গদ্যেই তিনি রেখে গেছেন তার অনির্বচনীয় রূপরসগন্ধবর্ণবীক্ষণের সুস্থায়ী উত্তরাধিকার। এই কথাগুলিই জিস্ট হিশেবে নিতে হবে এই বিপুলায়ত বই থেকে, এমন হয়তো নয়। কিন্তু এই কথাগুলি রিডারের আগ্রহপারদ খানিকটা বাড়াতে পারে। এবং যদি মনে রাখি যে এই বইয়ের একটা আস্ত অধ্যায়েরই নাম ‘মহাগদ্যকবি রবীন্দ্রনাথ’, বইটা নাড়াচাড়া করে দেখবার ইচ্ছাটা জাগতেই পারে বিশেষত কবিদের এবং কবিতাথার্স্টিদের। তিরিশিদের অভিঘাতে শেষদিকটায় বেশকিছু গদ্যমকশো কবিতা লিখেছিলেন দেখতে পাই, কিন্তু গ্রন্থকার তারে ‘মহাগদ্যকবি’ কিসের বলদর্পে বানিয়ে তুললেন এইটাই দেখতে ইচ্ছা হতে পারে।
প্রতিবেদন / আতোয়ার কারিম
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS