কিছু হুমায়ূন নিজে বানিয়েছেন, কিছু হুমায়ূনকাহিনি নিয়ে অন্যরা বানিয়েছেন এবং সম্প্রতি খোদ হুমায়ূন নিয়া বায়োপিকও হয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রথমটা আর হবে না, দ্বিতীয়টা আরও অনেকদিন হতে থাকবে এবং তৃতীয়টা মাত্র শুরু হয়েছে বানানো; বহু ভুজুংভাজুং গণপ্রচারণাগানে গগন ফাটিয়ে ‘ডুব’ নামে একটা বায়োম্যুভি রিলিজ হয়েছিল কিছুদিন আগে, হুমায়ূনজিন্দেগি নিয়ে ক্যামোফ্ল্যাজে/ছদ্মবেশে, ব্যাপারটা নিয়া পরিচালকসিন্ডিকেটের বহু গণমাধ্যমষণ্ডামির শেষে দেখা গেল হয়েছে একটা পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো অকাণ্ড। তবে এই ট্রেন্ড তো থামবে না মনে হয়, সেলিব্রেটি এই লেখককে নিয়া আরও জীবনীসিনেমা হবে নিশ্চয়। লেখকের কাহিনিগুলোর স্বত্ব খরিদ করে ফিল্ম তোলার কাজটাও চলতে থাকবে অনেকদিন আরও। শুধু হুমায়ূন নিজে আর ছবি বানাবেন না। ক্যামেরাভাষার কোনোই রিমার্কেবল চিহ্ন না রেখে এক্কেবারে নায়্যিভ সিম্পলিসিটি দিয়া বানানো ম্যুভি শুধু গল্পের টানে দেখতে বাধ্য করবেন না আর-কাউকেই। নিজের লেখাগুলোতে যেমন তিনি লিটারেরি ক্যারিশ্মার তোয়াক্কা না করে লিখে গেছেন, ম্যুভিগুলোতেও তেমনি ফিল্মল্যাঙ্গুয়েজের থোড়াই পরোয়া করেছেন। ১৯৪৮ সনের ১৩ নভেম্বর জন্ম-নেয়া কাহিনিকুমার হুমায়ূন আহমেদ ২০১২ সনের ১৯ জুলাই ইন্তেকাল করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ মোটমাট আটটা ছায়াছবি ডিরেকশন দিয়েছেন। অন্যরা তার অনুমতি নিয়া বা কেউ কেউ তার চিত্রনাট্য নিয়া বানিয়েছেন এমন ম্যুভির সংখ্যা হুমায়ূনের নিজের পরিচালিত ম্যুভিগুলোর দ্বিগুণ হবে এখন পর্যন্ত। হুমায়ূনপ্রস্থানের পরেও উনার উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে কাহিনিস্বত্ব খরিদ করে এরই মধ্যে একাধিক ম্যুভি বানিয়ে মার্কেটে রিলিজ করা হয়েছে, পাইপলাইনে আছে আরও গোটা-কয়েক, এই সিলসিলা চালু রইবে বাংলাদেশের সিনেমাজগতে ফ্রেশ ব্লাড আগমনের আগ পর্যন্ত। এই নিবন্ধে আমরা হুমায়ূনের নির্দেশিত ও পরিচালিত ছবিছায়াগুলোর একটা তালিকা পাবো, সঙ্গে কিছু খুচরা বার্তালাপ।
হুমায়ূন নিজে ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে এভার-ফার্স্ট যেই পিকচারটা তোলেন সেইটা ‘আগুনের পরশমণি’, রিলিজ পায় ১৯৯৪ সনে। এইটা ন্যাশন্যাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পায়। সেভেন্টিওয়ানের কন্টেক্সটে এইটা ভালো ও উজ্জ্বল একটা কাজ। অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, শীলা আহমেদ, আবুল হায়াত, ডলি জহুর এবং দিলারা জামান প্রমুখ। ছবিটা বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ম্যুভিদর্শকশ্রেণিটাকে প্রেক্ষাগৃহে টেনেছিল দুই দশকের সিনেমাহ্যলছিন্নতার পরে।
এরপরের কাজটা ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, যথাপূর্ব হুমায়ূনের কাহিনি ও ডিরেকশনে, প্রথম পরিচালনার সাফল্যের পরে ছয় বছরের একটা লম্বা গ্যাপ নিয়া কাহিনিচিত্রটা মার্কেটে মুখ দেখায় ২০০০ সনে। এবং সম্ভবত বহুদিন বাদে প্রেক্ষাগৃহগুলোতে উপচে-পড়া দর্শকঢলের পুরানা বাংলা ফ্রেইজের দেখা পাওয়া যায়। প্রেমের গল্পের সঙ্গে একটুখানি ইতিহাস আর বংশমর্যাদা ইত্যাদি মিশিয়ে গানে গানে ভরা একটা গ্রামনিসর্গপটভূমির সফল চিত্রায়ন। অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, মুক্তি, আনোয়ারা, গোলাম মুস্তাফা এবং সালেহ আহমেদ প্রমুখ। স্যুপারডুপার হিট হয়েছিল ছবির গানগুলো।
একই বছরে এই লেখক কাম্ ম্যুভিমেইকারের তৃতীয় ছবিটাও মুক্তি পায়। সেই ম্যুভিটা আগের দুইটার মতো অতটা না-টানলেও দর্শক দেখতে যায় প্রেক্ষাগৃহে ঠিকই, ‘দুই দুয়ারী’ সেই ম্যুভির নাম। শ্রেষ্ঠাংশে রিয়াজ, মেহের আফরোজ শাওন, মাহফুজ আহমেদ, মাসুদ আলী খান, নাসিমা খান, এজাজুল ইসলাম এবং অনেকে আরও। এই ম্যুভিতে অভিনয়ের জন্য বাংলাদেশের মূলধারা বাণিজ্যিক ছায়াছবি ইন্ডাস্ট্রির নায়ক রিয়াজ পয়লাবারের মতো বছরের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কারটা পান। ছবিগুলোর গানগুলোও জনপ্রিয় হয়েছিল। সাবিনা ইয়াসমিন এই ছবিতে প্লেব্যাকের জন্যে শ্রেষ্ঠ নারী-কণ্ঠশিল্পীর ন্যাশন্যাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত ‘চন্দ্রকথা’ ছায়াছবিটা ২০০০-অনোয়ার্ডস্ কোনো বছরে রিলিজ হয়। আসাদুজ্জামান নূর, মেহের আফরোজ শাওন, ফেরদৌস, আহমেদ রুবেল সহ অনেকেই সিনেমার চরিত্রগুলো রূপায়ণ করেন। খুব-একটা ভালো নির্মাণ বলা না-গেলেও হুমায়ূনের ধারায় হেলাফেলা আর হুড়োহুড়ির দাগ বহনকারী সিনেমাগুলোর মধ্যে এইটা আরেকটা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়া আরেকটা কাহিনিচিত্র হুমায়ূন তোলেন ‘শ্যামল ছায়া’ নামে। এইটা ২০০৫ সনে মুক্তি পায়। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একটা কাহিনির বিস্তৃতি সিনেমায় দেখানো হয়। ১১০ মিনিটের ফিচার ফিল্ম। অভিনয় করেন হুমায়ূন ফরিদী, তানিয়া আহমেদ, শিমুল, রিয়াজ, শাওন সহ অসংখ্য কলাকুশলী। কিন্তু ‘আগুনের পরশমণি’-র সেই ডিরেক্টরকে এইখানে সেভাবে পাওয়া যায় না।
‘শ্যামল ছায়া’ রিলিজের ঠিক দুইবছর পরে ২০০৭ সনে হুমায়ূনের আরেকটা ধুমধাড়াক্কা ফানি সিনেমা অপরিচ্ছন্নতার অজস্র দাগ গায়ে নিয়া বাইর হয় এবং দর্শকেরা বলা যায় বিরক্তিই বোধ করে। প্রয়াত অভিনয়শিল্পী দিতি, তানিয়া আহমেদ, ফারুক আহমেদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, আসাদুজ্জামান নূর সহ আরও অনেকেই অভিনয় করেছেন। উল্লেখ্য, ম্যুভিটা আগাগোড়া হুমায়ূনের নিজের ড্রিম ফিল্মভেন্যু নুহাশ পল্লিতে চিত্রায়িত।
এর পরের বছরে, ২০০৮ সনে, বেরোয় ‘আমার আছে জল’ ছবিটা। জাহিদ হাসান, ফেরদৌস আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, বিদ্যা সিনহা মিম প্রমুখ অভিনয় করেন। ‘চলো বৃষ্টিতে ভিজি’ এবং ‘আমার আছে জল’ গানদুইটা ছায়াছবিটিকে দেশজোড়া প্রেক্ষাগৃহে ব্যবসা দেয়। প্রেমের গল্প। বিয়োগান্তক ট্র্যাজেডি। মূল গানগুলোর গীতিকার পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ স্বয়ং।
হুমায়ূনের পরিচালনায় শেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। ছায়াছবিটি রিলিজ পায় হুমায়ূনপ্রয়াণের দুইমাসের মাথায়। নানা কারণেই ম্যুভিটা আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। এই নিবন্ধে তেমন আলাপ বাড়ানো যাবে না, যারা অভিনয় করেছেন তাদের নামগুলো উল্লেখ করে রাখি। তারিক আনাম খান, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মুনমুন আহমেদ, তমালিকা কর্মকার, প্রাণ রায় প্রমুখের অভিনয়ে ফিচার ফিল্মটা স্মরণীয় হয়ে আছে। নেত্রকোনা অঞ্চলের হাওর মূর্ত হয়ে রয়েছে এই সিনেমায়। গানবাজনা ঘিরেই সিনেমার কাহিনি। একটা গাতক দল ঘিরেই কাহিনি আবর্তিত। সেই গাতক দলের একটা আন্ডারএইজেড কিশোর এবং তার সেকশুয়্যল এক্সপ্লোয়েটেশন। এতদঞ্চলের একদা সাংস্কৃতিক কিছু অজাচার আর পানিঘেরা গ্রামজীবনের দৈনন্দিন ক্রীড়া আর ক্রাইসিস সিনেমায় ভালোভাবেই এসেছে।
এ গেল হুমায়ূনের নিজের বানানো দুইহালি সিনেমার ব্রিফ হিস্ট্রি। এর বাইরে হুমায়ূনের গল্প/উপন্যাস ভেঙে এখন পর্যন্ত যে-সিনেমাগুলো হয়েছে, সেগুলোর কয়েকটা নামোল্লেখ পর্যন্ত করে রেখে ক্ষান্ত দিচ্ছি।
হুমায়ূনের সর্বপ্রথম প্রকাশিত দুই উপন্যাসের দুইটাই সিনেমায় চিত্রায়িত হয়েছে। একটা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এবং ‘নন্দিত নরকে’ অন্যটা। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ বানিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান, মুক্তি পায় ১৯৯২ সনে। ‘নন্দিত নরকে’ সিনেমারূপ পায় ২০০৬ সনে এসে, এইটা বানিয়েছেন বেলাল আহমেদ। একই বছরে ‘দূরত্ব’ বানিয়েছেন মোরশেদুল ইসলাম। ২০০৬ সনেই আবু সাইয়িদ বানিয়েছেন নিরন্তর। এর পরের বছর ২০০৭ সনে বেরোয় ‘দারুচিনি দ্বীপ’ এবং ‘সাজঘর’; প্রথমটার পরিচালক তৌকির আহমেদ এবং পরেরটার শাহ আলম কিরণ। ‘দূরত্ব’ বানিয়েছিলেন যিনি আগে, একই পরিচালক ২০০৯ সনে আবারও হুমায়ূনকাহিনি নিয়া আরেকটা ম্যুভি করেন ‘প্রিয়তমেষু’ নামে। এছাড়া কিছুদিন আগে মেহের আফরোজ শাওন বানিয়েছেন ‘কৃষ্ণপক্ষ’। সম্প্রতি ‘দেবী’ শীর্ষক আরেকটা সিনেমায় রিলিজের প্রহর গুনছে খবর পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনকারী : বিদিতা গোমেজ
… …
- শৈলিন উডলির কথাগুলি (৭) - August 11, 2019
- কেইটের কথাবাত্রা (১০) - July 25, 2019
- টিল্ডা টোল্ড (২) - May 12, 2019
COMMENTS