আইসক্রিমকাকু || সরোজ মোস্তফা

আইসক্রিমকাকু || সরোজ মোস্তফা

জীবনের একেকটা সময়ে মনের প্রদেশে অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকে একেকটা মানুষ। তারপর অন্তর্গত অনুভব ছাড়া আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। সমস্ত সম্পর্ক কখন কীভাবে যে লুপ্ত হয়ে যায়!— সে এক রহস্য। মাছের সাঁতারের মতন আমাদের সম্পর্কও সাঁতরায়। মানুষ কখনো বৃত্তের ভেতরে থাকে না। তবে বৃত্তের বাইরে দৌড়ুতে থাকা মানুষেরও শৈশব থাকে; থাকে স্মৃতির সিন্দুক। অল্পবয়সে রচিত ভূগোলটা কখনোই উধাও হয়ে যায় না। পুরোটা জীবন আনুগত্যে ও ভক্তিযোগে এরাই থাকেন। সাধন-কথায়, ব্যর্থতা কিংবা সিদ্ধির কথায় পূর্ণ থাকে না এসব জীবনী। তবুও-তো সূর্যমুখী ফুলের মতো নামগোত্রহীন এই জীবন সম্পর্কিত মানুষেরা ফিরে ফিরে আসে। কথা বলে। শৈশবের দোলনায় বসিয়ে দেয়। বোকা স্বপ্নের চেয়ে এসব চরিত্রেরা সত্য।

একসময়ে আমাদের কাছে এরাই ছিলেন বিপুলানন্দ ও পরিচিত নাম। শৈশবের আইসক্রিমকাকুর নামটি অগোচরে লুপ্ত হয়ে ছিল। আজ হঠাৎ আশ্বিনের চাঁদে মন থেকে নেমে এলেন। তাও নেমে আসতেন না মোটেও; যদি-না পৃথিবী থেকে তার বিদায় নেয়ার খবরটি না পেতাম। গতকালই চলে গেলেন তিনি। কাশফুলের মতো নরম আর ছোট হতে হতে মানুষ পৃথিবী ছাড়ে। মোমের আলোর মতো হঠাৎই থামে মানুষের ফুসফুস।

আইসক্রিমকাকুর কথা বলছিলাম। শৈশবের দিনগুলোতে তিনি হিরোই ছিলেন। নামটা জানা ছিল না তার। আজ জানলাম উনার নাম প্রহ্লাদ। আমরা ডাকতাম আইসক্রিমকাকু কিংবা আইসক্রিমওয়ালা। হালকা রোদের ভেতরে ঘণ্টা বাজিয়ে এই আনন্দপ্রভুরা আসতেন। আমার মতো অনেকের তৃষ্ণা মেটাতেন। স্কুলের সামনে, পাড়ায়, মহল্লায়, অলিতে-গলিতে ঘুরে ঘুরে উনি আইসক্রিম বিক্রি করতেন।

পিতলের একটা আশ্চর্য ঘণ্টায় টের পেতাম উনাদের গমনাগমন। কাঠের একটা বড় বাক্সকে কাঁধে নিয়ে উনারা আসতেন। বাক্সের ভারে পুরো শরীরটা বেঁকে যেত। কেমন যেন কায়িক গতিতে হাঁটতেন। তারপর বাক্সটা নামিয়ে ঘণ্টা বাজাতে থাকতেন। কখনো কখনো  বাক্সের ঢাকনাটা শব্দ করে বন্ধ করতেন। আমরা সেই শব্দের মোহে কিংবা আইসক্রিমের সাদা ও শীতল আহ্বানে গোল হয়ে দাঁড়াতাম। সবদিন পয়সা থাকত না। চার-আনা কিংবা আট-আনা পয়সা সহজ ছিল না শৈশবে। যেদিন পয়সা থাকত না সেদিনও বাচ্চাদের জটলার ভেতরে দাঁড়াতাম, আইসক্রিমকাকুর চোখ কিংবা আইসক্রিমের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমাদেরকে সামনে রেখে বরফের আইসক্রিম প্লাস্টিকে পেঁচিয়ে বাক্সের মুখটা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে গুঁড়ো করে গোলাকার লাড্ডুজাতীয় আইসক্রিম বানাতেন। আশ্চর্য অমৃতের মতো দ্রুত মিলিয়ে যেত এই আইসক্রিমের শোভা।

কী আশ্চর্য সুরে যে উনারা ডাকতেন;  — এই আইসক্রিম … এই আইসক্রিম …! —   নারকেলের আইসক্রিম, মালাই আইসক্রিম,  বরফ আইসক্রিম! — ডাইমন্ড আইসক্রিম, বেবি আইসক্রিম, মধু আইসক্রিম! আসো আসো, বাবুরা আসো। চাইরআনা, আডানা, একটেহার আইসক্রিম খেয়ে যাও! — প্রহ্লাদের মতো অনেকেই এই স্বরে ডাকতেন। স্কুলগেটের পাশে বসে থাকতেন। টিফিনপিরিয়ডে বাক্স দ্রুতই খালি হয়ে যেত। প্রহ্লাদের মতো আইসক্রিমকাকুরা আবার ফ্যাক্টরিতে এসে আরেক বাক্স আইসক্রিম নিয়ে যেতেন।

মগড়ার তীরে উকিলপাড়ার ডায়মন্ড আইসক্রিমই ছিল সেরা। ছোট শহরে আমরা হাঁটতে হাঁটতে আইসক্রিমের ফ্যাক্টরিতে চলে যেতাম। বরফের বিরাট বাক্সের ভেতরে মুখ ডুবিয়ে ঠাণ্ডা হতাম। আমাদের শৈশবে বাড়িতে বাড়িতে ফ্রিজ ছিল না। রমজানের সময় ইফতারের আগে আগে আইসক্রিমফ্যাক্টরি থেকেই মানুষেরা বরফ কিনে নিয়ে ঠাণ্ডা শরবত বানাত। একটা হুলুস্থুল লেগে যেত ফ্যাক্টরিতে — কার আগে কে বরফ সংগ্রহ করবে।

আমাদের শৈশবেই দেখেছি কাঁধের পরিবর্তে রিক্সায় উঠে গেছে আইসক্রিমের মসৃণ বাক্স। এটাকে তখন বলত আইসক্রিমের ভ্যান। কিন্তু খুব দ্রæতই মরে গেল আইসক্রিমের ফ্যাক্টরিগুলো। ইগলুর মতো বড় বড় কোম্পানির লগোর ভেতরে মরে গেল আমাদের পাড়ার মধু কিংবা বেবি আইসক্রিম। ‘ডায়মন্ড ফ্যাক্টরি’ এখনো আছে। কিন্তু শৈশবের ঔজ্জ্বল্য নেই। কিছু বরফ তৈরির ফ্যাক্টরি হয়েছে। সবার চোখ এখন ব্র্যান্ডের আইসক্রিমে। তাই মরে যাচ্ছে গলির আইসক্রিম ফ্যাক্টরি। মরে যাচ্ছে পেশা।

প্রহ্লাদদার মতো আইসক্রিমকাকুরা চলে গেছেন কিংবা যাচ্ছেন। এখন আর কেউ ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে পাড়ায় মহল্লায় আইসক্রিম বিক্রি করতে আসবে না। ক্রেতাকেই যেতে হবে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে।


প্রয়াত প্রহ্লাদদা/আইসক্রিমকাকুর প্রতিকৃতিশিল্পী আলী মুকাদ্দেস পাঠান (Ali Mukaddes Pathan) ।। এছাড়া নিবন্ধে ব্যবহৃত অন্য সমস্ত স্থিরচিত্র লেখকের ক্যামেরায় ধৃত। 

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you