আজ বিউটি বোর্ডিংয়ের কথা কে বা না জানে! আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল বেশ কয়েকবার তার দু’তলার ঘষা কাচে মুখ দেখার। ইলিশ-ভাত খাওয়ার। ম্লান হলুদ ও আগাছারা তাকে ঘিরে আছে সারাক্ষণ। সেসব রঙচটা দেয়ালে দেয়ালে কত কথা, কত স্মৃতি, কত কবিতা। রাত হলেই হয়তো এখনও বিউটি বোর্ডিংয়ের ৬০ ওয়াটের বাল্বের নিচে বা উঠোনে আড্ডায় মেতে ওঠেন শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান, আহমদ ছফাদের হলাহলপূর্ণ ভূত।
বাংলাদেশে যেমন শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বিউটি বোর্ডিং তেমনি আমেরিকান শিল্পী-সাহিত্যিক-অভিনেতা-গায়কদের জন্য এখনও মুখে মুখে ফেরে চেলসি হোটেলের কথা। নিউইয়র্কের ২৩তম রোডের ১২তলার ২৫০ কক্ষের এক চেলসি হোটেল। যদি তার দেয়ালগুলো কথা বলতে পারত তবে আমরা পেতাম লেখক থেকে আর্টিস্ট, মিউজিশিয়্যান, অভিনেতা, ফিল্মমেকার সহ অসংখ্য কিংবদন্তির গল্প।
একদিন ক্লাব টুয়েন্টি সেভেনের মেম্বার জেনিস জপ্লিনের স্মৃতি নিয়ে লেওনার্দ কোহেনের ‘চেলসি হোটেল’ গানটা শুনছিলাম। পরে বব ডিলানের ‘সারা’ গানেও শুনলাম চেলসি হোটেলের কথা। এই চেলসি হোটেল তীর্থস্থানের মতো স্মরণীয় হয়ে আছে বিখ্যাতদের পদচারণা এবং অনেক মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে। পরে একটু নেটে খোঁজখবর নিলাম। ‘ইনসাইড হুক’ নামের এক সাইট জানাচ্ছে, ১৮৮৩-৮৫ সালের মধ্যে নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত হয় চেলসি হোটেল । বিউটি বোর্ডিংয়ে যেমন কবি শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমানরা বাস করা শুরু করেছিলেন তেমনি মার্ক টোয়েন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জেমস ফেরেলের মতো লেখকরা চেলসি হোটেলকে আস্তানা বানিয়েছিলেন।
১৯৮০ সালের দিকে বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ম্যাডোনাও বাস করতেন এখানে। ১৯৬৮ সালে চেলসি হোটেলেই অ্যাফেয়ারে জড়ান কোহেন-জপ্লিন। তারপর সব ইতিহাস। কথিত আছে, প্রণয়ের দিনে দু’জনে হোটেলের ২২২ নাম্বার রুমেও ছিলেন। দু’জনের সম্মুখপরিচয়টা দারুণ সিনেমাটিক। হঠাৎ লিফটে জপ্লিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কোহেনের। সেই মুহূর্তটির কথা পাওয়া যায় ‘চেলসি হোটেল#২’ নামক গানে। কোহেনের রাশভারী কণ্ঠ যখন ‘I remember you well / at the Chelsea Hotel / you were talking so brave and so sweet / giving me head on the unmade bed / while the limousines wait in the street…’ গেয়ে ওঠে তখন পৃথিবী ভরে যায় বিষাদে। আহা! গোলাপকাঠের বিছানায় শুয়ে-থাকা জপ্লিন!
বব ডিলান থাকতেন ২১১ নাম্বার রুমে। চেলসি হোটেলজীবনে ১৯৬০ সালে তিনি তার ‘Blonde On Blonde’ ক্ল্যাসিক অ্যালবামের গানগুলো লেখেন। ১০ বছর পর ডিলান তার ‘সারা’ নামক গানে তুলে আনেন চেলসি হোটেলের স্মৃতি। তিনিও হয়তো কোহেনের মতো প্রেমে পড়েছিলেন। অবশ্য ডিলানের প্রেমিকা ছিল বিষণ্ন চোখের অধিকারী — ‘staying up for days in the Chelsea Hotel, writing Sad-Eyed Lady Of The Lowlands for you…।’
চেলসি হোটেলের আবাসিকের তালিকাটা ছিল দীর্ঘ। পিঙ্ক ফ্লয়েডের মেম্বাররা থেকে শুরু করে জিমি হ্যান্ড্রিক্স, জিম মরিসনও আছেন সেই তালিকায়। এমনকি টাইটানিকট্রাজেডিতে বেঁচে-যাওয়া অনেকে আশ্রয় নিয়েছিলেন চেলসি হোটেলে। টমাস উল্ফ এবং জ্যাক কেরুয়াক থেকে অ্যান্ডি ওয়ারহোল এবং জ্যাকসন পোলকই বা বাদ যাবেন কেন! কেরুয়াক থাকবেন আর নিজের শহর বানিয়ে ফেলা নিউইয়র্কের এমন রঙিন জীবনে বিট জেনারেশনের আরেক কিংবদন্তি কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ থাকবেন না, তা অসম্ভব।
সৃষ্টি আর ধ্বংসের তুমুল সাক্ষী হয়ে আছে চেলসি হোটেলের ছোট ছোট কক্ষগুলো। ষাটের দশকে নাট্যকার আর্থার মিলার ‘আফটার দ্য ফল’ সহ মোট তিনখানা নাটক লিখেছিলেন এখানে। ‘২০০১ : অ্যা স্পেস অডিসি’ মুভ্যিটি দেখেননি এমন সিনেমাবোদ্ধা পাওয়া দুষ্কর। স্ট্যানলি কুব্রিকের সেই ক্ল্যাসিক মুভ্যি এখনও মাইলস্টোন হয়ে আছে। এই সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়েছিল আর্থার সি. ক্লার্কের উপন্যাস ‘২০০১ : অ্যা স্পেস অডিসি’ থেকে, যা লেখা হয়েছিল চেলসি হোটেলেই।
অ্যান্ডি ওয়ারহোলের শর্ট ফিল্ম ‘চেলসি গার্ল’ আর আমেরিকান সিঙ্গার ম্যাডোনার ১৯৯২ সালে প্রকাশিত বই ‘সেক্স’-এর জন্য ফটোশ্যুটও করা হয়েছিল চেলসি হোটেলে। পাল্প ফিকশন ও কিল বিল খ্যাত অ্যাকট্রেস উমা থারমানের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর চেলসি হোটেলের এক দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ওঠেন ইথান হাউক। তারপর ‘চেলসি ওয়ালস’ নামের এক মুভ্যিও বানিয়ে ফেলেন তিনি।
তবে চেলসি হোটেল নন্দিতদের জায়গা দেওয়ার পাশাপাশি বিখ্যাত হয়ে আছে আরেকটি কারণে। দ্য টেলিগ্রাফ জানাচ্ছে, শিল্পসাহিত্য চলার পাশাপাশি হোটেলটিতে মৃত্যু-হত্যা-আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। পাঙ্ক-রক জনরার লাইনআপ সেক্স পিস্তলের বেসিস্ট সিড ভিশাস চেলসি হোটেলে তার গার্লফ্রেন্ড ন্যান্সি স্পাঙ্গেনকে খুন করে নিজের নামের মর্যাদা রাখেন। চেলসি হোটেলে বসে মদ্যপান করতে করতেই নিজেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন বিখ্যাত কবি ডিলান থমাস। আর ১৯৬৮ সালে নিজ রুমে আত্মহত্যা করেন লেখক চার্লস জ্যাকসন।
শুরুর কয়েক বছরের মধ্যে বন্ধ হযে গিয়েছিল চেলসি হোটেল। পরে ১৯০৫ সালে পুনরায় খুলে দেওয়া হয় তার দরজা। কিন্তু এরপরই কিংবদন্তি হয়ে ওঠার জন্য একের পর এক ঘটনা জন্ম দিতে থাকে চেলসি হোটেল। ২০১১ সালে হোটেলটি ৮০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন এক এস্টেট ডেভেলপার। এরপরই বিক্রি হয়ে যায় চেলসি হোটেলের একেকটি দরজা।
… …
- প্রেম, সৃষ্টি, মৃত্যু ও আত্মহত্যামুখর এক চেলসি হোটেলের গল্প || উপল বড়ুয়া - April 24, 2020
- ওপেন এ্যায়ার কন্সার্টের রাগী ঘোড়া || উপল বড়ুয়া - October 2, 2017
COMMENTS