১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ফকির দেবোরাহদিদি এবং রাজনদা এসেছিলেন সিলেটে। অপূর্ব এক মুগ্ধতা রেখে গেছেন। যতটুকু না আমি আনন্দ পেয়েছি তার থেকেও বেশি পেয়েছে আমাদের পরিবার। ছোটবেলায় দেখতাম বাবা গানের মানুষজনদের বাড়ি নিয়ে আসতেন। প্রতিবেশী অন্যের বাড়িতেও শিল্পী অতিথি হলে সকালবেলার জলখাবারের পর্বটা অন্তত আমাদের এখানে। সখ্য থাকলে তো সাদামাটা নিমন্ত্রণপর্বের সেবাও থাকত। বাবার আয়েশি, বিলাসী জীবনযাপন ছিল না বলে আয়োজনগত সারল্য, ভক্তি ছিল।
বাবা খুব একটা উঁচালম্বা নন কিন্তু ভরাট, সুরেলা গলা ছিল তাঁর। দূর থেকে কথা শোনা যেত। পালাগান, বৈঠকীগান, ধামাইল সহ নানা আঙ্গিকের গানবাজনা আমাদের ঘরে, উঠানে হতো। কুষ্টিয়ার দেবোরাহদিদি আর রাজনদার দল, এই অতিথিদের পেয়ে খানিকটা বাবার কথা মনে পড়ছিল। টানাপোড়েনের সংসারে তাঁর আনন্দকে খানিকটা ছুঁতে পারলাম বলে বেশ ভালো লাগল। গানে-প্রাণে গুরুকৃপা থাকলে এমন সৌভাগ্য হতে পারে হয়তো।
লালন সাঁইজিপ্রাণা অতিথিরা এত অল্প সময় নিয়ে এসেছিলেন যে অনেককেই জানাতে পারিনি। খবর পেয়ে কেউ কেউ অভিমান-অনুযোগ করেছেন। সুদিন, সময় এলে নিশ্চয়ই সকলে মিলে আবার সাধুসঙ্গ, এমন গানআড্ডা হবে।
দেবোরাহদিদির সাথে অল্প আলাপ ছিল আগে থেকে। যদিও ফ্রান্সের বাসিন্দা। গুরুসূত্রে কুষ্টিয়ার। এখানেই আশ্রম করে নোঙর করেছেন। প্রাণে গেঁথে নিয়েছেন সাঁইজির গান, বাংলা আর ফকির রাজন আর সাধুফকির-ভক্তকুলকে। এসেছিলেন নদীপথে হাওর হয়ে বাউল শাহ্ আবদুল করিমের প্রয়াণতিথিতে। করিমতীর্থ দর্শন করে সিলেটে এসে দু’দিন কাটিয়ে গেলেন।
তাৎক্ষণিক ছোট্ট আয়োজন ছিল। কলেজশিক্ষক শ্রদ্ধেয় পংকজ কান্তি দত্ত আমার প্রিয়জনদের একজন। মেঠোসুর বা ব্যক্তিগত নানা বিষয়ে পরামর্শ করি। উনি তাৎক্ষণিক সুনাদ তবলা একাডেমিতে একটা গানআড্ডা, সাউন্ড, নাস্তা এসব বিষয়ে পরামর্শ প্রদান ও সহযোগিতা করেন। সন্তান সহ উনার পরিবারও আন্তরিক সময় দেন।
ঘরোয়া পরিসরে তাৎক্ষণিক ডাকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের কয়েকজন এসেছিলেন। এসেছিলেন ড. জফির সেতু, সৈয়দ মনির হেলাল, আব্দুল করিম কিম, মোহাম্মদ বিলাল উদ্দিন, রাজন দাশ, গোলাম সোহবান চৌধুরী দীপন, সুদীপ্ত অর্জুন, সুমন ভট্টাচার্য, মালেকুল হক, সুফি সুফিয়ান, স্বপন আচার্য্য, বারীন্দ্র দাস, সন্দীপন শুভ সহ তরুণ প্রজন্মের অনেকেই।
মির্জাজাঙ্গালস্থ সুনাদ একাডেমিতে কথা, ভাবভক্তি ও লালন সাঁইজির গান ‘এসো হে অপারের কাণ্ডারী’ পরিবেশন করেন ফকির রাজন শাহ। ‘এসো হে প্রভু নিরঞ্জন’, ‘রাখিলেন সাঁই কূপজল করে আন্দেলা পুকুরে’ পরিবেশন করেন ফকির দেবোরাহ জান্নাত। তারা উভয়ে কুষ্টিয়া-দৌলতপুরের হেমাশ্রম পরিচালনা করেন। দেবোরাহ শোনান ‘সামান্যে কি তার মর্ম জানা যায়’। টুটুল ফকির শোনান ‘ইলাহি আলামিন গো আল্লাহ’, ‘তুমি ডুবায়ে ভাসাইতে পারো’; তিনি কুষ্টিয়া-সোনাতলা-দৌলতপুরের নিত্যধাম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। মনোমোহন দত্তের গান ‘চাই না বেহেস্ত চাই না দোজখ’ ও লালন সাঁইজির গান ‘ঐ নাম ভুল করিলে পড়বি ফেরে’ পরিবেশন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নবীনগর-সাতমোড়া আনন্দ আশ্রমের রনি ফকির।
কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের প্রয়াণপ্রায় অবস্থা শুনে সকলে মিলে তাৎক্ষণিকভাবে গাওয়া হয় ‘তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না’।
মাঝপর্বে সিলেটের গান পরিবেশন করেন বাউল শীতনবাবু। তিনি বাউল শাহ আবদুল করিমের ‘যে গুণে বন্ধুরে পাবো’, ‘দরদিয়া রে বন্ধু দরদিয়া রে’ গেয়ে শোনান।
আরও উপস্থিত ছিলেন আশিক আফজাল ও জয়, রাইপুরা, নরসিংদি; রিয়াদ ও ফাতেমা, রূপসা, খুলনা; মাসুম, ফেনি; দিবাকর ও আকাশ, মানিকগঞ্জ; পারভেজ, চট্টগ্রাম, সিলেটের ইমামুল ইসলাম রানা, বাচ্চু তালুকদার, মিজানুর রহমান মিজান, সুপর্ণা সেন, সন্দীপ অপু, আব্দুল মালেক, অর্ণব রায়, ঝলক চৌধুরী, প্রাঞ্জল দত্ত, পদ্মনাথ দত্ত প্রমুখ।
পরদিন ক্ষিতি স্থপতিতে এক আড্ডা অনুষ্ঠিত হয়। আড্ডাটি ‘ইমজা’ কর্তৃক আয়োজিত। ইমজা মিলনায়তন প্রাঙ্গনে দেবোরাহ ‘গুরু তুমি পতিত পাবন’, রাজন ফকির ‘গুরুপদে মন যার হবে’, টুটুল ‘প্যারী ক্ষমো অপরাধ’, ‘লীলা দেখে লাগে ভয়’ ইত্যাদি গানগুলি গেয়ে শোনান।
সবশেষে সকলে মিলে গাওয়া হয় ‘মিলন হবে কত দিনে’। এদিন সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন দেবব্রত ঘোষ চৌধুরী বাপ্পা, স্থপতি রাজন দাশ, শশাংক মনি চন্দ রিংকু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বিমান তালুকদার রচনারাশি
গানপারে লালন সাঁই
- সাধুসঙ্গ ও সাধনসংগীত || বিমান তালুকদার - October 3, 2025
- নাট্যনির্দেশনাগত নকল প্রযোজনা || দেবজ্যোতি দেবু - September 30, 2025
- জুবিনের জীবন ও সংগীত || সুশান্ত দাস - September 30, 2025
COMMENTS