কাগজ ও কন্টেন্ট : বৈষয়িক বৈচিত্র্য ও অন্যান্য গড্ডলপ্রবাহ || আহমদ মিনহাজ

কাগজ ও কন্টেন্ট : বৈষয়িক বৈচিত্র্য ও অন্যান্য গড্ডলপ্রবাহ || আহমদ মিনহাজ

‘কিন্তু ছোটকাগজ কি পাঠক পড়ে?’ — প্রশ্নটা আজকাল ধাঁধার মতো লাগে। একবার মনে হয়, — পড়ে; পরের মুহূর্তে ভাবি, — আরে দুর, উল্টায়পাল্টায়ে বইয়ের তাকে রেখে দেয়! ছোটকাগজের চর্চা বা বিপণন বিগত দশকগুলায় সীমিত আকারে যেটুকুন ছিল অদ্য তার কিছু অবশিষ্ট নাই। ফি বচ্ছর নতুন-পুরাতন মিলেঝুলে অনেকগুলা বাহির হয় এবং অচিরে আঁধারে মিলায়। কারো সময় নাই তার খবর করার!

আজি হইতে পনেরো-কুড়ি বৎসর আগে ছোটকাগজের লেখক-পাঠকরা কাগজের ভালোমন্দ সমাচার জানিয়ে চিঠিপত্র দিতেন। সাক্ষাতে অনেক সময় কথা হইত। একদম টাটকা কোনো কাগজের পরিচিতি ও আলোচনা চোখে পড়ত। কাগজ করার খর্চা না উঠতে পারে কিন্তু ছোট্ট এক পাঠকশ্রেণির গণ্ডিতে সে তখন দিব্যি হেসেখেলে দিন পার করেছে। কাগজের ভালোমন্দ তালাশের ছলে লেখক-পাঠক মিলে জমিয়ে গুলতানি মারার কালচারটা বেশ লাগত তখন। এখন ওসবের বালাই নাই। সুতরাং পড়ে অথবা পড়ে না ইত্যাদি ধাঁধায় বেলা পার হয়।

হাল জামানায় ছোটকাগজ প্রকাশ যাইবার খবর মিলে ফেসবুকে। কাগজ বের করার সংবাদ জানিয়ে সম্পাদক মহাশয় একখানা স্ট্যাটাস ছাড়েন সেখানে। কতিপয় লাইক ও কমেন্ট হাসিল হইবার পর লেখককপি ও বইয়ের দোকানে কাগজখানা প্রেরণের কথা তার স্মরণ হয়। এর অধিক কিছু ঘটে কি? এমনও হয়, চেয়েচিন্তে লেখা ছেপে লেখককপি পাঠানোর তাড়া সম্পাদককে উতলা করে না! ছোটকাগজে যারা রোজকামলা খাটেন তারাই এর লেখক কাম পাঠক কাম প্রকাশক কাম বিজ্ঞাপক; — এমতো সংঘ বা গোষ্ঠীচেতনায় ভর দিয়া কাগজ করার প্রথা খতম হওয়ার পথে। এই অচলাবস্থায় আরেকটা কাগজ প্রকাশে কী ফায়দা সেইটা তাই বুঝে আসে না!

স্পষ্ট করেই বলি,— বাংলাদেশে সাহিত্যের কাগজটাগজ কেউ পড়ে না। একটা সময় ছিল ঈদসংখ্যার অপেক্ষায় চাতক পাখির ন্যায় মোরা তাকিয়ে থাকতাম। বিচিত্রা  সাপ্তাহিকের ঈদসংখ্যা লক্ষাধিক ছাপা হইত তখন। শুনতে পাই ঈদসংখ্যা নাকি তিন-চারশো কপির বেশি এখন ছাপে না! ভাবা যায়! ব্লগ, ফেসবুকের মচ্ছব শুরু হওয়ার আগে সুপরিচিত সাহিত্যপত্র বা ছোটকাগজ দুই-তিন হাজার কপিও ছাপা হইতে দেখসি। ওপার বাংলা থেকে আসা কাগজগুলার জন্য অপেক্ষার অন্ত ছিল না! এখন দুই-তিনশো কপি ছাপাটাই আবান্তর মনে হয়। লেজেগোবরে অবস্থাটার জন্য সম্পাদক নাকি পাঠক দায়ী সে-তল্লাশে নামার শক্তি অধমের নাই। এটুকু কেবল জানায়ে রাখি, ছোটকাগজের মরাগাঙে জোয়ার উঠানোর বাসনা যদি মনে পোষেণ তবে পুরানা ধ্যানধারণা বাদ দিয়া নতুন করে ভাবা প্রয়োজন।


অনলাইন আর প্রিন্টমিডিয়া মিলেঝুলে লেখক-পাঠকের বৃত্ত বা সার্কেল গড়তে না পারলে এই লিটলম্যাগ/লিটলম্যাগাজিন বা ছোটকাগজ মাধ্যমটার মরণ ঠেকানো নামুনকিন! মন স্বপ্ন দেখে, — লেখক-পাঠকের এই সার্কেলের সদস্যরা পড়ুয়া হবে। নিজে ভাববে ও ভাবনাটা নানান ছলে বিনিময়ের উপায় খুঁজবে। দুই হাত উজাড় করে তারা লিখবে ও অন্যদের মাঝে সক্রিয়তাটা ছড়িয়ে দিবে। এই স্বপ্ন ও দুরাশা ছাড়া আপাতত সম্বল বলে কিছু নাই হাতে। ই-মেইলের আঁটোসাঁটো পরিসর ছোটকাগজের ভূতনামা তদন্তের জায়গা নয়। মনখারাপ ঘটনার পরোয়া না করে একটা ছাপাকাগজের নতুন সংখ্যা করার জেদে যদি অটল থাকতে মন চায় তাহলে বুলেট আকারে কিছু ভাবনা সংযুক্ত করে যাই এইবেলা।

বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা  বের করার ইচ্ছা থাকলে এই কথা মাথায় রাখা জরুরি যে এই কামে খাটনি বিস্তর। খনিশ্রমিকের শ্রম দিতে পারে এমন লেখক ছাড়া বিষয়নির্ভর সংখ্যা কাগজের অপচয় ঘটায়। লক্ষকোটি বৃক্ষ সাবাড় করে যে-কাগজ ফি বৎসর তৈয়ার হয় তার অপচয় পরিবেশবান্ধব ছোটকাগজকে কি মানায়? বিষয়ের গভীরে প্রবেশ যাইতে না পারলে সকলই বৃথা। নিজের ওপর সুবিচার করতে পারবেন ও সঠিক সময়ে লেখা দিবেন এ-রকম একগুচ্ছ লেখকের তালিকা যদি করা যায় তাহলে ঠিক আছে, অন্যথায় বিষয়ভিত্তিক চিন্তা বাদ দিয়া আগানো উত্তম মনে করি। কথাটা বিবেচনায় রাখা দরকারি।

কী বিষয় নিয়া কাগজ সাজাইতে চান সেইটা ঠিক করা বিরাট ঝকমারি! রঙের সংসারে বিষয়ের অন্ত না পাই! কাকে রেখে কাকে বাছবেন সেই বিষয়ে আগে চাই সম্পাদকের মন স্থির করা। বাকি কাজগুলা ওই পথ ধরে আপনা থেকে আগাবে। যেমন ধরেন, গানবাজনায় আপনার বা আপনাদের সম্পাদনা পর্ষদের মধ্যে যার জানাশোনা ও চর্চা ব্যাপক তার এলেমের ওপর ভরসা করে গানভিত্তিক সংখ্যার পরিকল্পনায় হাত দিতে পারেন। সংগীতের মহাসাগর হইতে বিশেষ কোনো মণিমুক্তা তুলে আনতে গানসায়রে ঝাঁপ দেয়া ছাড়া শর্টকাট নাই।

পঞ্চকবি রবীন্দ্র-নজরুল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রলালের যুগ অস্ত যাওয়ার পর বাংলা আধুনিক গানের গলিঘুঁজিতে যত ঢেউ উথলে উঠেছিল বা এখনো ওঠে তার ভালোমন্দ পাঠের লক্ষ্যে সংখ্যা সাজানো যায়। বাংলা গানে পাশ্চাত্য সংগীতের ধারা ও বাদনপ্রণালির প্রভাব, এর সঙ্গে মিলন, দূরত্ব, বিচ্ছেদ সেখানে আপনা থেকে প্রাসঙ্গিক জায়গা চেয়ে নেবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ কর্তব্য, কবীর সুমনের মতো সংগীতব্যক্তিত্ব আমাদের সময়ে বেঁচে আছেন। উনাকে দিয়া লেখানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। লিখতে না চাইলে স্বরচিত বহিপত্র ও ইউটিউবে ছড়ানোছিটানো সংগীতভাবনাকে একতারায় গেঁথে রচনা তৈরি করা যাইতে পারে। উনার অনুমতি লাগবে অবশ্য। সংকলিত অনুলিখনটা পাঠাতে হবে। দেখেশুনে যদি অনুমতি দেন তবে সংগীতে তাঁর অবদানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হবে কাজটা। বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাস ও বিবর্তনকে নিজের হাতের তালুর মতো চিনেজানে এ-রকম লোকের সংখ্যা বঙ্গে অধিক জীবিত নাই এখন। সময় থাকতে কবীর সুমনকে ব্যবহার করা উচিত মনে করি। প্রতুল মুখোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিক হইতে আরম্ভ করে বাংলাদেশের সাইম রানা বা  মাকসুদুল হক সহ আরো অনেকের লেখাজোখা অ্যাকোমোডেট করতে পারে এমন একটা গানসংখ্যা অনুপভোগ্য হবার কারণ দেখি না। গান গাওয়া ও শ্রবণ নিশ্চয় সংগীতের শেষ কথা, তবে হ্যাঁ, সংগীত বিষয়ে দুছত্র লেখাটাও সমান দরকারি। সবাই লিখতেই হবে এমনও নয় সবসময়, যিনি লিখতে রাজি হন তিনি লিখবেন নতুবা সাক্ষাৎকারের ছলেও কথা বের করা সম্ভব। বাংলাদেশের গীতিকার, সুরকার, গায়কদের মধ্য থেকে নির্বাচিত কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিতে পারেন। গান বিষয়ক ভাবনার বিচিত্র অনুষঙ্গ উঠে আসবে ধারণা করি। গান তো অজস্র কিন্তু তার পাঠবিশ্লেষণ আজোবধি নগণ্য বলা যায়। সুতরাং বাংলার গানভাবিক লোকজন কাজটার জন্য পত্রিকাটা স্মরণ করবে। তরুণ সংগীতভাবিক লোকজন দেশ-বিদেশে বিরাজ করে বৈকি। তাদের খুঁজে বের করা সম্পাদকের মিশন হওয়া উচিত।


এইবার অন্য কথায় আসি। নির্দিষ্ট বিষয় বাদ দিয়া একাধিক প্রসঙ্গ বা অনুষঙ্গ এক-মলাটে জুড়ে কাগজ হইতে পারে। এই ধরেন, গত একদশকে যেসব কবিরা কবিতায় হাত মশকো করেছে তাদেরকে উপজীব্য করে সংখ্যা করা কঠিন নয়। নিজ হস্তে রচিত প্রিয় কবিতা সম্পর্কে অনুভূতি ও ভাবনা তারা কাগজটায় লিখবেন। নিকট-দশকের (…আশি থেকে শূন্য পর্যন্ত হইলে ভালো হয়…) কবিতায় চাউর লক্ষণ নিয়াও খানিক আলাপ জুড়বেন সেখানে। তাদের নিজস্ব পাঠপদ্ধতিতে যে-লক্ষণটাকে সবচেয়ে সিগ্নিফিক্যান্ট মনে হবে তার ভালোমন্দ নিয়ে পাঠ-অনুভবের আকারে একখানা গদ্যও প্রসব করবে। এই দুইখান গদ্যে ভর করে বাংলা কবিতায় গত এক দশক ও নিকট দশকগুলার জার্নিটাকে পত্রিকাটা ধারণ করবে সেখানে। সঙ্গে তরুণ কবিদের কবিতা তো থাকবেই। কাজটা করতে পারলে ফলাফল খারাপ হওয়ার কারণ দেখি না। চ্যাংড়া কবিদের সঙ্গে বুড়োহাবড়াদের জেনারেশন গ্যাপ  দূর করার উপায় বোধ করি এই উসিলায় পাওয়া সম্ভব হবে তখন।

এইটা গেল প্রথম। এইবার এক-মলাটে অন্য আরেকটা অনুষঙ্গকে স্থান দেওয়া যাইতে পারে। পপ কালচার-এ সংজ্ঞায়িত চিহ্ন থেকে এলা এক-দুইটা বাছাই করেন। রিকশার পাছায় আঁকা চিত্রকলা (Rickshaw Painting) চমৎকার সাবজেক্ট সেখানে। বদ্রিলারের তত্ত্বকথার প্রভাবে হাইপাররিয়েল  ওরফে অতিবাস্তব চিত্রকলার কত নামডাক শুনি চারদিকে! রিকশার পাছা ও বডির সাজসজ্জায় অতিবাস্তবতার এইসব আবেশ বহু আগে থেকে নীরবে বহে! মার্কিন দেশের নাগরিক অ্যান্ডি ওয়ারহোলের সুবাদে ছবি আঁকার পদ্ধতিতে পপ কালচারের প্রভাব প্রবল হইতে শুরু করে। পাশ্চাত্য ঘরানার পপআর্টের সঙ্গে সংযোগ না থাকলেও বাংলার ত্রিচক্রযানে সিনেমার নায়ক-নায়িকা হইতে জীবজন্তু, পাখাপাখালি বা নিসর্গের অতিমাত্রিক অতিরঞ্জন দিব্যি সচল ছিল এক-সময়। সিনেমার পোস্টারে একদা তার ছাপ আছড়ে পড়েছিল। স্মৃতিকাতর ওই যুগটাকে ছোটকাগজের পরিসরে বন্দি করার ক্ষণ ঘনায়েছে।

মধ্যবিত্ত চিলেকোঠায় বন্দি কবি-লেখক-আঁকিয়ে বা গবেষকের মনে এইসব চারুকলার সংবাদ লইবার ঠেকা কভু তীব্রতা পাইতে দেখি নাই। এস. এম সুলতানের ক্যানভাসে বন্দি বাংলাদেশ বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রম হইলেও আপাদমস্তক পৃথক ঘটনা। সুলতানের অঙ্কনপদ্ধতি বা জীবনধারার সঙ্গে পপআর্ট একপ্রকার সংযোগরহিত জিনিস। পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, রিকশা পেইন্টিংয়ের অঙ্কনমাহাত্ম্য বোঝার জন্য বিদেশপানে জাতিকে তখন তাকাইতে হয়েছিল! লোকগবেষক হেনরি গ্লাসির কারণে অঙ্কনরীতিটা দেশের আপামর সুশীল সমাজের টেবিলে সাময়িক জায়গা নিতে সক্ষম হয়। এই শিল্পকলায় সক্রিয় জীবনবেদ পাঠের নেশায় গ্লাসি আশির দশকে বাংলাদেশ ঘুরতে আসছিলেন। অতঃপর আমাদের হুঁশ হয় এবং আমরা আচমকা বুঝতে পারি, — হায় আল্লা! ইহাও একপ্রকার শিল্পকলা হয় বটে!  তারপর আবারো বিস্মৃতির গর্ভে তারে গুম হইতে দেখছি। বহুদিন গত হওয়ার পর শিল্পী রনি আহম্মেদের প্রজন্মে দেখা দেওয়া দু-চারজন আঁকিয়ে এবং অকালপ্রয়াত প্রতিভা আফ্রিদি তানজিম মাহির ক্যানভাসে পপআর্টের শৈলী ও জীবনবেদ খানিক উঁকি দিয়াছিল বোধহয়। মাহি আত্মহত্যাটা না করলে কৈশোরেই পরিণত এই শিল্পীকে দিয়া অতুল কিছু সম্ভব ছিল।

অতিবাস্তব রীতির অঙ্কনপদ্ধতি ছাড়াও বহু বিষয় নিয়া ক্রোড়পত্র করার পথ খোলা রয়েছে। আরেকবার উদাহরণ টানি, ক্যাসেট-সিডি তথা এলপি রেকর্ডিংয়ের যুগে শ্রোতাদের জন্য অ্যালবাম আকারে গান অবমুক্ত করার কালচার দেশে প্রবল হয়। ভারতীয় শিল্পীদের একচেটে দাপটের যুগে দেশের সংগীতকারগণ সমানে গান লেখা ও সুর দিয়েছেন। বাংলাদেশের আধুনিক গানের জার্নিকে তাই জমিয়ে লেখা সম্ভব। চাঁদরাতে নতুন গান অবমুক্ত করার ঘটনায় দেশে তখন বেশ হল্লাগল্লা হইত। স্মৃতিকাতর এই ঘটনার মাঝে জনসংস্কৃতির মনোজগৎ পাঠের সুযোগ বিদ্যমান। পাঠযোগ্য উপায়ে পরিবেশন করা গেলে পাঠক আন্দোলিত হবে ধারণা করি। ক্রোড়পত্রে এ-রকম চিহ্নের ব্যবচ্ছেদ বিষয়বৈচিত্র্যের সম্ভাবনায় কাগজকে ধনী করে।

সেকাল ও একালের পার্বণ/উৎসবের লক্ষণ এবং পালাবদলকে উপজীব্য করে ক্রোড়পত্র সাজাইতে পারেন। অথবা ধরেন, ওয়াজি হুজুরগণের ওয়াজ মাহফিলের ভাষা, বাক্যচয়ন ও বাচনিকতায় ম্যাঙ্গোপিপলের সংযুক্তির ইতিনেতি সম্পর্কে লেখা যায়। আমজনতার মনের তারে এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও ধর্মীয় আচার-ব্যবহারের সাম্প্রতিক বিবর্তন টের পাওয়ার পক্ষে জরুরি খাদ্য বটে। সাঈদী হইতে আজহারী এইখানে একটা ধারা। তাহেরি আঙ্কেলরা আবার পৃথক আরেকখান ধারা সেখানে। আজহারী গানবাজনার ব্যাপারে খানিক নমনীয়, কারণ ওয়াজ জমাইতে ওইটা কামে লাগে। তাহেরি আঙ্কেলের ‘বসেন বসেন’ বা ‘আমি ঘুমভাঙানিয়া পাখি’-র সিগনিফিকেন্স, মনে-মনে ভাবি দেরিদা বা রলাঁ বার্থের মতো কারো হাতে পড়লে নতুন চিহ্নবিজ্ঞানে মুখর হইত নিশ্চয়। দেরিদার অফ গ্রামাটোলজি  তো রুশোর কুড়ি পৃষ্ঠার একখানা অখ্যাত রচনার পাঠবিশ্লেষণের জের ধরে ঢাউস কিতাবে মোড় নিয়াছিল। সময়-সমাজকে কেমন করে পাঠ যাইতে হবে তার তরিকা তিনি শিখায়া গেলেন। ওয়াজ মাহফিলে ইসলামকে ডেলিভারির তরিকায় দুই ধারার সংঘাত, তাদের বাচন ও দেহভঙ্গি বিষয়ে জমিয়ে লেখা সম্ভব। ডিকনস্ট্রাকশনটা লিখবে কে? — লেখার কাজে যোগ্য মানুষটাকে এডিটর খুঁজে নেবেন। ঢুঁড়িলে নিশ্চয় পাইবেন। সম্পাদকের এইটা হইসে একমাত্র কাজ।

বাঙালি ললনার নিজেকে সাজানোর অতীত হইতে বর্তমান অর্থাৎ প্রসাধনশিল্প নিয়া ইচ্ছা করলে ক্রোড়পত্র ফাঁদতে পারেন। ঈদসংখ্যার সেকাল-একাল, বাহারি স্ট্রিটফুড ছাড়াও অগণিত চিহ্ন বঙ্গে সদা বহে আর মিলায়। মালজোড়া ও কবিগান তো আজকাল বন্দি পায়রা। ক্বারী আমির উদ্দিনকে কেন্দ্র করে আস্ত একখান ক্রোড়পত্র করা ভীষণ জরুরি। উনি লন্ডনে থাকেন শুনেছি। ভক্ত-আশেকান ছাড়া সহজে কাউকে দেখা দিতে চান না। দেশে আসছিলেন মাঝখানে। সেজুল হোসেন অনেক চেষ্টা করে দেখা করতে পেরেছিলেন। পেটের ভিতর থেকে অধিক কথা যদিও বের করতে পারেন নাই। কিন্তু সময় নিয়া নাছোড়ের ন্যায় চেষ্টা করলে লোকটা নিজেকে মেলে ধরতেও পারে। পত্রিকার পাতায় এই লোকটারে ডকুমেন্টেড করা আজকালের মধ্যেই করে নেয়া ছাড়া টাইম বেশি নাই। ক্বারীসাব কবে মরে যায় তার ঠিক কী!

মৃত রমেশ চন্দ্র শীল বা আবদুল গফুর হালী কিংবা রাজ্জাক দেওয়ানকে নিয়া লেখা ফাঁদার অঢেল সুযোগ রয়েছে। হাবিবের হাত ধরে বাউল করিম বা আবদুল গফুর হালীর নাগরিক সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের ঘটনাটা পাঠযোগ্য আলোচনায় হাজির করতে পারলে ছোটকাগজের জাত মারা যাবে না। ফোকসম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগমের গায়কিসত্তার বিবর্তন অথবা পতন … এই জার্নিকে লেখক-সম্পাদক যদি ধরতেই না পারল তাইলে খালি দু-চারখান গৎবাঁধা কোবতে ও গদ্যে পাতা ভরিয়ে কী লাভ আমারে বুঝান!

সাহিত্য আন্দোলন এখন মরহুম কী কারণে? — এই প্রশ্নের জবাব হয়তো চারদিকে স্রোতের মতো উপচে-পড়া চিহ্নের সঙ্গে আমাদের শীতল নাকউঁচা মনোভাবের দূরত্বের মাঝে নিহিত। মানে অবশ্য এই নয়, যা-কিছু ধ্রুপদী তারে বাদ দিতে হবে। ধ্রুপদী গানবাজনা নিয়া সংখ্যা বা ক্রোড়পত্র অবশ্যই হবে। পরদেশি ও ভারতীয় উপমহাদেশের ধ্রুপদী সংগীতের কোনো ঘরানা টার্গেট করে আগানো যায় কি?

আলোকচিত্র নিয়া কাজ হবে জোরেশোরে। সৃজনশীল চলচ্চিত্রের ভাষাকে ছোটকাগজে অবশ্যই নিবিড় মমতায় খনন করে যাবে। সেইসঙ্গে উপমহাদেশের মূলধারার সিনেমার ভাষা ও বয়ানকে সমান গুরুত্ব সহকারে স্থান দেওয়া প্রয়োজন।


এইসব বলার একটাই উদ্দেশ্য, — পপ কালচারে সচল অনুষঙ্গরা হচ্ছে সেইসব চিহ্ন যার ভিতর দিয়া জাতি কথা কয়। অণুবীক্ষণ চোখে তাকে নজরে আনতে পারলে জনমানসের বিবর্তন, আবর্তন ও পালাবদলের সবটাই পাঠ যাওয়া সম্ভব। রলাঁ বার্থ এই ক্ষমতার বদৌলতে সাইনোলজিকে নতুন উচ্চতায় নিয়া গেলেন! কুস্তিকে বিষয় করে তাঁরে লিখতে দেখি। সোপ অপেরা নিয়া মজমা জমাইতে কসুর করে না। রাস্তায় টানানো বিজ্ঞাপনের বুলি দেখে তাঁরেও বুলি কপচাইতে শুনি। আবার ফটোগ্রাফির অন্দরমহলে ঢোকার দিন হইতে জবরদস্ত কাব্যি করতে দু-বার ভাবে না এই লোকটা। ক্যামেরা লুসিডার মতো ছোট্ট কিতাবখানা পাঠ যাইতে কী যে স্বাদ কী যে স্বাদ…!

একটা সংখ্যায় তো আর সব ধারণ করা সম্ভব না। পপ সংস্কৃতির সকল উপযোগ নিয়া একটা কাগজ খণ্ডে-খণ্ডে কাজ করতে পারে। ছয়-সাতখান সংখ্যা করা লাগবে হয়তো! বেশি হইলে দশ। প্রতি সংখ্যায় একটা বা দুইটা চিহ্ন বেছে কাজে নেমে পড়েন। এর পাশাপাশি গল্প-কবিতা-অনুবাদ ও মুক্তগদ্য ছাপানো যাইতে পারে। অসুবিধার কিছু নাই। যজ্ঞটা সফল করতে লেখক বিছড়ানো সবচেয়ে বড় কাম। চেষ্টা করলে সেইটাও সম্ভব।

ছোটকাগজের মরা গাঙে যদি জোয়ার বহাইতে চান তবে কাজ সে-রকম হওয়া চাই যার জোরে পাঠক নিজে থেকে আপনাকে বুকে টানবে। গৎবাঁধা ঢেঁড়সভাজি আর কতদিন চলবে ভাই! এইবার বোধ করি খ্যামা  দেওয়া প্রয়োজন। হয় নতুন কিছু হবে নতুবা শীতিনিদ্রা সকল ব্যাধির মোক্ষম উপশম। আজ এইটুকু। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক, সকলেই অনন্ত নিরাকারে নির্বাণ লাভ করুক। আমিন। সুম্মা আমিন।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
গানপারে ছোটকাগজ বিষয়ক লেখাজোখা

COMMENTS

error: