আমাদের ইউএসট্যুর || রাহাত শাহরিয়ার  

আমাদের ইউএসট্যুর || রাহাত শাহরিয়ার  

আমেরিকা মহা একটা দেশ। তার ওপর বীরশ্রেষ্ঠদের জাতি। দেশে দেশে যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত। তাই একটা ভয় কাজ করে। ৮/৯ বছর ধরে বড়ভাইদের প্রতিবেশী। পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধবে সয়লাব। তার ওপর ৩ বছরে প্রথম ভ্যাকেশন। আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা হলাম আমরা।

লাগোয়ারডিয়া ছোট বিমানবন্দর। ঝামেলা ছাড়া বেরিয়ে পড়লাম। খালু এসে পিকআপ করলেন। গাড়ি থেকে নিউইয়র্ক শহর দেখছি। ডানে বামে। ফ্লাশিং মিডো। ওপেন টেনিস। আগাসি/সাম্প্রাসের। টিভির দেখা সব চোখের সামনে। গরম মারাত্মক। টরন্টোর মতোই। ঘরবাড়ির আদলও অনেকটা একরকম। রাস্তার ট্রাফিক সিগ্নালও। তবে সবকিছু তুলনায় বড় আর বেশি বেশি। দীনদুনিয়ার রাজধানী হিসেবে ধরা হয়। সেই রকম ব্যস্ত। গাড়ির হর্ন বাজছে একেবারে ঢাকা শহরের মতো। খালার বাসায়। প্রথমবার আসা। তার ওপর জামাই আদর। অতুলনীয় সমাদর। পরের দিন ভার্জিনিয়া যাওয়া। আগের রাতে ঘুম হয়নি। প্রথম সন্ধ্যা ঘুমিয়েই কাটালাম।

পরের দিন মামা আসলেন। আপনজনের সাথে ১০/১২ বছর পরে দেখা হবার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার স্পর্ধা করা ঠিক নয়।

আমরা নিউইয়র্ক ছাড়ছি। মামা গাড়ি থেকে টাইম স্কোয়ার, জাতিসংঘ অফিস দেখালেন। ম্যানহাটন হয়ে। বের হওয়ার জন্য আমরা লিঙ্কন টানেলে ঢুকলাম। নদীর নিচে রাস্তা। অবিশ্বাস নিয়ে আবার মামাকে জিজ্ঞেস করলাম। নিউইয়র্ক শহরের সেতুগুলোর প্রতি আমার অনেক দুর্বলতা। কিন্তু টানেলটা আমাকে শিহরণ দিচ্ছে। এত বড় নদীর নিচে রাস্তা বানিয়ে ফেলল! আমেরিকা মহা একটা দেশই বটে। আমরা টানেল শেষে সিটির বাইরে চলে এলাম।

ভার্জিনিয়ার পথে।


ফার্স্টব্লাড কথাটায় আমি তেমন গা করি না। তবে এই ফার্স্টব্লাড আমায় সবসময় গা করে এসেছে। প্রবাসজীবনে আমার কাজিনভাগ্য আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো। শুরু থেকেই ভাইদের সাপোর্ট ছিল মেনিটোবায়। টরোন্টোতে এসেও হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। বলবার আগেই কাজিনের সাপোর্ট চলে আসে। কথা হচ্ছে প্রাক-প্রবাসজীবনেও আমি কাজিনসাপোর্ট পেয়েছি। সেই সাপোর্ট এখন ভার্জিনিয়ানিবাসী। যাওয়া নির্ধারিত হবার পর থেকে সে ক্রমাগত আপডেট নিলো। ছোটমামার সাথে প্ল্যান করে একেবারে সব ঠিকঠাক করে রেডি। এ-জন্যেই সেখানে যাওয়া।

টানেল শেষেই নিউজার্সি। আমার বন জোভির ‘নিউজার্সি’। হতাশ হলাম একটু। কালারফুল। কিন্তু নিউইয়র্কের এত কাছে একটু পিছিয়ে-পড়া মনে হলো। চলে আসলো ডেলাওয়ার সেতু। দেখার মতো একটা সেতু হচ্ছে এটা। হা করে দেখতে দেখতে নদীর কথা ভুলেই যাচ্ছি। আমাদের অন্টারিওতে নদী খুব কম। আমি যেখানে আছি সেখানে তো খালকে নদী বলে চালাচ্ছে শত বছর ধরে। তাই অনেকদিন পর বিশাল মেঘনা সাইজের নদী দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। ব্রেক নিলেন মামা। প্রচণ্ড মানসিক শক্তি আর নিখাদ আদর না থাকলে উনার এই শরীরে এতদুর ড্রাইভ কেউ করবে না। গ্যাসস্টেশান আর রেস্টহাউজ। হোটেল উজানভাটি! সবখানেই আছে। বিজ্ঞাপন, পণ্য আর সেবা ভিন্ন। সবখানের মতোই ওয়াশরুম। জীবনে প্রথম দেখা পাবলিক ওয়াশরুম দেখেছিলাম বন্দরবাজার, সিলেটে। ২ টাকা পার শট। এখানে ফ্রি। পরিষ্কারও করছে একটু পরপর। তাতে কী! ঘ্রাণ বন্দরবাজারকেই মনে করিয়ে দেয়!

আবার রওনা। আমি আশেপাশের বিশাল গাছের দিকে তাকিয়ে আছি। ডালগুলো কত উন্নতি দেখল এই কয়েকশো বছরে। প্রচুর বনায়ন হাইওয়ের দুপাশে। গাড়িতে, ট্রাকে আমেরিকান পতাকা লাগিয়ে যাচ্ছে। যেন দু মিনিট পর পর মনে করিয়ে দেয়া, ‘ব্যাটা, আমেরিকায় আইসত কইলাম’। বাড়িতে বাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ানো বাংলাদেশ বাদে সবাই সারাবছর করে। আমরা করি পার্বণ আসলে।

হাল্কা একটু পেন্সিলভেনিয়া ছুঁয়ে আমরা মেরিল্যান্ডে। বাল্টিমোর। সন্ধ্যার আলোয় বাল্টিমোর এত সুন্দর লাগল! একবার সময় নিয়ে আসতে পারলে হয়। অবশ্য এর ক্রাইম রেট খুব বেশি। থাক।

রাত ৯ টার সময় আমরা ফেয়ারফ্যাক্স, ভার্জিনিয়ায় এলাম। কাজিন আর তার ওয়াইফের ঘুম হারাম। একে ছোট বেবি, তার ওপর আমরা ৫ জন বড় বেবি। কিন্তু তাদের উত্তেজনা দেখে কে! আড্ডা খাওয়াদাওয়ার পরে ঠিক হলো পরের দিন আমরা ডিসি যাব।

ভার্জিনিয়া খুব ছিমছাম। রাস্তাহাটে বাম্প নেই। মানুষও কম। খোলামেলা। আমরা ওয়াশিংটন, ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায় ঢুকলাম। প্রথম রোড যেটা চোখে পড়ল, তার নাম, ‘Black Lives Matter’ রোড। মাত্র কিছুদিন আগে জর্জ ফ্লয়েডের সম্মানে। একটা আফ্রিকান-আমেরিকান জাদুঘর আছে সেখানে। যাওয়া হয়নি যদিও। গাড়ি পার্ক করে আমরা হন্টন করে হোয়াইট হাউজ দেখতে গেলাম। জারিজুরি সবই ইউটিউবে দেখা। তারপরও সামনাসামনি দেখা বলে কথা। মোড়ল সদর দপ্তর। হায় ট্রাম্প! দূর থেকে আবছা দেখা গেল। ছবিটবি তুলে আমরা ওয়াশিংটন মনুমেন্ট দেখতে গেলাম। দেখার মতো একটা মিনার। ১৮৮৪ সালে নির্মাণ শেষ হয়। মুগ্ধ হতে গিয়েও পারলাম না। কত দাসদের শ্রম এতে লেগে আছে! আমি বরং লিঙ্কন মেমোরিয়াল নিয়ে বেশি আগ্রহী। এই লোকের সততা জগজ্জোড়া খ্যাত। তাকে ‘Honest Abe’ নাম দেয়া হয়েছে। ভাবলাম তাকে জড়িয়ে ধরে একটা ছবি তুলব। নাহ, এ পুরো দুর্গা দেবীর মূর্তির মতো, তার ওপর মাস্ক পরেননি। জড়িয়ে ধরা নিরাপদ না। বিশাল সাদা পাথরের। টুরিস্টদের ভিড়। বেশি কাছে যাওয়া গেল না। দূর থেকে লিঙ্কনের চোখ দেখলাম। এই চোখের কিছু ভালমানুষী ভিশন আমেরিকা আর বাকি দুনিয়াকে বদলে দিল। ডিসি আসা সার্থক আমার।

রাতে আমরা ফোর্ট ওয়াশিংটন গেলাম। এটা ম্যারিল্যান্ডে। তবে কাছেই। নদীর মোহনায়। বিশাল তবে। তীরে টুরিস্ট স্পট। ক্যাসিনো, বোট, নাগরদোলা। পারফেক্ট ফ্যামিলি আউটিং। DONE.

পরের দিন দুপুরে আমরা নিউইয়র্ক চলে আসব। বিদায়কালে গাড়ি থেকে আমি শেষবার তাকিয়েছিলাম আব্বুর প্রতি। আমাকে বিদায় দিতে এয়ারপোর্ট যেতে পারেন নাই। এরপর থেকে বিদায়বেলায় আমি আর পেছনে তাকাই না। আজ তাকালাম। ওরা তিনজন আমাদের টা টা দিচ্ছে। মনখারাপ হয়ে গেল। পারলে সাথে করে নিয়ে আসতাম।

কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি…


ভার্জিনিয়া থেকে নিউইয়র্ক ফেরার পথে ঝুম বৃষ্টি। ডেলাওয়ারের চমৎকার সেতুটা আবার ভালো করে দেখলাম। আর দেখা না-ও হতে পারে।

আমার এক খালাকে দেখতে গেলাম। খালা আমার মায়ের কাজিন। খুবই স্নেহ করতেন আম্মুকে। আম্মু মারা যাওয়ার পর শুধু দোয়া পাচ্ছেন। খালার স্নেহের অংশ এখন আমাদের। খালাতো বোন আর দুলাভাই এজন্যে বিশাল আয়োজন করেছেন। অনেক রিলেটিভকে একসাথে জড়ো করলেন। অনেকের নাম ছোটবেলা থেকে শুনেছি। এই প্রথম দেখা। এমনকি এক মামা তো আমার মা-বাবার বিয়ের ঘটক ছিলেন। অসম্ভব ভালো একটা সময় কাটলো। ভুরিভোজ, আদর-আপ্যায়ন; কিছুরই কমতি ছিল না।

আমেরিকার প্রতি মোহ কোনোকালেই ছিল না। সিলেটি হিসেবে বিলাত আমার ফেভারিট ছিল। তবে আমার বাল্যকালের ২/৩টা (?) শখের মধ্যে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখার মোহ ছিল। খালু ফেরিঘাটে নামিয়ে দিলেন। বোঝাই হয়ে ফেরি রওনা দিলো। নতুন করে শুরু করবে এই আশায় যারা জাহাজে আমেরিকা পাড়ি জমাতো, তারা নাকি জাহাজ থেকে এই মূর্তি দেখতে পেয়ে দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তি ভুলে যেত। প্রথম প্রজন্ম ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে সেই অনুভূতি আমার চেনা। আসলেই দেখার মতো কারিশমা। সবগুলো টুকরো জাহাজে করে এনে এই দ্বীপে এসেম্বল করেছে। সামান্য একটা টেবিল এসেম্বল করেছিলাম একবার। আজও পায়া নড়বড় করছে। ভাবছি, কীভাবে করল ওরা! একটা মিউজিউয়াম আছে। কীভাবে শুরু আর কীভাবে শেষ, এই নিয়ে। প্রচুর ট্যুরিস্ট। সবাই খুশি। আসার সময় অ্যালিস আইল্যান্ড উঠলাম। পুরো দ্বীপটাই ছিল জেলখানা। বিশেষ করে নতুন আসা ইমিগ্র্যান্ট বা দাসদের জন্য। খারাপ লাগল। এক-দেড়শ বছর আগে এলে হয়তো আমাকেও এখানে পুরে রাখত।

এরপর আসলে আমাদের সময় খুব তাড়াতাড়ি উড়াল দিলো। জ্যাক্সন হাইটসে কয়েকবারই গেলাম। ঢাকার পরিবেশ। দেশি সবকিছু পাওয়া যাচ্ছে। ফুচকাটা অনেক ভালো লাগল। কোনো মারামারি ছাড়া সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। জাতি হিসেবে বিদেশের মাটিতে এই একটা ক্রেডিট আমরা নিতেই পারি।

কাল হো না হো ব্রিজ, স্যরি, ব্রুকলিন ব্রিজ, রাতের টাইম স্কোয়ার, হান্টার পার্ক থেকে রাতের ম্যানহাটন দেখা, তাক-লাগানো পরিষ্কার জোন্স বিচে অনেকদিন পর সমুদ্র দেখা — ৩ দিনে নিউইয়র্ক সিটি দর্শন। এই প্যাকেজে অনেককিছুই বাদ পড়ে গেল। শেষের দিন শুধু কিছু মানুষের সাথে দেখা করে কেটে গেল। ভালো মানুষ! কিছু মানুষের সাথে দেখা হলো না।

মানুষগুলোকে খুব মিস করব আমরা। মনখারাপ-করা বিদায়, আগের বিমানবন্দরটাই। তবে এবার বেশি কড়াকড়ি করল। যাবার দিনের মতোই আমরা ঘুমহীন। মন্ট্রিয়ল হয়ে টরন্টো। ব্যাক টু দি প্যাভিলিয়ন। বাসায় ব্যাগ রেখেই নিচে গেলাম। ডাবল ডাবল। ওহ টিম হর্টন! হাও আই মিসড ইউ!

আমি সবসময়ই যাযাবর ছিলাম। ঢাকার বাসায় খুব কম থাকা হতো। কানাডায়ও এখানে-সেখানে যয়দিন কয়দিন। এখন যেখানে থাকি, সে-বাসায় উঠার পর আড়াইবছর একরাতও আমি বাইরে থাকিনি। এবার প্রায় ৯ দিন বাইরে। এবার অনেকবছর পর আমি নিজের ঘরে ফেরার আনন্দ উপভোগ করছি।

যার জন্যে অবশ্য এটা নিজের হয়েছে তার সাথে শেয়ার করতে গেলাম ব্যাপারটা। হলো না। গভীর নিদ্রায় ইতোমধ্যে… ।

অগাস্ট ২০২১


রাহাত শাহরিয়ার রচনারাশি

COMMENTS

error: