পাশেই কারোর একখানা হাত ধরো
কাছেই কাউকে তোমার বন্ধু করো
দূরেও রয়েছে বন্ধু মিষ্টি হেসে
হয়তো কোথাও হয়তো অন্য দেশে
কোথায় তোমার সেই বন্ধুটা থাকে
সেও কি হাতটা অন্যের হাতে রাখে
নিশ্চয়ই রাখে বন্ধু হবার টানে
তার হাতটাই ধরছি আমার গানে
[কবীর সুমন]
এই গানটা উঠে এল সদ্য সন্ধ্যায়, স্মৃতির ইঁদারা থেকে এই নোটে, এক ভিজে শীতাসন্ন বর্ষণমন্দ্রিত মুহূর্তে। এটা ভারি আশ্চর্য যে, একেকটা গান বছরের পর বছর ধরে তলিয়ে রয় স্মৃতিপাতকুয়ার ভেতরদেশে, এবং অকস্মাৎ উঠে এসে একদিন অধিকার করে নেয় একটি বিকেল, ভরে তোলে দেয়াল ও ঘরের ভেতরকার ফল্স রুফ সুরের ডানায়, লিরিকের লকলকে লেলিহান লবঙ্গলতিকায়! একেকটা সাঁঝের মায়া আমাদেরে নিয়া যায় সেই কবেকার ফসল-কেটে-নেয়া মাঠময় কৈশোরের দেশে…সেই আমাদের ঘনঘোর ধানক্ষেতের বাতাস বিধৌত গ্রামের বাড়িতে…বেলগাছ ও জলপাইয়ের পাতায় রিফ্লেক্টরত রৌদ্ররঙ্গিলা মাতুলালয়ে। এইটা আমি রেগ্যুলার অবাক-নির্বাক হয়ে ভাবি যে, কেমন করে একটা গান অবিকল রয়ে যায় মনে—যেখানে এমনকি নিজের রোজগারসুযোগের বহু জরুরি ইনফর্মেশন হরদম ভুলে বসে থাকি, এবং লোকসান মেনে নিই হাঁড়িমুখে বহু অল্পের-জন্য-হাতছাড়া ধান্দার!
এই যে একটু আগে যে-গানটা গুনগুনিয়ে লিখে ফেলতে পারলাম পূর্ণাঙ্গ, নোটেশন ট্রান্সক্রিপ্টিং আয়ত্তে থাকলে সুরটাও তুলে দেখিয়ে দিতে পারতাম, এইটা আজ থেকে ঠিক বছর-চৌদ্দ পূর্বাব্দের গান। মনে আছে, সহস্রাব্দ অন্তিমের মুহূর্তে কবীর সুমনের পঙক্তিবাঁধন-সুরসৃজন ও সংগীতায়োজনে একটা গানসংকলন হয়েছিল, সুমনের পরিচালনায় গেয়েছিলেন অনেকেই সেই অ্যালবামে, এর মধ্যে সন্ধ্যা-স্বাগতালক্ষ্মী-ইন্দ্রাণী-লোপামুদ্রা ছিলেন মনে পড়ে, এবং তাদের গাওয়া গানগুলোও উইথ ফ্যুল-লেংথ লিরিক্স। ‘বন্ধু’ শিরোনামের এই গানটা গাওয়ানো হয়েছিল ছোট্ট একটি শিশুকে দিয়ে, কাঁপাকাঁপা রিমিঝিমি কণ্ঠে মেদুর আবহ হয়েছিল ফলে, এবং সুমন নিজেও গলা দিয়েছিলেন তৎসঙ্গে গানটার রিপিটেশনাংশে।
এই গান যে-অ্যালবামে ছিল সেই অ্যালবামটার নাম, যদ্দুর মনে পড়ে, ‘ছোটবড় মিলে’। বেরিয়েছে এইচএমভি থেকে। ক্যাসেটযুগ ছিল তখন, ফ্লপিডিস্ক এলেও তখন কম্প্যাক্ট ডিস্ক ওইভাবে মেইনস্ট্রিম হয়নি কিংবা অতদূর তখন কল্পনাতেও ছিল না আমাদের, একটা লাল রঙের স্টেরিয়ো ক্যাসেটপ্লেয়ার ছিল রূপকের, যেইটা আবার বছরের এগারো মাস জুড়ে আমি বিলং করতাম। রূপক দেব, পুরোনাম রূপক রঞ্জন দেব, আমার আকৈশোর বন্ধু অথবা আক্ষরিক অর্থে ছিল আমাদের ফ্যামিলিমেম্বার। ছিল। নেই। বালাই ষাট! বন্ধুত্ব অটুট, আজও, অথচ দুনিয়ায় নাই সেই সাহেবজাদা বেঁচে। শেইক্সপিয়্যরের রঙ্গমঞ্চ থেকে সে ২০০৬ ইসায়ীতে, এই অক্টোবরে, স্যাল্যুট না-জানিয়েই বিদায় নিয়েছে। দেবানন্দ কায়দার ভাঁড়ামো।
রূপকের ক্যাসেটপ্লেয়ার, টেইপ বলতাম আমরা। লাল সেই ক্যাসেটপ্লেয়ার গ্যালাক্সির কোথাও কোনো অচেনা স্টেশনের আশেপাশে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভিজে এই শীতাগমনী দিনের বর্ষণসন্ধ্যায়। সেই ফিতার ক্যাসেটও দুনিয়া থেকে উঠে গেল রূপকপ্রস্থানের পর গত সাত-আট বছরে। এই-যে এই গানটা, আরও অসংখ্য এমন, রূপক আর আমি একসঙ্গে গেয়েছিলাম কোনো-এক দিনের-পর-দিন। সুমনের গান তো ঝেড়ে মেমোরাইজ করে ফেলতাম শোনার অব্যবহিত পরেই। কী দীর্ঘ জীবন, মনে হয় মাঝে মাঝে, কাটায়া গেলাম ভবে! সেসব কোনো দূর ইতিহাসোর্ধ্ব সভ্যতার সুর বলে মনে হয় এখন।
তো, রূপক নেই, সেই লাল ক্যাসেটপ্লেয়ার নেই, ফিতের ক্যাসেটে গান শোনার ঘটনা গল্প-উপন্যাসেও গরহাজির বহুকাল, সুমনও বুড়িয়ে এসেছেন ক্রমে। স্ট্রেইঞ্জ! অট্টহাসি বিনে বেঁচে-থাকার কোনো পথ আমি খুঁজে পাই না। লাফিং আউট, অ্যাগেইন অ্যান্ড অ্যাগেইন, লাউডলি…
জাহেদ আহমদ অক্টোবর ২০১৩
- ভারতীয়া শারদীয় সংখ্যায় একটা বাজারবান্ধব নভেলা পাঠের স্মৃতি - November 9, 2025
- সন্দীপন স্বল্পায়তন - November 5, 2025
- ম্যাক দ্য রকার || জাহেদ আহমদ - November 3, 2025

COMMENTS