মোদ্দা কথা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধরায় আগমন, যাপন ও মরে-যাওয়া মানুষের কপালে নেই! যে-কারণে এই ত্রয়ীকে সে তার কথার জালে সংজ্ঞায়িত করে। সংজ্ঞায়নের কারণে হয়তো তারা বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে, নতুবা জীবন ও মরণ ঘিরে বিরচিত অযুত ঘটনাকে মেটাফিজিক্যাল ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না! ঘটনা যেমন হোক কথা অর্থাৎ বচনামৃত বাদ দিয়ে ফিজিক্যাল কিংবা মেটাফিজিক্যাল কোনোটাই সম্ভবে না! অগত্যা কামরুজ্জামান কামু বিরচিত ‘চক্রবর্তীর হাসি’ কবিতাখানা মনে পড়ে যায়। কেউ যখন হাসে কবির কাছে কেন যেন মনে হয় তার এই হাসিটা কথায় ধরানো মুশকিল, আর সেই হাসি যদি চক্রবর্তী মহাশয় হাসেন তবে তাকে বচনাতীত বা মেটাফিজিক্যাল ছাড়া কিসসু ভাবতে মন চায় না। এখন বচন ছাড়া চক্রবর্তীর হাসি মেটাফিজিক্যাল এই কথাখান কবি মুখ ফুটে বলবেন কী করে! রসিক কামু কবিতা রচনা করে মামলায় ইতি টানেন :— ‘হাসি ব্যাপারটা কবিতায় বহু প্রচারিত, তবু / বিশ্বে আপনি যতবার হাসেন ততবার / মেটাফিজিক্যাল শব্দটা আমাকে ব্যবহার করতে হয় / এখানে মেটাফিজিক্যাল অর্থ অনির্বচনীয় / মানে যাহা অধিজগতের, যাহা বচনের অতীত, তবু / বচন ব্যতীত আমি কথা বলি কীভাবে হে বালা?’ (দ্রষ্টব্য : তবু চক্রবর্তীর হাসি মেটাফিজিক্যাল, কামরুজ্জামান কামু)।
রাইসু যেহেতু বচন দিয়ে নিজেকে চেনান আর পাঠকরাও বচনের শরণ মেগে তাঁকে চিনে, তাঁর পক্ষে অনন্ত মৌন থাকা সম্ভবপর নয়। মৃত্যুপারাবারে সকল কথার চির-অবসান ঘটার পর অস্তিত্ব যাপনের চিহ্নগুলোর পরিণাম তাঁকে ভাবায় এবং ভাবনটা সেখানে কথা দিয়েই রাইসুকে সাজাতে হয়। ২০১৬ অথবা ১৭-য় ‘নদীর কিনারায়’ ও ‘জলে মৃত্যু’ শিরোনামে প্রকাশিত দুটি কবিতা যেন বদ্রিলারের কথার প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বাজে। দুটি কবিতাই দীর্ঘ হওয়ায় সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি সম্ভব নয়, তবু অংশবিশেষ পাঠক বরাবরে তুলে দেওয়া প্রয়োজন :—
যেন কোনো জাতিস্মর
অহেতু শৈশব নিয়ে
শুয়ে আছে
আকাশের
তারাদের নিচে
যেন কেউ আর নাই বহু বহু দিন ধরে
সমুদ্রের পারে যেন
রোদ নাই
ছায়া নাই
অন্ধকার
যারা ছিল চলে গেছে
তোমার যাওয়ার কোনো কিছু নেই…
যেন প্রয়োজনহীন মৃত্যু
আগুয়ান
যেন এই মৃত্যু সাবলীল, সাদা মৃত্যু
ভেজা মৃত্যু
অন্ধকারে যে কোনো মৃত্যুর মত
ইচ্ছাজাগানিয়া
শুধু যেন হাওয়া বয়
যেন আমি শুয়ে আছি
ঘুম থেকে জাগার আগেই যেন
বালুতটে, পড়ে আছি
যেন আমি আমবনে জুঁইশাখে
রয়েছি জড়ায়ে।
(জলে মৃত্যু)
…
আমরা এই দুনিয়ায় ছিলাম কি কোনো দিন
আমরা এই দুনিয়ায় ছিলাম না কোনো দিন
এখন আসছি যখন দেখতে পেলাম
আরো না কতই লোকে
একই উদর হইতে আসা
একেক পরিবার
অন্য সবার থেকেই নাকি
আলাদা তারা থাকে
আলাদা ঘর
আলাদা বাঁচা
আলাদা নিজ নিজ
এখানে এসে দেখতে পেলাম
কত কিছুই আছে
কেবল আমরা মাত্র নাই
এখন যখন কোনো কিছুই নাই
যখন আবার আমরা মরতে আছি
আরেক বারের মত
তখন আবার কোনো বাঁচাই যখন নাই
তখন মরতে গেলাম নদীর পাড়ে তাই…
(নদীর কিনারায়)
এই কবিতার পাঠমূল্য কী দাঁড়াবে সে-বিবেচনা ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দেওয়া উত্তম; তবে মরণইচ্ছুক ভাষাঅঙ্গে যখন লিখেন তখন রাইসুর প্রকৃত সত্তাকে পাঠক টের পায়। আফটার অল মরণপারাবারে কেন্দ্র ও কেন্দ্রাতিগ হওয়া নিয়ে যত বিরোধ তার চির-অবসান ঘটে! মৃত্যু একমাত্র কেন্দ্র যেখানে গমনের পর কেন্দ্রের বোধ অবশিষ্ট থাকে না। মৃত্যুর পর মানুষ যা-কিছু পেছনে ফেলে যায় সেগুলো আমবনে জুঁইশাখে জড়িয়ে থাকা স্মৃতির অবশেষ। স্মৃতিকাতর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া দ্বিতীয় অর্থমূল্য এখন আর অবশিষ্ট নাই! আগামীতে রাইসুর ভেতরে ঘুমন্ত রাইসুর দেখা পেতে এই কবিতারা কাজে দিতেও পারে। মানুষ হয়তো তাঁর চিন্তুনপদ্ধতিতে মনঃক্ষুণ্ণ অথবা মুরিদ হয়, কিন্তু দিনশেষে এর আড়ালে লুকানো মানুষটিকে সম্যক বোঝে বলে মনে হয় না। পুনরাবৃত্তি ও প্রথাবন্দি অভ্যাস হলো নিমর্ম ফাঁদ! একে যত ব্যাখ্যা করা হয় মনে গোল বাঁধে। রাইসু সেটি উপলব্ধি করেন বলে মনে হয়। সময়ের সঙ্গে তাঁর কবিতারচনায় ভাটা পড়ার পেছনে এটি হয়তো কারণ। হতেও পারে নতুন কোনো বাঁকে মোড় নেওয়ার জন্য বিগত কয়েক বছর ধরে তিনি সবিরাম কবিতা রচনায় মৌন। সে যা-হোক, রাইসুঘরানায় বিরচিত কবিতার তরঙ্গে সম্ভবত সেই আবেদন ছিল যা শূন্য ও পরের দশকে একাধিক কবির মনোবিশ্বে প্রেরণা যুগিয়েছিল। পাঠক এই ধারার কবিতায় বিগত তিন দশক ধরে অভ্যস্ত বলে কামু সহ অন্য কবিগণ থেকে বাড়তি উদ্ধৃতির প্রয়োজন দেখছি না।
রিলেটেড রচনারা
রাইসুর রাজ্য ও নৈরাজ্য ১
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
COMMENTS