বুদ্ধগল্প

বুদ্ধগল্প

একটি কি দুটি পাখি। বুদ্ধদেব বসু-র একটি গল্পের নাম। দে’  প্রকাশিত ‘বুদ্ধদেব বসু-র শ্রেষ্ঠ গল্প’ গ্রন্থে সংকলিত। বহু বছর হয় এইটা আমার অভিজ্ঞতার অন্তর্গত। মনে রাখা যাক যে, সেইবারই প্রথম বুদ্ধদেব বসু-র কোনো গল্প পড়ে উঠতে পেরেছিলাম আমি। কিন্তু বুদ্ধগল্পগাছা পাঠেরও অনেক আগে অবশ্য তার কিছু কবিতা, বোদলেয়্যর-র্তজমা, বিশিষ্ট ভূমিকা সহ মেঘদূত-বঙ্গানুবাদ ইত্যাদি পড়া ছিল। আর, হ্যাঁ, প্রায় সমস্ত প্রবন্ধই সুখপাঠ্যতার গুণে পড়ে ফেলতে পেরেছিলাম। উপন্যাস বলতে কেবল ‘তিথিডোর’ আর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ পড়েছি এ-যাবৎ। এর বাইরে কিছু পড়ার জন্য অতটা তাগিদ কখনো বোধ করিনি, বা নিজে থেকে উদ্বোধিত হইনি পড়তে, সে-যা-হোক। উপরোল্লিখিত সময়খণ্ডে তথাগতপ্রাণ এক প্রাজ্ঞ ও বর্ষীয়ান পাঠকের উপর্যুপরি প্রণোদনের ফলে পড়ে ফেলতে পেরেছিনু কয়েকটি গল্প, বুদ্ধদেবের। পয়লা-পরথম যেটি পড়েছি এবং পড়ে বেশ পাঠ-উত্তর প্রতিক্রিয়াচ্ছন্ন হয়েছি মনে পড়ে, সে-গল্পটিই এই ‘একটি কি দুটি পাখি’।

যিনি পড়তে প্রাণিত করেছেন বইটি, তথাগতভক্ত প্রোক্ত সহমর্মজন, তার অটোবায়োগ্র্যাফিক্ রেফ্রেন্স সম্বলিত এই গল্প — অমন ইঙ্গিত পেয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম অনেকটা গোয়েন্দা মনোবৃত্তি নিয়ে। অন্যের গোপনকাহিনি জানবার অন্যায় আগ্রহ। পাঁচপাতা-ব্যাপ্ত গল্পের ঠিক দেড়পাতা-মাথায় বিশেষ ওই বৃত্তি উবে যায়, যেয়ে সেখানে থাকে নিছক গল্পপাঠের আকাঙ্ক্ষা। আসলে গল্পটিই টেনে নিয়েছিল তার ভেতরে। গল্পটিই দাবি করেছিল অভিনিবেশ। গল্পের কোথাও কোনো ভাবালুতা বা কান্না-দুঃখ ইত্যাদি কিছুই নাই, অথচ কেমন বিপন্ন বিষাদে ভরে গিয়েছিল বোধি, গল্পপাঠ-অন্তে একটা প্রান্তরছাপানো উদাসীনতা পেয়ে বসেছিল অল্পক্ষণের জন্য হলেও। প্রতিটি অক্ষর যেন বিষাদের অব্যক্ত মঞ্জুষায় ভেজানো, পড়তে পড়তে অমনটাই মনে হচ্ছিল। বিস্ময় আরেকটা জায়গায়, এবং সেইটি বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে (যদিও সে-সুযোগ এখানে অল্পই নিচ্ছি)। আর সেইটা এমন বলা যায় যে, আর কিছুই না, গল্পটা প্রেমের। একেবারেই প্লেটোনিক্, অর্থাৎ প্রেম-অচরিতার্থতার, একেবারেই ‘দেহহীন চামেলীর’ গল্প। অত সুবোধ রোম্যান্তিক ত্যাগতিতিক্ষার গল্প তো ধুম-মাচালে লাইফ-লিডকারী আমাদের ভালো লাগবার কথা নয়। কিন্তু তবু কেন যেন মনে হচ্ছিল ওইটা আমাদেরই গল্প — আমাদেরই জীবনের চেনা-আধচেনা — অনির্ণীত অন্তর্গত ভাবনাজীবনের। যৌবনে-প্রৌঢ়তায় এহেন হাজারও খোয়াইশ এবং তৎসঞ্জাত অবদমন ও অচরিতার্থতা আমাদেরে বেচইন করে রাখে ভিতরে ভেতরে।

এইটা আশ্চর্যের বটে, কেননা কম গল্প তো পড়া হয় নাই হে! — কত কত করণ-প্রকরণ-আঙ্গিক, কত অভাবিত অনন্য গদ্যভাষার নমুনা খোদ এই বাংলাভাষাতেই, তবু তুমি ওই গল্পে নিজেকে পেয়ে গেলে! হ্যাঁ, এমন তো হতেই পারে এবং হয়, পেয়ে যাওয়া যায় খড়ের গাদায় সেলাইয়ের স্বর্ণসুচ খুঁজে। এবং সেজন্যেই মনে হচ্ছিল যে, কেন হুদা হাঁউকাঁউ করা, একটা ভালো লেখা সবসময়েই ভালো। অজান্তেই ক্রিয়া করে চলে সে, ফেসবুকিশ সহস্রকল্লোলিত কচলাকচলি-দলাইমলাইয়ের দিনেও, সংগোপন সহজিয়ানায়। একটা সৎ লেখা পরিবর্তিত সময়েও পথ করে নেয় তার, কোনো-না-কোনোভাবে কম্যুনিকেইট করে নেয় তার অব্যবহিত পরের পরের পরের প্রজন্মের সঙ্গেও।

মনে হচ্ছিল, পুরানাকালিক মনে-হওয়াই, কিছু লোক যারা লেখা নিয়া মারামারি-ধস্তাধস্তি করে অহেতু, তারা খুব-সম্ভব এইধারা গল্পপাঠের ভেতর দিয়া যায় নাই কখনো। হতে পারে, তেমনটা, না-ও হতে পারে। ফের আরেকটা ব্যাপার, সকল গল্পকার, এই বঙ্গে, কেন-যে দল বেঁধে আজিজ আর আখতার বনবার মন্ত্রসাধন-শরীরপাতন শিঙা বাজায়া যায়, সে-এক রহস্য বটে। গল্পও তো, কবিতার মতো, হরেক প্রকারের অনেক প্রণালির বহু রকমের। তবু সবাই কেন যে বেহুদা সমাজচিত্র আর অন্ত্যজ শ্রেণির দুর্দশা পরিবেশনে ব্যস্ত-পর্যুদস্ত, অলমাইটিও অবগত কি না কে জানে। এবং পুরস্কারদাতা প্রাতিষ্ঠানিক ফড়িয়ারা পুরস্কৃত করে ওই-সমস্ত গল্পগুলোকেই শুধু, যেগুলো কথিত অতিক্লিশে ‘গ্রামীণ জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা-হতাশা-হাসিকান্না’ ইত্যাদি চিত্রিত করে বেহদ্দ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে; এবং আরেকটা জিনিশ নাকি সেথায় বিধৃত থাকে, যার গণ্ডভরা নাম ‘লড়াই’! কে-যে এদেরে এই দাওয়াই বাৎলেছে যে, লেখার/গল্পের ভালে ‘ভালো’ তিলক জুটাইতে হলে ‘লড়াই’ দেখাইতেই হবে! আরে বাপ, ও-জিনিশ দেখানোর কিছু নয়। এমনিতেই দেখা যায়, জিনিশটা, থাকলে।

যে-সমস্ত লেখাপত্র গল্প/উপন্যাস হিশেবে বেরোয় বছর-বছর বইমেলায় গ্রন্থাকারে, কোথাও তো আমি আমাকে পাই না! আমার চেহারা, আমার রোজকার রাগ-রক্ত-ঈর্ষা-হিংসা-ঘৃণা-বিরংসা-বীরতা পাই না, পাই না আমার জেরবারদশা টানা ও পোড়েন। আমি আমার চেহারা আমার কাম আমার দ্বিধাদীর্ণ দিবাযাম কিংবা দাঁতে-দাঁত-চাপা দমনপীড়ন কোথাও তো দেখি না। যা দেখি, যা পাই, তা তো আমি চিনি না! যে-মানুষটা/মানুষগুলো, যে-চাল যে-চলন যে-সমাজচেহারা চলিতস্রোতের গল্পে-উপন্যাসে দেখি, তা তো আমার কাছ-থেকে-দেখা নয়! যিনি লিখছেন/দেখাচ্ছেন, তিনিও তো ওই জায়গার নন। তিনি, যিনি লিখছেন, রীতিমতো গবেষণাপ্রাপ্ত উপাত্ত-তথ্য থালায় সাজিয়ে লিখতে বসেন, সম্ভবত। অর্থাৎ, তিনি সোজা রাস্তাটাই নেন। পাঠকের অগম্য জায়গায় ভ্রমণ করিয়ে আনার মহৎ কাজ! রিস্ক কম, যেহেতু জায়গাটায় খুব-একটা কেউ যায়টায় না, যাচাই করে লেখকের ফাঁকি ধরে ফেলবে অমন ঝুঁকি অতএব প্রায় নাই। রিস্ক নাই, ইন্ রিপ্লাই যা আছে তার নাম গুচ্ছে-উপগুচ্ছে মিলে প্রশংসার আহা-উহু পিঠথাপড়ানি বিদূষকপনা। মানে গল্পকার বেঁচে যান, গল্প যায় মরে। লেখক তার নিজের শ্রেণিটাকে নিজের চেহারাটাকে যদি আঁকতেন, তখন আমার চেহারাখানা ঠিকই দেখতে পেতাম। ও-কাজ কম কঠিন নয়। কঠিন, ফলে ও-পথ মাড়াতে পারেন কম গল্পজ্ঞ।

বুদ্ধদেব বেশ চমৎকার এঁকেছেন আমার/চেনাজনের চেহারা/চারপাশ। এইসব ভাবছিলাম। আর ভাবছিলাম, ‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে’ শীর্ষক ইলিয়াসের প্রবন্ধটির সংযোজনী হিশেবে সম্প্রসারিত দ্বিতীয় একটা পাঠ লিখতে পারলে মন্দ হতো না।

লেখা / জাহেদ আহমদ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you