চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৫ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৫ || শেখ লুৎফর

আলীর হাতের জুলফিকার, মা ফাতেমার তির


নিজের বাড়িতেও অহাকালুর মন টিকতে চায় না। যেহেতু তার পৃথিবীটা পস্ট দুইভাগে বিভাজ্য। সেই দুই ভাগের একটা হলো টাকা। তার অনেক টাকা চাই। অনেক অনেক টাকা মানে অহাকালুর হিসাবে এক হাজার, দুই হাজার, তিন…এর বেশি সে ভাবতেও পারে না। ভাবলে হৃদকম্প শুরু হয়। ছোটকালে বসন্ত রোগে তার যে-চোখটা নষ্ট হয়ে গেছে, সেই নষ্ট চোখের থকথকে গর্তটা তখন রিরি করে কাঁপে। তার মনের অন্য ভাগে আছে এক নারী। বউ নামের অনাগত সেই নারীকে কেন্দ্র করে মাকড়শার জালের মতো সে স্বপ্নের জাল বোনে। তাই তার নাছোড় মনটা দিনমান দুই ভাগে চরাট করে। টাকা আর নারীর ভগ্নাংশে ছুটাছুটি করতে করতে হাঁফ ধরে গেলে মাঝেমাঝে সে বিলপারে ধুন-ধরে বসে থাকে। একটা নরম গতরের মানুষের অভাব তাকে কিছুটা প্রকৃতিপ্রেমিক করে তুলেছে।

যেদিন কাম থাকে না অর্থাৎ গিরস্তের বাড়িতে কোনো কাম না পাওয়ার জন্য সেই বেকার দিনটার বেশিরভাগ সময় সে কালাই পাথারটা সামনে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিড়ি টেনে টেনে বিরহ যাপন করে। মানুষের সঙ্গ তখন জহরের মতো বিষাক্ত লাগে। মাঝেমাঝে গতরের আবিল উত্তেজনায় তার খুব কষ্ট হয়। তখন রাগে শরীরটা মরিচের মতো জ্বলে। শান্তি নাই! কত আশা করে ভাঙা ঘরটা সে মেরামত করল। একমুঠি (পাঁচটাকা সাড়ে-আটআনা) টাকা দিয়ে কিনল লুঙ্গির রাজা ভাগলপুরী। সেই লুঙ্গি পরে বিয়ে করেছিল জালু কলু। মানুষটা বউয়ের সাথে তিনমাসও ঘুমাইতে পারল না। বুধবার বুধবার সে বরমীর বাজারে কুলিগিরি করত। সেদিন টিপটিপ বৃষ্টির মাঝেই নাওয়ে মাল বোঝাই চলছিল। তাবাদে জালু কলুর গর্দিশের কপাল; পা পিছলে দুইমন ওজনের ধানের বস্তা বুকের উপর ধরাম-করে পড়ে যায়। মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত এসে পলকের মধ্যে লাশ হয়ে গেল এই জোয়ান মর্দটা!

জালু কলুর মৃত্যুর সপ্তাখানেকের মধ্যেই অহাকালুর মাথায় বাই চাপে। সে এখন চাইলেই তো জালু কলুর বিধুবা বউটাকে নিকা করতে পারে! আবেগে-উত্তেজনায় তার ভালো চোখটা দপদপ করে জ্বলছে। ভয় আর সন্দেহে বুকটায় শুরু হয়েছে ধকধকানি।

জুম্মার নামাজে সবার পিছনে কলুদের কাতারে কলু ছাড়া পারতপক্ষে অন্য কেউ দাঁড়ায় না। দুই ঈদের নামাজেও তাই। সেই কলুব্যাটার স্বামীখাওয়া রাক্ষসী বউটাকে অহাকালু বিয়ে করতে চায়? তামাম গ্রামে রব ওঠে, — হায় হায়! ইজ্জত গ্যালো রে…!
অহাকালুর বুড়ি মা হাতের ঝাড়ুটা বাতাসে ঘুরিয়ে ঘোষণা করে, — এই বাড়িত্ কোনো কুলুমাগীর জাগা নাই।

এইসব অনাহক আলাপে কান দেওয়ার মতো সময় অহাকালুর হাতে নাই। সে দশটাকার একটা নোট নিয়ে কেতু মুন্সির বাড়ির সামনে গিয়ে লম্বা হয়ে পড়ে, — মুন্সিসাব বাড়িত্ আছুন?

কেতু মুন্সি খুব বিষণ্ণ। অবস্থা দোষে বিপন্নও। তার বিবির পরনে কাপড় নাই। একটামাত্র শাড়ি সম্বল করে খোদার নামাজ-কালাম আদায় হয় কী করে; কী করে বিবিসাহেবান পর্দাপুশিদা রক্ষা করে?

অহাকালুর মাত্র একটা ডাকে কেতু মুন্সি বুঝি দুনিয়াদারির আসমানটাই হাতের নাগালে পেয়ে যায়। সে একটা মোচড় দিয়ে চাটাই থেকে উঠে পড়ে। একডাকেই বিচক্ষণ মুন্সি বউপাগল মানুষটার মনের খবর ধরে ফেলেছে। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে কান খাড়া করে। খোদার রহমতস্বরূপ অহাকালু তার দেউড়ির পিছন থেকে ডাকছে, — মুন্সিসাব, অ মুন্সিসাব?

কেতু মুন্সির কাঠি কাঠি পা দুইটাতে কচি বাছুরের উন্মাদনা ভর করে। সে দুই কদমে বেরিয়ে আসে। টুপিটা বিছানায় ছিল; তাড়াহুড়ায় আনতে ভুলে গেছে। সংসার খুব খারাপ জিনিস; পদে পদে পরহেজগারীতে বিঘ্ন ঘটায়।

অহাকালু কলাপাতার দেউড়ির পাশে রাক্ষসের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বসন্তের খাউদা খাউদা দাগে ভরা মুখটা দুশ্চিন্তায় চুপসানো। নষ্ট চোখের গর্তটা থেকে হলুদ কেতুর উপচে পড়ছে। কেতু মুন্সি একটা পিঁড়ি হাতে অহাকালুর কাছে এসে দাঁড়ায়, — কালু মিয়া যে, ভালা আছ?
— আর আমার একটা ভালা!
অহাকালু এই কথা বলে বড় করে দম ছাড়ে। বালেগ পুরুষের যৌবনের আগুনে ঝলসানো দীর্ঘশ্বাসকে কেতু মুন্সি আজ আর ভয় পায় না। সন্ধ্যারাতের এই নিরিবিলিতে খোদার আসমান ভরা তারা, জমিন ভরা পোক-জোঁক, কীটপতঙ্গ সবাই এখন আল্লাহর জিকিরে ব্যাস্ত। শুধু মানুষ গোনাগারিতে আকণ্ঠ ডুবে যাচ্ছে!

কেতু মুন্সি বিসমিল্লা বলে মাটিতে পিঁড়িটা রাখে। অহাকালু পিঁড়িতে বসে না, মুন্সির মুখের পচা গন্ধটাকে আজ আর পাত্তা দেয় না। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলে, — একটা পয়গাম লইয়া যাইতে অইব।

কেতু মুন্সির গলায় স্বজনের সুর, — যায়াম। নিরিচ্চয়ই যায়াম। অহন পিঁড়িতে বও।

অহাকালু বসে না। জালু কলুর বউটাকে সে মোটমাট দুইবার দেখেছে : হাঁটার সময় পাছায় ঢেউ দ্যায়া কৈন্যা ভাইঙগ্যা ভাইঙগ্যা হাঁটে! তখন হীরামতির বুকে জবর একখান ঢেউ ওঠে, কুড়াপক্ষীর মতো গলায় নরম সুর তুলে টেনে টেনে আলাপ করে! অহাকালুর বুকের ভিতর কে যেন চিৎকার দিয়ে পড়ে, — কোন চুতমারানী জাতের কতা কয়, অহাকালু জাত ধোইয়া পানি খাইব?
হ্যাঁহ্…!

হ্যাঁহ্ শব্দটা দিয়ে খুব সংক্ষেপে অহাকালু নিজেকে নিজেই বোঝায়। গত দশ বছর ধরে একটা বউয়ের অভাবে হাবিয়া দোজখ ভোগ করছে সে। জালুর বউয়ের গতরে কি কলুর সিল মারা?
কর্ম দ্যায়া মানুষের ধর্ম।

অহাকালু পিঁড়িতে বসতে বসতে বলে, — জালু কলুর বিধুবা বউয়েরে আমি নিকা করতাম।
এই কথায় কেতু মুন্সি ভড়কে যায়। অহাকালুর পাঁচটা ভাই। একে তো বিধুবা তার ওপর কলুর মেয়ে। এই পয়গাম সে নিয়ে গেছে শুনলে অহাকালুর ভাইয়েরা তার কাঠি কাঠি পা দুইটা ভেঙে দিবে না? মুন্সি তার পায়ের চিকন নলিতে হাত বুলাতে বুলাতে সংশয়ে বলে, — যাইয়ামনে।
অহাকালু কোমরের কশি থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে টেনেটুনে ঠিক করতে করতে বলে, — আসছে কাইল পরস্তাব লইয়া যাইবাইন।

অহাকালুর কথায় মুন্সি অবাক হয় কিন্তু চালে ভুল করে না। তাই হাসি হাসি মুখে সে বিয়ে-পাগলাটার হাত থেকে ছোঁ-মেরে নোটটা নিয়ে খুব দ্রুত লুঙ্গির ফাড়ে গুঁজে ফেলে। তাবাদে তার পায়ের কাঠি কাঠি নলি হাত দিয়ে ঢলতে ঢলতে বলে, — অহন বিঘ্নি আছে।
— কী বিঘ্নি? কী বিত্তান্ত?
— হাদিস-কোরানে নিষেধ আছে।
অহাকালু অকাশ থেকে পড়ে, — আমার নিকার বিষয়ে হাদিস-কোরান কী কয়?
— জালু কলুর বিধুবা বিবিরে চল্লিশ দিন সময় দ্যাও কালু মিয়া। একটা পুরুষরে ভুলুক। তাবাদে না আরেকটা পুরুষের কলিমা কৈতে পারে।

শুধু রাতের অন্ধকার নয়, হতাশার অন্ধকারে অহাকালুর মোটা মোটা হাড়ের বিরাট খাঁচাটা নুয়ে পড়ে। দশটাকার দুঃখে এখন তার নষ্ট চোখটা দিয়েও পানি ঝরছে। এই হাদিসটা যদি একটু আগে বলত তবে কি সে মুন্সির হাতে টাকাটা দিত?

অহাকালুর ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। তাবাদে সে বাড়ির দেউড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। বিষুরির থলির দিক থেকে হু হু করে বাতাস আসছে। সেই হারুম হুরুম বাতাসে তাদের বাড়ির কলাপাতার দেউড়িটা খস খস করে দুলছে। অহাকালুর বাড়ির মানুষগুলা খুব গালিগালাজ করছে। কাকে করছে বোঝার জন্য সে দেউড়ির পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়ির সবার গলা অহাকালুর ছোটভাইয়ের একটা হুঙ্কারের নিচে চাপা পড়ে যায়, — একব্যাটারির কত সাহস! হে কুলনী মাগীরে নিকা করত চায়?
উত্তরের ভিটা থেকে তার বড়ভাইয়ের গলা ভেসে আসে, — তার ঘর আমি ভাইঙ্গা বিষুরির থলিত্ ফালায়া দ্যায়াম।
অহাকালুর সবচে ছোট ভাইটা বলে, — হের ঘরে আমি অনহি আগুন ধরাইয়্যা দ্যায়াম।

অহাকালুর ভালো চোখটা দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরা আরও বেড়ে যায়। শুধু সে ছাড়া সবার ঘরে বউ আছে। রাত হলে সবার ঘরের চৌকিতে ক্যাঁতকুঁত শব্দ হয়। সকালে সবাই লুঙ্গি-গামছা কাঁধে ফেলে নিসিন্দার ডাল দিয়ে দাঁতন করতে করতে বিলের ঘাটে যায় ফরজ গোসল করতে। মনে মনে অহাকালু কাতরে ওঠে, — খালি আমার…,খালি আমার.. কেউ নাই।

অহাকালু যেমন নীরবে এসেছিল তেমনি সকলের অজান্তে কাঁদতে কাঁদতে বিলপারের দিকে সরে যায়। এখন আর বিড়ির তৃষ্ণাটা নাই। বুকটাও ভয়-ঘিন্নায় হিম হয়ে গেছে। মাগনা কী আর মালেক জীবনের উফরে তিখ আনছে?
এইসব বলতে বলতে অহাকালু অন্ধকার বিলপারের কান্দার ঘাসে লম্বা হয়ে পড়ে।

এইসব মাস দুইয়েক আগের কথা। আজ ঈদের দিন। তাই কর্মহীন দিনটা অহাকালুর কাছে গজবের মতো কষ্টের। বাড়িটাতে হাঁসের গোশতের সুবাস ছাড়া ঈদের কোনো ছিরি নাই। আজকের দিনটাও আর-দশটা দিনের মতো। এখন অহাকালু সর্বাঙ্গ দিয়ে মালেকের কথাটা বিশ্বাস করে। প্রায়ই মালেক হাসতে হাসতে বলে, — মাটির ঘর ল্যাইপ্প্যা, লালগুড় দ্যায়া হাতে-ঘষা সেমাই রাইন্দ্যা খাওয়াই হইল গরিবের ঈদ।

অহাকালুর মা আর ছোটভাইয়ের বউ কালকে ঘর লেপেছে, আজ সকালে হাতে-ঘষা সেমাই খাওয়া হয়েছে। এখন আর ঈদ কৈ?

বিরক্ত অহাকালু ফিরতি হাঁটা দেয়। সে বিলপারে চলে আসে। সামনে থৈ থৈ কালাই বিল। এই শুকনার দিনেও বিষুরির থলি অথৈ সাগর। দেখলে ভয়ও হয় আবার শান্তিও লাগে। এই বিলপারে এসে বসলে নারীদেখার মতো একটা অশেষ আরামে তার পরান শীতল হয়ে আসে।

বিলপারে আসতেই অহাকালু রাজারূপী কাদুর দেখা পায়। কাদু জল-কাদায় মাখামাখি। এই ঈদের দিনেও সে বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিল। হাতে একটা ভারী খলুই। কশে নেংটিমারা গফুর বাদশা গানের রাজা অহাকালুকে দেখে হেসে ওঠে, — ভাগলপুরী লঙ্গিটা তরে খুব মানাইছে। এক্কেবারে ষোলোআনা জামাই জামাই ভাব।

কাদুর কথায় অহাকালু খুশি হয় ফের মনে মনে কষ্টও পায়। তাই মনের কথাটা সে বলেই ফেলে, — ভাব লইলে কী অইব। ভাবে খালি ভাবনা আনে।

রাজা আন্তরিক হাসে। মানুষটা জীবনভর রাতের রঙ্গমঞ্চে রাজার পাঠ করতে করতে সত্যিই বুঝি রাজা হয়ে গেছে। মনটা কালাই পাথারের মতো বিশাল। শত দুঃখ-কষ্ট তার হাসিটাকে একটুও মলিন করতে পারে না। অন্তত অহাকালু একদিনও মলিন দেখেনি। এবার অহাকালু রাজাকে অভিবাদন না জানিয়ে পারে না। তাই সে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে রাজাকে কুর্নিশ করে ডায়ালগ দেয়, — মহারাজ অধমের গোস্তাকি নিবেন না, মাছ যা পাওয়া গেছে তাতে জনাবের পরিবারের দিন-দুই চলবে।

কাদুর হাসিটা আরও চওড়া হয়, — বিলক্ষণ বলেছেন উজিরেআলা। কিন্তু চেমননগরের নীল আকাশে অমাবস্যার তিথি উঁকি মারছে।

অহাকালু চমকে ওঠে। তাই রাজার ডায়ালগের জবাবে আঁতকে ওঠা গলায় কাদুকে জিজ্ঞেস করে, — কোনো দুঃসম্বাদ আলামপনা?
— বিলক্ষণ, হাওয়াখালিতে ওলা বিবি গতকাল পত্তন নিয়েছেন।
অহাকালুর একগজ লম্বা গলাখানা কচ্ছপের আদলে খাটো হয়ে আসে, — কবে কইলা?
— গেছে রাইত।

অহাকালু একেবারে কোঁচার ঘা খাওয়ার মতো কাবু হয়ে আসে। এরই মাঝে তার মুখটা ডেকচির তলার মতো আংরা-কালো হয়ে গেছে। একে বদনসিব ছাড়া আর সে কী বলতে পারে! সে একটা মেয়েলোকের খোয়াবে আপাদমস্তক ডুবে আছে। তা না হলে এমনও হয়! তার গতরের সবকটা লোম বুঝি পটপট করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তাই দেখে কাদু সাহস দেয়, — ডরাছ ক্যা, ডরের কী আছে?
— অহাকালু ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠে,  — কী যে কও? এই জিনিস কেউরে খাতির করে না।
রাজা আবার বলে, — জানস না ‘ডরাইলেই ডরে খায়’।

এশার আযানের পরেই পাড়ায় পাড়ায় নাড়া আর তুষের আগুন জ্বলে ওঠে, সাথে ম্যালা মানুষের জোর চিৎকার, — হেই আল্লা আল্লা বলো…
কাদু-কালুরাও আগুনের পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ফিরতি আওয়াজ দেয়, — হেই আল্লা আল্লা বলো…।

এবার হাওয়াখালির দিক থেকেও একই ডাক ওঠে। কালাই পাথারের পুব-উত্তরপারে হাওয়াখালী, পশ্চিমপারে নামাকান্দি, দক্ষিণে ছ’আনি, পশ্চিম-দক্ষিণ কোনায় নেওকা গ্রাম। মাঝে বিশাল পাথার। শীত-কুয়াশা আর কুচকুচা কালো অন্ধকারের মাঝে কারা যেন ফিসফিস করে কথা কয়! সেই ফিসফিসানিটা বুঝি বাতাসে কানপেতে চারপাশের সবকয়টা গ্রামের বাসিন্দারা শুনতে চায়। কিন্তু পারে না। এবার সড়কের পশ্চিমপারের জয়ধরখালী থেকেও খেলাদের চিৎকার ভেসে আসে।

কাদু-কালুরা সারারাত খড়-নাড়ার জ্বলন্ত আগুন ঘিরে বসে বসে কথা কয়, আল্লাকে ডাকে। কিন্তু ভুলেও কেউ মঞ্চের ডায়ালগ দেয় না। এক পাড়া থেকে জোহার ভেসে আসলে তার প্রতি-উত্তরে আরেক পাড়াও চিৎকার দেয়। এইভাবে একটার পর আরেকটা পাড়া থেকে ভেসে আসতে থাকে :

আলীর হাতের জুলফিকার, মা ফাতেমার তির
যেইদিক থেকে আইছ রে বালা (মাসিবত) সেইদিকেতে ফির।

বহু মানুষের বুকফাটা আকুতি রাতভর চলতেই থাকে। শিশুরা ঘুমের মাঝেও বারবার কেঁপে ওঠে। মুরগির পাখনার নিচে ছানাপোনা আগলে রাখার মতো ঘরে ঘরে মায়েরা বুকের-ধন আগলে রেখে আধাঘুম আধাজাগরণে রাত কাটায়। শেষরাতে হাওয়াখালীর দিক থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসে, — আমার যাদু মইরা গেছে রে…,মইরা গেছে…
কাদু-কালুরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এবার মানু মিয়ার বাড়ির দিক থেকে জোর গলার আওয়াজ ওঠে —

আলীর হাতের জুলফিকার মা ফাতেমার তির,
যেইদিক থেকে আইছ রে বালা সেইদিকেতে ফির।

অহাকালু ঘ্যানর ঘ্যানর গলায় যেন প্রতিবাদ করে, ঈদের দিন রাইতে এই কী গজব! দানবকালু আগুনের পাশে বসে একটা বিড়ি পাকাতে পাকাতে বলে, — যমের কি ঈদ-পরব আছে?

কাদুর বড় ছেলে গত তিন বছর ধরে তার সাথে রোজে কামলা খাটে। সবেমাত্র ছেলেটার বুকের ছাত্তিটা তার মতো পাট্টা বাঁধতে শুরু করছে। এই ছেলেটার জন্য কাদুর যত চিন্তা। এর আগের দুই-দুইটাও ছেলে ছিল। সবার বড়টা মরেছিল গুটি বসন্তে আর পরেরটা মরেছে নিউমুনিয়ায়। তিন নম্বরটাই খালি এখন টিকে আছে। এই ছেলেটার পরে তো সব কয়টা মেয়ে। তার চারটা মেয়ের সবকয়টাই যমের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিব্যি গড়গড়া হয়ে উঠছে।

এইসব ভাবনার মাঝে দানবকালু বলে, — মনে কয় হাওয়াখালীতে জোয়ান কেউ মরছে।
কাদু একটা বিড়ি নিজের কানে গুঁজে আরেকটা মাগীকুদ্দুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, — পুত না মরলে কি কোনো মা যাদু কৈয়্যা কান্দে?
কাদু বিড়িটায় টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, — মেয়েলোক অইছে তিঁতা নাইল্ল্যাআলি (পাটবীজ), হেগর মউত নাই।

অহাকালু পাশেই ছিল। কাদুর এই কথা তার বুকে শেলের মতো ঘা মারে। মেয়েলোক কি জিনিস এখন সে পদে পদে টের পায়। মেয়েলোক ছাড়া কেউ কোনোদিন সুখশান্তির কথা কল্পনা করতে পারে? চর্তুদিকে জাল বিস্তার করে তারা মাকড়শার মতন জীবন পাতায়। তাই সে মুখ না খুলে পারে না, — কী যে কও তুমি, বেটিমানুষ ছাড়া সংসারের কথা কেউ চিন্তা করতারব? বংশ টিকব?
অহাকালুর কথা শেষ হওয়ার আগেই চারপাশের সবাই খল খল করে হেসে ওঠে। কাদু বলে, — বেটিমানুষের কদর তুই ছাড়া আর কে ভালা বুঝে?

অহাকালু হা-করে কাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পালাগানের রাজার শুধু হাসি না, রঙ্গরসও রাজার মতোই। কিন্তু অহাকালু ভাবছে, ফের তার চারপাশের সবাই নয়া করে জানল যে, মেয়েলোকের অভাবটা অহাকালুর রক্তে অষ্টপহর জেগে থাকে। এই সময় পশ্চিম দিক থেকে একটা আতঙ্কভরা চিৎকার আসে। অহাকালু সহ সবাই কান পাতে। দানবকালু দিশ-ধরে একটু শুনেই বলে, — মড়লপাড়ার দিক থাইক্যা না?
— হ, খাতু মড়লের বাড়ির দিক থাইক্যা।
দানবকালু পারতপক্ষে কথা কয় না। বড়ভাইকে মাইন্যতা দিতেই সে সকলের আলাপ শোনে। সে একটা গলা খাকারানি দিয়ে বলে, — এই সংবাদে মানু মিয়া খুশি অইব। তার জাতশত্রু খাতু মড়ল। হের বাড়িত ওলা বিবি পত্তন নিছে।
দানবকালুর এই কথায় অহকালু বারকয় নীরবে মাথা ঝাকিয়ে মেনে নেয়। কাদু বলে, —জগতে কেউ কেউ যে নিচা মনের মানুষ এইডাই অইল হেই চিহ্ন।

তারা কথা বলছিল পাড়াটার উত্তরপাশে দাঁড়িয়ে। তার কয়হাত সামনেই কালাই বিলের পাথার শুরু। তাদের পেছনদিকে মড়লপাড়া, বাঁয়ে কলুপাড়া, সামনে কালাই পাথারের অন্ধকার ও বিষুরির থলি। সে-অন্ধকার মরণের মতো ভয় আর আতঙ্কের নজির।

অহাকালু সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। পানির তিরাশে সে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু একা বাড়ির পিছনদিকটা ঘুরে, বিলপারের তিনটা কান্দা ডিঙিয়ে পানি খেয়ে আবার একা ফিরতে ফিরতে সে বুঝি ওলা বিবির ডরে পাছা উল্টে মরেই থাকবে।

অহাকালু জানে, ওলা বিবি এই কালাই বিলের পার ধরে ধরে হাঁটে। প্রথমে সে এক বাড়িতে পত্তন নেয়। তারপর ফি রাতে বাড়িটা থেকে বের হয়ে পাশের বাড়িতে ওঠে। কোনো কোনো সময় একরাতে সে সাত-আট বাড়িতে হানা দেয়। চলার সময় তার গতর থেকে নাকি হাম হাম করে গরম বাতাস বের হয়। সেই বাতাসের বাওয়ার লাগলেই হল। ঘণ্টাখানেকর মাঝেই শুরু হবে দাস্ত। চালধোয়া পানির মতো মলের রঙ। অহাকালুর গতরটা শিরশির করে ভেঙে আসে। সে ভয় কাটাবার জন্য মুখ খোলে, — খাতু মড়লের সাতটা পুত। এক-দুইডা গেলে কী অইব, কয়দিন বাদে যেই খাতু হেই খাতু। কোদাল কান্ধে লইয়া বাতরে বাতরে হাঁটব আর খালি কর্তারে তালাশে রাখব।

অহাকালুর এই আলাপে কেউ রা করে না। সবাই ঝিম মেরে বসে থাকে। বিলের উত্তর কান্দায় ঘা খেয়ে শনশন করে বয়ে যায় ঠাণ্ডা বাতাস। সেই ঠাণ্ডা পরশে বুঝি তারা মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে চমকে ওঠে। তাই দানবকালু জানপ্রাণে একটা ডাক দেয় — হেই আল্লা আল্লা বলো…

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you