স্বপ্নের নৌকা
উঁচু আর চওড়া বারান্দায় খেজুরপাতার চাটাই বিছিয়ে খানার ব্যবস্থা। হাত-পা ধুয়ে সবাই ধীরেসুস্থে প্লেট সামনে নিয়ে বসেছে। নবী শেখের ডানে আঙ্কুর বাঁয়ে বিকাশ। সে থমথমে চেহারার মানু মিয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে একটু হাসে কিন্তু সরাসরি বলে, — কী কও কর্তা, শুরু করা যায়?
নবী শেখের ডাকে ইঁদারার পানিতে ঢিল মারার মতো মানু মিয়া ভেতরে-বাইরে আলোড়িত হয়। তাকে এখনো ঘাটুদলের সকলেই তমিজ করছে দেখে মনে উত্তেজনা আসে। আমোদ লাগে। জায়গা ছেড়ে দেওয়া সহজ। তাবাদে তুমি কতটা জায়গা ছাড়বা? বাতর ঠিক না রেখে যদি তুমি বছর বছর পিছিয়ে আসো, তাহালে দেখবা তোমার পাশের জমিনের চাষাটা বাতর ঠেলে ঠেলে তোমার বুকে চলে এসেছে। তাই ঠেলা শুধু সইলে হবে না। তোমাকেও ঠেলতে হবে। মানুর বিচারে এই ঠেলাঠেলি চালু রাখাটাই বেঁচে থাকা। নবী শেখের কথায় অন্ধকার অকাশ থেকে খসে পড়া তারার মতো মানু মিয়ার মুখটা ঝলক দিয়ে ওঠে, — জে, অবশ্যি অবশ্যি।
মানু মিয়া ফের নিজের মাঝে ডুব দেয়। তার বাপের অসহায় মুখটা মনে পড়ে। মানু মিয়ার কোনো ভাই ছিল না। পাঁচটা বোনের পরে সে দুনিয়াতে এসেছিল। তাই তার বাপের পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ ছিল না। বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক মানুষটাকে আশপাশের সবাই সমীহ করলেও মড়লদের বুকে সবসময় জ্বলত হিংসার চিতা। তাই একটু সুযোগ পেলেই তারা গায়েপড়ে ঝগড়া লাগাত। অশ্লীল গালিগালাজের তুবড়ি ছুটিয়ে সবক’টা লাঠি নিয়ে ছুটে আসত।
মড়লদের দাপটে লোকটা কেঁচোর মতো একটা জীবন কাটিয়ে গেছে। মানু তখন দশ বছরের বালক। সেই সময় মড়লরা তার বাবাকে মারার জন্য মাঠ থেকে তাড়া করে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। তার বাপ একদৌড়ে ঘরে ঢুকে কপাটে খিল দিয়েও জান বাঁচাতে পারছে না। মড়লরা ছুটতে ছুটতে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে গেল, হাতের রামদায়ের ঘাড়া দিয়ে দরজায় পিটিয়ে পিটিয়ে বলে গেছে, অহন মাগী হইছে …, বড়লোকের হালা অহন মাগী…।
বাড়ির সব মহিলারা গলা ফাটিয়ে রোদন পাড়ছে। তো এই ঘটনা তাকে এখনো কৌশলে চলতে উৎসাহ জোগায়। আগের দিনের মানুষ বলত : ‘ধন যার, মান তার।’ কিন্তু মানু বলে : ‘লাঠি যার, মান তার।’ তাই যারা ত্যাঁদড় তাদেরকে বাঁদরের মতো নাচাতে তার ভালো লাগে। এই মাটি বড় কঠিন। এখানে নরম হাতে নাঙল ধরলে তেপথে বসে কাঁদতে হয়।
মালেক, ঘোড়ামোবারক, অহাকালুরা মানুর হুকুমের অপেক্ষায় ছিল। দলের কর্তার ‘অবশ্যি, অবশ্যি’ কথাটা শুনে তারা পঞ্চাত্মায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। নবী শেখ পাতের কোণা থেকে চিমটি পরিমাণ লবণ নিয়ে পান-জর্দা আর বিড়ি-তামাকের নিকোটিনে অচেত জিবটায় ছেড়ে দেয়। মুহূর্তে মুখের ভেতরটা নুনতা লালায় চনচন করে জেগে ওঠে। বিরই ধানের পুরানা চালের গরম গরম ভাত থেকে বেরোচ্ছে মিঠা মিঠা সুবাস। তার সাথে মসুর-ডালের মচমচা বড়ার সুঘ্রাণ। অহাকালুর মুখাবয়বে বেহেস্তি আরাম। মানুষের এই সুখটুকু দেখতে নবী শেখের খুব ভালো লাগে। সারাজীবন কষ্টের সাথে লড়তে লড়তে নিজের কাছ থেকেই সে জেনেছে এই সুখের মূল্য অনেক। তাই মানুষকে তৃপ্তিতে দুমুঠো খেতে দেখলে নবী শেখের খুব ভালো লাগে।
নবী শেখ জানে, এই বৈঠকী খানাটা অহাকালুরা চালাবে ম্যালাক্ষণ। খাবারের আয়োজন-আনাজপাতি দেখে খেলার প্রস্তুতিও আন্দাজ করা যায়। সে আঙ্কুরের দিকে তাকায়। মড়লদের এই অচল ছেলেটাকে সে মন থেকে পছন্দ করে। ইতরের মতো জটিল আক্কলের মড়লগোষ্ঠীর একমাত্র উজ্জ্বল আওলাদ এই আঙ্কুর। নবী শেখ শরীরের শক্তিতে অবিশ্বসী। বড় বড় গাঙে মাল বোঝাই নাও নিয়ে, ঝড়-তুফানের সাথে লড়ে লড়ে, বুদ্ধি আর সাহসের পরীক্ষায় বারবার পাশ করে নবী শেখ এই জিনিস ভালোই জেনেছে।
নবী শেখ একটু বড়া ভেঙে, লাল লাল চিকন ভাতের সাথে চটকাতে চটকাতে ফের আঙ্কুরের দিকে তাকায়। ছোট ও চাপা ধরনের থুতনি। বিষণ্ণ চোখদুইটা গভীর, সতর্ক এবং ধারালো বুদ্ধির আমেজে চকচকা। সে পাতের দিকে তাকিয়ে মচমচা বড়া আর ভাত চটকাচ্ছে। আঙ্কুরের পাশেই রাজারূপী কাদু। তার শক্তপোক্ত প্রবীন শৈলগতরে রাজার মতোই সজাগ ব্যক্তিত্ব এবং রোদে-পোড়া চওড়া কপালে ভাবনার ভাঁজ। নবী শেখের মনটা সিকি-আধলির মতো ঝন্নাৎ করে ওঠে। এই মুহূর্তে কাদু নিশ্চয়ই নৌকা মার্কার কথা ভাবছে। বঙ্গবন্ধু নৌকা প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাদেশে ছাত্ররা নিজেদের টাকায় পোস্টার ছাপিয়ে, বাঁশ-কাগজের বড় বড় নৌকা নিয়ে, শহরে-বন্দরে, গ্রামের হাটবাজারে মিছিল করছে। সারাদেশে আজ এক রব, এক আওয়াজ, ‘জয়বাংলা…জয় বঙ্গবন্ধু।’
নবী শেখ হাতের ভাতটুকু মুখে পুরে বলে, — তাবাদে রাজার মতামত কী?
কাদু পাত থেকে দৃষ্টি তোলে : কালো চকচকে, বড়সড় ভারী মুখ-মাথার রাজা একটু ধিরিক ধরে ভাবে। কপালের বলিরেখায় বিবেচনার আভাস। নবী শেখের কথার রেশ ধরতে পেরে একটু বুঝি হাসেও, — আমার মতামতে কী আয়ে-যায়। তোমার মতের কতা কও, শেখ মুজিবের কতা কও।
নবী শেখ ডানে-বামে মাথা ঝাঁকায়, — উঁহু, তোমারটাই আসল। আমি ত মুজিবভাইয়ের ভক্ত, আমার কতায় পক্ষপাত থাকব।
চকচকা দৃষ্টি মেলে রাজা জবাব দেয়, — মানলাম মুজিবভাই রাজা অইব, এতে আমার ফয়দাডা কী?
অহাকালু সহ প্রায় সবাই মুখ ভর্তি ভাত নিয়ে প্রথমে রাজারূপী কাদুর দিকে তারপর নবী শেখের দিকে তাকিয়ে, উপর-নিচে বারকয় মাথা ঝাঁকায়। কাদু বোধকরি তাদের প্রাণের কথাটাই একবাক্যে বলে দিয়েছে। গত আট-দশ বছরে তারা দুই-একবার ভোট দিয়ে দেখেছে, ভোটের নামে একটা দিন খামাখা মাটি করে হাড়ে-গোশতে সমঝেছে, ওটাতে গরিবের কোনো আয়-বরকত নাই।
নবী শেখ কাদুর কথায় খুশি হয়। জানার ইচ্ছাতেই আসল সুরাহা। মানুর মতো তালামারা সিন্দুক হয়ে বসে থাকলেই যত অসুবিধা। তাতে একরোখা দাঁড়াশ সাপের মতো চিন্তার কোনো বাঁক-মুচড় নাই। নবী শেখ জানে, কাদু-কালুদের তেমন কোনো চাওয়া নাই, জীবনের কাছে বিশেষ কোনো দাবি নাই। ক্যাড়াবিজলা জীবনটা কোনোমতে পাছ করতে পাড়লেই তারা বাঁচে। তাই তারা কালাই বিলের বাতাস আর রোদ-পানির রসে-তাপে আজীবন তাজা। তাদের মুখের কথা মানে আত্মার কথা। মাঠের পেঁক-কাদা আর রোদ-পানিতে মাখামাখি এই মানুষগুলা খুব অল্প কথায় আদত জিনিস খপ্ করে ধরে ফেলে। ওরা নিজের অজান্তে নাপিতের ক্ষুরের মতো চিন্তার দুই-এক টানে কঠিন বিষয়ও সহজে রফা করে দেয়।
নবী শেখ আরেকটু বড়া ভাঙতে ভাঙতে কাদুর দিকে তাকায়, — অ রাজা হুনছ, মাঝেমাঝে মনে অয় সারাজীবন যে লাখ লাখ মুণ পাট চালান দিলাম কিন্তুক এর ট্যাহা যায় কই?
সবগুলা চোখ নবী শেখের দিকে। মাগীকুদ্দু মস্ত মস্ত কৈ মাছের ভাজা সবার পাতে দিতে দিতে ঝনঝন করে ওঠে, — হাচা কতা। হুনছি কুটি কুটি মুণ পাট, ঝিন্না বিলের মতন বড় বড় জাহাজ ভইরা বিদেশে যায়। হেই ট্যাহার একটা আধলিও এই দেশের কামে লাগে না, সব পচ্চিম পাকিস্তানে চালান অয়, হেইখানে মিল-কারখানা অয় আর আমগর দেশে খালি কলেরা-বসন্ত অয়, দুর্ভিক্ষ অয়।
বিকাশ-আঙ্কুর-নবী শেখ সবার চোখ পড়ে মাগীকুদ্দুর ওপর। ছোটখাটো শৈলগতরের মানুষটার খাড়া নাক-মুখ-চোখে আজব এক আলো ভেসে উঠেছে। বিকাশ সেই দিকে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, — এই খবর কেমনে পাইলা?
— ক্যান, গত দশ বছর ধইরা হাটবাজারের মিটিঙে মিটিঙে ছাত্ররা ত এই-রহম কতাই গেরামের অশিক্ষিত মানুষরে বুঝাইতাছে। এই জিনিস অহন মুতের পুলারাও জানে।
বিকাশ-আঙ্কুর-কিংবা নবী শেখ যারা এইসব মারপ্যাঁচের খবর রাখে, বাঙালির দুর্দশার কথা ভাবে, মুক্তির স্বপ্ন দেখে, তারা মাগীকুদ্দুর এই জবাবে দিব্যি বুঝে ফেলে — জিন্নাটুপির ওম ভেঙে, কালের কুটিল ফের ছিঁড়ে, বাঙালিদের বেরিয়ে আসতে আর বেশি দিন নাই। বিকাশের ঠাণ্ডা চোখ-মুখে চিকন হাসি, — কুদ্দু, আসলে তোমার কথাটা লাখ কথার এক কথা।
— অ বিকাশ বাবু, মনে কয় ছাত্রগর রোদনে বাংলার মানুষের ঘুম ভাঙছে।
এই কথা বলতে বলতে নবী শেখ মালেক-ঘোড়ামোবারক আর অহাকালুর দিকে তাকায়। তিন তরুণ পাশাপাশি বসেছে। পেটুক বলে গ্রামে তাদের তিনজনেরই যথেষ্ট বদনাম আছে। এখন হাত ও মুখের ব্যস্ততায় তাদের সারাশরীরে আমোদ ও অস্থিরতা। পাতের ভাত বড় বড় লোকমা পাকিয়ে, অল্প কয়বার চিবিয়ে ওরা দেদারসে গিলছে। এই দৃশ্য নবী শেখের মনে বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মনের সেই অনুভবে কষ্ট ও আনন্দ দুইটাই সমান।
বিশাল দেহের দানবকালু দুই পা ভাঁজ করে লেপচে বসেছে। তাল গাছের কাণ্ডের মতো তার নির্মেদ গতরের চ্যাপ্টা পেটে পাতলা চামড়ার তিনখানা চিকন ভাঁজে বিন্দু বিন্দু ঘাম, বিরাট গোঁফজোড়ার নিচে চাপা-পড়া চিকন ঠোঁটদুইটাতে একটা অমায়িক ভঙ্গি, ভেজা ভেজা খাদা নাকটায় তাচ্ছিল্য ও উদাসীনতা। ছোট ছোট লোকমায় খাবার খাওয়া রাও-শব্দহীন দানবকালু একাই বুঝি গোটা বারান্দাখানা ভরাট করে ফেলেছে। বহুক্ষণ সে টুঁ শব্দটা করেনি। কিন্তু নিশব্দে বয়ে চলা শিরার রক্তের মতো তার চিন্তাও সকলের তাবৎ আলাপে প্রথম থেকেই সামিল ছিল। সে বাহিরের চে ভিতরটা বেশি দেখে বলেই হয়তো ভাবেও বেশি। হঠাৎ সে ভাবনার রেশ ধরেই বলে ফেলে, — কলেজের ছেলেরা যে দশে-বিশে ডাইক্ক্যা ডাইক্ক্যা কইতাছে :
‘নৌকা মার্কায় দিলে ভোট
ভবিষ্যতে হবে সুখ।’
এই ভবিষ্যতটা কী?
মুখ ভর্তি মাছ-ভাত চিবাতে চিবাতে সবাই দানবকালুর দিকে তাকায়। রোদে-জ্বলা তার বিশাল বাবরিটা জল-তেলের পরশে এখন বেশ সিযিলমিসিল। নিরীহ চোখদুইটাতে আজব একটা উপেক্ষা। বিকাশের বড় বড় চোখদুইটা মহীরুহের মতো দানবকালুকে পরখ করে। আর নবী শেখ জহুরির মতো দানবকালুর সরল চোখের জটিল ভাষা পাঠযোগ্য করে তুলতে মনে মনে চেষ্টা করে।
চতুর মানু হিয়ালের মতো খাপ-পেতে অপেক্ষায় ছিল। এখন সুযোগ পেয়ে নিজেকে জাহির করে, — দেশটা গোল্লায় গ্যাছে ত, হ্যাল্লিগ্যা ভবিষ্যতটা অহন একটা রসগোল্লা।
মানুর কথাটা কারো ভালো লাগে না। তাই তারা সবাই নীরবে খেতে থাকে। নবী শেখ, আঙ্কুর কিংবা বিকাশবাবু জানে, এখন কথা বলার চে না-বলাটার দাম বেশি। তাতেই মানু টের পাবে, দলের কর্তা হলে কী হবে, আসলে সে বায়েন ছাড়া কাঁসার কর্তাল। একলা একলা এক কোণায় পড়ে আছে। আর এতেই মানুর অবস্থা আরো জটিল হবে। সে না পারবে সইতে, না পারবে কৈতে।
পাখির ছানার মতো এই এতটুকুন পেটের আঙ্কুর, ছোটখাটো গতরের নবী শেখ আর বিকাশ তিনজনই আহারে নিরস। তারা খানার চে আলাপেই বেশি মনোযোগী। বাকিরা রণাঙ্গনের নিপুণ যোদ্ধার মতো মারমুখী। মানু মিয়া তো আস্ত একখানা কৈ মাছ দাঁতের নিচে ফেলে, চোখ বুজে এমনভাবে চিবুচ্ছে যে :
‘চুতমারানির কৈ
অহন যাইবে কৈ?’
কারণ কৈ মাছ ধরা সবচে কঠিন কাজ। তাকে ধরতে গেলেই সে তার সর্বাঙ্গের কাঁটাগুলা খাড়া করে তোমার হাতে বসাবে। তাবাদে কড়কড়া করে ভাঁজা কৈমাছটা চিবুতে চিবুতে মানু মিয়া ভাবে, জীবনে যুদিন কোনোদিন সুযোগ পাই তে ঘাটুদলের সব চুতমারানিরে এই-রহম চাবায়া খাইয়াম।
প্রমাণ সাইজ মাছটার তেল-চর্বি, মাংস-কাঁটার মিলিত স্বাদে মানু মিয়ার তালুটা ঝিনঝিন করে। সেই চরম মুহূর্তে তার চতুর মনটা কুনকুনিয়ে ওঠে। এই-রকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে-থাকা কোনো কামের না। তাই সে নিজের আদত জিনিস চেপে রেখে ফের সিন্দুকের ঝাঁপি খুলে, — অ বিকাশবাবু, ছাত্রটাত্রগর চিক্কাইরে পেসিটাইন ইয়াহিয়া হাচাহাচাই ইলেকশন দিব?
আসলে মানু মিয়া এইসব বোঝে না, জানেও না। সে তালুকদারদের কাছ থেকে শোনা কথার প্রতিধ্বনি করে মাত্র। বিকাশ পাতের কৈমাছের পেট-পিঠের কাঁটা ছাড়িয়ে, লাঠিম লাঠিম মাথাটা ভেঙে পাত থেকে সরিয়ে রাখে। তাবাদে পিঠের দিকের একটু মাংস ছিঁড়ে নিতে নিতে বলে, — দেখা যাক কী হয়। সাড়ে-সাতকোটি বাঙালি সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না।
হাসিতে নবী শেখের তরমুজের বিচির মতো কালো দাঁতগুলা বেরিয়ে আসে, আগরতলার মামলার সময় বাংলার ঘরে ঘরে মুরুব্বিরা মুজিবভাইয়ের লাইগ্যা রোজা রাখছে, ছাত্র-অছাত্র সহ সব তরুণগর মিছিল-মিটিংয়ে দেশটা আগুনের মতন জ্বলছে, এইসবের অর্থ কী?
তাচ্ছিল্যে মানু মিয়ার মুখের হাসি চওড়া হয়। তার মনে বিচিত্র যুক্তি। কিন্তু ওসব বলার জন্য মনে কোনো উৎসাহ পায় না। এইসব দুইআনার পাগলছাগল আর কুলি-কামলাদের ফালতু কথায় তর্ক শুরু করার কোনো মানে হয়? বড় তালুকদার, ছোট তালুকদার, আকন্দরা সব জিন্নার ভক্ত। তারা বলে, যতসব ছোটলোকদের জন্য শেখ মুজিব বাংলাদেশ-বাংলাদেশ চেঁচায়। ওদের ভাতকাপড়ের কথা বলে, লেখাপড়ার কথা বলে। এইসব ছোটলোকগুলার ভাতকাপড়ের আকাল ঘুচলে, তুমি মানু মিয়া কী আর মানু মিয়া থাকবা? বুঝছ মানু মিয়া, জীবনেও ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা ছাড়ব না।
বড় তালুকদারের সেই ভরসার কথা মনে হতেই আত্মগৌরবে মানুর মনের হতাশা অনেকটা থিতিয়ে আসে।
বিকাশ মানুর দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুর কথায় একটুও অবাক হয় না। টাকাওয়ালা, জমিওয়ালা মানুর মতো গুটিকয় মানুষ পাকিস্তান-পাকিস্তান গায়। তারা বলে, পাকস্থান। হাজার বছরের বাংলাদেশ রাজনীতির ঘুটির চালে, ধর্মের হুজুগে রাতারাতি পাকস্থান হয়ে গেল?
আঙ্কুর ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনের কষ্ট লাঘব করতে চায়। তাবাদে মানু মিয়ারা দেশ বোঝে না, জাতি মানে না। তা ইসলামের জন্য নয়। ওদের হিসাব অন্যখানে। অপরদিকে বাংলার পনেরোআনা মানুষ বঙ্গবন্ধুকে চায়। তারা নেতা শেখ মুজিব আর বাংলাকে আজ এক আঁজলায় বুকে তুলে নিয়েছে।
নবী শেখ এক-কামড়ে আস্ত একটা কাঁচামরিচের অর্ধেকটাই নিয়ে নেয়। সারাক্ষণ পান চিবিয়ে তার মুখের ভেতরটা ভোঁতা। ভাজা মাছের স্বাদটা ষোলোআনা আদায় করে নিতে হলে ঝালের তুলনা নাই। তাছাড়া পুরুষের ঝাল না খাইলে চলে? ঝালেই ত আসল মর্দামি।
মানু মিয়ার কথায় মরিচের ঝালের সাথে নবী শেখের মনের ঝালও খিঁচে উঠেছে। কিন্তু সে তো শুধু শেখ মুজিবের ভক্ত নবী শেখ না, জান-গতরে একজন নিপুণ মাঝিও। ঝড়তুফানের সময় অটল মনে হাল ঠিক রাখাই তার শিক্ষা। সে মানুর দিকে তাকায়। কাঁঠালগাছের গুঁড়ির মতো প্রকাণ্ড শরীরের মানু খুব তৃপ্তিতে খাচ্ছে। রোদে-পোড়া নবী শেখের টাইট শরীরটা জ্বলে ওঠে। তার ইচ্ছা হয় দাঁত খিঁচিয়ে মানুকে জিজ্ঞেস করতে, — বাংলার ভাত খাও আর তলে তলে পাকিস্তান চুদাও?
কিন্তু তার বদলে সে মানুর ছোট ছোট চোখদুইটা দেখতে থাকে। ঝিলঝিলা চোখদুইটাতে মানুষটার মনের কোনো ছবি নাই।
নবী শেখ ভাত চিবাতে চিবাতে ভাবে, — তাবাদে গতকাল জয়ধারখালী বাজারে জালু কলুর বরাত খোলে গেছিল।
বাজারে এসে দোকানে দোকানে এককুড়ি-দুইকুড়ি করে বিকিসিকি শেষের দিকে, হঠাৎ তার চোখে পড়ে শাপলাপাতার উল্টা পিঠে কিসের যেন একটা ছাপ? সে ভালোমতো চেয়ে দেখে ঠিক একটা ডিঙি নাওয়ের জলছাপ। জিনিসটা সে হাছুকলুকে দেখায়। ছোট একটিন সরিষার তেল নিয়ে লোকটা হালছাড়া ভঙ্গিতে বসে আছে। তার বুকে কত কষ্ট। জামাইবাড়ি থেকে ফেরৎ আসা মেয়েটাকে মানু মিয়া ফোঁসলাচ্ছে। তবু জালু কলুর কথায় সে চোখটোখ কচলে চেয়ে দেখে, হাচাহাচাই শাপলাপাতার উল্টা পিঠে বেশ লম্বা আর তরতরা একটা ডিঙি নাওয়ের ছাপ। সে তার পাশের জনকে দেখায়। লোকটা পেশায় পাটের ফড়িয়া। নবী শেখের সাথে তার খাতির-মহব্বত আছে। সে শাপলাপাতাটা হাতে নিয়ে নবী শেখকে দেখায়। সে শাপলাপাতার জিনিসটা এক-নজর দেখেই হাউৎ করে ডাক মারে, — এই দ্যাহ বঙ্গবন্ধুর নৌকা…।
নবী শেখ মাঝি হলেও হক-কথার মানুষ তাই তার ডাকে অনেকেই এগিয়ে আসে। মন দিয়ে দেখে। তাবাদে যে-ই দেখে সে-ই অবাক গলায় মতামত দেয়, — হ, নৌকা।
নবী শেখ আবার হাউৎ করে ওঠে, — এই-যে তোমরা দ্যাহ, বঙ্গবন্ধুর নৌকা শাপলাপাতায় ভাইস্যা উঠছে। কোনো ব্যাডা তারে আর ফিরাইয়া রাখতারত না।
বাজারে একটা হুরুন্টি রব ওঠে। সবাই শাপলাপাতার জন্য পাগল অবস্থা। বিকিসিকির পর শাপলাপাতার ছোট বান্ডিলটার উপর বসে জালু কলু বিড়ি টানছিল। বাজারের মানুষের হামগাম রবে সে নড়েচড়ে বসে। মানুষের মুখে মুখে এক রব, — শাপলাপাতা কৈ?
গ্রামের অনেকের মুখেই শোনা যায়, কলুর বুদ্ধি সাতচোঙ্গা। হাশরের ময়দানের মতো শাপলাপাতা-শাপলাপাতা রবে জালু কলু বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে শাপলাপাতার ছোট বান্ডিলটা বুকের কাছে আগলে ধরে বসে থাকে। তার বুকের দিকে অনেক অনেকগুলা হাত এগিয়ে আসে, — এই শাপলাপাতা দ্যা।
— আগে পৈসা দ্যাও।
অনেকেগুলা গলা একসাথে তার কাছে জানতে চায়, — কয় পৈসা?
— দুইআনা।
অবিশ্বাস্য দাম শুনে একজন অবাক গলায় আরেকবার জানতে চায়, — কয় আনা?
— দুই আনা।
সবগুলা মানুষ জালু কলুর দিকে অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তাবাদে একে একে সবাই পকেটে হাত দেয়। বঙ্গবন্ধুর নৌকা শুধু একা তারাই দেখবে? কয় বছর আগে তার মা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলে বন্দি শেখ মুজিবের মুক্তিকামনায় সাতটা রোজা রেখেছিল। এখন সে একটা শাপলাপাতা ছাড়া কি করে তার মায়ের সামনে যাবে?
শাপলাপাতা কমতে থাকে আর জালু কলু দুইআনা থেকে দাম বাড়াতে থাকে। শেষ শাপলাপাতাটার দাম সে একটাকা হাঁকে। সকলেই মুখ কালো করে ফিরে গেলেও সিরাজ সরকার দাঁড়িয়ে থাকে। তরুণ বয়সে সিরাজ সরকার দুর্গাপূজার সময় নাটকে সিরাজদৌলার পাঠ করত। সেই সুবাদে জালু কলু তার ভক্ত। তাবাদে পর্বতসমান বড় একটাকার লোভটা ঝাড়া মেরে ফেলে জালু কলু হঠাৎ শাপলাপাতাটা সিরাজ সরকারের হাতে তুলে দিয়ে বলে, — লইয়া যাইন গ্যা, পৈসা লাগত না।
সিরাজ সরকার নবাব সিরাজদৌলার মতো হাসতে হাসতে বলে, — দূর বোকা, ল। আটআনা ল।
চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
COMMENTS