ঘরপোড়া বাউলের নিষ্পলক চোখ || উজ্জ্বল দাশ

ঘরপোড়া বাউলের নিষ্পলক চোখ || উজ্জ্বল দাশ

পুড়ে ছাই বাউলের ঘর। পুড়িয়া আংরা বাদ্যযন্ত্র, উস্তাদ মহাজনদের প্রতিকৃতি, ঘরের কড়িবর্গা আর আসবাব সমুদয়। বাউল রণেশ ঠাকুরের পুড়ে-যাওয়া গানের আসরঘর আর তার চারদশকের সযত্নলালিত স্বহস্তরচিত পদাবলির পাণ্ডুলিপিগুলো। অগ্নিনির্বাপিত ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে বাউল তাকিয়ে আছেন নিষ্পলক এই নির্মমতার দিকে। এই স্থিরচিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে ফ্যাকাশে বাংলাদেশে। এই ছবি দেখছি আমরা, আর আহা হায়-হায় করছি, সমবেদনার মন্তব্য ঝরাচ্ছি রাশি-রাশি, কিছু ক্রোধ কিছু প্রতিবাদও প্রকাশ করছি নিরাপদ তন্দ্রায় নিমজ্জিত হবার আগে। কেউই আমরা বাউলের নিষ্পলক চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারছি না।

রাতের অন্ধকারে কে বা কারা বাউলের সাধনগৃহে আগুন দিয়েছে। পুড়ে গেছে বেহালা, হার্মোনিয়াম, দোতারা। পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে বাউলের গানের খাতা। সারা দুনিয়ায় এসেছে ঘনিয়ে এমনিতেই মহাদুর্যোগ। দুইমাস হয়ে গেল বন্ধ দুনিয়াদারি। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এই অনিশ্চয়তার ভিতর সবকিছুই ঠিকঠাক হয়ে উঠবে একদিন হয়তো-বা, হাঁটতে শুরু করব আবার আমরা স্ট্র্যাটেজি পাল্টে নিয়ে কিছুটা, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে গানবাজনা। আর এর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতির আশঙ্কা প্রান্তিক বাউল ও লোকায়তিক চর্যার সাধকদের। এমনিতেই বাংলাদেশে এই মানুষগুলো দিন-কে-দিন কোণঠাসা, বায়না প্রায় বিরল হয়ে এসেছে, আর করোনার লকডাউনকালে তারা আরও নিরুপায় দিন কাটাচ্ছেন গান গেয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের ন্যুনতম ব্যবস্থাটা আর করা যাবে কি না এই আশঙ্কায়। এরই মধ্যে বাউলগৃহে আগুন। এরই মধ্যে বাউলের উপর জেলজুলুম। এরই মধ্যে বাউলের বিরুদ্ধে মামলামোকদ্দমা।

রাতের অন্ধকারে? হ্যাঁ, যা-কিছু রাতের অন্ধকারে সংঘটিত হয় তার বীজ দিনের আলোতেই প্রোথিত। প্রকাশ্য দিবালোকে আমরা যা-কিছু করছি বা যে-আচরণ প্রশ্রয় দিচ্ছি তারই নিট ফল বাউলের ভিটায় অনল। কে বা কারা? বাংলা ভাষায় কিছু বাগধারা আমাদেরে নিরন্তর গা বাঁচিয়ে চলতে আশকারা দ্যায়, ‘কে বা কারা’ আর ‘রাতের অন্ধকারে’ তেমনই দুই প্রাগৈতিহাসিক বাংলা বাগবিধি।

বিদেশবিভূঁইয়ে থাকি বলে এমনিতেই না-ঘর না-ঘাট অবস্থায় থাকি, এর মধ্যে দেশের দুর্ঘট-দুষ্কৃতির খবরগুলো গোচরে আরও মুষড়ে পড়ি। কি করব, কি করতে পারি, ভেবে পাই না কিছু। উদ্ভ্রান্ত লাগে। এতসব না ভেবে নাম্বার জোগাড় করে ফোন দিয়ে ফেলি ঘরপোড়া বাউল রণেশদাকে। অদ্ভুত নিরাসক্ত ও শূন্য গলায় কথা বলেন বাউল রণেশ ঠাকুর। দাদার সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি কথা বলি তার আরও কয়েকজন ঘনিষ্ট সংগীতানুরাগীর সঙ্গে। এখানে কেবল রণেশদার কথার সারসংক্ষেপ শোনাই আপনাদেরকে।

টেলিফোনিক কনভার্সেশনে দাদা আমায় বলেন, “বসতবাড়িতে আমি থাকি, খাইদাই, মরার মতো ঘুমাই। এইসবই তো করি। আর সবাই মিলে গানবাজনা করি। আমার আসরঘর দিয়েই আমি বাঁচি। আসরঘরটা আমার সাধনার জায়গা। কারো সাথে তো আমার বিরোধ নাই। আসরঘর পোড়ানোর সাথে সাথে আমার অনেককিছুই হারিয়ে গেছে। চিরতরে হারিয়েছি আমার লেখা গানের খাতাগুলারে। এখন, ঘটনার পর থেকে, অনেকে খোঁজ নিয়েছেন, নিচ্ছেন, পুলিশ তদন্ত করছে! জানি না কী হবে।”

‘সুনামগঞ্জের খবর’ লিখেছে, উজানধলের রবনী মোহন চক্রবর্তী কীর্তনীয়া ছিলেন। তার দুই ছেলে রুহী ঠাকুর ও রণেশ ঠাকুর বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের শিষ্য। স্বনামখ্যাত বাউল দুই ভাই-ই। উস্তাদ শাহ আবদুল করিম ও রণেশ ঠাকুরের বড়ভাই রুহী ঠাকুর লোকান্তরিত হবার পর ভাটি-অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে যে কয়জন বাউল জনপ্রিয়, তাদের মধ্যে একজন রণেশ ঠাকুর।

বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের বসতভিটার লাগোয়া রণেশ ঠাকুরের ভিটায় করোনাকালের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই বাউলগানের আসর বসতো। রণেশ ঠাকুরের বসতঘরের উল্টোদিকে তার বাউলচর্চার আসরঘর। ওখানেই তার নিজের ও শিষ্যগণের যন্ত্রপাতি থাকত।

রণেশ ঠাকুরের প্রায় চল্লিশ বছরের সাধনার সকল যন্ত্রপাতি, গানের বইপত্র পুড়ে ছাই হয়েছে।

রণেশ ঠাকুর বলেছেন, গ্রামের বা আশপাশের কারো সঙ্গেই তার কোনো শত্রুতা নাই। কারা যে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে তা তিনি বুঝতেই পারছেন না। দুর্বৃত্তরা আগুন ধরানোর সময় ঘরের অন্য অংশে থাকা দুটি ভেড়াকে ছেড়ে দেয়। ভেড়া দুটি অক্ষত রয়েছে।

দেশে-বিদেশে বাংলার সংগীতসংস্কৃতিপিপাসু অনেকে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন। শিল্পীর এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। সবাইকে এই নিবন্ধের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ধন্যবাদ জানাই। সেইসঙ্গে আপনারা কেউ কেউ রণেশদার সাথে কথা বলতে চাইলে ইনবক্সে জানাবেন, ফোননাম্বার দিয়ে দেবো। কয়েকজন প্রবাসী এরই মধ্যে শিল্পীর বিকাশনাম্বার চেয়েছিলেন। বেশ কয়েকজন রণেশভক্ত বলেছেন, সবাই মিলে বাউলের জন্য নতুন আসরঘর বানিয়ে দেয়া যায় না? যায়, নিশ্চয় যায়, চেষ্টা তো করা যায়। এবং কিছু করতে পারলে সেটি তো অনন্য ব্যাপার হবে। আমার ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে পাশে থাকব। আপনিও থাকুন যতটা পারা যায়।

আমরা বাউলের অমূল্য যন্ত্রগুলো, তার কয়েক দশকের স্মৃতির স্মারক, রণেশ ঠাকুরের পাণ্ডুলিপিস্থ অমূল্য পদাবলি ফিরিয়ে দিতে তো পারব না। ভালোবাসা নিয়ে বাউলের আসরঘর বানিয়ে দেয়া কঠিন হবে কেন? ফেসবুকে ফান্ড রেইজ করে আমরা দেশের বাইরে থেকে সহজেই শরিক হতে পারি।

কিন্তু ‘রাতের অন্ধকারে’ এবং ‘কে বা কারা’ — প্রাগৈতিহাসিক এই বাগধারাগুলো দিয়া আমরা ধামাচাপা দিয়া যাব কদ্দুর? কই যাব? কোন পথে চলেছি আমরা? রাষ্ট্র জবাব দেবে না, আমি নিরুত্তর, আপনিও তথৈবচ।

ঘরপোড়া বাউলের নিষ্পলক চক্ষুদ্বয় জেগে রয় আমৃত্যু।

… …

উজ্জ্বল দাশ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you