[বইপত্রের প্রকাশনা নিয়া আমাদের যে-কায়কারবার, গাদাগুচ্ছের বই বেরোচ্ছে বেদম বছরান্তে, ফেব্রুয়ারি এলে তো মোচ্ছব লেগে যায় একেবারে, এইটা ডিক্লেয়ার্ড ইন্ডাস্ট্রি হোক বা না-হোক এর ভাওতাবাজি এর পুঁজিপাট্টা-লগ্নিবিনিয়োগ-রিটার্ন ইত্যাদি নিয়া আমরা আন্দাজি হলেও যথেষ্ট খোঁজখবর রাখতে পারি। কিন্তু গানবাজনার ব্যবসাপাতিটা আদৌ কতটা হয়, কেমনে হয়, এর প্রকাশ-প্রচার-প্রসার কে এবং কোত্থেকে করে, এইটা দাঁড়িয়ে আছে না ধসে যেতেছে এইসব নিয়া জানাজানি বিশেষ হয়ে ওঠে না। গানের বাজার, গানের শিল্পকারখানা, গানের বিপণন কীভাবে হয় জানতে চাইলে বেশিকিছু সম্ভব হয় না জানা। বাংলাদেশের কথা বলছি, নিশ্চয় বিদেশে এইসব নিয়া জানাজানি হয়। এইটুকু বুঝতে পারি যে এই শিল্পের কারবারিরা, গায়ক-বাদক-গীতিকার-সুরকার-অ্যারেঞ্জার-ম্যানুফেকচারার সবাই, ব্যাপক একটা সাফারিঙসের ভিতর দিয়া রাস্তা পার হন কোনোমতে। এইসব নিয়া আমাদের দেশের গানকেন্দ্রী শিল্পীকলাকুশলীরা আশ্চর্য চুপ থাকেন কেন জানি না। গানপার থেকে আমরা চাইছি মিউজিকের ইন্ডাস্ট্রিটা বাংলাদেশে কেমন তরিকায় চলে, এর ফলাবর্তনগুলো কোথায় গুম হয়ে রয় এবং কেন, এর আপ-ডাউন গ্র্যাফটা, এর উন্নয়নপয়েন্টটা এবং সর্বোপরি এর অনুন্নয়নের গতিধারাটা বা গানশিল্পের ব্যবসায়-বিপণনচালিকাশক্তি ডিন্যামিক্সগুলো ডক্যুমেন্টেড রাখতে। এবং সেক্ষেত্রে শিল্পীদের সঙ্গে, ব্যান্ড-ননব্যান্ড সব ধারার শিল্পীকলাকুশলীর সঙ্গে, একটা ডায়লগের রাস্তাঘাট বাঁধানো দরকার। সাধ আছে ষোলোআনা, গানপারের, সাধ্যিতে এখনও কুলাচ্ছে না। খানিকটা শুরু করা গিয়েছে তবু, কয়েকজনের সাক্ষাৎকার ধারণ করা হয়েছে যেগুলো কম্পোজিটরের টেবিলে এখনও, অচিরে এর কিছু প্রকাশ হলে বেশ-একটু সংযোগ ত্বরান্বিত হবে ভরসা রাখি।
কিন্তু বর্তমানে এইখানে আমরা একটা আড্ডা পুনর্প্রকাশ করছি, যে-আড্ডাটা আজ থেকে একদশক আগে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার পাক্ষিক ক্রোড়পত্রে ছাপা হয়েছিল। ছয়জন সংগীতশিল্পী একত্র হয়ে এইখানে বাংলাদেশের নয়া গান ও গোটা গানব্যবসায় নিয়া আলাপ করেছেন। আমরা গানপার থেকে যে-অন্তর্বেদনা মাথায় রেখে মিউজিশিয়্যানদের সঙ্গে একটা আলাপসংযোগের ভাষা হাতড়ে চলেছি, এই আড্ডায় সেই ইশারাগুলো অনেকটাই ইনক্লুডেড মনে হয়েছে। এইটা ছাপা হয়েছিল ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ পত্রিকার ‘বিনোদন ২০০০’ শীর্ষক পাক্ষিক ক্রোড়পত্রে। এক্সট্রা একটা বিনোদনম্যাগ সাপ্তাহিকটার সঙ্গে এঁটে বেশ কিছুদিন মূল পত্রিকার সাবস্ক্রিপশন ইনক্রিজ্ করার একটা ট্রাই ছিল বোধহয়। এই সংখ্যার প্রকাশকাল ৮ জুন ২০০৭। যে-আড্ডাটা আমরা গানপারে প্রিজার্ভ করছি, এইটা অর্গ্যানাইজ এবং ফ্যাসিলিটেইট করেছেন বিজলী হক। লক্ষণীয়, শোবিজের মানুষদের নিয়া বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় একটা আখাম্বা টাইপের শ্যালো রম্যকথিকা ছাপা হয় খালি। বিশেষত গানের মানুষদেরেও যখন দেখি নিছক গ্ল্যামার নিয়া আলাপচক্রে পুঁছতাছ করতে, বেহুদা লাগে। এই আড্ডাটা সেসব বিবেচনায় চিন্তা-অন্বেষী, ইঙ্গিতগভীর, তাৎপর্যবহ। পয়লা কিস্তিটা ছাপা হচ্ছে এখানে, একটানা টাইপ করার মুদ্রাক্ষরিক নাই গানপারে, নেক্সট কিস্তিতে ব্যান্ড ও সোলো সংগীতশিল্পীদের আরেকটু সবিশদ কথাবার্তা থাকবে এবং সেইসঙ্গে এই ইন্ডাস্ট্রি নিয়া তাৎপর্যবাহী কিছু কথাবার্তা-ব্যাখ্যান আমরা পাবো। কম্পোজিটরের হাত থেকে এলে নেক্সট ইনস্টলমেন্ট আপ্লোড করা যাবে আপকামিং উইকেই।
বিজলী হক এই আড্ডার সঞ্চালনা ও গ্রন্থনার শ্রমসাধ্য কাজটা করেছেন, আমরা তার হোয়ারঅ্যাবাউটস্ জানি না বলে এইখানে লেখকপ্রোফাইল দিতে পারছি না; পারি নাই রিপ্রিন্টকালে তার ইজাজত নিতেও। তবে এই কথাচক্রটা কাগুজে মাধ্যম থেকে তুলে এনে এইখানে নেটদুনিয়ায় রাখার কারণে কেউ ক্ষুণ্ণ হবেন বলে মনে হয় না। আড্ডাসঞ্চালকের কাছে এই সুযোগে থ্যাঙ্কসটা জানায়া রাখি।
মিনোয়াইল, দশক গড়িয়ে গেছে এবং ইভোল্ভিং ওভার টাইম ন্যাচার্যালিই কিছু পরিবর্তন এসেছে এই শিল্পীদিগের ক্যারিয়ারে। ‘মেঘদল’ তাদের দোসরা অ্যালবাম রিলিজ করেছে, এরও পরে ঢের সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় গেছে, তেসরা অ্যালবাম আসি-আসি করছে; একটা নয়া গান সম্প্রতি রিলিজ হয়েছে মেঘদলের সিগ্নেচারমার্ক বজায় রেখে এবং এর মিউজিকভিডিয়োর ভিশ্যুয়্যাল কন্টেন্টটা আলোচিত হয়েছে অ্যাফার্ম্যাটিভলিই। ‘শিরোনামহীন’ তাদের নিজস্ব সংগীতছাপ রেখে আরও দুইটা অ্যালবাম প্রোডিউস করেছে, এর মধ্যে একটা তাদের অরিজিন্যাল এবং আরেকটা কাভার ভার্শন্স ফ্রম টেগোর; ভ্যেরি রিসেন্টলি শিরোনামহীন ভাঙনের মুখে যেয়েও মোটামুটি ফিরে এসেছে, এদ্দিনের লিড-ভোক্যাল তুহিন সরিয়া যাওয়ায় লাইনআপে চেইঞ্জ ঘটেছে, ব্যান্ড থেকে একটা গান অলরেডি রিলিজ হয়ে ফ্যানগোষ্ঠীর আদর কুড়িয়েছে; মেঘদলের ন্যায় শিরোনামহীনের সিঙ্গেল মিউজিকভিডিয়োটা সাড়া জাগিয়েছে ফ্যানসমাজে। এছাড়া কৃষ্ণকলি নিজের ক্যারিয়ারে প্লেব্যাক ছাড়াও মৌলিক আরেকটা এবং পাহাড়িয়া গানের একটা অ্যান্থোলোজি করে শ্রোতা বাড়িয়েছেন; সম্প্রতি একটা আনএক্সপেক্টেড ঘটনায় কৃষ্ণকলি কিছুটা গানমঞ্চহীন দিনগোজরান করছেন সম্ভবত। সজীবের উল্লেখযোগ্য কোনো নড়াচড়া আর টের পাওয়া যায় নাই।
কিছু কথা আরও বলতে পারব পরের কিস্তিটা আপ্লোডকালে। হ্যাপি রিডিং সেই-পর্যন্ত। — গানপার]
গানের মানুষ জিয়া কৃষ্ণকলি সজীব তুহিন শিবু সুমন
একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়। আমরা অনেকেই বলি। গান আর এখন শোনার বিষয় নয়, দেখার বিষয় হয়ে গেছে। এক ধরনের হতাশা থেকেই কথাগুলো আসে। হয়তো কিছুটা সত্যতা আছে। কিন্তু এর ভিন্ন চিত্রও আছে। শোনার মতো গান গাইছে এই সময়ের কিছু ছেলেমেয়ে। প্রচার মাধ্যম এদেরও অতটা সামনে আনে না বা আনতে পারেও না নানা কারণে। এ-রকম কিছু মেধাবী মিষ্টি কণ্ঠের গানওয়ালাকে নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন … লিখেছেন বিজলী হক
দিনটি ছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২৫ মে, শুক্রবার। আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী। পরিকল্পনাটি ছিল এই দিনটিতে একটু অন্যরকম কিছু করার। তাই এই সময়ে যারা একটু ভিন্নরকম গানচর্চা করছেন তাদের নিয়ে বসলাম এক জমজমাট আড্ডায়। শহর থেকে কিছুটা দূরে, বিরুলিয়া গ্রামে বটের ছায়ায়। আকাশ ও প্রকৃতির বেশ কাছাকাছি এই জায়গাটিতে এসে একটা স্বস্তির ভাব ছিল সবার মনেই।
আমাদের সঙ্গে ছিলেন কৃষ্ণকলি, সজীব, ‘শিরোনামহীন’ ব্যান্ডের তুহিন ও জিয়া এবং ‘মেঘদল’ ব্যান্ডের সুমন ও শিবু। সাপ্তাহিক ২০০০-এর পক্ষ থেকে আমি, কনক, মিশায়েল এবং ফোটোগ্র্যাফার শ্রাবণ। বেলা সাড়ে-১১টার দিকে আমরা সাপ্তাহিক ২০০০-এর অফিস থেকে বিরুলিয়ার উদ্দেশে রওনা হলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।
যাদের নিয়ে আড্ডাটা জমিয়েছিলাম তাদের সবার একটা কমন বিষয় ছিল। বিষয়টা হলো এরা প্রত্যেকেই নিজেরা গান লেখে, সুরও করে নিজেরা এবং গান তো করছেই। এদের প্রত্যেকের মধ্যে মৌলিক গানের চর্চাটা প্রাধান্য পাচ্ছে। আমরা আমাদের আলোচনার প্রথম প্রসঙ্গটি শুরু করেছিলাম এই বিষয়টি দিয়ে।
প্রসঙ্গ মৌলিক গান
কৃষ্ণকলি : গানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা বিশেষ সময় পার হয়ে গেছে। গত বিশ/ত্রিশ দশক ধরে {বিশ-ত্রিশ বছর ধরে, ম্যে বি প্রিন্টমিস্টেইক, বা দুই-তিন দশক ধরে, তাই না? — গানপার} একই বিষয় নিয়ে গান হচ্ছে তা হলো ‘আমি … তুমি … ভালোবাসা’ — এই ভালোবাসাটা আসলে কী? সময়ে ভালোবাসার এলিমেন্টগুলো পাল্টে গেছে। এখন গাছের প্রতি ভালোবাসা, মাঠের মধ্যে বাঁধা ছাগলের প্রতি ভালোবাসা, যেন ‘মোর সকল ভালোবাসা’ এ-রকম একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে। ইমদাদুল হক মিলন একটা বিশেষ চাপ দিয়েছে। সেই হ্যাঙোভারটা কাটানোর সময় এসে গেছে। আমরা একটা ভালো সময়ের মধ্যে আছি, একটা মোড়ের মধ্যে আছি। আমরা শত্রুমিত্র মিলে একটাকিছু করছি, চেষ্টা করছি ভালো কিছু করার। শুধু গানের ক্ষেত্রে নয়, সবগুলো ক্ষেত্রেই আসলে একই রকম বিল্ডিং — একটা রাস্তায় তা না-থাকলে তো মনোটোনাস লাগবে। বাংলাদেশের এই ৩৫ বছর বয়সে এর আগে একবার এ-রকম উত্তেজনা এসেছিল — রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আহমদ ছফা ওনারা তৈরি করেছিলেন। এখন আবার তা পূর্ণ উত্তেজনার সঙ্গে আমরা অনেকে মিলে শুরু করেছি। এরা ভালো গান, ভালো কবিতা, ভালো ফোটোগ্র্যাফি করার চেষ্টা করছে। আমাদের আসলে এই ‘টায়ার্ডনেস’ থেকে বেরোতে হবে। মৌলিক কিছুর জন্ম দিতে হবে, ভালো কিছু তৈরি করতে হবে।
তুহিন : আমি বলব, বর্তমান সময়ে ‘আমি-তুমি’ সুন্দর করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ‘ভালোবাসা’ — ব্যাপারটার বিশেষ প্রয়োজন আছে আমাদের জীবনে। স্যাটেলাইট কালচারের একটা বিশেষ প্রভাব পড়েছে এ-সময়টায়। আমরা যে-মানবতার কথা বলছি, যে-বাস্তবতার কথা বলছি, কিছু মানুষ মোল্ড করতে পেরেছে বলেই আজকে তা এক্সপেরিমেন্ট করতে পারছি। এখনকার সময়টাও কিন্তু একটা অনস্বীকার্য ধারা। কলিম শরাফী বলেন বা যারা নজরুল-গণসংগীত করতেন তাদের কথাই বলেন সবটাই কিন্তু আমাদের এখনও ভাবায়। তবে ইন্সট্রুমেন্টাল ডিফ্রেন্সটা ছিল। আমাদের গানগুলোর ক্যারেক্টার হলো ভালো কিছু গান। প্রেম-ভালোবাসার গান প্রচুর হয়েছে। আরো দরকার আছে। আজীবন লাইলী-মজনুর দরকার আছে। তবে তাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে যে-বাস্তবের মুখোমুখি হচ্ছি, যে-যুদ্ধ করছি সেখানে যদি কম্ফোর্টেবল জোনটা দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে কিন্তু আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ব। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে গানটা একটা স্বপ্ন। ভিন্ন ভিন্ন আইডিয়োলোজি নিয়ে আমরা চলছি। যে-ছেলে ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বাবা দুধের গ্লাসের নিচে দুটো পাঁচশ টাকার নোট রেখে গেছে — তার জীবন, তার মিউজিক, তার অ্যাঙ্গার এক-রকম; — আমরা যারা বাংলাকে ভালোবেসে — শহরকে ভালোবেসে — ফাইট দিয়ে গান করছি তাদেরটা বেশি জোরালো। আমাদের গানের তীব্রতা আরেক রকম। প্রকৃতিপ্রদত্ত যে-যেমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেই বিষয়টার প্রভাবই তার গানে বেশি পড়ছে।
জিয়া : আমাদের কনভার্সেশন খুব সুন্দর এগোচ্ছে। তবে আমি একটু ডিফার করে বলছি। ‘আমি-তুমি’ নিয়ে গান আগেও হয়েছে, হচ্ছে, আরো হবে। থাকতেই হবে। তবে এখানে বসে একটু আগে যে-গানটি গাচ্ছিলাম সেটি কিন্তু এ-দেশের প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর গান। ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া’ গানটি। তখনও কিন্তু এ-ধরনের গান হতো। আমার যেটা মনে হয় আমরা অনেক বেশি ফিউসড, আমাদের ওয়ে অফ থিঙ্কিং পাল্টে গেছে, উই আর গেটিং স্মার্টার। আমাদের লাইফস্টাইলে চেইঞ্জ হয়েছে প্রযুক্তির প্রভাবে এবং কম্পিউটারাইজড জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া, এই টেক্নোলোজিক্যাল চেইঞ্জটার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া, এই টেক্নোলোজিক্যাল চেইঞ্জটার সঙ্গে আমার গানলেখাটাও জড়িত। আমার অভিজ্ঞতার বাইরে তো আমি যেতে পারব না। আমরা সবকিছু খুব সরাসরি রিলেট করি। যেমন আমরা এখানে বসে চা খাচ্ছিলাম; সে-সময় বসে অনেক গল্প করছিলাম, খেয়ে চলে গেলাম, গল্পগুলো বাতাসে রয়ে গেল — লেখার সময় সেভাবেই লিখব। বিষয়টা আগে এভাবে ছিল না। লাইফস্টাইলকে এভাবে তুলে ধরা হতো না, যেটা এখন হচ্ছে — সিচ্যুয়েশনটা ঠিক তার মতো তুলে ধরা হচ্ছে।
শিবু : ’৭১-এর পর থেকে এখানে লিরিকের যে-চর্চা হয়েছে তার মধ্যে কাব্যময়তার অভাব ছিল। বিশেষ করে আমাদের ব্যান্ডসংগীতের ক্ষেত্রে দেখেছি। এর বিশেষ কারণ ছিল; — আমাদের যারা কবি-সাহিত্যিক ছিলেন তাদের সঙ্গে গানলেখকদের কোনো যোগসূত্রতা ছিল না। ফলে একটা অ্যামেচার ধারার সূত্রপাত হয়েছে, যেখানে কে কি ভাবছে তা ভেবে দেখার দরকার নেই। আগে সাহিত্যচর্চা ভালো ছিল, কিন্তু যারা গান করছে কিংবা লিখছে তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব ছিল। কবি-সাহিত্যিকদের একটা সোসাইটি; আবার যারা গান করছে, ব্যান্ড করছে, তারা যেন একা, প্রায় অ্যালিয়েন! আর এদের মধ্যে যে-রেষারেষিটা তা যেন স্থূলভাবে হলেও টের পাওয়া যেত। যেমন আমরা দেখেছি, আইয়ুব বাচ্চুর গানে সেই কাব্যময়তা ছিল না। আবার এদিকে মাইলসের লিরিকে দেখেছি ‘জ্বালা জ্বালা জ্বালা অন্তরে’ — এর অনেক অনেক আগেই কিন্তু শহীদ কাদরী লিখেছেন “বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা / মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ / কালো রাত্রি বিস্মিত হবে শাদা …” এ-রকম কথা কিন্তু আমাদের এখানে অনেক আগে রচিত হয়েছে। তখন যদি সেই সমন্বয়টুকু ঘটত তাহলে কিন্তু আজ এতদিন পরে মাইলস এই লাইনটি লিখত না। সেই সেতুবন্ধনটুকু তখন ঘটেনি বলেই আমাদের এই ধারাটি জন্ম নিয়েছে। ফলে লিরিকেও এই চেইঞ্জগুলো এসেছে।
জিয়া : যারা গান গাচ্ছে আর যারা লিখছে তাদের মধ্যে একটা গ্যাপ আছে। যে যে ফিলিংস থেকে গান লিখছে বা ইন্টার্প্রেট করতে চাচ্ছে বিষয়টা সেভাবে মিউজিক্যালি ইন্টার্প্রেটেড হচ্ছে না। …
(একটু প্রসঙ্গান্তর হয়েছে তবু আলোচনা এগোচ্ছে) …
প্রসঙ্গ সংগীতশিল্পীর লিভিং ও লড়াই
কৃষ্ণকলি : এখানে একটা টেক্নিক্যাল জায়গায় কথা বলা দরকার। যে লিখছে সে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার ও বাস্তবতার আলোকে লিখছে, তারপর থাকছে কম্পোজিশন এবং তারপর কে গাইবে কার গলার সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা ম্যাচ করবে সেটাও ভাবার বিষয়। এটা একটা জ্বালাতন। এখানে প্রোমোটারদের একটা সমস্যা আছে — কে কাকে প্রোমোট করবে, কেন করবে, কীভাবে করবে; মিডিয়া আরেকটা সমস্যা — তারা এলিট ফ্যামিলি, হাইসোসাইটির ছেলেমেয়েদের সহজে সুযোগ করে দেয়। এটা যে অপব্যবহার করছে, ব্যাপারটা তা না; আসলে ওদের সঙ্গে একটা সহজ যোগাযোগ থাকে … কারোর বাবা সংবাদপত্রের মালিক, কারোর মা সেখানকার লেখক, আবার কারোর চাচা বড় কোম্প্যানির এমডি; সবকিছু মিলিয়ে দেখা যায় যে আমার চাচা, আমার ফুফু, আমার খালা দিয়েই হয়ে যাচ্ছে। এই ওয়েতে আমাদের দেশে সবকিছু দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ‘ক্লোজআপ-ওয়ান’ জিনিশটায় কি হচ্ছে? এখানে ট্যালেন্ট খুঁজে আনা হচ্ছে। আজ থেকে বিশ বছর আগের গান একই সুরে একই কথায় একই এক্সপ্রেশনে এ-গানগুলো গাওয়ানো হচ্ছে; — কিন্তু এটা যদি হতো এমন যে একইসঙ্গে নতুন মিউজিক ডিরেক্টর, নতুন ‘লিরিকার’ খুঁজে এনে তারপর তাদেরকে দিয়ে ওই সময়োপযোগী ও ওই আবহাওয়া-উপযোগী গান গাওয়ানো যেত তবে ব্যাপারটা আরো ইন্ট্রেস্টিং হতো। আমি আজকে ১৪ বছরের মেয়ে কিন্তু গান গাচ্ছি ৬৫ বছরের বুড়োর গান, আমি কীভাবে তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গানটি গাইতে পারব? সমস্যাটাই ওখানে। আমাদের জেনারেশন্যাল গ্যাপ, কন্সেপ্চুয়্যাল গ্যাপ — এই বিষয়গুলো নিয়েই তো নানা প্রশ্ন।
তুহিন : ক্লোজআপ-ওয়ানটা কিন্তু আমাদের জন্যে একটা অ্যাচিভমেন্ট। তবে সেই ছেলে অথবা মেয়েটিকে যদি হুট করে গাড়িটা না-দিয়ে সেই টাকাটা দিয়ে বলা হতো তুমি সঞ্চয়পত্র কিনে রাখো, অর্থাৎ একটা সিস্টেম করে দেয়া হতো এবং তাকে পাঁচজন গুণী দিয়ে ভালো করে গানের চর্চা করানো হতো তাহলে অন্য বিষয় দাঁড়াত। কিন্তু তাকে দিয়ে একটা হুলস্থূল করিয়ে নিয়ে এবং যে তাকে এতগুলো টাকা দিলো তারও নামধাম হলো জোরেশোরে, সবকিছুর পরে সেই ছেলে অথবা সেই মেয়েটা হারিয়ে গেল। আবার টেনে আনা হচ্ছে আরেকজনকে। এতে করে তার প্রতিভার সঠিক প্রকাশটা আর হচ্ছে না।
শিবু : আমার গান আমি গাইব। আমার নিজস্ব শক্তি থেকে গাইব। আমি যদি নন্দনতাত্ত্বিক বিচারের জায়গাটা থেকে বলি তাহলে বলব, তখনকার সালেকা-মালেকা (আযম খানের) গানটি কিছুই হয়নি। তবে এর চাইতেও ভালো লিরিক তখন ছিল কিন্তু প্রচার পায়নি। তবে এই প্রক্রিয়াটাকে রেস্পেক্ট করা উচিত। এই-যে চেষ্টাটা, সেই বিষয়টা অনেক বড় রেস্পেক্টের জায়গায় ছিল। আমাদের এখানে এই প্র্যাক্টিসটারই অনেক অভাব। এখানে ক্লোজআপ-ওয়ানটাই হচ্ছে আমাদের হাইট।
সুমন : আশির দশকে সিম্পল লিরিকে আমি-তুমি নিয়েই গানগুলো হয়েছে। যে-গানগুলোর ওই সময়ে প্রয়োজন ছিল। যেমন, ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ (সোলস ব্যান্ডের) ইত্যাদি লিরিকের গান। এখন বিষয়গুলো খুব বেশি স্পেসিফিক হয়ে গেছে। প্রেম-রোম্যান্স তখনও ছিল এখনও আছে। কিন্তু বিষয়গুলো পাল্টে গেছে। এখন একটা চায়ের কাপে, ছোট চৌকো জানালায় কিংবা বিভিন্ন জায়গায় এর ছাপ পাওয়া যায়। আসলে এই এলিমেন্টগুলো কোথাও ক্ষুদ্র, আবার কোথাও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় গল্প বলা হয় না কোথাও। ছোট্ট একটা খোঁচা দিয়েই অনেক বড় একটা পয়েন্ট বলে দেয়া যায়। সেগ্মেন্টগুলো ছোট, পরিসর ছোট হয়ে এসেছে। গানের পার্স্পেক্টিভ পাল্টে গেছে। ভিশ্যুয়ালাইজেশন পাল্টে গেছে। তখন অনেক বড় গল্প বলা হতো, এখন অনেক ছোট ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে অনেক বড় ইতিহাস পাওয়া যায়। আমার মনে হয়, এখন যারা গান করছে তারা বিষয়টাকে পেইন্টিঙের মতো করে ভাবছে। যেমন, অর্ণবের গানের কথাই বলি — যেখানে একটা ছোট্ট মুহূর্তকে পেইন্টিঙের মতো করেই তুলে ধরা হয়। আসলে ইম্প্রেশনিস্টরা যেটাকে পেইন্টিঙের ক্ষেত্রে চিন্তা করেছিলেন, আমরাও গানের ক্ষেত্রে তা-ই করছি।
জিয়া : এখানে ওয়ার্ল্ডমিউজিকের হিস্ট্রিতে গেলে দেখা যাবে, ইম্প্রেশনিজমটা তখন পুরোপুরিই কাজ করত। যেমন, যখন ক্লদ মনে পেইন্টিং চর্চা করতেন তখন গানগুলো সেভাবেই ইন্টিগ্রেইটেড হতো। আবার যখন স্যুরিয়্যালিজম এল, সালভাদর দালি যখন পেইন্টিং প্র্যাক্টিসে, তখন সাইক্যাডেলিক শুরু হয়ে গিয়েছিল মিউজিকে। কিন্তু আমাদের এখানে আমরা কখনো নাটক, ম্যুভি, গান, পেইন্টিং একসঙ্গে আনতে পারি না। সব জায়গায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন অথবা শিল্প-আন্দোলনে কবি, সাহিত্যিক, মিউজিশিয়্যান — সবকিছু মিলিয়ে ঘটনাটা ঘটে। কিন্তু আমাদের এখানে নাটক, চলচ্চিত্র, আর্ট ও সংগীত — চারটা চার লাইনে আছে। একত্রে কখনো ম্যুভ করা হয়নি।
সজীব : ইন্টার্মিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েই আমি দেশের বাইরে। গানের সঙ্গে বসবাস ছোটবেলা থেকেই। এক-সময় ভুপেন হাজারিকা, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে একেবারেই পাগল। আবার দেশের বাইরে কাটানো সময়টা সুমন-নচিকেতার গান শুনে আবারও দিওয়ানা। তার ওপর একেবারে একা একা। একা মানে সেই একা না; — দেশের কাছাকাছি নাই, বন্ধুবান্ধবছাড়া, — এই একা মানে একাকিত্ব। বাবাই ছিলেন গানের ক্রিটিক। আদতেই কিছু হচ্ছে নাকি হচ্ছে না তা উনিই ধরিয়ে দিতেন। আমরা আজকে জাগরণের কথা বলছি। কিন্তু এই জাগরণে সাড়া দেবে কারা? এই ক্ষোভ থেকেই নিজের গান নিজে লেখা শুরু করেছি। আমি একেবারে একা ফাইট করেছি। নিজের মতো করে গান করব বলেই। আজকে আমি গান করতে এসে আবার ‘সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা’ গাইব না, বাংলাদেশে কিন্তু বিষয়টা বুঝতে সময় লেগেছে। সেই রাগ, ক্ষোভ, অভিমানগুলোরই সংমিশ্রণ রয়েছে আমার গানে।
প্রসঙ্গ সোলো এবং ব্যান্ড
সজীব : বেড়ে-ওঠার সময়টা দেশের বাইরে। বাবা-মা-ভাই প্রত্যেকেই গানের জগতের মানুষ। বলতে গেলে ঘরেই একটা ব্যান্ডকালচার ছিল। ক্ল্যাসিক্যালের চর্চা, নজরুলগীতির সুরের মেলা … সবকিছুই চলত ঘরে। নিজের লেখা গানগুলো যখন বাবাকে শোনাতাম, বাবা বলতেন, “ঠিক আছে, করো।” এভাবেই আস্তে আস্তে এগোচ্ছিলাম। সবকিছুরই কালেকশন হচ্ছিল। দেখলাম যে ইজি হচ্ছে জায়গাটা। কারো কারো সঙ্গে মেন্টালি মিলছে না। সেই কারণে ব্যান্ড ফর্ম করতে গিয়েও করা হয়নি। তারপর ভাবলাম, — আমি লিখছি, সুর করছি, কিবোর্ড বাজাচ্ছি — ঠিক আছে, অ্যারেঞ্জ করে দেখি কেমন হয়। বিষয়টা আসলে অনেক ধরনের গান শোনার অভিজ্ঞতা থেকে হয়েছে। অ্যালবামও বের করলাম। সবাই ভালো বলায় খুশি। সেখানে আমার মনমতো দুয়েকজনের কাছ থেকে ইন্সট্রুমেন্টাল সাপোর্ট ও ওই দিকগুলো থেকে আমি কম্ফোর্ট জোনটা পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন যদি কেউ আমাকে বলে ব্যান্ডে এসে গান করতে, হয়তো আমি সেভাবে পারব না। কনফ্লিক্ট তৈরি হবে না, কারণ আমি জানি আমি খুব সহনশীল। কিন্তু একভাবে শুরু হয়েছে তো, হয়তো সেই স্বাচ্ছন্দ্যটা থাকবে না। দেশে থাকলে হয়তো আনুষঙ্গিক সবকিছু নিয়ে অন্য একটা ব্যাপার ঘটত।
শিবু : আমি একটা অন্য জায়গা থেকে বিষয়টাকে বলব। আমাদের গোষ্ঠীবদ্ধতার জায়গাটা ভাঙতে ভাঙতে একটা একক জায়গায় চলে এসেছে, যেখানে আমরা অনেক নিঃসঙ্গ এবং একা। এই-যে একাকিত্ব এবং ইগো, এটাই সোলোতে প্রকাশ পায় যা কিনা টিমওয়ার্কে প্রকাশ পায় না; — যার প্রতিফলন আমরা আমাদের পরিবারগুলোতে দেখতে পাই। ব্যান্ডে যখন আমরা পাঁচজন একসঙ্গ হই সেখানে অনেক কম্প্রোমাইজিঙের জায়গা থাকে; তবে একটা সোলো আর্টিস্টের ওই জায়গাটা নাই। তার নিজস্ব একটা জায়গা থাকে। সে অনেক বোল্ড ও পাওয়ার্ফুল। আমরা যারা ব্যান্ড করছি তাদের মোটামুটি সবারই এ-রকম একটা প্রবণতা আছে যে, আমার নিজস্ব ভাবনার জন্য একটা আলাদা কাজ করতে হবে। তবে আমাদের একটা জন্মগত চেতনা আছে যে, — গ্রুপ করে, সিকিউরিটির কথা ভেবে, কাজ করতে হবে। এটা একটা প্যাটার্ন্যাল জব। সত্যিকার অর্থে আমি যখন প্রবলভাবে ভাবি তখন আমারও মনে হয় আমি শুধু আমার কথা বলি। তবে এটাকে ভাঙন বলব না, বলব একটা পৃথক প্ল্যাটফর্ম।
(আগামী কিস্তিতে সমাপ্য)
প্রতিবেদনের সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিগুলো ধারণ করেছেন শ্রাবণ রেজা; প্রতিবেদনকারী : বিজলী হক
সমাপ্তি কিস্তি: গানের মানুষ ছয়জনা : আড্ডায় গানগল্প
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS