কার্টুনিস্ট কিশোররে চিনেন না কিন্তু বাংলাদেশে দুই-চার বছর কার্টুন আঁকেন এমন কাউরে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। চিনুক বা না চিনুক, দেশে যখন একজন কার্টুনিস্টরে কার্টুন আঁকার জন্য গ্রেফতার করা হইল এইটা নিয়ে কথা বলা, প্রতিবাদ করা তার জন্য ফরজ। এইটা তার নেশা/পেশার স্বার্থেই সে করবে, করা উচিৎ।
একটু মনে করে বলেন তো আপনারা গত ১০ মাসে বাংলাদেশের কার্টুনিস্ট কমিউনিটির কাছ থেকে স্পেসিফিক্যালি কিশোরের জন্য কোনো প্রতিবাদ দেখছেন? কিশোরের মুক্তির কোনো দাবি কি তুলছিল তারা? আমি অন্তত দেখি নাই। কেউ দেখলে আমার সাথে একটু শেয়ার কইরেন তো! বরং দেখছি দেশের বাইরের কার্টুনিস্টরা কিশোরের মুক্তির দাবি করছে, তারা কিশোরভাইয়ের জন্য কার্টুন আঁকছে।
দেশি কার্টুনিস্টদের এই নীরব থাকা দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশের কার্টুনিস্ট কমিউনিটির বড় অংশের সাথেই ঠোঁটকাটা কিশোরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব-একটা ভালো ছিল না। কিশোর প্রায় সবাইকেই কোনো না কোনো সময় তাদের কাজ, কর্ম, ধান্দা নিয়ে দুই কথা শুনায়ে দিছেন। অবশ্য উনি যে-রকম লোক তাতে মনেও হয় না রাখঢাক করে পিঠ পিছে কিছু বলছেন, বললে মুখের উপরেই বলে থাকবেন। আর এজন্যই তারা কিশোরের উপর বিলা হইছেন।
আরেকটা কারণ মনে হয় কার্টুনিস্টরা এখন আর সরকাররে ঘাটাইতে চান না। মিডিয়ার আকালের দিনে রুটি-রুজি রক্ষার ব্যাপার আছে, সরকারি অনেক প্রজেক্টে এখন কাজটাজ পাওয়া যায়। এগুলোর জন্য সরকারের সাথে সদ্ভাব থাকা লাগে। কিশোরের মতন বোকা ছাড়া আর কে-ইবা এসব পায়ে ঠেলবে?
আবার ধরেন কিশোরকে ঝি বানিয়ে বউকে শিক্ষা দেবারও একটা ব্যাপার হইছে। মানে কার্টুন আঁকলে কি পরিণতি হতে পারে এটার একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ তৈরি করে সামনে রাখা হইছে বাংলাদেশের কার্টুনিস্ট কমিউনিটির।
তবে দেশের বাইরে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা এবং একসময়ে নিপীড়নের শিকার হওয়া কার্টুনিস্টও এই নীরব থাকার দলে ছিলেন। নাম নিয়েই বলি, কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমান। উনি এখন নেদারল্যান্ডে থাকেন, অনেক বড় অ্যাক্টিভিস্ট হইছেন, ফেসবুকে দেখি। ২০০৮-’০৯ সালে আরিফুর রহমান যখন কাঠমোল্লা আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌথ প্রযোজনার দাবড়ে জান নিয়ে দৌড়ের উপর, সেই প্রচণ্ড দুঃসময়ে কিশোরভাই কার্টুনিস্ট আরিফের জন্য ব্যক্তিগতভাবে কি করছে সেইটা আরিফ আর তার আল্লাহই ভালো জানে, আমি এইটা নিয়ে কিছু বলব না। কিন্তু কিশোরভাইরে গ্রেফতার করার পর থেকে আটক থাকার এই ১০ মাসের পুরাটা সময় আরিফ যেভাবে মুখ ঘুরায়ে অন্যদিকে ফিরে থাকল এইটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। মানুষ চিনতে হয় বিপদের দিনে। আরিফরে চিনলাম, এই চেনাটা খুব দরকার ছিল।
সাংবাদিক কাজল যখন গুম হইলেন (গুম কারণ তখনও আমরা জানতাম না উনি ফিরবেন নাকি ফিরবেন না) আপনাদের মনে আছে কি না জানি না, সাংবাদিক কমিউনিটির অনেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিবাদ করা শুরু করলেন। যারা উনারে হয়তো ভালো করে চিনেও না, কিন্তু একই পেশার মানুষ, না-হলে একই টঙদোকানে দাঁড়ায়ে চা খাইছেন, এমন লোকজনও আগায়ে আসছিলেন প্রতিবাদ করতে। কিছু না-হইলেও অন্তত নিজের ফেসবুক প্রোফাইলের ছবিটা বদলায়ে “কাজল কোথায়?” এই লেখাটা ঝুলাইছিলেন। সাংবাদিকরা তাদের কমিউনিটির জন্য তখন আওয়াজ তুলছিলেন বলেই কিন্তু গুম-হওয়া কাজলরে ম্যালা নাটকের মধ্য দিয়ে হলেও ফেরত দিতে বাধ্য হইল সরকার। তিনি গুম থেকে প্রকাশ্যে আসলেন শেষ পর্যন্ত। যদিও তারপরে তিনি জেলে ছিলেন ম্যালাদিন। তখনও তার মুক্তির জন্য সাংবাদিকরা শহিদমিনারে দাঁড়াইছেন, বিষয়টা নিয়ে লেখালেখি করছেন। অন্তত জানার চেষ্টা করছিলেন কার লেজে পাড়া দিলেন বলে কাজলকে এমন অজ্ঞাতবাসে যাইতে হলো।
এইটা হচ্ছে কমিউনিটি রেসপন্স। আপনি একটা কমিউনিটিতে বিলং করেন বলে সেই কমিউনিটির কাউরে আপনি ওন করবেন, সে যদি আপনার খুব পরিচিত না-ও হয় তারপরও। এইটা মানুষের চিরন্তন অভ্যাস, মানুষ মূলত গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, তারপর সামাজিক প্রাণী।
আপনি কাউরে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না করতেই পারেন। কিন্তু তার সাথেও যদি কেউ অন্যায় করে আপনি তার প্রতিবাদ করবেন। করবেন আপনার কমিউনিটির স্বার্থে, করবেন আপনার স্বার্থে। কেননা আপনি যখন অন্যের উপর হওয়া অন্যায়টা দেখেও না-দেখার ভান করবেন তখন আপনি আসলে নিজের জন্যই একই গর্ত খুঁড়বেন।
আপনি ভাবতেছেন সরকারি কাজ করেন, দুই-চারটা সরকারি দপ্তরে যাতায়াত আছে বলে আপনি সেইফ? স্বার্থে আঘাত লাগলে এই জুলুমবাজ সরকার কারে কখন কিজন্য ধরবে তার কোনো মা-বাপ নাই। কাজেই একজন আরেকজনের পাশে থাকেন। দিনশেষে আমাদের আমরা ছাড়া আর কেউ নাই।
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক কারাগারে নিহত লেখক মুশতাক আহমেদ (ডানে) এবং মুশতাকখুনের পর গণচাপে ছয়মাসের জামিনে বেরোনো কার্টুনিস্ট কিশোর (বাঁয়ে)
… …
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
- মাসুম পারভেজ : কবি, কাব্যগ্রন্থহীন || সরোজ মোস্তফা - February 7, 2025
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
COMMENTS