১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম ওয়াইলার নির্দেশিত ‘বেনহার’ জিতে নিয়েছিল ১১টা অস্কার। সে-সময় ওটাই ছিল সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করে বানানো সিনেমা। হিটও হয়েছিল ওটা; আর নায়ক চার্লটন হেস্টন এবং নায়িকা হায়া হারায়িট হয়েছিলেন তুমুল জনপ্রিয়।
পুরোটাই মিলে যাবে বেনহারের সঙ্গে আরেকটা সিনেমা; — কাহিনিগত মিল নয়, রিলিজের পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনাঘটনের মিল; — ‘টাইট্যানিক’ এই সিনেমার নাম, বেনহারের প্রায় চার-চারটা দশকের বাদে এইটা বানানো। ম্যুভিদ্বয়ের বাজেট থেকে শুরু করে অস্কারপ্রাপ্তি পর্যন্ত অনেক দিক থেকেই মিল পাওয়া যায়, কেবল একটা ব্যাপার ছাড়া — ‘টাইট্যানিক’ ছায়াছবিটিতে জ্যাক ডসন চরিত্রে এত চমৎকার অভিনয় করেও অস্কার তো দূরের কথা, নমিনেশন পর্যন্ত পাননি সিনেমাটির নায়ক লেয়োনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়ো (Leonardo DiCaprio)।
ওই সময়ে, সেই নাইন্টিসের শেষদিকটায়, অ্যামেরিকা ছাড়াও বহু জায়গায় ডিক্যাপ্রিয়োর অস্কারবঞ্চনা নিয়া মানুষজন কথা বলেছেন আফসোস-আক্ষেপ করেছেন। বাংলাদেশেও হৈহৈ হয়েছে বেশ। যদিও ‘টাইট্যানিক’-পরিচালক জেমস ক্যামেরনের মতে ক্যাপ্রিয়োর ওই-সময় অস্কার না-পাওয়াটা ঠিকই আছে। ক্যামেরন মনে করেছিলেন, অতিরিক্ত প্রশংসা ছেলেটার মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। এছাড়া ক্যামেরনের ধারণা যে ছেলেটা আদ্যোপান্ত অভিনেতাই হতে চায়, — ক্যাপ্রিয়ো-অভিনীত চরিত্র নির্বাচনে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
লেয়োনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়োকে প্রথম দেখা যায় ‘দিজ্ বয়েজ্ লাইফ’ সিনেমায় একটা চরিত্রে। অভিনেতা হিশেবে দ্রুত পরিচিতি পেয়ে যান ‘হোয়াট ইজ্ ইটিং গিলবার্টস্ গ্রেইপ’ ছবির জন্য অস্কার নমিনেশন পেয়ে। এই সিনেমায় ওইটুকু পুঁচকে ছেলের অভিনয় অনেকের চোখ কপালে তুলে দিয়েছিল। ছবিতে তিনি ছিলেন একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। তার সাথে এইটায় আরও ছিলেন হলিউডের আরেক স্যুইটহার্ট জনি ডেপ। সবসময় লেয়োনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়ো ম্যুভিতে অভিনয়কালে নিজের অভিনয়দক্ষতা বাড়ানোর জন্য স্টারকাস্ট না-দেখে চরিত্র দেখে বেছে নিয়েছেন কাজের যোগ্য ছবি।
ঠিক সেই কারণেই সিনেমা ফ্লপ করেছে একাধিকবার, কিন্তু লেয়োনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়োর অভিনয় অ্যাক্লেইম কুড়িয়েছে ক্রিটিকের স্পেক্টেটরের। অভিনয়লোভেই ১৯৯৫ সালের বিশাল ফ্লপ ছবি ‘টোট্যাল এক্লিপ্স’-এ কবির ভূমিকায় কাজ করেছেন। ওটাতেও ক্যাপ্রিয়োর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। আর ‘দ্য বাস্কেটবল ডায়রি’ সিনেমাটা তো এতই বাজে ছিল যে ওটার কথা আজ কেউ মনেই রাখে নাই।
ডিক্যাপ্রিয়ো গোটা পৃথিবীর ম্যুভিইটারদের চোখের মণি হয়ে ওঠেন ‘রোমিয়ো+জুলিয়েট’ ছবিতে অভিনয় করে। ‘স্ট্রিক্টলি বলরুম’ ছবিটাই রোমিয়ো-র আগে আলোচিত ছবি ছিল পরিচালক বাজ্ ল্যুর্ম্যানের। শেইক্সপিয়্যরের মহান সৃষ্টির আধুনিকায়ন ফ্লপ হবে ভেবে অনেকেই নাক সিঁটকেছিল। ছবি স্যুপারহিট হবার সাথে সাথে একনামে ল্যুর্ম্যানকে সবাই চিনে ওঠে। “ইট ইজ্ দ্য ইস্ট, অ্যান্ড জুলিয়েট ইজ্ দ্য সান”-এর মতো অমর প্রেমের বাণী ডিক্যাপ্রিয়োর মুখে শুনে কোটি কোটি মেয়ে প্রেমে পড়ে যায় প্রেমিক রোমিয়োরূপে ক্যাপ্রিয়োর। জুলিয়েটরূপে যে-অভিনয়শিল্পী ছিলেন ম্যুভিটিতে, সেই ক্লেয়ার ডেন্স বলেছিলেন, — “শেইক্সপিয়্যর সম্ভবত ওর মতো কাউকে মাথায় রেখেই চরিত্রটা লিখেছিলেন।”
১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রথম সমুদ্রযাত্রাতেই নোভা-স্কশিয়া উপকূলের কাছে আইসবার্গের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় তথাকথিত আনসিঙ্কেবল টাইট্যানিক জাহাজ। গেল শতাব্দীর অন্যতম দুঃখজনক এই ট্র্যাজেডিটা অবলম্বন করে ১৯৫৩ সালে একটা সিনেমা হয়েছিল। অত সফল হয়নি সেই সিনেমাটা। তারপরে শতাব্দীপ্রান্তে এসে — নব্বইয়ের শেষপাদে — ‘দ্য অ্যাবিস্’, ‘ট্রু লাইজ্’ ‘টার্মিনেটর’ প্রভৃতি সিনেমার পরিচালক জেমস ক্যামেরন টাইট্যানিকট্র্যাজেডি নিয়া কাহিনিচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। ২০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ছবিটি নির্মিত হয়।
ক্যামেরনের ‘টাইট্যানিক’ যদিও রোজ্ নামের একজন নারীকে কেন্দ্র করে, এর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে রোজেরই জবানি দিয়ে, এরপরও আলোচনায় জ্যাক ডসন চরিত্রে লেয়োনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়োর কথা এসেই পড়ে। প্রথম থেকেই পরিচালকের পছন্দ ছিলেন তিনি। তার চরিত্রটা এক ইমিগ্র্যান্ট যুবকের। জাহাজে উঠে জ্যাকরূপী ডিক্যাপ্রিয়ো ধনী বিলি জেনের বাগদত্তা রোজরূপী কেইট উইন্সলেটের প্রেমে পড়ে। ‘রোমিয়ো+জুলিয়েট’-এর বিপরীতে এই ম্যুভির শেষে তিনি প্রেমিকার কোলে মাথা রেখে মারা যান।
ছবিটিতে জ্যাকের তথা ক্যাপ্রিয়োর মৃত্যুদৃশ্য দেখে অসংখ্য দর্শক চোখ মুছতে মুছতে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়েছেন। যদিও লেয়োনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়ো পরিচালকের কাছে চেয়েছিলেন চরিত্রটাতে একটু মন্দের মিশ্রণও দিতে। ক্যামেরন সেই প্রস্তাবে রাজি না-হয়ে বলেন, “সেইটা কি করে হয়? তোমার ভালোত্ব-যে মেয়েটার জীবনে আলো এনে দেবে এবং পরিবর্তন আনবে।” লেয়োনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়ো পরে স্টার টিভির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, — শুধু অভিনয় নয়, পুরো টাইট্যানিক টিমের সদস্য হয়ে আনন্দ পেয়েছেন প্রচুর। বলেছেন, এমন আনন্দ আর কখনও পাননি।
ঠিক যে ক্যামেরন ওই-সময় ক্যাপ্রিয়োর চরিত্রে মন্দ মেশাতে রাজি হন নাই, কিন্তু শয়তান চরিত্রেও অবশেষে তিনি অভিনয়ের সুযোগ পান অচিরেই। আলেকজান্দার দ্যুমার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিতে ক্যাপ্রিয়ো প্রথম শয়তান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ, পরে তো মন্দমেশা আরও অনেক ম্যুভিতে একের পর এক দুর্ধর্ষ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। ‘ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক’ ম্যুভিতে ক্যাপ্রিয়ো দুষ্ট রাজা চতুর্দশ ল্যুই এবং ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। সিনেমায় তার সাথে আরও রয়েছেন জেরেমি আয়রন্স, জেরার্দ দেপার্দ্যু ও গ্যাব্রিয়েল বায়ার্ন। দর্শকও হু হু করে গেছে সেই সিনেমা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে। এই সিনেমায় ক্যাপ্রিয়ো ১৭শ’ শতকের অদ্ভুত পোশাক পরা সত্ত্বেও দর্শক তাকে নিয়েছে, গ্রহণ করেছে, ভালোবেসেছে।
ব্যক্তিগত জীবনে ক্যাপ্রিয়ো একটু অন্য রকমের। অবসরদিনের অনেকটা সময় তার কেটে যায় কবিতা লিখে। প্রেমিক হিশেবে দারুণ মজার মানুষ তিনি। বলেন, “আমি যখন কোনো মেয়ের সাথে একা থাকব, তখন বাচ্চাদের মতো কথা বলব আর টেডি বিয়ারের মতো আদর করব।”
মেয়েরা ক্যাপ্রিয়োকে এত পছন্দ করে কেন, অনেকের কাছে ব্যাপারটা এক রহস্য। ‘বডি প্রোজেক্ট : অ্যান্ ইন্টিমেইট হিস্ট্রি অফ অ্যামেরিক্যান গার্লস্’ বইয়ের লেখক জোয়ান ব্রুমবার্গ একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “মেয়েদের মধ্যে সবসময়ই মেয়েলি দেখতে ছেলেদের পছন্দ করার ঝোঁক থাকে। মডার্ন মিডিয়ার আগে উনবিংশ শতাব্দীতেও লর্ড বায়রনের ক্ষেত্রে এটা দেখা গেছে।”
লেয়োনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়ো গত একদশকে যে-পরিমাণ প্রেস্টিজিয়াস প্রোজেক্টে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, নৈপুণ্যের যে-বাহার দেখিয়েছেন প্রায় ব্যর্থতাহীন, অস্কারও অর্জন করেছেন অবশেষে, সেসব গল্প এই প্রতিবেদনের বাইরেই রয়ে গেল অবশ্য।
লেখা : অদিতি কবির
সূত্র : তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা আনন্দভুবন ১৯৯৮ ঢাকা
গানপার কর্তৃক সংক্ষেপিত ও অনেকাংশ সম্পাদিত
… …
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS