নতুন পৃথিবীর পাঠশালা
গত পাঁচ বছর ধরে মাগীকুদ্দু পলোবাওয়ায় যায় না। গ্রামদেশের মানুষ শীতকালে বিলে বিলে পলোবাওয়াকে বলে ‘হাত।’ হাতে ভাগ্যপরীক্ষাটা একেবারে হাতেনাতে। সে বহুবার হাত থেকে ফেরার সময় দেখেছে : কেউ লাছি ভরা মস্ত মস্ত রুই-কাতল কিংবা বোয়াল মাছের ভারে পিঠ বাঁকা করে ফিরছে। আবার কেউ কেউ শত অপরাধীর মতো পলোর আড়ালে শূন্য হাতটা লুকিয়ে চুদা-খাওয়া মাগীর মতো ফিরছে। শুধু পলোবাওয়া না, এইযেন নগদানগদি জয়-পরাজয় রাহুর মতো মানুষের জীবনের প্রতি মুহূর্তে ঘটছে, ঘটবে। তাবাদেও ঘটতেই থাকবে। পলোবাওয়ার জয়-পরাজয়টা সরাসরি চোখে পড়ে। তাই মাগীকুদ্দু কষ্ট পায়। সেইজন্য গত কয় বছর ধরে হাতের দিনগুলাতে ভোরে সে খেতার নিচে শুয়ে শুয়ে মানুষের হাঁকডাক শোনে। দুপুরে যখন পলো কাঁধে নেংটিকাছা মানুষের বহর বিলের দিক থেকে ফিরতে থাকে তখন পাওয়া/না-পাওয়া জিনিসটা দেখতে মাগীকুদ্দুর খুব খারাপ লাগে। হারজিতের জীবনে একটা মানুষ কতবার জিততে পারে? মাথা থেকে মায়ের পেটের বিজল শুকানোর আগেই মানুষের জীবনে শুরু হয় দৌড়। নিরানন্দের সেই দৌড় কবরের আগে আর শেষ হয় না।
এইসব ভাবতে গেলেই মরে যাওয়া মানুষদের মুখ মাগীকুদ্দুর মনে পড়ে। দ্যাখতে দ্যাখতে কত মানুষ কবরে চলে গেছে! মরে গেলা তো শেষ হয়ে গেলা। তোমার কথা আর কেউ মনে করবে না। মাগীকুদ্দু নামে একজন শিল্পী ছিল। সে একনাগাড়ে পঁচিশ বছর রানির পাঠ করে রঙ্গমঞ্চ কাঁপিয়েছে! মরে যাওয়ার কয়েক মাস পরেই জগতের মানুষ এই বিরাট কথাটা ভুলে যাবে। মাগীকুদ্দুর খুব খারাপ লাগে। সে একদিন মরে যাবে এই ভয়ে না। তার মতো আচান্নক এক রানিকে মানুষ ভুলে যাবে তাই। তাবাদে মাগীকুদ্দুর মনে পড়ে তার দাদির মুখ। কুঁচকানো চামড়ার লাল বুড়ির ঠোঁটের কোণা বেয়ে সবসময় পড়ছে পানের রস। শীতের দিন সকালে সাত-আট বছরের মাগীকুদ্দুকে পাশে নিয়ে বুড়ি উঠানের চুলায় শুকনা পাতা দিয়ে ভাত রাঁধত। বুড়ির পাশে বসে আগুন তাপানোর সুখটা বরাবরই ভাবতে তার ভালো লাগে। অথচ সে মাঝেমাঝে তার দাদির নাম মনে করতে পারে না। তাদের বাড়িতেই মাসে, ছয়মাসেও কেউ তার দাদির কথা বলে না। তে ক্যামনে সে তার দাদির নাম মনে রাখবে?
এক হাতবারে মাগীকুদ্দু কঠিন এক ভাগ্যপরীক্ষায় পড়েছিল। পলোবাওয়ার শুরু থেকেই একজন বুড়া মানুষ তার পাশেপাশে পলোবেয়ে যাচ্ছে। তিনটা বিলে পলোবেয়ে এখন চার নম্বরে পড়েছে। সে আশপাশে চেয়ে দেখে এরই মাঝে সবাই চার-পাঁচটা করে মাছ পেয়ে গেছে। মাগীকুদ্দুর কোমরে বাঁধা দড়ির লাছিতেও গাঁথা আছে তিনটা মাছ। লাল টকটকা পাকা রুইমাছটা ছুটে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তখনো দড়ি টানাটানি করছে। পানিতে গুপ্পুর গুপ্পুর শব্দ তুলে পলো চাপতে চাপতে সবাই সামনের দিকে ছুটছে। শীতে হি হি করতে করতে তার পাশেপাশে বুড়াটাও ছুটছে। এখনও সে একটা মাছও পায়নি। এই বছরের মতো আজকেই শেষ হাত। সে আবার বুড়ার দিকে তাকায় : মোটা মোটা হাড়ের মানুষটা শীতে কেমুন টুন্ডা মেরে গেছে। গর্তে-বসা চোখের মণিদুইটা মরা মাছের চোখের মতো ধূসর। আজ যদি মানুষটা মাছ না পায়? যদি সামনের বছরের আগেই বুড়াটা মারা যায়?
একটা বিরাট শক্তিধর মাছ মাগীকুদ্দুর হাঁটুতে গুত্তা মেরে শূন্যে লাফিয়ে ওঠে। সাথে সাথে বিলের হাজারে-বিজারে মানুষ ‘হেই-ই…’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। মাগীকুদ্দু মনে মনে খোদাকে মিনতি করে, — আমি আর মাছ চাই না খোদা। খোদা রে, আমার ভাইগ্যের মাছটা তুমি বুড়ারে দ্যায়া দ্যাও…।
খেতার নিচের ওমে শুয়েশুয়ে মাগীকুদ্দু এইসব ভাবতে ভাবতে একটা বিড়ি ধরায়। কুখাবনগরের রাজা মানু মিয়া তাদের সবার কাছ থেকে জমি হরণ করে নিয়ে গেছে! কালকের সেই চিন্তাটা তার মাথায় কন্-করে ডেকে ওঠে। তাবাদে চিন্তাটা মাগীকুদ্দুর মগজে কুট কুট করে কামড়াচ্ছেই। সে একটা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে আসে। শীতের মিঠা মিঠা রোদে দুনিয়াটা ঝলমল করছে। সেই ভোরে উঠে সকালের সবকিছু শেষে সে আবার বিছানায় গিয়ে আরাম করছিল। আজ সবাই হাতে গেছে। কারো কোনো কাম নাই। গিরস্তেরাও আজ হাতে। তাই সে অবসরের সুখটুকু খেতার নিচে শুয়ে শুয়ে যাপন করছিল। কিন্তু কর্ম তাকে বিধির মতো ডেকে তুলেছে। চল, চল হে বীরবাহু, সম্মুখে ডাকিছে সমর… বলতে বলতে মাগীকুদ্দু বিলপারের উঁচু কান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে পুবের বড় সড়ক দিয়ে কলেজের ছেলেরা মাইকিং করে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে, নৌকা মার্কা নির্বাচনের শেষ মিটিং সামনের বিষুদবারে। স্থান গয়েশপুর মাদ্রাসা মাঠ। তাবাদে ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ চিৎকার দিতে দিতে ছাত্ররা দক্ষিণের দিকে চলে যায়। কী ঝকঝকা একেকটা পোলা! কী তাদের মুখের তেজ, চোখের আগুন, বুকের বল! এম্নি এম্নি কী আর ইয়াহিয়া খান ছাত্রগর ডরে কাপড়ে পেশাব করে?
মাগীকুদ্দু তরস্ত পায়ে আঙ্কুরের দোকানে এসে ঢোকে। আঙ্কুর ছেঁড়া, তেলচিটচিটে খেজুরপাতার পাটিতে বসে নতুন লেখা গানটা কাটাকুটি করছে। মাগীকুদ্দুকে দেখে সে খাতার ফাঁকে কলমটা রেখে দেয়, — তাবাদে খবর কী?
এই বলে আঙ্কুর মাগীকুদ্দুকে বসতে দেওয়ার জন্য নিজে একটু সরে বসে। মাগীকুদ্দু বসতে বসতে বলে : খবর অইল, মানু মিয়া আমগর কাছ থাইক্ক্যা ভাগে জমিন কাইর্যা নিছে।
মানু মিয়াকে কর্তা না বলে মাগীকুদ্দু নাম ধরে ডাকছে দেখেই আঙ্কুর একটু বেশি সচেতন হয়ে ওঠে। তারপর দুইজনে খুব বিড়ি টানে আর আলাপ করে। কত কথা, সংসারের কত আচাভুয়া ঘটনার কথা। কিন্তু তারা দলের কথা, কর্তার কথা ভুলেও ওঠায় না। কর্তা নামের কেউ এই ত্রিসংসারে ছিল সেই কথা যেন তারা ভুলেই গেছে। ঘণ্টাখানেক বাদে মাগীকুদ্দু বলে, — অহন যাই রে…।
‘যাই রে’ বলে মাগীকুদ্দু আঙ্কুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে : হুনছস, হাছু কুলুর জামাই-খ্যাদাইন্ন্যা ছেরিডারে কর্তা হিব্বার…।
অনেক বছর ধরে আঙ্কুর কিছুদিন পর পর এইসব খবর শুনে আসছে। আঙ্কুর তার শিরাবহুল হাড়সর্বস্ব হাতটা উঁচু করে মাগীকুদ্দুকে থামিয়ে দিয়ে বলে : হাছু কুলুরে কৈছ একবার আমার লগে দ্যাহা করতে।
— আমিও ত এইডাই কৈতাছি রে আমার পরানের ভাই…।
এই কথা বলতে বলতে মাগীকুদ্দু আমুদে বসে বসেই পাছা নাড়ায়। সেই তালে তার ছোটখাটো শরীরটাও নাচে। আঙ্কুর সরাসরি ক্লিনশেভ করা মাগীকুদ্দুর ঠোঁটের উপরের তিলটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে, উপরের ঠোঁটে তিলওয়ালা মেয়েমানুষ খুব কুটিল আর কলহপ্রিয় হয়। মাগীকুদ্দু বেটিমানুষ না-হলেও তার ধর্মকর্মের চৌদ্দআনাই মেয়েলি। তাই আঙ্কুর তার নিজের রুগ্ন ঠোঁট ও ফিরিঙ্গিমার্কা পাতলা গোঁফের আড়ালে একটু হেসে নিয়ে বলে : ছাত্রলীগের ইউনিয়ন সেক্রেটারি বরাবর একটা পিটিশন দিতাছি। কী কস্?
বিদ্যুৎতরঙ্গের মতো মাগীকুদ্দুর গতরে মঞ্চের মহারানির জোশ চলে আসে। সে রাতের রঙ্গমঞ্চের মতো বুকের গামছাটার একমাথা শাড়ির আঁচলের আদপে ধরে, গয়েশপুর বাজারের দিকে নির্দেশ করে ডায়ালগ দেয়, — চেমননগরের যুবরাজদের (ছাত্রদের) কানে একবার শুধু সংবাদটা পৌঁছে দিন উজিরে-আলা, খেইল দ্যাখবেন, ভানুমতির খেইল।
আঙ্কুর মাগীকুদ্দুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। মাগীকুদ্দুর খুব ইচ্ছা করছিল আঙ্কুরের পাশে বসে ফের আলাপ জোড়ে। কিন্তু আঙ্কুরের নিরাসক্ত চোখ দেখে সে হাছু কলুর বাড়ির দিকে চলে যায়। আঙ্কুর গানের খাতা থেকে একপৃষ্ঠা কাগজ ছিঁড়ে লিখতে বসে।
বিকাশের মনটা আজ বিক্ষিপ্ত। পড়তে একটুও ভালো লাগছে না। সে হাতের বইটা রেখে, লম্বা বারান্দার এমাথা-সেমাথা হাঁটতে শুরু করে। চওড়া উঠানে শীতের হলুদ সকাল। দীঘির পুবপারের বাঁশঝাড় ঘিরে হালকা কুয়াশার চাদর। বিকাশদের পুকুরপারের পরেই মাঠের শুরু। মাঠ শেষে হাইল বিল। বিলের দিক থেকে হিলহিল করে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে সরিষাফুলের মিষ্টি সুবাস। তার ঘরের একটি মাত্র দরজার পাশে, বেড়ার টিনে নৌকা প্রতীক সহ বঙ্গবন্ধুর একটা পোস্টার। কাগজের সাদা-কালো জমিনে সাড়েসাত কোটি বাঙালির হৃদয়ের বন্ধু, আত্মপ্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধুর পৌরুষদীপ্ত গোঁফের ফাঁকে হাসিমাখা অঙ্গীকার।
বিকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার হাঁটতে শুরু করলে বহুদিন আগের একটা সকাল তার হৃদয়ে ঝলসে ওঠে। তখন সে কলেজে পড়ে। বাংলাভাষার জন্য টেকনাফ টু তেতুলিয়ায় কবরেরও ঘুম ভেঙে যায় বাঙালির দাবি এতই বিরাট। সেদিন বিকাশদের কলেজে ছাত্রদের মিটিং ছিল। তারা আশপাশের গ্রামের তিশ-চল্লিশজন গরিব ছাত্র সকালের ট্রেনে কলেজে যায় এবং ক্লাস শেষে বিকালের ডাউন ট্রেনে আবার ফিরে আসে। অন্যদিনের মতো সেদিনও স্টেশনে ট্রেন আসতেই তারা দল বেঁধে একটা খালি কম্পার্টমেন্টের দিকে ছোটে। হি হি-করা শীত আর কুয়াশাঘেরা সকাল। তাই বোধ করি দরজাটা ভেতর থেকে ছিটকিনি মারা। বিকাশ হ্যান্ডেলে ঝুলে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা মারতে থাকে। এই ওয়াগনটা বেশ খালি খালি। বাকি সবগুলাতেই ভিড়। তাই নিচে ভিড় করে থাকা বাকি ছেলেরাও হৈ চৈ শুরু করে। তাদের হাঁকডাকে হঠাৎ দরজাটা খুলে যায়। সারা দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা পাকিস্তানি। তার ঘুমজড়ানো চোখে-মুখে ক্রোধ-ঘেন্না।
বিজাতীয় প্রাণিটাকে দেখে বিকাশের নেমে যেতে লজ্জা করছিল। তাই সে জোর করেই কামরায় উঠতে চায়। লোকটা দিবে না। প্রায়ই এমন হয়। চার-পাঁচজন পাকিস্তানি কিংবা পাঞ্জাবি আস্ত একটা কামরা দখল করে শুয়ে-বসে আড্ডা মারতে মারতে যাবে। অথচ বাঙালিরা টিকিট করেও ঠাঁসাঠাসি ভিড়ের ওয়াগনে ওঠে। ছাত্ররা জানে, ওরা রিজারভেশন না নিয়েই কামরাটা দখল করে নিয়েছে। রেলকর্তৃপক্ষ এসব দেখেও দেখে না। কারণ প্রত্যেকটা অফিসেই তো পাকিস্তানিরা হর্তাকর্তা। আর কুলি-কামলা-কিষাণ, পাটকলশ্রমিক ও সাধারণ বাঙালিরা তো পাকিস্তানি দেখলে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কে না জানে, পূর্বপাকিস্তানে আইন শুধু বাঙালির জন্য, পুলিশ-আর্মি শুধু বাঙালির বুকে গুলি চালাবার জন্য।
বিকাশ পাকিস্তানির চোখে চোখ রেখে উঁচা গলায় বলে, — পথ ছেড়ে দাও।
লোকটা আগুন চোখে তার কাছে জানতে চায়, — তুম কোন হে?
— আমরা যাত্রী। আমাদের টিকিট আছে।
— ইধার নেহি, ওধার যা।
— কেন?
— আপ তু মর শালা বাঙ্গাল কুত্তাকা বাচ্চা।
বিকাশের বুকে দুম করে একটা লাথি পড়ে। ফুটবলের মতো উড়ে গিয়ে বিকাশের লিকলিকা দেহটা ছেলেদের ভিড়ের মাঝে পড়ে। মুখ থুবড়ে পড়া আধা-অজ্ঞান বিকাশকে ধরাধরি করে সবাই অন্য একটা কামরায় ওঠে।
কয়েকদিনের চিকিৎসায় বিকাশ সুস্থ হয়ে উঠলেও চিরদিনের সঙ্গী হয় শ্বাসকষ্টের মতো মারাত্মক রোগ। মাঝেমাঝে কয়েক মিনিটের জন্য জ্ঞানও হারায়। একটু বেশি ভাবলে, কাজ করলে হুটহাট শ্বাসনালিটা কে যেন চেপে ধরে। এই কালব্যাধির জন্য লেখাপড়া গেল, রাজনীতি গেল। কারো বোঝা হওয়ার ভয়ে শেষতক আর বিয়েটাও করল না। বেঁচে থাকার তাকিদে নিজের অজান্তে সে মিশে যায় পালাগানপাগল, আজগুবি স্বপ্নবাজ ঘাটুদলটার সাথে। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে নিরীহ আমুদফুর্তি আর নির্ভার জীবনাচরণে। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে তার বই পড়ে কিংবা পালাগানের নতুন নতুন কাহিনি রচনায়। হোমিওপ্যাথিটা একটু রপ্ত হতেই সে মূলবাড়ি থেকে সরে গিয়ে পুকুরপারের দিকের বাংলা ঘরটায় চলে এসেছিল। কারণ সময়গময় নাই তার কাছে নানান কিসিমের মানুষজন আসে। তাই এখন তার অন্দরের দিকে না থাকাটাই ভালো। মা-বাবা গত হয়েছেন। ছোটভাইয়েরাও বিয়ে করে হয়েছে কঠিন সংসারী।
দহিল দহিল রে বিরহঅনলে চিত্ত দহিল,
একে হাম কুলবালা — সহে না বিরহজ্বালা,
কার কাছে কহিমু দুঃখ প্রিয়া পরদেশে
উত্তরের বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে মাগীকুদ্দুর গলা ভেসে আসছে। বিকাশ মুচকি হেসে চেয়ারে ফিরে যায়। ঝিমিয়েপড়া চায়ের তৃষ্ণাটা মাগীকুদ্দুর গলা শুনেই আবার চাগিয়ে ওঠে। তাবাদে বুঝতে পারে, এতক্ষণ চায়ের তৃষ্ণাতেই বইয়ে মন বসছিল না। বিকাশ বইটা হাতে নিয়ে আবার চেয়ারে বসে। কলকাতার নীলমণি ঘটকের লেখা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বই ‘মেটেরিয়া মেডিকা’ সে রোজ সকালে ঠাণ্ডা মাথায় ঘণ্টাখানেক পড়ে। তারপর নিজের হাতে বানানো এককাপ চা খেয়ে পুবের বারান্দার চেম্বারে গিয়ে বসে। গ্রামের গরির-দুঃখীরা তার রোগী। ওদের কোনো সময়গময় নাই। কেউ সকালে আসে। কেউ দুপুরে। আবার বিকাশ যদি ঘরে না থাকে তাহলে কেউ কেউ সন্ধ্যার সময় এসে তার অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে।
বাড়ির আঙিনায় পা দিয়েই মাগীকুদ্দু গান থামিয়ে দেয়। বিকাশ চেয়ারে হেলান দিয়ে আলাপ জোড়ে, — তা কেমন আছ কুদ্দু?
— আজ্ঞে ভালো আছি মশায়। ভালো না থাকলে কী আর আফনেরে দ্যাখতে আই?
বিকাশ মুচকি মুচকি হাসে, — ঠিক আছে ঠিক আছে। আগে চা বানাও দ্যাখি।
মাগীকুদ্দু বিকাশের কাছে ফিসফিস করে ডায়ালগ দেয়, — চেমননগরের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা মহারাজ।
বিকাশ মুখে কষ্ট জড়ানো হাসি নিয়ে বলে, — মেঘের ঘনঘটার পরেই বৃষ্টি হয়। তারপর রোদের আলো।
এই কথায় কথা না-বাড়িয়ে মাগীকুদ্দু রান্নাঘরে ঢুকে যায়। দশমিনিটের মাঝে ধোঁয়াওঠা চা আর মুড়ির বাটি বিকাশের সামনে রেখে যায় মাগীকুদ্দু। একটু পরে নিজের মুড়ির বাটি হাতে এসে বিকাশের সামনাসামনি বারান্দায় একটা পিঁড়ি পেতে বসে। চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিকাশের নাকে লাগে চাপাতার তাজা ঘ্রাণ। সে ফুরফুরা মনে কুদ্দুর দিকে তাকায় : ছোটখাটো মানুষটা সংসার ও আরস্তিগিরস্তির সব খুঁটিনাটিতে উস্তাদ। চা-টাও বানায় দারুণ। অবশ্য সে নিজে এই জিনিস খায় না। ওটা খেলে নাকি রাতে তার ঘুম আসে না। শুধু মাগীকুদ্দু না, বলতে গেলে এক আঙ্কুর ছাড়া এই এলাকাতে কেউই চা খায় না।
বিকাশ জানে, কোথাও কাজ না পেলে কিংবা ভালো কিছু খেতে মন চাইলে কুদ্দু সোজা তার বাড়ি চলে আসবে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সারা বাড়ি ঝাঁট দিবে। বসতঘরটা গোবর-গোলা মাটি দিয়ে লেপবে। তারপর পুকুরঘাট থেকে সাফ-শুতু হয়ে কাছে এসে নিচু গলায় জানতে চাইবে, — আইজ কী ব্যাঞ্জন অইত?
তার বাড়িতে এসে মাগীকুদ্দুর হিন্দুদের রেওয়াজমতো চলার চেষ্টা দেখে বিকাশ হাসে। কাদু-কালুদের সাথে মাখামাখির জন্য তার সমাজ কবেই তাকে নিঃশব্দে খারিজ করে দিয়েছে। বিয়ে কিংবা পূজাপার্বণে তার স্বজাতিরা তাকে নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ ঠিকই করে কিন্তু তাদের কেউই মন থেকে চায় না বিকাশ দাওয়াত রক্ষা করুক। বাড়ি এসে উঠানে দাঁড়িয়ে, দূর থেকে নিমন্ত্রণ কথাটা ছুঁড়ে দিলেই কি বিকাশ যেতে পারে? বিকাশ তাকিয়ে দেখে, তাকে নিমন্ত্রণ দিতে আসা লোকটার চোখে-মুখে কুসংস্কারের অস্বস্তি। সে নিজেও বাজে একটা অস্বস্তিতে পড়ে। ওরা চোখের লজ্জায় এসে খামাখা তাকে কষ্ট দিয়ে যায়। সবাই জানে, বিকাশ যাবে না। তাহলে কেন অহেতুক একটা নাটক করতে আসে? শুধু একজন মানুষ হিসাবে বাঁচতে গিয়ে বিকাশ আজ ধুতি-পৈতা, টুপিহীন হয়ে পড়েছে।
বিকাশ হাসছে। বিকাশের হাসি দেখে মাগীকুদ্দু একটু শরম পায়। অনেক দিনের অভিজ্ঞতায় বিকাশ মাগীকুদ্দুর মনমতি বুঝতে পারে। সে বই থেকে চোখ না তুলেই প্রতিবারের মতো আজকেও বলে দেয়, — তোমার যা ইচ্ছা।
চটপটে বেটিমানুষের মতো আমোদ-জড়ানো শরীরে একটা তড়লড় ভঙ্গি তুলে মাগীকুদ্দু রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। বিকাশের পুবের বারান্দাটা রান্নাঘর। কতক্ষণ পর সেখান থেকে রান্নাবান্নার খুডুর খুডুর শব্দের সাথে খিচুড়ির সুবাস নাকে লাগতেই বিকাশের মনে হয়, মাগীকুদ্দুর রুচিটা মন্দ না।
খেলা আসে ঠিক দুপুরে। একা এবং কিছুটা গম্ভীর। ফুর্তিবাজ সুঠাম শরীরের খেলার সাথে যা একটুও মানায় না। বিকাশ বারান্দায় বসে নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করছে। কোলে লুঙ্গি-গামছা, পায়ের কাছে সাবানের বাক্স। দাঁতন শেষ হলেই সে পুকুরে স্নান করতে যাবে। রান্নাঘরে মাগীকুদ্দু ডালে সাম্বার দিচ্ছে। এইসময় আদাপ, আদাপ… বলে খেলা এসে বিকাশের সামনে দাঁড়ায়। বিকাশও উঠে দাঁড়ায়, — আসো খেলা। তোমার কথাই মনে মনে ভাবছিলাম।
মাগীকুদ্দু রান্নাঘরের দরজায় উঁকি দেয়। উঠানে খেলাকে দেখে তার মনে আমোদ হয়। ফের চতুর বেটিমানুষের মতো মানু মিয়া আর ঘাটুদলের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে কূটনীতির একটা চাল মনের কোনাকানায় নড়চড়া করে। বারান্দায় বসতে বসতে খেলা বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, — বাবু জানুইন কি না জানি না; কর্তা খুব বড় ঝক্কি মারছে।
— জানি।
বিকাশ নীরবে খেলাকে পরখ করে। খেলা কোমরের কশি থেকে বিড়ি-ম্যাচ বের করে। একটা বিড়ি ধরিয়ে লম্বা করে দম দেয়। তারপর দূরে, মাঠের মাঝে হলুদ সরিষা ক্ষেতগুলার দিকে বিষাদমাখা চোখে তাকিয়ে থাকে। মাঠের পরে হাইল বিল। শীতের দুপুরে বিলের পরিষ্কার পানিতে নীল আকাশ ঝকঝক করছে। এইসব দেখতে দেখতে খেলা বড় করে একটা শ্বাস ফেলে টিনের বেড়ার পোস্টারটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পোস্টারটা দেখতে দেখতে খেলার মালুম হয়, ছবির মানুষটাকে শুধু এই দেশের মানুষজন নয়, বাংলার আকাশ-বাতাস-মাটি ও ঘাস-লতা-পাতা এখন আপনার জন বলে চিনে ফেলেছে। আর এই মানুষটাকেই মানু মিয়াদের মতো টাকাওয়ালা মানুষেরা কেন সহ্য করতে পারছে না? এর পেছনে কী বিত্তান্ত? কী রহস্য? জানতে হবে, জানতে হবে…
এই এক জিজ্ঞাসা খেলাকে আজ দুইদিন ধরে কামড়াচ্ছে। তাই এই বিষয়টা বাবদ একটু তত্ত্বতালাশের জন্য সে এসেছে বিকাশের কাছে। ঠিক এই সময় তার পেছন দিক থেকে ভেসে আসে অহাকালুর গলা। অহা ডায়ালগে বলছে — ‘দ্যাখি আজ আমায় কে রোধে; ছিন্ন করিব তাহার মস্তক, ছিনান করিব সেই নরাধম অসুরের রক্তে।’
অহাকালু নিরীহ, ধুরন্দর অর্থলোভী এবং ছিঁচকে চোর। তার মুখে রক্তপাতের অঙ্গীকার একটুও মানায় না। তাই খেলা কিছুটা অবহেলার চোখেই পেছন ফিরে তাকায়। একসারিতে তিনজন এইদিকেই আসছে। সবার আগে রাজার মতো বুক ফুলিয়ে হাঁটছে মঞ্চরাজ কাদু। তার পেছনে দানবকালু। কালুর বিরাট বাবরির উপর দিয়ে বকের মতো টান টান অহাকালুর লম্বা গলা।
খেলা উঠে দাঁড়ায়। বিকাশের উঠতে একটু দেরি হয়। সে হাতের দাঁতন কামড়ে ধরে, এক হাতে লুঙ্গি আরেক হাতে সাবান নিয়ে দাঁড়ায়। মাগীকুদ্দুও এসে বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। মঞ্চরাজ কাদু রেডিমেডি হয়েই এসেছে। তাই সে বিকাশের দিকে তাকিয়ে একটু নিচু ও শান্ত গলায় ভরাট কণ্ঠে ডায়ালগ দেয়, — কুখাবনগরের অনাচারী পাপিষ্ঠ রাজা মানু মিয়া অর্বাচীন বালকের মতো আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, নিশ্চয়ই আমার বিচক্ষণ উজিরে-আলা এই সংবাদ অবগত আছেন?
খেলা চকিতে একবার বিকাশের দিকে তাকায়। হাড়গিলা চেহারার বিকাশবাবু শ্বাসের রোগী। তাই তার পাঙসা চেহারা-গতরে কোনো প্রকার উত্তেজনার আভাস মিলে না। সে অটল। পালামাস্টার হিসাবে সবাইকে ডায়ালগ শিখালেও সে নিজে ডায়ালগ দেয় না। কিন্তু এই মুহূর্তে রাজার আহ্বানে সাড়া না দিলে শিল্পীর অবমাননা হয়। বিকাশদের মূল বাড়িটাও কাছেই। তাই কাদুও নরম গলায় ডায়ালগ দিয়েছে। এখন পরিস্থিতিমতো বিকাশের হয়ে খেলা সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে, রাজাকে ছোট্ট একটা কুর্নিশ করে তেমনি নিচু গলায় বলে, — বান্দার গোস্তাকি মাপ করবেন জাহাঁপনা, রাজনীতির রণকৌশল নির্ধারণে আজ আমরা আবার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসব। তাই আপাতত রাজদরবার মুলতবি ঘোষণা করুন আলামপনা।
রণকৌশল শব্দটা শুঁটকিভর্তার ঝাঁঝালো স্বাদের মতো মাগীকুদ্দুকে উসকে দেয়। সে আমুদে পাছায় একটা নাড়া দিয়ে, দুই হাতে দুইটা পিঁড়ি নিয়ে উঠানের দিকে তড়লড় ভঙ্গিতে ছুটে আসে। সবার পরে পিঁড়িতে বসে অহাকালু। নানান দিক থেকে এই দলের মধ্যে সে নিজেকে সবচে ছোট মনে করে। দলে থাকার সময়টা তারা সবাই নিজের বুদ্ধিমতো কিছু কিছু জিনিস মেনে চলে। ব্যাতিক্রমও আছে, যেমন মানু মিয়া, ঘোড়ামোবারক, মালেক। মালেকের কথা ভিন্ন। সে ফাজলামি করে। মানু মিয়া কিংবা তার একান্ত বশংবদ ঘোড়ামোবারকের মতো প্রতারণা কিংবা চোখ লাল করে না।
বিকাশ আগে যেখানে বসেছিল সেখানেই সে আবার বসে। দানবকালুর গোল গোল চোখ দুইটার নজর আজ চকচক করছে। এবং তাকানোর ভঙ্গিটাও কঠিন কোনো পুরুষের মতো ধারালো। আজ তার চোখে-মুখে দানব সেজে দানবীয় হুঙ্কারে রঙ্গমঞ্চ কাঁপানোর আভাস।
আজ কয়দিন ধরেই দানবকালুর খুব দুঃখ হচ্ছে। অনুতাপে তার জীবন জর্জর। জীবনটা বেহুদা গেল। দানবীয় একটা শরীর নিয়ে সে সারাজীবন একটুকরা হাড়গোস্তের খোঁজে কুকুরের মতো বিত্তবান কৃষকের জমিনে জমিনে মুখ নিচু করে কাটিয়েছে। পরনে আড়াই টাকার ‘হাতি মার্কা’ খাটো লুঙ্গি। কাঁধে ত্যানার মতো একটা পুরানা গামছা। রাতের রঙ্গমঞ্চে যে কালুর একটা গর্জনে হাজার হাজার মানুষ কাঁপে, বাচ্চারা কাপড়ে পেশাব করে দেয়; সেই কালুই তো সারাদিন মুনিববাড়ি ‘রোজের কামলা।’ তাবাদে মনে যা-ই থাকুক ঘাটুদলের জন্য বলতে গেলে সারাজীবনটাই তাদের কেটেছে মানু মিয়ার সাথে। সেই লোকটাই মিটিং-এ যাওয়ার ঘটনায় হাতঝাড়া দিয়ে মাছির মতো সকলকে তাড়িয়ে দিলো? দানবকালু মিটিং-এ দেখেছে, এই এট্টু এট্টু ছেলেদের চোখে-মুখে কী আগুন! কথায় কথায় কী বিরাট বিরাট সাহস দেখায়, গরিব মানুষের ভাতকাপড়ের জন্য লড়াইয়ের কথা বলে। লড়াই মানে যুদ্ধ। কাদু-কালুরা যদি হাত বাড়ালেই ভাত-কাপড় পায় তাহলে নিশ্চয়ই মানু মিয়ার লাল চোখকে পরোয়া করবে না। কিন্তু এখন এইযেন মানু মিয়া চোখ পাকায়া বলে দিলো, তার জমিন হে নিজেই চাষ করবে। করুক। জমিন নাই বলেই তো সে গরিব। তা দুনিয়ার সবাই তো আর তালুকদার হয়ে জন্মায় না। সে গরিব হয়েছে বলেই কী তার মন নাই, মান নাই?
বিকাশ ভাবছিল, নিজের স্বার্থের জন্য মানু মিয়া তাদের অনেকগুলা বছরের প্রেমের কীর্তি ঘাটুদল নামের তাজহলটা এক লাথে উড়িয়ে বিষুরির থলিতে ফেলে দিল! এই চিন্তায় তার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। মানুষের এইসব তাকে খুব কষ্ট দেয়। তার শ্বাস নিতে কষ্ট লাগছে। এত বড় পৃথিবীতে একটু বাতাসের অভাবে প্রায়ই বিকাশ একা একা ছটফট করে। হঠাৎ দানবকালু উঠে দাঁড়ায়। বিরাট শরীরের চাপে তার ডান হাঁটুটা মচ্ করে আওয়াজ দেয়। নোংরা, ছেঁড়া গামছাটা দিয়ে সে মুখ মুছতে মুছতে খেলাকে একনজর দেখে নেয়। তাবাদে সে অহাকালুর দিকে তাকিয়ে ঘোষণার মতো করে বলে, — বিকাশবাবুর কাছে জানতে অইব, নৌকার ইলেকশনের আর কয়ডা মিটিং আছে।
দানবকালুর এই সাহসী পয়গামে মাগীকুদ্দু কুটিল মেয়েলোকের মতো বুকে জড়িয়ে রাখা গামছাটা আঁচলের মতো টেনে মুখের কাছে এনে বলে, — কর্তা ভেবেছে ভাতের লাইগা চেমননগরের গোষ্ঠী কান্নাকাটি করব? রজনী পোহাইতেই সকলে তাহার পায়ে তেল মাঞ্জন করব?
হঠাৎ মাগীকুদ্দু আবেগে, রাগে পাছায় একটা মোচড় দিয়ে সোজা কথায় বলে, — আমি না-খায়া মরলেও মানু মিয়ার কাছে জমিন চাইতাম না।
এই কথা বলেই মাগীকুদ্দু আবার চিকন সুরে মহারানির মতো ডায়ালগ দেয়, — বাঁদির গোস্তাকি মাপ হয় জাহাঁপনা, কুখাবনগরের শত্রুসৈন্য রাজধানী অবরোধ করে আছে তিনদিন। আর কয়দিনের মধ্যে অন্ন-জলের অভাবে মরতে শুরু করবে নগরবাসী। তবু বলছি মহারাজ, আপনার ললাটে চিন্তার ভাঁজ মানায় না। পারিষদবর্গ নিয়ে আগে রণকৌশল নির্ধারণ করুন আলামপনা।
খেলা একটু মুচকি হাসে। বিকাশ নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করছেই। রাজনীতি বুঝুক আর না বুঝুক, রাজনীতির জন্য বাঙালি সব পারে। মানু মিয়ার অবস্থা দেখে বিকাশের এই কথা আজ সত্য বলে মনে হয়।
খেলা শেষ-হয়ে-আসা বিড়িটা উঠানের মাটিতে ঘষে ঘষে নিবিয়ে ফেলে। তারপর সরাসরি রাজারূপী কাদুর চোখে চোখ রেখে বলে, — বিষুদবার দিন গয়শপুর মাদ্রাসা মাঠে শেষ মিটিং।
বিকাশ বড় করে দম ছাড়ে। এতদিন সে খেলার কাছে যা চেয়েছে তা একটু দেরিতে হলেও ঘটতে যাচ্ছে দেখে সাবান আর লুঙ্গি-গামছা সহ উঠে দাঁড়ায়, — তোমরা একটু বসো, আমি পুকুর থেকে একটা ডুব দিয়ে আসি।
খেলা কোমরের কশি থেকে বিড়ি বের করে একটা ধরায়। তারপর সে কাদুর দিকে বান্ডিলটা এগিয়ে দেয়। কাদু একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে খেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, — কর্ম নির্দিষ্ট কর খেলা, এখন কর্মের টাইম।
রাজারূপী কাদুর এই ঘোষণায় উপস্থিত সকলেই খুশি হয়। রাজার এই ঘোষণা কী বলে? এই কথা বলে যে এখন থেকে খেলাই তাদের দলের কর্তা। তাকেই সামনের দিনগুলা মোকাবেলা করতে হবে। খেলা আড়চোখে মঞ্চরাজকে একপলক দেখে। মাগীকুদ্দু বসে বসে পিঁড়ির ওপরেই পাছাটা একটু নাড়িয়ে মানু মিয়ার উদ্দেশ্যে বলে :
টুক্কুরু, টুক্কুরু, আর করবা না টুক্কুরুর আশা
টিক্কার আগুনে পুড়িয়া গ্যাছে টুক্কুরুর বাসা
মাগীকুদ্দুর বচনে খেলারা কেউ রা করে না। সে মাথা নিচু করে ভাবছে : তাহলে বোঝা গেল মানু মিয়া অনেক ভেবেচিন্তেই কাজটায় হাত দিয়েছে। নিশ্চয়ই তার পিছনে কাদু-কালুদের সমকক্ষ কেউ কেউ আছে। এবং সেই সামন্তবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হবে চোরের সর্দার ঘোড়ামোবারক। তাবাদে এই ঘটনার জবাব হিসাবে মানু মিয়ার সাথে পাশাখেলার মঞ্চে নামলে এমন একটাকিছু করতে হবে যেন লুচ্চাটা কোনো দিশা না পেয়ে পাত্থর হয়ে যায়।
একটাকিছু করতে হবে। এই ইলেকশানের ময়দানে এমন একটাকিছু করতে হবে যাতে একদিকে মানু মিয়ার মতো প্যাঁচি লুচ্চার থোঁতামুখ ভোঁতা হয়ে যাবে ফের দেশের মানুষ তাইজ্জ্যব হয়ে খেলাকে দেখবে। খেলার জন্মের পরপরই তার বাপ অবাক খুশিতে তার নাম দিয়েছিল খেলা। অর্থাৎ লীলা। এই সংসারের লীলার জ্ঞানে খেলা টনটনা না হলেও বুদ্ধিতে সে খুব খাটো না। তাই সে শেখ মুজিব কিংবা তার ছয়দফা, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান যতটা-না বোঝে তারচে অনেক বেশি বোঝে মানু মিয়ার দফা দফা প্যাঁচ-মোচড়। ঘাটুদলের উছিলায় কাদু-কালুরা আজ তার ভাইয়ের মতো। বিকাশ তাদের সবার কাছে সম্রাট আকবরের বৈরাম খাঁর মতো। তাদের গপসপের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ দেশের কথা উঠলে বিকাশ খুব আস্তে আস্তে, একটু একটু করে আজ কত বছর ধরে তাদের রক্তে মিশিয়ে দিতেছে দেশভাগ, বায়ান্ন, ছয়ষট্টি, উনসত্তরের নানান সব জটিল জটিল কথা। তারা এক কান দিয়ে শুনেছে তো আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছে। এইসব কী তাদের জিনিস? খেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মঞ্চরাজ কাদুর দিকে একটা বিড়ি এগিয়ে দিয়ে নিজেও আরেকটা ধরায়। এতগুলা…এই এতগুলা মানুষকে মানু মিয়া কোনো ইজ্জত দিলো না! খেলার খুব খারাপ লাগে। যে-কোনো সরল বিশ্বাস মানে নির্বুদ্ধিতা। যে-সময়েই হোক, যে-কোনোখানেই হোক, কাউকে বেশি ইজ্জত দিতে গেলে আগে নিজেকে ছোট করতে হয়। মানু মিয়ার কাছে তাদের সেই ছোট হওয়াতে ভালোবাসা নামের একটা জিনিস ছিল। আজ সেই জিনিসটাই খেলার কাছে গুয়ের মতো লাগছে।
খেলা হাতের কাঠিটা দিয়ে উঠানের মাটিতে টেনে টেনে একটা সমান্তরাল সরলরেখা টানে। তাবাদে রেখা দুইটাকে কাঠি দিয়ে কেটে কেটে একেবারে মিশমার করে দেয়। কাটাকুটি করা সেই জমিনটার ওপরের দিকে খেলা বড় করে একটা পালতোলা নৌকার ছবি আঁকতে শুরু করে। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় সে ছবি আঁকার ক্লাসে সারাজীবনে মাত্র তিনটা ছবি আঁকতে শিখেছিল :
১. পালতোলা নৌকা সহ একটা বিরাট নদী।
২. ছনে-ছাওয়া দুইটা ঘর সহ সুখী সুখী একটা বাড়ি।
৩. সবুজ মাঠের মাঝে বাঁধনহীন একটা ষাঁড় মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছে।
পাতলা পাতলা কয়েকটা টানে পালতোলা নৌকার ছবিটা শেষ করে খেলা বলে, — আমার ইচ্ছা চাকাওয়ালা নৌকায় ঘাটুগান গাইতে গাইতে আমরা সকলে মিটিং-এ যাই।
রাতের রঙ্গমঞ্চের রাজা কাদু পায়ের চেটু থেকে পথের ধুলা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলে, — তুমিই আমগর কর্তা।
রাজারূপী কাদুর প্রস্তাবে অহাকালুর নষ্ট চোখটার গর্তে জেগে থাকা হলুদ কেতুরের বিন্দুটা আনন্দে কেঁপে ওঠে। আর চকচক করা ভালো চোখটা দিয়ে উসটে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার অবুঝ আত্মাটা। সে জোরে জোরে আর তাড়াতাড়ি বলতে গিয়ে ঘাউ ঘাউ করে বলে, — কতকন পরে পরে আমরা গলা ফাডায়া জোহার দ্যায়াম ‘দলের কর্তা খেলা গ মিয়া, অ-হারে হে…।
চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
- সিনেমার চিরকুট ৮ - January 19, 2025
- টুকটাক সদালাপ ২ - January 17, 2025
COMMENTS