কাসেমের সাহিত্য ও সেকুলার মধ্যবিত্ত || সুমন রহমান

কাসেমের সাহিত্য ও সেকুলার মধ্যবিত্ত || সুমন রহমান

কাসেম বিন আবুবাকার যেভাবে নায়িকারে বোরখা পরাইবার মধ্য দিয়া বাংলা সাহিত্যরে বেপর্দা করে ফেলছেন, তার প্রেক্ষিতে কিছু পর্যবেক্ষণ দাগায়া রাখা দরকার। মনে পড়ে, নব্বই দশকের প্রথমদিকে মফস্বলের একটি কলেজে ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞাস করছিলাম তাদের প্রিয় লেখক কে কে। অভিসন্ধি ছিল, তারা যখন হুমায়ূন বা মিলনের নাম বলতে আরম্ভ করবে, তখন তাদের আরো ‘সিরিয়াস’ সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব। নির্দোষ সাহিত্যিক আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু তাদের জবাবে ভড়কায়া গেলাম। তাদের প্রিয় লেখকদের ধারাক্রম ছিল এমন :

১. কাসেম বিন আবুবাকার
২. এমডি মুরাদ
৩. হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূনের থার্ড হওয়া দেইখা তখন খুব মায়া লাগছিল। পরে বুঝছিলাম, ঐটা হুমায়ূনের পরাজয় ছিল না, বিজয় ছিল। তিনি বরং এগজটিক একটা পাঠকগোষ্ঠীর মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছিলেন। আমরা যেহেতু মধ্যবিত্তের সাহিত্যের প্রতিনিধি হিসাবে সেই পাঠককে রিকগ্নাইজ করতে পারতাম না, ফলে বিষয়টা আশ্চর্যের ঠেকত।

কাসেমের পাঠকগোষ্ঠী আছে। অনেকদিন ধরেই। ফলে ক্যাটাগরিক্যালি তাকে সাহিত্যিক বলতে হয়। কিন্তু মধ্যবিত্তের সাহিত্য যে ক্রাইটেরিয়ার ওপরে দাঁড়ানো, তাতে কাসেমকে আঁটাতে অস্বস্তি হয়। কারণ, আমাদের অজান্তেই আমরা সাহিত্যের একটা শ্রেণিগত সংজ্ঞার ওপর দাঁড়ায়ে আছি। এই সঙ্কীর্ণ মধ্যবিত্ত সেকুলার বলয়ের বাইরে বিস্তীর্ণ অল্পশিক্ষিত ননসেকুলার জনগোষ্ঠীর জন্য দৃশ্যত সাহিত্যের কোনো সেবা নাই। আমাদের এই সাহিত্য এতখানি আত্মগর্বী যে, সে তার নান্দনিক মূল্য দিয়েই সব পাঠককে কিনে নিতে চায়। কিন্তু পাঠক তো শ্রেণিবর্গে বিভাজিত। মধ্যবিত্তের নাগরিক জীবনে আগ্রহ নাই বা কম, এমন পাঠক কোন সাহিত্য পড়বে? মধ্যবিত্ত সাহিত্যিক যখন ‘গ্রামীণ’ সাহিত্য করে, সে তো আরো নাখাস্তা, প্লাতোনিক! সেখানে বাস্তবতার ডকুমেন্টেশন থাকলেও আকাঙ্ক্ষার ডকুমেন্টেশন কোথায়? গরিবের ফ্যান্টাসি কি চিরদিনই একমুঠো ভাত? আর শ্রেণিসংগ্রাম?

ফলে, কাসেম বিন আবুবাকারের স্পেইস তৈয়ার হয়। তিনি সুন্দর সাহিত্য লেখেন কি না, গল্প বলতে পারেন কি না, সেইটা বিবেচ্য নয়। আর সৌন্দর্যের সংজ্ঞা, ন্যারেটিভের সংজ্ঞাও তো শ্রেণিভেদে ভিন্ন হওয়া সম্ভব। বিবেচ্য হলো, তিনি কার গল্প বলেন। কাসেম যার বা যাদের গল্প বলেন, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এরা চরিত্র আকারে অনুপস্থিত। বা ভুলভাবে উপস্থিত। বা যেভাবে উপস্থিত থাকাটা তাদের পছন্দ, সেভাবে উপস্থিত নেই। তাহলে তারা তাদের গাঁটের পয়সা খরচ করবে কোন দুঃখে?

আরেকটা গ্লোব্যাল প্রবণতার কথাও খেয়াল রাখতে হবে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে এখন সাহিত্যের দুটো জাঁরা বিকশিত হইতেছে। এক, ইসলামিক রোম্যান্স, আর দুই, ইসলামিস্ট থ্রিলার। ইসলামিক রোমান্স মূলত ইসলামিক আদব-লেহাজ ও পরিভাষা দিয়ে রোম্যান্টিক গল্প বলে। ইসলামিস্ট থ্রিলার অন্য জিনিস। সেখানে ইসলামি বিপ্লব থাকে, প্রেম থাকে, লেবানন আফগানিস্তান থাকে, অনেকখানি জেমস বন্ড স্টাইলে। কাসেম বিন আবুবাকার প্রথম জাঁরার প্রতিনিধি। দ্বিতীয় জাঁরাটিও বাংলায় বিকশিত হইতেছে, যদিও অনুবাদপ্রধান। নসীম হিজাযী নামের এক পাকিস্তানি লেখক বাংলাদেশে বিশেষ জনপ্রিয়। এ-রকম আরো আছেন।

সাহিত্যসংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার ব্যাপারে স্বল্পশিক্ষিত ননসেক্যুলার গ্রামীণ বা আধাশহুরে জনগোষ্ঠীর আগ্রহ তাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে। বইয়ের জগতে এই আগমনটা টের পেতে দেরি হলেও গানের জগতে সেটা অন্তত আরো দুই যুগ আগেই টের পাওয়া গেছিল। তবে গানের ভুবনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রোতা এবং ভোক্তা হিসাবে যতখানি মাইনরিটি হয়ে গেছে, বইয়ের জগতে এতখানি হবে বলে মনে হয় না। মমতাজের গান যেভাবে বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে কব্জা করে ফেলেছে, কাসেমের উপন্যাস তা পারবে না।

তবে কাসেমের ভাইবেরাদরেরা কিন্তু গোকূলে বাড়িছে, ওহে অ্যাওয়ার্ডহ্যাপি মধ্যবিত্ত সাহিত্যিক ভাইবেরাদরেরা!

… …

COMMENTS

error: