লোকায়ত জীবনাচরণ ও তার অন্তর্গত সংস্কৃতি || সুমনকুমার দাশ

লোকায়ত জীবনাচরণ ও তার অন্তর্গত সংস্কৃতি || সুমনকুমার দাশ

শিলং একটি চাকচিক্যপূর্ণ শহর। চারপাশে অজস্র আলোর ঝলকানি। সুরম্য সব দালানকোঠা। সারি সারি বিপণিবিতান। এতসবের মধ্যে একটি চমকপ্রদ বিষয় আমার চোখে পড়ে। প্রথমত অবিশ্বাস্য মনে হলে পুনর্বার তাকালাম। ঠিক দেখছি তো? একটি সুরম্য বিপণিবিতানের এক কোণার অংশে উপর্যুপরি চুন মাখানো। বোঝাই যায়, কেউ পান খেয়ে আঙুলের চুন প্রতিদিন দেয়ালে ঘষে-ঘষে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। তৎক্ষণাৎ বিষয়টির খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওই বিপণিবিতানের সামনের একটি টঙজাতীয় দোকানে এক বয়স্ক লোক বিভিন্ন পসরা নিয়ে বসেন। তিনিই দোকানটির মালিক। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময় মুখে পান পুরে আসেন। এবং এখানে এসে আঙুলের চুন মোছেন। ফলে আঙুলের চুন লেগে-লেগে দেয়াল ভরে উঠেছে। অভিজিৎ ঘোষ নামের ওই ব্যক্তির পূর্বপুরুষেরা সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বাবা দেশভাগের সময় শিলঙে বসতি স্থাপন করেন। বাবার কাছ থেকেই পান খাওয়া শিখেছেন। তাঁর বাবাও ওইভাবে পান দেয়ালে মুছতেন। বাবাকে দেখে-দেখেই এমন শিক্ষা। লোকায়ত সংস্কৃতি কীভাবে একজন থেকে অপরজনের কাছে ছড়িয়ে পড়ে — এটি এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আরেকটি ঘটনার কথা বেশ মনে পড়ে। সেটা বছর ছয়েক আগের ঘটনা। এক সন্ধ্যায় আমার এক বন্ধুর বাসায় বসে রয়েছি। তার বাসা সিলেট শহরের কাজিটোলা এলাকায়। হঠাৎ শুনি — খুবই ক্ষীণ স্বরে বন্ধুটির মা উলুধ্বনি দিচ্ছেন। একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম, পাশের ঘরে ঠাকুরের ছবির সামনে সান্ধ্য প্রদীপ জ্বালিয়ে খুবই চাপা গলায় উলুধ্বনি দিচ্ছেন। আমার মনে খটকা লাগল। গত কিছুদিন আগেও মাসিমাকে খুব উচ্চস্বরে উলুধ্বনি দিতে শুনলাম। এখন এত ভয়মিশ্রিত চাপা গলায় উলুধ্বনি দেয়ার কারণটা কী?

মাসিমার সান্ধ্য পূজা শেষে তাঁকে কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম। মাসিমা বললেন, ‘বাবা রে আগের বাসা পাল্টিয়ে গত মাস দুয়েক আগে নতুন এ বাসায় ভাড়াটিয়া এসেছি। বাসার মালিক মুসলিম। বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে মালিক শর্ত দিয়েছেন কোনও উলুধ্বনি দেওয়া যাবে না। কী আর করব? বাসা ভাড়া পাওয়া যে কত কষ্টের, সেটা তো বোঝো। তাই শর্ত মেনে উঠে গেলাম। কিন্তু এতদিনের সান্ধ্য পূজা ছাড়ি কীভাবে? তাই ক্ষীণ স্বরে উলুধ্বনি দিই, যাতে মালিক শুনতে না-পারে।’

মাসিমার কথাগুলো শুনে আমার খটকা দূর হলো। মনে মনে ভাবলাম, মানুষ তার লোকায়ত সংস্কৃতি শত বাধা-বিপত্তিতেও ত্যাগ করতে পারে না। এ অভ্যাস নির্মূল করা অসম্ভব। এই মাসিমার একদিকে যেমন রয়েছে মালিকের ভয়, অন্যদিকে বহুদিনের আচার। সেই ভয় মনে রেখেই আচার পালন করে আসছেন। এভাবেই মানুষ তাঁর লোকায়ত সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে।

নিজের অজান্তে অনেক সময় মানুষ তার পূর্বপুরুষের আচার-সংস্কৃতিকে মনে ঠাঁই দিয়ে ফেলেছেন। কোনও কোনও মুহূর্তে সেটা প্রত্যক্ষও করা যায়। এই যেমন আমার পরিচিত একজনের কথা মনে পড়ছে। যতটা জানি, তিনি সংস্কৃতিকর্মী, উদার, সংস্কারহীন ও প্রগতিশীল। ধর্ম-মাজার এসব বিষয় নিয়ে তার চরম অনীহা রয়েছে। একদিন তার সঙ্গে রিকশাযোগে বিশেষ প্রয়োজনে একজায়গায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম — আমার সঙ্গী মাঝে মাঝে কপালে ছুঁয়ে সালাম করছেন। শুরুতে বিষয়টি বুঝতে পারিনি।

আরেকবার এইরকম ভঙ্গিতে সালাম করার সময় খেয়াল করলাম — আমাদের রিকশাটি একটি মাজারের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। এবার আর সালামের আড়ালের বিষয়টি বুঝতে আমার একটুও বাকি রইল না। আমি তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি যেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যান। অনেকটা কাচুমাচু হয়ে জবাব দেন, ‘ছোটবেলায় আব্বা-আম্মাকে দেখতাম কোনও মাজার সামনে পেয়ে সালাম করতে, তখন থেকেই সেটি আমার মনে গেঁথে যায়। এখন মাজারের সামনে দিয়ে গেলে আপনাআপনিই হাত কপালে উঠে যায়।’

একই রকম বলা যায় সিলেটের বাউলগায়ক রণেশ ঠাকুরের গল্পও। প্রয়াত বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম তাঁর গুরু। রণেশ হাটে-মাঠে-ঘাটে করিমের গান গেয়ে বেড়ান। করিমের লেখা গান পরিবেশনের সময় যখন নামপদ বাক্যটি উচ্চারণ করা লাগে, তখন রণেশ বাড়তি ‘ওস্তাদ’ শব্দটি নামপদের আগে জুড়ে দেন। যেমন — ‘বাউল আবদুল করিম বলে বুঝিয়া নায়ের ভাও’। সেখানে রণেশ গেয়ে ওঠেন এভাবে — ‘ওস্তাদ আবদুল করিম বলে বুঝিয়া নায়ের ভাও’। এমনি করে প্রত্যেকটি গানের নামপদের আগে রণেশ ‘ওস্তাদ’ শব্দটি অযাচিতভাবেই জুড়ে দেন।

রণেশের গান গাওয়ার এ ধরনটা লক্ষ করে একদিন তাঁকে বললাম, ‘রণেশদা, শাহ আবদুল করিম তো তাঁর গানে ওস্তাদ  শব্দটা লিখেননি। তবে কেন আপনি বাড়তি এই শব্দটা প্রতিটি গানেই জুড়ে দিচ্ছেন?’ আমার প্রশ্ন শুনে রণেশ বললেন, ‘দাদা, ওস্তাদ শব্দটা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করি। আমার মুর্শিদ তিনি, কেবল নাম উচ্চারণ করতে ঠোঁট কাঁপে, তাই এর আগে ওস্তাদ শব্দটা জুড়ে দিই।’ প্রতিউত্তরে বলি, ‘কিন্তু এটাও তো একধরনের গানের বিকৃতি। তাই এই শব্দটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।’ আমার কথায় রণেশ বলেছিলেন, ‘আর এমন হবে না দাদা’।

কিন্তু কোথায় কী? গানের পরিবেশনা যখন জমে ওঠে, রণেশ ঠিকই ভুলে যান সেই নিষেধাজ্ঞার কথা। তিনি ‘ওস্তাদ’ শব্দটি জুড়ে দিয়েই একের পর এক গান গাইতে থাকেন। এরপর তাঁকে একই ভুলের বিষয়টি অবহিত করলে তিনি জিহ্বায় কামড় দিয়ে লজ্জা ও বিস্ময় প্রকাশ করে ভবিষ্যতে কখনও এমন হবে না বলে কথা দেন। তবে এ ভুল অব্যাহতভাবে চলতেই থাকে। এটা ঠিক রণেশ ঠাকুরের ক্ষেত্রে নয়। বরং প্রতিটি মানুষের লোকায়ত জীবনাচরণ ও সংস্কৃতির এ পথচলা বহুদিনের। মানুষ জেনে-বুঝে অথবা নিজের অজান্তে উত্তরাধিকারসূত্রে এসব লোকায়ত সংস্কৃতির ধারা বহন করে চলেছেন। কেউ কেউ এগুলোকে কুসংস্কার বলে ভাবেন। সেটা অন্য বিতর্ক, তবে এগুলো যে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশবিশেষ সেটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এসব বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের স্রোতধারায় বয়ে আসা উপাদান।

অতিশয় ছোট্ট প্রাণি টিকটিকি ‘টিক টিক’ শব্দ করলে পাশের টেবিল, চৌকি কিংবা শক্ত কোনও বস্তুতে আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে ঠোকা দিয়ে আলাপরত মানুষেরা কথা-বলার সত্যতা নির্ধারণ করে থাকেন। কোনও ব্যক্তি নির্জলা মিথ্যা কথা বলার সময়ও যদি টিকটিকি ‘টিক টিক’ করে শব্দ তোলে, তাহলেও নির্ঘাৎ শ্রোতাদের অনেকেই আঙুলের ঠোকা দেবেন। মূলত সেটি মানুষের অভ্যাস ও চর্চা। হাঁচি এলে যেমন বলা হয়ে থাকে কেউ তাকে স্মরণ করছেন। কিংবা হঠাৎ কোনও শিশু ভয় পেলে মা-চাচিরা ওই শিশুর বুকে থু থু ছিটিয়ে ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করেন। সেটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এই আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত যুগেও এসব সংস্কার যে একেবারেই কমে গেছে, তা কিন্তু বলা যাবে না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির বদলে এগুলোকে লোকায়ত সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ বিবেচনা করাটা উচিত হবে।

একইভাবে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করার সময় সেটি যদি শরীরের কোনও অংশে স্পর্শ করে, তাহলে কাউকে কাউকে দেখি পাখাটিকে বার-দুয়েক মাটিতে ঠুকছেন। সে-রকমই একদিন দেখেছিলাম আমার বন্ধু ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর দেবাশীষকুমার সরকারকে। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ এ-কারণেই করলাম, এত উচ্চশিক্ষিত হয়ে এবং শহরে দীর্ঘকাল বসবাস করেও সে কিন্তু শৈশবের দেখা মা-জেঠিদের আচার-সংস্কার কোনওভাবেই ভুলতে পারেনি। বরং সেটি সে তাঁর প্রাত্যহিক জীবনেও ব্যবহার করছে। হয়তো ভবিষ্যতেও তার বংশধরেরা উত্তরাধিকারসূত্রে এই আচার বহন করে চলবে। এখন এ বিষয়টিকে আমরা কী বলব? এটি কুসংস্কার নাকি দীর্ঘদিনের বয়ে-আসা বাঙালির ঐতিহ্যগত সংস্কার?

এ-রকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। এককথায় আমরা জ্ঞাতসারে হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক — মূলত লোকায়ত ঐতিহ্য-কৃষ্টি-চেতনাকে মনের গভীরে পোষণ করে চলেছি। হঠাৎ হঠাৎ সেগুলো প্রকাশ হয়ে পড়ে। সেগুলোর প্রকাশভঙ্গি ও বিষয়বৈচিত্র্য এতই আকর্ষণীয় ও নান্দনিক যে — তা নিতান্তই বাঙালির নিজস্ব সম্পদ। সময়ের পরিক্রমায় এসব আচরণগত লোকায়ত সংস্কৃতিতে যদিও একদিন ভাটা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তবু কালের বিবেচনায় মানুষের লোকায়ত জীবনাচরণ ও তার অন্তর্গত সংস্কৃতির আবেদন যুগে-যুগে কালে-কালে অনন্য অভিধায় বিবেচিত হয়ে আসবে।

ব্যানারে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী  সত্যজিৎ রাজন

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you