শিমুল মাহমুদ : পরিদৃশ্যে সঞ্চালিত ভাষা || আহমদ মিনহাজ

শিমুল মাহমুদ : পরিদৃশ্যে সঞ্চালিত ভাষা || আহমদ মিনহাজ

শিমুল মাহমুদের বয়ান কবির চেতনসত্তায় যাপিত উদ্গানকে প্রকাশের লক্ষ্যে প্রধানত গদ্যছন্দি ভাষা-প্রকরণে নিজের স্থিতি বুঝে নিয়েছে। নব্বইয়ের পটপ্রবাহে মানুষের অস্তিত্ব যাপনের রকমারি অনুষঙ্গে মুখর অনুভবের প্রকাশ পাঠক টের পায় নিকট-সাম্প্রতিক পঙক্তিমালায় :—

লিখতে লিখতে কমবেশি সকলেই অপচয় করে ফেলে নিজেদের। কেউ কেউ বাতিল উপমায় ঠাঁসা মৃতভাষা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে নক্ষত্র হয়ে কাছে ডাকে। আমি নক্ষত্রের দিকে এগুচ্ছি; বুঝতে পারছি না ইশারা। মন ও মগজ থেকে মুছে গেছে ভাষা; বহু আগেই মন ও মগজের জায়গা দখল করেছে সংকেত; ভাষাকে শাসন করছে গণিতের ডিজিট।…

মানুষের ভেতর বসবাস করলেও আমাকে যখন একজন মানুষ আঁকতে বলা হলো, আমি ব্যর্থ হলাম। পারলাম না খুব স্পষ্ট করে মানুষ এঁকে দিতে। তাহলে কি ‘মানুষ’ রহস্যে মোড়ানো অশরীরী? নাকি প্রকৃতির কোনো রঙ বা রেখা দিয়ে মানুষ আঁকা সম্ভব নয়!
(গভীরতলের রূপান্তর)

কবির মনে জাগরুক এই জিজ্ঞাসা নব্বইয়ের সূচনালগ্নে নতুন ভাষা-প্রকরণ সন্ধানের তাড়নায় সংঘটিত বিচিত্র পরীক্ষানিরীক্ষা ও ভাঙচুরের স্মৃতি ফেরত নিয়ে আসে। সন্দেহ নেই ভাষার শরীরে সাংকেতিক অনুভব চারিয়ে তোলার সাহায্যে কবিতাকে পরাভাষায় রূপ দানের প্রবণতা অগ্রজ দশকগুলোর তুলনায় নব্বইয়ে অধিক ব্যাপকতা লাভ করেছিল। সূচনালগ্নের এই ভাষা পাঠকের জন্য নতুন আস্বাদ নিয়ে এলেও তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ঝকমারি ছিল। যাপিত সময় ও পরিপার্শ্বকে পরাভাষায় ঐশ্বর্য প্রদানের জন্য কবির পরিণতমনস্ক হয়ে ওঠা আবশ্যক হয়। উন্মেষপর্বে সেখানে ঘাটতি থাকায় এর আশ্রয়ে যেসব কবিতা তখন প্রকাশিত হচ্ছিল সেখানে অসংলগ্নতা, আড়ষ্টতা ও চকিত উল্লম্ফন অনেক সময় পীড়াদায়ক মনে হতো, যদিও জীবনবেদ সম্পর্কে কবিদের বয়স ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় ঘটনাটি অস্বাভাবিক ছিল না। সময় কবিকে পরিণত করে তোলে এবং শিমুল মাহমুদের ত্রিশ বছরের কবিতাভ্রমণে বিষয়টি চোখে পড়ে। তাঁর কবিতা চেতনপ্রবাহে শোষিত দৃশ্যানুভূতির চিন্তনযোগ্য রূপকল্পকে ভাষায় পরিণতি দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। পাঠকের ভাষাবোধে নবীন ভাববীজ ও অনুভূতি পুঁতে দেওয়ার লক্ষ্যে কবির মনোবিশ্বে সচল দৃশ্যানুভূতি বিবৃতি বা স্ট্যাটমেন্টের আদলে হাজির হতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করে না। আপাত দৃষ্টিতে রূপচাক্ষিক মনে হলেও অন্তর্গত ঝোঁক বিবেচনায় এই কবিকে ভাবচাক্ষিক বলাটা বোধহয় যুক্তিসংগত। রাখালিয়া গীতের গঠনসৌকর্যে অভিভূত শিমুলের ‘দেশভাগ হইল একফালি নকশাদার লাল তরমুজ’ যেমন দৃশ্যানুভূতি তুলে আনার ছলে কবির মনোবিশ্বে সক্রিয় ভাবনাকে বিবৃতির ঢঙে প্রকাশ্য করে তোলে :—

বচন অর্থ, ‘আপনি’। ‘আপনি’ হইলেন বস্তু। আর বস্তু হইতেই অস্তিত্ব যাহাকে বলা হয় ‘আহম’। আহম হইতেই সজ্ঞার সূচনা আমরা সজ্ঞাচালিত বস্তু বৈ অতিরিক্ত কিছু নই…
(দেশভাগ হইল একফালি নকশাদার লাল তরমুজ)

নব্বইয়ের বন্ধুবৃত্তে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভাষাকে ভাবনাশ্রয়ী বিবৃতির বাহক করে তোলার প্রবণতা শিমুল মাহমুদকে অন্যদের থেকে স্বকীয় রাখে। স্থানবাস্তবতার রকমারি উৎস পেরিয়ে কবির মনোজগতে প্রবিষ্ট দৃশ্যানুভূতির সংশ্লেষ যবে ভাষায় মূর্ত হয় সেখানে রূপময়তার আবেদন ছাপিয়ে দার্শনিক অনুসিদ্ধান্তে গমনের ঝোঁক দ্রষ্টব্য ঘটনায় রূপ পায়। শিমুল মাহমুদের কবিতায় তা-বলে চিত্ররূপময় পঙক্তির অভাব নেই, তবে সেখানে তাদের সমাবেশ এজন্য নয় যে কবিমনে সঞ্চালিত দৃশ্যানুভূতির প্রকাশ ঘটাতে তারা ব্যাকুল, বরং পাঠকের ভাষাবোধকে দৃশ্যের আড়ালে বহমান অনুসিদ্ধান্তে জড়িত করা মূল লক্ষ্যে পরিণত হয় :—

পিঁপড়েটা বৃত্ত অতিক্রম করতে পারছে না; আমি অতিক্রম করতে পারছি না গোলাকার পৃথিবী। পিঁপড়ে ও আমি ভাঙতে পারছি না বৃত্ত; বাইসাইকেলের টায়ারের মতো একটা বৃত্তের ভেতর আটকে গিয়েছি। আমি ও পিঁপড়ে আবারও হাঁটতে শুরু করেছি, সময় ও সূচনাবিন্দু বরাবর।
(গভীরতলের রূপান্তর)

উদ্ধৃত পঙক্তিমালা কাঠামোবদ্ধ জগতে বসবাস ও তাকে অতিক্রমের বাসনায় অস্থির কবির অস্বস্তিকে প্রকট করে। কবির ভাষাবোধ জাগতিক বাস্তবতার বিন্যাস ভেদ করে পরাভাষায় প্রবিষ্ট হতে ইচ্ছুক, যেহেতু তিনি বিশ্বাস করেন পরাভাষার সাহায্যে সেই বৃত্তে গমন সম্ভব যেটি তাঁর সত্তার প্রকৃত স্বরূপ চিনিয়ে দিতে তাঁকে সাহায্য করবে, কিন্তু কবির প্রয়াস শেষাবধি বৃত্তের প্রারম্ভিক বিন্দুতে তাঁকে ফেরত যেতে বাধ্য করে! সারকথাটি হলো জগৎ জুড়ে বিরাজিত স্থানবাস্তবতার কাঠামো যতক্ষণ নিজের থেকে ভেঙে না পড়ছে ততক্ষণ অবধি কবির পক্ষে নতুন বৃত্তে প্রবেশ অথবা তাকে ভাষা প্রদান সম্ভব নয়। সূচনাবিন্দুতে ফেরত যাওয়ার ঘটনা বাস্তবতায় বিদ্যমান ভাষার সাহায্যে কবির মস্তিষ্কে প্রবহমান দৃশ্যানুভূতির প্রকাশ ঘটানোর সমস্যা তুলে ধরে।

লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন বিশ্বাস করতেন দৃশ্যমান রূপের জগৎ ও তাকে কেন্দ্র করে বিরচিত স্থানবাস্তবতা কেবল ভাষার সাহায্যে যৌক্তিক বক্তব্য রূপে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। ভিটগেনস্টাইনের কথা যদি স্বীকার যাই তবে ভাষার সাহায্যে প্রকাশিত বক্তব্যকে অযৌক্তিক ভাবার সুযোগ থাকে না। ইন্দ্রিয়জ ও স্নায়বিক শক্তির অধিকারী ব্যক্তি যখন কোনোকিছু ভাবে এবং ভাষায় প্রকাশ করে তখন তার এই বক্তব্য স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন, অন্যথায় একে অযৌক্তিক ভাবার ঝোঁক এড়ানো কঠিন হয়। ওদিকে যে-স্থানবাস্তবতায় ভাষিক বিবৃতি জন্ম নিলো সেটি যদি যৌক্তিক ঘটনার স্বীকৃতি লাভ করে তাহলে সেখানে জন্ম নেওয়া বক্তব্য অযৌক্তিক গণ্য হতে পারে না। ভাষার পরিধি যতদূর অবধি সক্রিয় রয়েছে বাস্তবতা সম্পর্কে ব্যক্তির বোধ ও চেতনা সেই সীমারেখা অবধি বহাল থাকে। বাস্তবতার স্বরূপকে ভাষা যতখানি ব্যাখ্যা করে ব্যক্তির যুক্তিবোধের সীমানা ততদূর অবধি সচল বলে মানতে হয়। সুতরাং ব্যক্তি যখন ভাষার সাহায্যে ‘এটা আছে, ওটা নেই অথবা হয়তো আছে’ ইত্যাদি বক্তব্য প্রদান করে তখন সেটি বৈধ হয় না। ভাষার সাহায্যে ব্যক্তি যাকে এই মুহূর্তে ‘নেই’ বলে ঘোষণা দিচ্ছে সেটি হয়তো ‘আছে’ কিন্তু বক্তার ভাষাবোধে স্বচ্ছ হওয়ার অবস্থায় পৌঁছায়নি :— ‘Logic fills the world: the limits of the world are also its limits. We cannot therefore say in logic: This and this there is in the world, that there is not.’ (দ্রষ্টব্য : Tractatus Logico-Philosophicus by Ludwig Wittgenstein)

শিমুল মাহমুদের বৃত্ত অতিক্রম করতে না পারার ঘটনা ভিটগেনস্টাইনের প্রবাদপ্রতিম উক্তি স্মরণ করতে বাধ্য করে। তাঁর পঙক্তিমালা ভাষার সাহায্যে স্বচ্ছ বক্তব্য প্রদানের ঘটনায় ব্যক্তির সংকট তুলে ধরে। পরাভাষা হলো সেই বস্তু যেখানে ভিটগেনস্টাইনের শর্ত মেনে স্বচ্ছ বা ক্লিয়ারকাট বক্তব্য কবি উপস্থাপন করতে পারছেন না, যদিও ভাষাকে আঁকড়ে ধরে অগ্রসর হওয়ার কারণে কবির বক্তব্যকে অস্পষ্ট বা অযৌক্তিক বলে খারিজ করাও সম্ভব নয়! সুতরাং ব্যক্তির ভাষাবোধে জন্ম নেওয়া বক্তব্য বাস্তবতা সম্পর্কে কবির সাংকেতিক বোধির বহিঃপ্রকাশে পরিণত হয়। আপাতভাবে দুর্বোধ্য বা অযৌক্তিক মনে হলেও ভাষারূপ ধারণের কারণে সংকেতভরা বিবৃতিকে অযৌক্তিক ভাবার সুযোগ থাকে না। নব্বইয়ের অন্যতম লক্ষ্য ছিল কবিতায় নতুন পরা-সংকেত তুলে আনার জন্য সময়-গহিনে প্রবেশ, যেন এর ওপর ভর করে নব্বই ও পরবর্তী কালপর্বের ভাষাকে কবি নতুন অঙ্গে যৌক্তিকতা দান করতে পারেন। শিমুল মাহমুদ সেই পাতালযজ্ঞে অন্যতম যাজ্ঞিক ছিলেন। ত্রিশ বছরের কবিতাযাত্রায় ভাষিক বিবৃতি বা বক্তব্য প্রদানের মৌল সূত্র নিজ সজ্ঞায় দ্রবীভূত করার যজ্ঞে কবি অনেকখানি সফল :—

অনুভবলিপি অর্থাৎ ভাষাচিহ্ন, আমরা যাকে ‘লেখা’ বলছি পক্ষান্তরে ওইগুলো তোমার ‘যমজ’। যখন কোনো কাজ থাকে না, তখন এইরকম বৈশিষ্ট্যহীন সন্ধ্যায় আমাদের যমজেরা ঘুরে বেড়ায় রাস্তায়। আমাদের ডাকনামের শরীরে রাখাইন তাঁতি মাকুর হাতে বুনে দিয়েছে শীতের চাদর। চাদর নিজেই এক ‘ভাষা’ যে কিনা উষ্ণতার ভেতর মিশিয়ে দেয় গান।
(পরিদৃশ্যের পরিভাষা)


নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you