কেইট ব্ল্যাঞ্চেট

কেইট ব্ল্যাঞ্চেট

শেখর কাপুর মহাবিপদে পড়ে গিয়েছিলেন, — শ্যুটিঙের যাবতীয় সবকিছু ঠিকঠাক, অথচ এলিজাবেথ চরিত্রের জন্য কাউকে পাচ্ছেন না। চেয়েছিলেন এমিলি ওয়াটসনকে, কিন্তু তিনি তখন ‘জ্যাকি অ্যান্ড হিলারি’ ছবির জন্য চুক্তিবদ্ধ। ওদিকে পাঁচমাস পার হয়ে গেছে। ‘এলিজাবেথ’-এর কাস্টিং-ডিরেক্টর ভেনেসা পেরেইরা বারবার শেখরকে অনুরোধ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান একদল অভিনেত্রীকে দেখার জন্য, শেখর কাপুর পাত্তাই দেননি। অবশেষে একদিন ‘অস্কার অ্যান্ড ল্যুসিন্ডা’ ছবির একটা প্রোমোশন্যাল রিল দেখতে গিয়ে পেয়ে গেলেন এলিজাবেথ কেইট ব্ল্যাঞ্চেটকে (Cate Blanchett)। কেইট অস্ট্রেলীয় জেনে ধরলেন পেরেইরাকে। এর কথা তাকে জানানো হয়নি কেন? উত্তরে পেরেইরা বললেন, — আপনি কি ভেবেছিলেন আমি অন্য কারো কথা বলেছিলাম?

cate blanchett‘অস্কার অ্যান্ড ল্যুসিন্ডা’ ছবিতে ল্যুসিন্ডার (কেইট ব্ল্যাঞ্চেট) নদীতে সাঁতার কাটার দৃশ্যটি শেখর দেখেছিলেন। ল্যুসিন্ডা চিৎ হয়ে সাঁতার কাটছে, শুধু তার মুখখানি দেখা যাচ্ছে। শুধুই একটা মুখ, বর্ণনা দেয়া কঠিন যতক্ষণ আপনি না দেখছেন। “ওই শটটিতে ছিল একটা স্বর্গীয় ভাব। এলিজাবেথকে আমি সেভাবেই ভাবি। একটা অন্যরকম আগুনও ছিল ওর চোখে” — মুগ্ধ হয়ে বলেন শেখর কাপুর।

কেইট কি সবসময় অভিনয়ই করতে চেয়েছেন? কখনোই না। তার খায়েশ ছিল আরেকটু উঁচু। সাত বছর বয়সেই পরিচালক হবার চিন্তা করতে থাকেন। তার জন্ম, তার বড় হওয়া সবই মেলবোর্নে। বাবা আমেরিকান নেভি অফিসার, আর মা স্কুলটিচার। কেইটের দশ বছর বয়সে বাবা মারা যান। বড়ভাই বব কাজ করেন কম্পিউটার নিয়ে, আর ছোটবোন জেনেভিয়েভ সিডনিতে সেট-ডিজাইনার। ও হ্যাঁ, আর আছে তাদের কুকুর স্নুপি।

ছোট বয়সে ভীষণ স্কুল ও পড়াশোনা ভালোবাসতেন। স্কুলটাও ছিল বিরাট, ২০০০ মেয়ে সেখানে পড়ত। তার বন্ধু তেমন-একটা ছিল না। স্কুলের নাটকে অংশ নিয়েছিলেন আর যোগ দিয়েছিলেন টেনিস টিমে। মেলবোর্ন য়্যুনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে অর্থনীতি ও ফাইন আর্টস নিয়ে পড়া শুরু করলেন। চতুর্থ বর্ষে পড়ার কথা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। কিন্তু তিনি তখনই অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সারা ড্যানিয়েলস-এ নাটক বায়্যার থ্রাইট-এর একটা য়্যুনিভার্সিটিপ্রোডাকশনে কাজ করার সময় একজন সহকর্মী প্রশ্ন করেন, তিনি কেন নাটক নিয়ে পড়ছেন না? মেয়েটা তাকে এটাও জানায় যে সে ব্ল্যাঞ্চেটকে ঠিক পছন্দ করে না। মেয়েটার সততায় ব্ল্যাঞ্চেট এক-রকম খুশিই হন। য়্যুনিভার্সিটির পড়ায় ইস্তফা দিয়ে ভর্তি হয়ে যান ন্যাশন্যাল ইন্সটিট্যুট অফ ড্রামাটিক আর্টে।

cate blanchettভর্তি হয়েই-যে অভিনয় করার কথা ভাবছিলেন তা কিন্তু নয়। বরং তখনো ভাবছেন একদিন ফিরে যাবেন। ফিরে স্থাপত্য বা অন্যকিছু করবেন। এরপরেই ‘ইলেক্ট্রা’ নাটকের সেই বিশাল ব্রেইক। ব্ল্যাঞ্চেটের জন্য ব্যাপারটা এখনও বিব্রতকর। রোলটা অন্য একটা মেয়ের করার কথা ছিল। মেয়েটা না-থাকায় তাকে করতে হয়। স্টেজে ওঠার ক্ষেত্রে যে-ভয় অনেকের থাকে সেটার জন্য পর্যন্ত কেইট সময় পাননি। মোট কথা, একটা হুলুস্থুলের মধ্যে ‘ইলেক্ট্রা’-তে কাজ করলেন।

অস্কারবিজয়ী আরেক অস্ট্রেলীয় অভিনেতা জেফ্রি রাশ ওই সময়টার কথা বেশ মনে করতে পারেন। কারণ ওই সময় পরিচালক লিন্ডি ডেইভিস ও তিনি একই বাড়িতে থাকতেন। ডেইভিস প্রতিদিন এসে জানাতেন যে, কী দারুণ একটা মেয়ে প্রোডাকশনে কাজ করছে! সে-সময় থেকেই ব্ল্যাঞ্চেটের নাম সবার মুখে মুখে শোনা যাচ্ছিল।

গ্র্যাজুয়েশনের মাস-ছয়েক পরে জেফ্রি রাশ ও কেইট ব্ল্যাঞ্চেট একসাথে কাজ করলেন সিডনি থিয়েটার কোম্প্যানির হয়ে। ডেইভিড মায়েটের জেন্ডার পোলিটিক্সের ওপর লেখা বিতর্কিত নাটক ‘ওলিয়ানা’-য় কেইট-জেফ্রি জুটি বাঁধলেন। নাটকে একটা দৃশ্য আছে এমন যে, রাশ কেইটকে আঘাত করবেন। রিহার্সেলে ব্ল্যাঞ্চেটকে হাসতে দেখে পরিচালক বকা দিলেন, উপদেশ দিলেন রাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে। নাটকটা হিট করেছিল, চলেছিল সিজনের পর সিজন।

জিলিয়ান আর্মস্ট্রং কেইট ও রেফ ফাইন্সকে ‘অস্কার অ্যান্ড ল্যুসিন্ডা’ ছবিতে নিয়েছিলেন বহু আগে। ফাইন্স তখনও ‘ইংলিশ প্যাশেন্ট’-এর সুবাদে বিখ্যাত হননি; আর ব্ল্যাঞ্চেট তো তখনও একেবারেই অপরিচিত। এখন অবশ্য দুইজনেই বিখ্যাত। নিজের সাথে ল্যুসিন্ডার কিছুটা মিল খুঁজে পান কেইট। অন্যান্য নায়িকার মতো তিনি দেখতে খুব-একটা ভালো না — সেটা অকপটে স্বীকার করেন। বোথো স্ট্রাসের নাটক ‘বিগ অ্যান্ড লিটল’-এ একজন মহিলার বর্ণনা আছে যে খুব বুড়োও না আবার জোয়ানও না। ব্ল্যাঞ্চেট মনে করেন, তিনিও খুব কুৎসিতও না আবার সুন্দরীও না, শুধু একজন মহিলা।

cate blanchett

শেখর কাপুর ব্ল্যাঞ্চেটের চেহারার সার্টিফিকেট দিতে গিয়ে বলেছেন, — ও একই সাথে আকর্ষণীয় ও অনাকর্ষণীয় হতে পারে, মনের ভাব চেহারায় প্রকাশ করতে পারে। এটা অনেকেরই ক্ষমতার বাইরে। জিলিয়ান আর্মস্ট্রং শেখরের কথাটায় সায় দিয়েছেন; বলেছেন, — ও এ-ব্যাপারে বিশ্বচ্যাম্পিয়ান। বুদ্ধিমতি, নিজের পছন্দ-অপছন্দ বাছাবাছির ব্যাপারে কুশলী।

(Cate Blanchett) কেইট ব্ল্যাচেট নিয়ে কথা বলতে গেলে যে-মানুষটার কথা ঘুরেফিরে আসে তার নাম অ্যান্ড্রু আপ্টন। পেশায় চিত্রনাট্যকার অ্যান্ড্রু, তবে এডিটিঙের কাজও করেন। অ্যান্ড্রুর এডিট-করা কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যুভি ‘পিগ ইন দ্য সিটি’। ১৯৯৭ সালে তাদের পরিচয়। ওই সময় ব্ল্যাঞ্চেট চেখভের ‘সিগাল’ নাটকে নিনার চরিত্রে কাজ করছিলেন। প্রথম দর্শনে একে অপরকে একেবারেই পছন্দ করেননি। আপ্টন তাকে বেখেয়ালি ভেবেছিলেন, আর ব্ল্যাঞ্চেট ভেবেছিলেন অভদ্র। পরে দুজনেই ভুল বুঝতে পারেন। সিডনিতে একটা ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করেন তারা।

Cate Blanchet

বই পড়তে কেইট খুব ভালোবাসেন। নাচও তার পছন্দ। প্রিয় নাটক ‘হ্যামলেট’। ব্ল্যাঞ্চেটের মতে, কেবল নাটকের প্লটের ওপর জোর দিতে গিয়ে এর বহু প্রোডাকশন ফেল মেরেছে। স্টেজে ওফেলিয়া আর মিরান্ডার মতো অনেক রোলই করেছেন ব্ল্যাঞ্চেট এবং করছেন। অস্কার ওয়াইল্ডের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘অ্যান আইডিয়াল হাজব্যান্ড’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য নব্বইয়ের দশকের শেষে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন কেইট ব্ল্যাঞ্চেট। ‘এলিজাবেথ’-এর জন্য গোল্ডেন গ্লোব পেয়েছেন কাছাকাছি সময়েই।

লেখা : অদিতি কবির
সূত্র : চতুর্থ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা আনন্দভুবন ১৯৯৯ ঢাকা
গানপার কর্তৃক সংক্ষেপিত ও ঈষৎ সম্পাদিত

… …

পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you