চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ২৩ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ২৩ || শেখ লুৎফর

জননী তোমার ছেলেরা আজ নাঙা তলোয়ার
পুবের সড়কের জামতলে ফালু ডাকাতের সর্দারিতে খেলার পঁচিশ হাত লম্বা নাওয়ের আগা-গলুইয়ে একটা কাছি বাঁধা হয়েছে। দড়িটা বাঘের লেজের মতো মোটা। শ’দেড়েক হাত লম্বা দড়িটা কাতারবন্দি শত শত লোক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার আগে, দড়ির মাথায় ধরেছে ফালু ডাকাত। নাওয়ের পাটাতনে পরীকে ঘিরে কাদু-কালুরা বসেছে অর্ধবৃত্তাকারে। বায়েনদের মাঝে আজ আঙ্কুরও আছে। তার সামনে হারমোনিয়াম। তার উপরে গানের খাতা। পরশুদিন সারারাত ধরে সে তেরো পৃষ্ঠার একটা গান লিখেছে। এই দেশের মানুষের উপরে পাকিস্তানিরা যত অবিচার করেছে, যত মানুষকে গুলি করে মেরেছে সব বিত্তান্ত সে লিখেছে বিচ্ছেদের আঙ্গিকে। কাল সারাদিন তালিম দিয়ে রেডি করেছে পরীকে।

আঙ্কুর হারমোনিতে পে-পো আওয়াজ তুলতে তুলতে বিড়বিড় করে বলে, — আইজ মানু মিয়া দ্যাখবা কাদু-কালুরা কি জিনিস।

আঙ্কুর জামতলা থেকে পুবে, মানু মিয়ার বাড়ির দিকে আগুনভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। নৌকার পাটাতনে আঙ্কুরের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল মালেক। আঙ্কুরের বিড়বিড়ানি শুনে সে চারপাশের বাতাসকে উদ্দেশ্য করে জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, — ঘুমের মানুষ খেলা হজাক অইয়া গ্যাছেগা…।

তারপর রাতের রঙ্গমঞ্চে যে ভাষা ও ভঙ্গিতে সে জোকারি করে সেইমতো সামনের দিকে কোমর খেঁচে খেঁচে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে জোকারির সুরে চিৎকার দিতে দিতে গায় :

চুদন কয় কারে,
দ্যাখবা চুদন বাতি নিবাইলে।

মালেকের এই অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও বয়ানে উপস্থিত তিন গ্রামের মানুষ হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। তারা বছরের পর বছর ঘাটুগান আর পালাগান শুনতে গিয়ে মালেকের এইসব দেখতেছে। দেখে দেখে যেমন মজা পায়। আজকেও সেইমতো আমোদে মত্ত হয়ে শিস মারে, চিৎকার পাড়ে।

আঙ্কুরের পাশে বসেছে বিকাশ। বলতে গেলে সে সারাজীবন ধরে এইরকম একটা দিনের আশায় ছিল। আজ কত বছর ধরে সে এই ঘাটুদলের সাথে জড়িত। কত বছর ধরে সবার অজান্তে এই গেঁয়ো, গোঁয়ার আর শিল্পীপ্রাণ মানুষগুলার মননে, রক্তে একটু একটু করে রাজনীতির উত্তাপ দিতে দিতে আজ ওরা সত্যি সত্যিই দপ করে জ্বলে উঠেছে। আজ তারচে আর কে বেশি সুখী?

বিকাশবাবু ইয়াহিয়া খান আর শেখ মুজিবকে নিয়ে তিরিশ মিনিটের একটা পালা রচনা করেছে। সেই পালায় অভিনয় করবে মঞ্চরাজ কাদু আর দানবকালু। ঘাটুদলের কর্তার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসার রীতি ভঙ্গ করে খেলা দাঁড়িয়েছে সবার সামনে, নাওটার আগা গলুইয়ে। কসকো সাবান দিয়ে ধোয়া খেলার বাবড়িটায় আজ তাইজ্জব একটা বাহার খেলছে। তার কোমরে টাইট করে বাঁধা একটা লাল গামছা। আবেগে, আমুদে চকচক করছে তার চোখ দুইটা। পরীর নিরাপত্তার জন্য পাছাগলুইয়ের দিকে কিছু গুপ্তি অস্ত্র মজুদ আছে। সেখানে মাগীকুদ্দু আর অহাকালু। মালেক বসেছে আঙ্কুরের বাঁ পাশে। বারবার তার চোখ খালি ভিড়ের দিকে চলে যায়। কড়া চোখে তালাশ করে মানু মিয়ার গুপ্তচরদের অসহায় মুখ। ঘোড়ামোবারক নিশ্চয়ই এখন কোনো ডাক্তারখানায় পড়ে আছে। মালেক ছাড়া চেমননগরের কেউ জানে না কাল মাঝরাতে বেনেভিটার আমতলে কি ঘটেছিল। কার রক্তে লাল হয়ে আছে বেনেভিটার সবুজ ঘাস।

নিশ্চয়ই গেছেকাল শেষরাতের শীতে অনেক পেরেশানি করে মানু মিয়া মানুষ জোগাড় করেছে। ছলিম আর জব্বর ছাড়াও মানু মিয়ার অনেক বিশ্বস্ত লোক আছে। টাকা ছড়ালে লোকেরর কি অভাব? তাবাদে ঘোড়ামোবারকের চিকিৎসা বাবদ নিজের সিন্দুক থেকে বেরিয়ে গেছে কয়েকশ টাকা। গ্রামদেশের মানুষ বলে, — পুত হারানোর দুঃক্কু সয়, টাকার দুঃক্কু সয় না। নিশ্চয়ই টাকার শোকে বক্কিল মানু মিয়ার গতরে আজ তিন খেতার জ্বর।

মঞ্চের মধ্যখানে পরী। পোশাকে-মেকাপে, ডৌল-গড়নে পরী এখন সত্যি সত্যিই পরীস্থানের বানেছাপরী। সবার আগে সে বিকাশের দিকে মাথাটা একটু নত করে গুরুর পায়ে সালাম জানায়। পিতা তাকে জন্ম দিয়ে বুঝবুদ্ধি হওয়ার আগেই মানুষের বাড়িতে পাঠিয়েছিল গরুরাখালের কাম করতে। তার বাবাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নগদ তিন মাসের বেতন আগাম দিয়ে তাকে খেলা এনে ঘাটুছেরা বানিয়েছিল। আর বিকাশ তাকে একটু একটু করে অনেক মেহনতে গড়ে তুলেছে শিল্পী। এখন সে রাতের রঙ্গমঞ্চে মানবজীবনের সকল কঠিন সত্যকে আত্মার নিপুণ আবেগ দিয়ে অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারে। এই অনন্য শক্তি ছাড়া বর্তমানে তার আর কোনো সম্বল নাই। দুঃখ-সুখে গড়া মানুষের জীবন। তাই তার ভবিষ্যৎ-জীবনে যতই বিপাক আসুক সে আর ভয় পাবে না।

কাছিতে ধরা লোকগুলা খেলার দিকে তাকিয়ে আছে হুকুমের আশায়। অন্য কার দলে কী রীতি খেলা জানে না। কিন্তু তাদের ঘাটুদলের নিয়মমাফিক খেলা আগাগলুই থেকে রাজারূপী কাদুর দিকে তাকায়। কাদু ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে রাজার মতো ভঙ্গি ও মেজাজে গলা ছেড়ে হাঁক দেয়, — হেই ভাইসব, আল্লা আল্লা বলো…।

নাওয়ের সামনে-পিছনে শত শত জনতা একসাথে জোহার দেয়, — আল্লা আল্লা…।

কাছিতে টান পড়ে। গরুর গাড়ির চাকাগুলা ক্যাঁতকুঁত আওয়াজ তুলে চলতে শুরু করে। বাজনার তালে তালে কদম মিলিয়ে, লাল ঘাগরা বাতাসে উড়িয়ে পরীও শরীরে তরঙ্গ তোলে :

আসমানেতে আছেন খোদা, সেজদা তাঁহার তরে,
বাংলা আমার মা জননী, ভক্তি জানাই তাঁরে।
গুরু আমার বিকাশবাবু তার তুলনা নাই,
দলের কর্তা খেলা গ মিয়া, সালাম নিবেন ভাই…

মেঘ-গর্জনে কাদু-কালুরা গায়, — দলের কর্তা খেলা গ মিয়া, সালাম নিবেন ভাই…

পরী বাজনার তালে তালে কোমর দুলিয়ে, সামনে থেকে পেছনে সরে আসে। তাবাদে মঞ্চের চৌদিকে ঘুরে ঘুরে গায় :

বঙ্গবন্ধুর সালাম আমি, জনে জনে জানাই,
নৌকা মার্কা দিবেন ভোট গ মোর পরানের ভাই।

কাদু-কালুদের গলায় গলা মিলিয়ে শতশত মানুষ গেয়ে ওঠে :

বঙ্গবন্ধুর সালাম আমি জনে জনে জানাই,
নৌকা মার্কা ভোট দিবেন গ মোর পরানের ভাই।

গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে কস্তুরীর সুগন্ধের মতো ছড়িয়ে পড়ে খেলার এই আজব মিছিলের কথা। জোয়ান-বুড়া-পোলা সব, সব শ্রেণির মানুষজন আল-বাত বেয়ে বেয়ে পিঁপড়ার লাছির মতো এসে মিলিত হতে থাকে মিছিলের সাথে। এইভাবে নৌকার মিছিল জয়ধরখালী বাজার পেরিয়ে পাইথলের সীমানায় এলে খেলা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, মানুষের মাথা মানুষে খায়।

বিশাল মাদরাসামাঠের উত্তরের শেষমাথায় ছোট্ট একটা মঞ্চ। সাত-আটজন ছাত্রনেতার সাথে তিন-চারজন প্রবীণ নেতাও আছে। মিটিং শুরু হতে এখনো একঘণ্টা দেরি। সবে দুই-চারজন করে মানুষ আসছে। মাদরাসার বিরাট মাঠে কিছু মানুষ চরাট-করতে-থাকা পাখিদের মতো কুটোরমুটোর করে গপসপ করছে। এই সময় পশ্চিম দিক থেকে সমুদ্রের গর্জনের মতো ভেসে আসে :

দেশের মানুষ আসেন সবাই জয়বাংলা গাই,
নৌকা মার্কা ভোট দিবেন গ মোর পরানের ভাই।

বিকাশ বারবার আঙ্কুরের লেখা গানটার মাঝে একটা-দুইটা নতুন নতুন শব্দ ভরে দিয়ে পরীকে বলে দেয়। এখন জোশে টগবগ করতে থাকা মানুষগুলা আবেগে, দরদে, ভালোবাসায় পরীর মুখের কথাগুলা অবিকল সুর-ছন্দে চিৎকার করে করে বলছে।

ক্ষুব্ধ সাগরের ঢেউয়ের মতো খেলার নৌকার পিছে হাজারে হাজারে জনতা মাদরাসামাঠে এসে আছড়ে পড়ে।

মাইক হাতে মঞ্চে দাঁড়ানো ছাত্রনেতা প্রবীণতম নেতার সাথে কানাকানি করে। তাবাদে মাইকে স্লোগান ওঠে :

জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
খেলা মিয়ার আগমন, শুভেচ্ছা-স্বাগতম…

মাঠের হাজার হাজার মানুষ গর্জে ওঠে :

জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
খেলা মিয়ার আগমন, শুভেচ্ছা-স্বাগতম…

আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সমুদ্রের গর্জনের মতো সেই হুঙ্কার গিয়ে পাশের গয়েশপুর বাজারে হামলে পড়ে। আণ্ডা-মুরগি ধান-পাট বেচে, নুন-তেল, চাল-ডাল কিনতে আসা দীনদুঃক্কী মানুষেরাও মাদরাসামাঠের দিকে আসতে শুরু করে। গরুর গাড়ির উঁচু উঁচু চাকা লাগানো খেলার নৌকাটা মঞ্চের পাশে থির হলে মিটিঙের ছোট্ট মঞ্চটা সকল নেতা-কর্মী সহ পঁচিশ হাত লম্বা পাটাতনের আড়ালে ডুবে যায়।

প্রবীণ নেতারা মিনিটখানেক আলোচনা করেন। তারপর মাইকে আবার হুকুম আসে, খেলার নৌকার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া মঞ্চটা সরিয়ে নিতে হবে। দুই-তিন মিনিট বাদে একজন ছাত্র বাঁশের একটা মই নিয়ে এসে খেলার নৌকার পাশে ঠেস দিয়ে রেখে দেয়। একে একে নেতারা সবাই মই বেয়ে খেলার হাত ধরে ধরে পাটাতনে উঠে পড়ে। গরুর গাড়ির চাকার উপর ফিটিং করা পাঁচ-ছয় হাত উঁচু পাটাতনে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষের মাথার ওপর দিয়ে নেতারা এক-নজরে বাংলাদেশের বহুদূর পর্যন্ত দেখে ফেলেন।

পেটে আমাশয়ের বেদনার মতো মানু মিয়া শুধু ছটফট করছে। শেখ মুজিবের নৌকা নিয়ে খেলার ক্যারদানিটা দেখবে না বলে সে ছোট তালুকদারের কাছে সকাল সকাল চলে এসেছিল। তালুকদারকে পাওয়া গেল গয়েশপুর বাজারের পাটগুদামপট্টিতে। লতিফবাওয়ানি জুটমিল তালুকদারের দুইটা গোদাম ভাড়া নিয়েছে। সেই অফিসের পাশের রুমের চেয়ারে বসে ছোট তালুকদার পা নাচাচ্ছে। মানু মিয়া অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। তালুকদার পা নাচানো বন্ধ করে বলে, — মানু মিয়া দেখছি, আসো, আসো।

বসো, বসো। শুনলাম তোমার সাগরেদ, নৌকার মাঝে তোমার ঘাটুদল লইয়া নাচতে নাচতে শেখ মুজিবের মিটিঙে আসছে?

মানু মিয়ার মুখের ভেতর জিবটা একখণ্ড কাঠের মতো অসার পড়ে থাকে। ঘাটুদলটা ছিল বলেই তার কব্জিতে তিন বাঘের শক্তি ছিল। আজ তার দলও নাই তাকতও নাই। তাই মানু মিয়ার জবানে কথা ফোটে না। মকদুরবাজির দুনিয়ায় ধনের সাথে জন না থাকলে কে কাকে খাতির করে? এইযেন ছোট তালুকদার তাকে এত মায়া করত তা তো তার পেছনের কাদু-কালুদের জন্যই। এখন এইসবের কী জবাব দেবে সে! ছোট তালুকদার রুষ্ট হলে সে দাঁড়াবে কোথায়? পোষা-কুকুরকে মানুষ যেমন আদুরে গলায় ডাকে তেমনি করে ছোট তালুকদার ডাকে, — এই কলিমদ্দি…, বাচ্চুরে ক দুইকাপ চা দিতে।

বিকালে মাদরাসামাঠের দিক থেকে আসা মাইকের আওয়াজ আর জয়বাংলা গর্জনে মানু মিয়ার গলা দিয়ে ডাল আর পোয়ারুটি নিচের দিকে নামতে চায় না। মনের কষ্ট, অপমানে বলতে গেলে মানু মিয়ার দিনটা গেছে উপবাসে। বিকালে ছোট তালুকদারের গদি থেকে মুখ কালো করে বেরিয়ে আর পা চলে না। তাই গয়েশপুরের মাউড়াপট্টিতে রসুল মিয়ার হোটেলে এসেছে একটু নাস্তাপানি খেতে। খাওয়ার মাঝেই মানু মিয়া মাইকে আচান্নক একটা ঘোষণা শোনে, — এখন পরী আপনাদের সামনে দেশের গান গাইবে। গানটি লিখেছেন ও সুর করেছেন গীতিকবি আঙ্কুরভাই।

মানু মিয়ার দুই কানে আর কোনো শব্দ ঢোকে না। তার সবকিছু দাবার একটা ভুল-চালে খেলা জিতে নিয়েছে। পাতের রুটি-ডাল পাতেই পড়ে থাকে। মানু মিয়া হোটেল থেকে বেরিয়ে, ছাতার আড়ালে আড়ালে মুখ লুকিয়ে এসে মাদরাসামাঠের পাশে জামতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। হাজার হাজার মানুষে মাঠটা কানায় কানায় ভরা।

মানু মিয়া রাগে বিড়বিড় করে গালি দেয় আর দাঁতে দাঁত ঘষে। চারপাশের দশগ্রামের সব মানুষ বুঝি আজ ভেঙে পড়েছে মাদরাসামাঠে! একটা মানুষের মুখে কোনো কথা নাই। সবাই হা-করে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে, নীরবে শুনছে পরীর গান। গানে পাকিস্তানিদের দ্বারা নির্যাতিত বাঙালির কষ্টের দীর্ঘ বয়ান। শরীরভরা রূপের আগুন নিয়ে চৌদ্দ-পনেরো বয়সের এক কিশোরী জাদুভরা গলায় গাইছে :

মতিউরের রক্ত লইয়া শপথ করেন ভাই,
নৌকা মার্কা ভোট দিবেন, সকলেরে জানাই।

কাদু-কালুদের সাথে হাজার হাজার মানুষ দীপ্ত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠে :

মতিউরের রক্ত লইয়া শপথ করছি ভাই,
নৌকা ছাড়া বাঙালির কোনো গতি নাই…

রাগে-ঘিন্নায় মানু মিয়ার বুক দোজখের আগুনের মতো দাউদাউ জ্বলে। হঠাৎ জনসমুদ্রের গর্জনে মানু মিয়ার চমক ভাঙে। সে দেখে, মঞ্চে নেতাদের পাশের চেয়ারে খেলাও বসে আছে। তার গলায় ফুলের মালা। চেয়ারে বসা নেতাদের পেছনে কাদু-কালুর সাথে সারি বেঁধে দলের সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আজ ওদের কী ইজ্জত, কী কদর! মানু মিয়া জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। হালার পুত ঘোড়ামোবারক তালের তাড়ি খায়া তার সব এক রাইতে গাঙ্গের জলে ভাসায়া দিছে!

এইসময় মাইকে ঘোষণা হয় : ভাইসব এখন আপনারা একটা ছোট্ট পালা দেখেবেন। পালাটার লেখক ও পরিচালক বাবু বিকাশ সাহা।

জনসমুদ্রের মুহুর্মুহু হাততালির শব্দে মানু মিয়ার বুকে বিষুরির থলির তুফান ওঠে। নেতারা নাওয়ের পেছনগলুইয়ের দিকে গিয়ে চেয়ারে বসে। খেলার পঁচিশ হাত লম্বা নৌকার বিরাট বড় পাটাতনে বাঘের মতো গর্জন দিয়ে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হয়। তার হাতে তির-ধনুক। কোমরে ঝুলছে কোষবন্ধ তলোয়ার। বঙ্গবন্ধু মাক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে সেই-ই ভঙ্গিতে ভাষণ দেওয়া শুরু করে। মঞ্চের কোনার দিকে আগেভাগেই লুকিয়েছিল ইয়াহিয়া খান। সে একটা জল্লাদের মতো বঙ্গবন্ধুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় যুদ্ধ। দুইজনই তির নিক্ষেপের মাধ্যমে পরস্পরকে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ করছে। তিরের ফটাস ফটাস শব্দে উপস্থিত জনতা অবাক আমোদে ঝিম ধরে বসে থাকে। বঙ্গবন্ধু গর্জন করে ওঠে :

হে দস্যু দুরাচার পাকিস্তানি! আর যদি তুমি আমার একটা মানুষ হত্যা করবা… আর যদি তোমার হুকুমে সোনার বাংলায় একটা গুলির শব্দ হয়…

বলতে বলতে কোট-টাইপরা ইয়াহিয়া খানকে বঙ্গবন্ধু বাণ নিক্ষেপ করেন। সেই বাণে জল্লাদ ইয়াহিয়া খানের ধনুক ভেঙে যায়। বঙ্গবন্ধুও নিজের হাতের তির-ধনুক নিচে ফেলে দেন :

না, না, নাহি করিব কতল তোমায় নিষ্ঠুর দানব!
তুমি মোর ভাই।
ভালোয় ভালোয় বাংলা ছেড়ে পাকিস্তানে ফিরে যাও।

কিন্তু পাপিষ্ট ইয়াহিয়া খান হাতের ভাঙা ধনুক ফেলে দিয়ে তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর। শেষ বিকালের লাল আলোয় যুদ্ধ চলে, তুমুল যুদ্ধ। মাঠের নীরব জনসমুদ্র হাঁ-করে দেখছে। হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর তলোয়ারের আঘাতে ইয়াহিয়া খানের তরবারি হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায় নিচে। বঙ্গবন্ধুও হাতের তলোয়ার ছুঁড়ে ফেলে দেন, কে আছো? বন্দি করো এই রক্তখেকো রাক্ষসকে। কাজীকে ডাকো, বিচার করো এই খুনি দুরাচারের।

সাদা চুল-দাড়ি, সাদা আলখাল্লাপরা মালেক আসে। হাতে খাতা-কলম। বিচারে কসাই ইয়াহিয়া খানের শিরশ্ছেদের হুকুম হয়। কালো পোশাক পরে অহাকালু নষ্ট চোখটায় কালো কাপড়ের একটা পট্টি বেঁধে, হাতে সাড়েতিনহাত লম্বা একটা রামদা নিয়ে মঞ্চে উঠে আসে। অপরাধী ইয়াহিয়া খানের গলায় একটা দড়ি বাঁধে সে। তাবাদে সেই দড়িটা টেনে টেনে, ঘাড়ের রামদাটা বিকট ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে চলে যায় গহিন বনের দিকে।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you