মেলা, বাংলা গানে || জাহেদ আহমদ

মেলা, বাংলা গানে || জাহেদ আহমদ

এমনিতে মেলা ব্যাপারটা বাংলা গানে এসেছে নানান বর্ণে ও ভাবে, রেকর্ড-করা গানে এবং রেকর্ড-না-করা গানে লোকস্মৃতি ও লোককণ্ঠ বেয়ে, যেহেতু মেলা ছিল বছরচক্রের বাংলা সংস্কৃতির একটা আদি ঐতিহ্য। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-অতুল-রজনী-দ্বিজেন্দ্র প্রমুখ রোম্যান্তিক গীতিকবিদের হাতে এবং তাদের আগে ও পরে মেলাপ্রাসঙ্গিক পঙক্তিচিত্র সংগীতের কথাবস্তুতে দেখতে পেয়েছি আমরা ভালোভাবেই। কিংবা লালন বা বাউল সাধকদের গানেও মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়, সেইটা আরেক মজমের মেলা অবশ্য, ‘তিন পাগলের হলো মেলা নদেয় এসে’ ইত্যাদি মর্মতত্ত্বের মেলা সেসব। মরমিয়ানার বাইরে যেয়ে যে-মেলা তার উল্লেখ সাঁওতালগানেও পাই, যেমন পাই পার্বত্য অঞ্চলের ভূমিবাসীদের গানে। প্রেমাস্পদের মানভঞ্জনের ওসিলায় মেলা থেকে এটা-ওটা আনিয়া দিবার অছিয়ত প্রকাশ করতে দেখা যায় গানে; এবং প্রেমিকাব্যক্তিটিকে তার প্রেমিকব্যক্তিটির নিকট আব্দার করতেও দেখা যায়। এইসব গানে মেলা স্থান পেয়েছে লিরিকের অনুষঙ্গ হিশেবে। মূল কন্টেন্ট হিশেবে মেলা রাবীন্দ্রিক ও রবীন্দ্রোত্তর স্বর্ণযুগজন্মা আধুনিক বাংলা গানেও গরহাজির। অথবা হাজির থাকতেও পারে, সেভাবে আমাদের দৃষ্টির সামনে নাই। কিন্তু সন্দেহোর্ধ্ব যে এ-সমস্ত গানে মেলা ব্যাপারটা পাঞ্চড আইটেম বৈ কেন্দ্রপ্রসঙ্গ নয়।


কেন্দ্রপ্রসঙ্গ হয়েছে, আধুনিক বাংলা গানে মেলা ব্যাপারটা, দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে দুইবার। এর মধ্যে একটা গানের জন্মস্থান বাংলাদেশ, অন্যটার জন্মজায়গা ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। দুইটাই বিউটি ও বস্তুনিষ্ঠতায় ইউনিক। দুইটাই বাংলা গানে দুই গ্র্যান্ড সাক্সেস। বাংলাদেশের গানটায় একটা নাগরিক মেলার বিবরণ প্রকাশিত, হোয়্যারেজ ভারতের গানটায় গ্রামীণ ক্ষয়িষ্ণু মেলাচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে দেখতে পাবো। দুইটা গানেরই লিরিক্স আমরা টান মেরে একবার দেখে নেব। তবে এ-প্যারায় নয়, একটু পরের একটা প্যারায়।


একবার মনে করে দেখি তো, খুবই সংক্ষেপে, বাংলা গানে নানান সময়ে পাঞ্চড অনুষঙ্গ হিশেবে মেলা ব্যাপারটা কীভাবে এসেছে। একবার দুইবার নয়, স্বাভাবিক ও সংগত কারণেই, এসেছে অসংখ্যবার বাংলা গানে মেলা। ভালোবাসাগানে, প্রেমপ্রকাশক গানে, শৈশবজাগৃতিমূলক গানে, স্মৃতিরোমন্থনমূলক গানে, ঐতিহ্য স্মরণ ও উজ্জীবনে, দেশগ্রাম ও পল্লিবাংলার চিত্রায়নে, মধু ও বিষাদের নস্ট্যালজিয়্যা আঁকার গরজে মেলা বাংলা গানের টেক্সট জুড়ে প্রেজেন্স জারি রেখেছে। একদম ঝটপট ঝটিতি উদাহরণ হৈমন্তী শুক্লার একটা গান। ‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি / বাঁশি তো আগের মতো বাজে না’ — এই গানে মেলা বাহন হয়েছে একটা আলাদা ছায়াছবি পরিস্ফুটনের নিমিত্তে। যেমন দেখা যাবে কাজীগানে — ‘দোল দোল দুলুনি / রাঙা মাথার চিরুনি / এনে দেবো হাট থেকে / মান তুমি কোরো না’ গানটাতেও গোটা ভাবটুকু প্রকাশের অন্যতম উপাদান হিশেবে মেলা/হাটের উপস্থিতি। ধরা যাক সলিল চৌধুরীর সৃজনে হেমন্তকণ্ঠে ‘দুরন্ত ঘূর্ণির ওই লেগেছে পাক / এই দুনিয়া ঘোরে বন বন বন বন / ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায়’ — এই গানেও গোটা দুনিয়াটাকে একটা বিশেষ রূপক হিশেবে ভাবতে যেয়ে মেলা বাহন হয়েছে মাত্র। ঝুমুর তালের আদিবাসী গানগুলোতেও অনুরূপে মেলা হাজির হয়েছে পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োজনে।


মেলা ব্যাপারটাও তো যুগে যুগে এক-রকমটা থাকে নাই, পাল্টেছে, পাল্টাতে পাল্টাতে একবিংশ অব্দি এসেছে। এক-সময় ছিল ‘মনের সনে মন মিলিলেই মেলা’, আজকাল ধনেদৌলতের সনে ধনদৌলত না-মিলিলে মেলা বা খেলাধুলা কিচ্ছুটি হবার নয়। ‘নাগরিক সভ্যতা’ নামে যে-জিনিশটা আমরা প্যাট্রোনাইজ্ করি, সেই জিনিশের ভিতরে মেলাগুলো সমস্ত পণ্য খরিদের মোচ্ছব। হোক সেইটা আনাজপাতি বিকিকিনি, ইরান-তুরান-ব্রিটেইন্-অ্যামেরিকার পোশাক-প্রযুক্তি বিক্রয়হট্ট, কিংবা বাংলাদেশজ বইয়ের। বছরভর, প্রায় প্রত্যেক মাসে, একটা মেলা আজকাল লেগেই থাকে এবং সেইটা বাণিজ্যমেলা বা ট্রেইড ফেয়ার। আমমেলা, কাঁঠালমেলা, কাঁচকলামেলা, সাবানশ্যাম্পু ও সোনামুগডালের মেলা। হাজারেবিজারে পণ্যমেলার পসারে সেকেলে মেলার মিলনদর্শন আজ মিলিয়ে যেয়ে একেবারেই বিস্মৃতপ্রায়। সেই দিন ফেরানোর চিন্তাও অবাস্তব।


মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলা গানে কিন্তু পণ্য তরফদারির মেলামোচ্ছব আজও সঙ্কুলান করে নিতে পারে নাই নিজেদের স্থান। প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপনী জিঙ্গেলের ব্যাপারটা বাদ দিতে হবে অবশ্য। এর বাইরে যে-মেলাটা ঘিরিয়া পাতিমধ্যবিত্ত বলয়ের বাঙালির রিসেন্ট বড়াই, বইমেলা নামে যে মশহুর, শাহরিক/ঊনশাহরিক লঘিষ্ঠাংশ ‘লেখক-পাঠকের প্রাণের মেলা’ স্লোগ্যানে বেলবহেড়াতলা ত্রাহিকম্প রয় ফেব্রুয়ারি-ডিউরিং আঠাশ-ঊনত্রিশটি দিন যেই কারণে, সেই মেলার প্রেজেন্স বাংলা গানে পাওয়া যায়? এর উত্তর সম্ভাব্য সমস্ত শ্রোতাপাঠকের কর্ণচক্ষুগোচরে রয়েছে। এক-দুইটা গানে হয়তো ছোট্ট উল্লেখের নজির টর্চ জ্বালিয়ে পেয়েও যাব, তবে সেইটাকে মেলাগান বলা যাবে না আর-যা-ই-হোক। ধরা যাক ইন্ডিয়ান-বাংলা ব্যান্ড ‘চন্দ্রবিন্দু’ ওদের একটা গানে এমন স্তবকের লিরিক্ টেনেছে, ‘বইমেলা-ধুলো / গার্গী-শ্রেয়সী / চেনা মুখগুলো / পরিচিত হাসি’, কিন্তু ওইটা তো পুরনো বন্ধুবেলার নস্ট্যালজিয়্যাঘেরা গান, ‘বন্ধু তোমায় এ-গান শোনাব বিকেলবেলায় / আরেকবার যদি তোমাদের দলে নাও খেলায়’, বইমেলার গান তো নয় এইটা! বা আরেক ধরনের মেলাও শহরে, এ-দেশের আধখেঁচড়া না-গ্রাম না-শহর ঝুঁকিজীর্ণ রাজধানীতে, এককালে ফ্যাশন্যাবল্ হয়েছিল খুব, ‘পুষ্পমেলা’, আজও হয় সিজন্ এলে, সেই নব্বইয়ের দশকের ইকোবানা-বানসাই কিংবা গুলশানের অট্টালিকামালকিন গোলাপকিষাণী গৃহবধূরা আজকাল প্যাস্টাইম্ হিশেবে অ্যানাদার ফ্যাশনে দিল্লাগি হয়েছেন, গানে সেইটা খানিক এসেছিল নব্বইয়েরই শৌখিন চপল প্রণয়গানে, ‘শিল্পকলায় এক ফুলের মেলায় / যে-ফুলটি কেড়েছে সব অন্তর / তুমি তারচেয়ে আরও বেশি সুন্দর’, আদনান বাবু নামের এক গায়ক তখন এই গান সম্বলিত ‘রং নাম্বার’ অ্যালবাম দিয়ে বছরের বেস্টসেলিং আইটেমের অধিকারী ছিলেন।


কথাটা বোধহয় মিথ্যেও নয় যে একটা জাতির রক্তে দ্রবীভূত হবার আগ পর্যন্ত কোনো ঘটনা বা গালগপ্পো সেই জাতির গানে জায়গা পায় না। ব্যাপারটা সাহিত্যের অন্যান্য পরিশাখাগুলোর ক্ষেত্রেও সত্যি নিশ্চয়, কবিতায় তো বলা বাহুল্য, এইসব বই কিংবা বাদবাকি বৈশ্যপণ্যগুলোর বেচাবিকি ফিকিরের মেলাগুলো পোড়ামুখা বাঙালির রক্তে মেশে নাই যে এর একটা ভালো প্রমাণ জাতিটার গানে-কবিতায় একেলে মেলাগুলো জমিজিরেত পায় নাই। কিন্তু অচিরে এদেরই মধ্যে থেকে কেউ, ধরা যাক কোনো ফোনকোম্প্যানির গ্রাহকসেবামেলা, হয়তোবা প্রাণের মেলা হয়ে যেতেও পারে। এছাড়া প্রাণ নিয়া খামাখা দুর্ভাবনার কিছুও তো নাই মনে হয়, কেননা সমনামী একটা পণ্যব্র্যান্ড তো রয়েছেই আমাদের, সম্পূর্ণ দেশজ পণ্য। শুধু বছরান্তের মিলনপিপাসু ঝুলনের মিঠে কানাকানি পিঠে চুলকাচুলকির মেলামাতালেরা খামোশ হবেন ম্যাঙ্গোজ্যুসের ময়দান দখলদারি দেখে। হ্যাঁ, ব্যাপারটা ‘ফালতু’ মজাক নয় কিন্তু! অন্তর্গত রক্তের ভিতরকার ডাক কিংবা ঢাকঢোলঝাঝর শ্রবণের রাস্তাটা আমরা মাড়ানো ভুলেছি, কিংবা বাইরেকার নতুন গিটার-ড্রামের আওয়াজটাও ধরবার গরজ বোধ করছি না। খালি ব্যবসায় দিয়া লাখের বাত্তি ঈশাণকোণের তালশীর্ষে জ্বালানো গেলেও সংস্কৃতির অংশ হওয়া খালি বেনিয়াগিরি দিয়া হবার নয় এইটা আলবৎ বিশ্বাস্য। মুখে যতই বিশ্ব মারুন, প্রাণের মেলা বইয়ের খেলা আওড়ায়ে চেল্লাচেল্লি করুন মনের হরষে একবিংশদিবসে, ফেব্রুয়ারি ফুরাইলেই ঠুশ! নতুন দিনের নিত্যমেলার বাংলা গানে অনুপস্থিতি নিশ্চয় ইতি-আদি বিভিন্ন কৌণিক পরিসর থেকে দেখা সম্ভব। অজরুরি কি অগুরুত্বপূর্ণ নয় বোধহয় এই কিসিমের ভাবনা। অ্যানিওয়ে।


মেলা উপজীব্য করে, মেলাকে সেলেব্রেইট করে, যে-দুইটা গানের অস্তিত্ব উল্লেখ করা হয়েছে একটু আগে, এদের একটা বাংলাদেশের ব্যান্ড ‘ফিডব্যাক’ ও অন্যটা ভারতের ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সম্পাদিত বাংলা গানের সৃজন। ফিডব্যাকের গানটা পাওয়া যায় ‘মেলা’ শিরোনামেরই অ্যালবামে, গত শতকের নব্বইয়ের গোড়ার দিকে এই গানটার জন্ম। ওদিকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-সম্পাদনায় গানটা ‘ঝরা সময়ের গান’ শীর্ষক অ্যালবামে প্রথম প্রকাশ। ঘোড়াগুলোর ওই অ্যালবামে আশ্চর্য সুন্দর তিনটা গানের একটা সিক্যুয়েল্ পাওয়া যায় ‘গানমালা’ শিরোনামে। সেই মালার মাঝখানের গানটা হচ্ছে মেলাপ্রাসঙ্গিক, ‘পেরিয়ে মাঠের সীমানা ওই মেলা বসেছে’ গানটার পয়লা লাইন। ফিডব্যাকের ‘মেলা’ অ্যালবামের টাইটেল্ স্যং শুরু হচ্ছে ‘লেগেছে বাঙালির ঘরে ঘরে এ কী মাতনদোলা’ লাইনটা দিয়ে। এখন পরপর দুইটা গানের লিরিক্স লক্ষ করব। পয়লা ফিডব্যাকের, তার বাদে মহীনের ঘোড়াগুলির।


লেগেছে বাঙালির ঘরে ঘরে এ কী মাতনদোলা / লেগেছে সুরেরই তালে তালে হৃদয়ে মাতনদোলা / বছর ঘুরে এল আরেক প্রভাত নিয়ে / ফিরে এল সুরের মঞ্জরী / পলাশ-শিমুল গাছে লেগেছে আগুন / এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি / মেলায় যায় রে, মেলায় যায় রে / বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায় / মেলায় যায় রে, মেলায় যায় রে / বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই / … / লেগেছে রমণীর খোঁপাতে বেলিফুলের মালা / বিদেশী সুগন্ধী মেখে আজ প্রেমের কথা বলা / রমনা বটমূলে গান থেমে গেলে / প্রখর রোদে এ যেন মিছিল চলে / ঢাকার রাজপথে রঙের মেলা / এ বুঝি বৈশাখ এল বলেই …


পেরিয়ে মাঠের সীমানা ওই মেলা বসেছে / চর্কি ঘোরে, পাঁপড় ভাজায় / মাতালিয়া ঢোলকে মনকে মাতায় / তোরা কে কে যাবি রে, কে কে যাবি রে / কে কে যাবি রে তোরা আয় / … / পয়সা যদি নেই পকেটে ভাবনা কী আছে / ঘুরতে মানা, চড়তে মানায় / ভিড়ে মেশা আনন্দের কী আসে যায় / তোরা কে কে যাবি রে, কে কে যাবি রে তোরা আয় / … / একরঙা এই জীবন ছেড়ে একটু পালানোর / এর বেশি হায় কে-ইবা কি চায় / বেচাকেনা হিসেবের খুশির মেলায় / মোরা সবাই যাব রে, সবাই যাব রে / সবাই যাব-যে রে মেলায় … তোরা কে কে যাবি রে, কে কে যাবি রে তোরা আয় …

১০
গান কথাশ্রিত যতটা না, তারচে বেশি সুরাশ্রিত। উপরোক্ত দুইটা গান সুরারোপিত হয়েছে এমনভাবে যে, একবার শুনলেই শ্রোতা টের পাবেন এদের অনন্যসাধারণত্ব। মহীনের ঘোড়াগুলির গানটাতে এমন প্রশান্তি লেপ্টানো রয়েছে, একবার শুনে এর রেশ ও আবেশ থেকে বেরোনো যায় না বাকি জিন্দেগিতে। এদিকে ফিডব্যাকের গানটা শুনে ছয়-বছরের শয্যাশায়িত মুমূর্ষুও গতর ঝাঁকানি দিয়া দাঁড়াবে সটান। সর্বমোট তিনসেকেন্ড-কম টানা সাড়ে-পাঁচমিনিটের গান ফিডব্যাকের ‘মেলা’। ওইটুকু কথাবস্তু দিয়া সাড়ে-পাঁচমিনিট টেনে যাওয়া আদৌ কথার নির্ভরতা না, বলা বাহুল্য, সুরের সৌকর্য, বাজনা ও বাদনের কারুকর্ম। গানটা মাকসুদুল হক লিখেছেন ও গেয়েছেন। মাকসুদের অননুকরণীয় ভোয়েস ও র‌্যান্ডিশন তখন পিকছোঁয়া। ফিডব্যাক  তাদের ব্যান্ডক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করছে সেই-সময়টায়। সাড়ে-পাঁচমিনিটের গানে ইন্টার্লিউড ও প্রেলিউড এতই দীর্ঘ অথচ অক্লান্ত ফুর্তির যে টেক্সট তথা গানের কথাবস্তু গৌণ হয়ে যায় এর সূচনা ও সমাপনকালীন বর্ষ-আবাহনী মিউজিকের মৌতাতে। গোটা দুই/তিন দশক পরের প্রজন্মের কাছেও ফিডব্যাকের মেলা আজও অপ্রতিরোধ্য ও অমলিন আবেদন নিয়া হাজির হয় ফি-বছর। যারা গানটা তার জন্মলগ্ন থেকেই শুনে আসছেন তারাও এর সুরাবেশ কাটায়ে উঠতে পারেন নাই এতটা কাল অতিক্রম করেও। বরঞ্চ এর আবেশ ও প্রয়োগোপযোগ উত্তরোত্তর বর্ধিষ্ণু। শ্রোতা যারা আজও শোনেন নাই ফিডব্যাক  ও মহীনের ঘোড়াগুলি  সম্পাদিত দুই মেলা-উদযাপনী গান, তারা শুনে দেখুন, বুঝতে পারবেন বাংলা গানের পাঠ্যপুস্তকে স্বর্ণযুগের পরেও কত স্বর্ণ-গজমোতি-হীরা-পান্না জন্মিয়াছে। বিফলে কথা ফেরৎ। ঝুট বোলে কাউয়া কাটে।

১১
ফিডব্যাকের গানে যে-মেলার ছবিটা পাওয়া যায়, সেইটা নাগরিক মেলা। ঢাকা শহরের উল্লেখও রয়েছে লিরিকের গায়। কিন্তু লক্ষণীয়, গত শতকের এই গানজন্মকাল থেকেই নাগরিক পরিসরে, গোটা দেশের জেলাশহরগুলোতে, একটা আর্বেইন কালচারাল রেনেসাঁ সাড়ম্বরে না-হলেও শক্তিসারবত্তা নিয়া সামনে আসতে শুরু করে। রাজধানীর আদলেই ছায়ানটসদৃশ বর্ষআবাহনী প্রভাতী সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন দিয়া দিনের শুরুয়াৎ, মাঙ্গলিক শোভাযাত্রা চালনা, দিনজোড়া নানা বর্ণিল উৎসবফোয়ারা ইত্যাদি সূচনাবৈশাখের পরিচয়চিহ্ন হয়ে উঠতে থাকে। এতই দীর্ঘ প্রভাববিস্তারক হয়ে উঠতে থাকে এই নগরকেন্দ্রী উদযাপনাগুলো যে অচিরে এগুলো দমাতে বোমা ফালানো হয়; এমনকি বোমাও রুখতে পারে না এর বেগ, এই উৎসবস্রোত। উত্তরোত্তর এই মিলমিশের মেলা বাড়তে থাকে, এমনকি ফি-বছর ক্ষমতাস্বার্থান্বেষীদের অপতৎপরতাও থোড়াই পরোয়া করে এই মিলনাকাঙ্ক্ষী নগরজনতা। বাংলাদেশের ব্যান্ডগান এই জাগৃতিতে একটা ভালো অবদান রেখেছে দেখতে পাবো। সময়ের কাজ করে যাওয়ার জন্যই তো গান ও অন্যান্য সমুদয় সাহিত্য ও শিল্পকলা।

১২
নাগরিক গণ্ডির বাইরে যে-মেলা মহীনের ঘোড়াগুলির গানে রেপ্রিজেন্ট করছে, সেই মেলাও ক্ষয়িষ্ণু হলেও বহাল বাংলাদেশে আজও। তবে একটা জায়গায় এইভাবে একটা ভিন্নতা টানা যায় গানদ্বয়ের মধ্যে যে, “একরঙা এই জীবন ছেড়ে একটু পালানোর / এর বেশি হায় কে-ইবা কি চায় / বেচাকেনা হিসেবের খুশির মেলায় / মোরা সবাই যাব রে, সবাই যাব রে / সবাই যাব-যে রে মেলায়” … এই-যে একটা নায়্যিভিটি মহীনের ঘোড়াগুলির গানে, স্রেফ একটু কৈশোর-উদ্বেলক ভূমিকায় মেলার উপস্থিতি এই গানে, এস্কেইপ করার একটা মওকা হিশেবে মেলার নেসেসিটি স্বীকার, ফিডব্যাকের গানটা ঠিক এইখানেই এগিয়ে। ফিডব্যাকের এই গান পোলিটিক্যালি একটা স্ট্রং পজিশনে দাঁড়ানো। উত্থানের জয়গাথা গাইছে গানটা, গাইছে চির-উজ্জীবনের মাভৈ। ফিডব্যাকের গানটা পোলিটিক্যাল একটা কনশ্যাস্নেস্ থেকে এগিয়ে থাকবে চিরকাল। মহীনের ঘোড়াগুলির মেলা যে-অর্থে চিরদিন নস্ট্যালজিয়্যায় মৃদু মর্মরিত রইবে, মেদুর করে তুলবে এর শ্রোতাদেরে সেই বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতি, ফিডব্যাকের মেলা গানের ক্ষেত্রে কোনোদিনই সেইটা হবে না। কারণ একটাই। ফিডব্যাকের গান কনফ্রন্ট করছে। এমনভাবে করছে সেইটা যে এই কনফ্রন্টেশন কখনো উবে যাবার নয়। ভিন্ন ফর্মে ভিন্ন ভিন্ন দেশকালপাত্রে কনফ্রন্টেশন্ তো চির-জাগরুক। তবে দুইটা গানই ইক্যুয়্যালি মেলা ইভেন্টটাকে সেলেব্রেইট করেছে অনবদ্য অনুপম উপায়ে। এই সেলেব্রেশনের জুড়ি মেলা ভার, অন্তত বাংলা গানের আবহমান পটভূমে এর তো জুড়ি নিমস্বরেও নাই।


ডিসক্লেইমার দেয়াটা আবারও দরকার যে, এমন ভাবার কোনো কারণ নাই মেলাপ্রাসঙ্গিক গান বাংলায় সাকুল্যে এই দুইটাই। বরঞ্চ উল্টো, অসংখ্য গান বাঁধা হয়েছে মেলা নিয়ে দেশগ্রামজুড়ে শত শত বছর ধরে। সেই বিশাল বাংলার গানভাণ্ডারের কতটুকুই-বা কানে এসেছে আমাদের? যেটুকু লোকায়তিক পল্লির পাতায় হাওয়ায় ভেসে-ফেরা গান আমরা শুনেছি, নিতান্তই অল্প তা বাহুল্যই বলা, সংরক্ষণের অভাবে সেটুকুও প্রমাণ আকারে পেশ করা যায় না প্রয়োজনের সময়। নাম-না-জানা বাউল, বোষ্টম আর ফকিরদের হাজার হাজার গানে মেলা উদযাপিত হয়েছে এক্সটেইসি সমেত। নববর্ষের মেলা নিয়ে, শিবের মেলা নিয়ে, বারুণীর মেলা নিয়ে, নবান্ন নিয়ে, হালখাতা নিয়ে, চৈত্রসংক্রান্তির মেলা নিয়ে, পির-আউলিয়াদের উরস নিয়ে, চড়ক নিয়ে, গাজন নিয়ে ব্যাপক সংখ্যায় গান বাঁধা হয়েছে বাংলায়। সেসব গান বেঁধেছেন গ্রামবাংলার অনক্ষর/অল্পসাক্ষর সহজিয়া দার্শনিক মহাজন পদকারেরা। বাংলাদেশের হাওরজনপদের মধ্যে এক এই সিলেট অঞ্চলেই ঋদ্ধ পল্লিগীতিসুরের যে ব্যাপক একটা ভাণ্ডার রয়েছে, সেখানে প্রায় প্রত্যেক পদকর্তাই নিজেদের অঞ্চলের মেলা নিয়ে একাধিক গান বেঁধেছেন। ধলমেলা শাহ আবদুল করিমের গানে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রেখেছে। এছাড়া ভাটির বিভিন্ন লোকসমাগম নিয়ে এই অঞ্চলের পদকারেরা গান রচনা করেছেন। পণাতীর্থস্নানের মেলা নিয়ে গান রয়েছে বিস্তর, রয়েছে শাহজালাল-শাহপরান আর তিনশ ষাইট আউলিয়ার প্রত্যেকের উরসে গেয় অজস্র গান। ওদিকে চট্টগ্রামে মাইজভাণ্ডারির উরস উপলক্ষে যেসব মেলা হয় সেসবের প্রত্যেকটায় প্রত্যেক পিরের দরবারশরিফেই পিরহুজুরের স্বরচিত বা তাকে নিবেদিত গানের একটা ভাগে মেলার বা মিলনোৎসবের জয়গাথাবাহী লিরিকের দেখা পাওয়া যায়। এসব মনে রেখেও বর্তমান নিবন্ধে কেবল দুইটা ব্যান্ড/রকগ্রুপের একজোড়া গান নজির হিশেবে নেয়া হয়েছে। কেন অত বিপুল ভাণ্ডার রেখে এই দুইটা মেলাগান/উৎসবসংগীতই শুধু কথাচক্রে মুখ্য করা হলো, আশা করি তা আর ব্যাখ্যার দরকার নাই।

১৪
ফিডব্যাকের মেলা চাইছে একটা ঐতিহ্য গড়ে তুলতে, একটা আবহমানতার সন্ধিক্ষণে নবায়ন করে নিতে নিজের জ্বালানিসামর্থ্য ও সংযোগধর্ম, চাইছে একটা জাতির প্রাণস্পন্দ ধরে ঝাঁকানি দিতে ফিরে ফিরে। সেদিক থেকে মহীনের ঘোড়াগুলির মেলা স্মৃতিজাগানিয়া হলেও মৌহূর্তিক এনার্জাইজ্ করার বাইরে যেন তার বিশেষ কিছু করবার নাই। কিন্তু গানটা এমনিতে ভালো। সুখশ্রাব্য। সুন্দর। দুই গানের লিরিক্সও সো-ফার বাহুল্যপ্রমাদমুক্ত। ওই অর্থে লিরিক্যাল বৈভব বা কাব্যধর্ম গরহাজির যদিও, কথাপ্রধান গানে এইটা বাড়তি মাত্রা যোগ করে ঠিকই, তবে এর অভাব অনুভূত হয় না গানের সুর ও সংগীতযোজনাগত নৈপুণ্যের জন্য। দুই গানের বাণীভাগে একাধিক আপোস লক্ষ করা যাবে। এমনটা আপোস গোটা আধুনিক বাংলা গানে এন্তার দেখা যায়, এবং কখনো কখনো অত বিরক্তির কারণও হয় না বৈকি। ফিডব্যাকের গানে যেমন ‘ললনা’ ও ‘রমণী’ এই দুই শব্দের সংস্থাপন আধুনিক সচেতনতার জায়গা থেকে আপত্তিকর। এছাড়া বাকি সবকিছু পার্ফেক্ট বলা যায়। তেমনি মহীনের ঘোড়াগুলির লিরিক্সটেক্সটে ‘মোরা’-‘তোরা’ সর্বনাম পদের প্রয়োগ। অন্যদিকে এইটাও সত্যি, ফিডব্যাকের গানে একটা লাইনেই সময়চেতনা দারুণভাবে টের পাওয়া যায় : ‘বিদেশী সুগন্ধী মেখে আজ প্রেমের কথা বলা’ … মাকসুদের গানে দেশপ্রেমচৈতন্যে ও ঐতিহ্যপ্রণয়ে অন্ধ হয়ে ‘আতর-গোলাব-চুঁয়াচন্দন’ গতরে ছিটাইয়া ছিটাইয়া মাখবার কথা বলা হলেই এই নিবন্ধ আজ আর ফাঁদতে হতো না। আল্লা বাঁচিয়েছেন অল্পের উপর দিয়া। আলাপ গুটায়ে নেবার আগে ফের একবার বলে নেয়া যাক যে ঘোড়াগুলির গানে শেষমেশ নস্ট্যালজিয়্যা বা স্মৃতিভারাতুরতাই লভ্য, ফিডব্যাকের গানে এর লেশমাত্র নাই। ফিডব্যাকের গান টানটান সমকাললগ্ন, চিরসমকালীন, দ্রোহদ্যোতিত। বখাটেদের লেবাস পাল্টাবে বা তাদের মুখের বোল পাল্টাবে ঠিকই, কিন্তু ওদের দৌরাত্ম্য ওদের রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ষণ্ডামি ঠিকই থেকে যাবে এবং সেই কারণেই রইবে মানুষের প্রতিরোধটাও। রইবে প্রতিরোধ-উদ্যোগী মানুষের পাশাপাশি ফিডব্যাকের মেলা গানটার মাতনদোলা। আহ্বান জানাবে মেলায় যোগ দিতে, আবাহনী গীত গাইবে নয়া জমানার মেলায় মানুষলগ্ন হইবার, দেবে রক্তে ও রগে রুখে দাঁড়াবার মন্ত্রণা। আজকে এই নিস্তরঙ্গ সংগীতধারা আর শাসনত্রাসনলুণ্ঠনের অবক্ষয়িত রাজনৈতিকতায় বাংলা গানের ফি-আমানিল্লা কামনা করি আমরা সক্কলে। এবং কামনা করি মেলার চিরপ্রাসঙ্গিকতা। দুই মেলারই। ফিডব্যাকের, মহীনের ঘোড়াগুলির। এবং অনাগত সকল মেলা বাণিজ্যনিরপেক্ষভাবে বেঁচে থাকুক, ভালো থাকুক, বিকশিত হোক, আমাদের সক্কলের আস্কারা পাক। বাংলাদেশের গানের, গণমানুষের, রুগ্ন রাজনীতি ও অধিপতিমনস্ক শ্রেণিপক্ষপাতদুষ্ট সংস্কৃতির স্থিতাবস্থা কাটুক।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you