আকবর আলি খানকে সামনাসামনি দেখিনি কখনো। তাঁর লেখা ও বক্তৃতার সাথে আছে মগ্ন পরিচয়। খুব পছন্দ করতাম। পক্ষাঘাতের জন্য বাচনিক সমস্যা থাকলেও ইতিহাস ও অর্জিত প্রজ্ঞায় এমন ভঙ্গিতে কথা বলতেন — মন পরিপূর্ণ ও পরিতৃপ্ত হতো।
সময় ও ইতিহাসকে তিনি স্পষ্ট বুঝাতে পারতেন। একের পর এক প্রিয়জনকে বিদায় জানিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে হয়তো বিষাদযাপনেই ছিলেন, কিন্তু বাইরে ছিলেন শক্ত-সত্যদ্রষ্টা।
’৭১ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শন ও দার্শনিকতার বিকাশে কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। একজন সলিড ধীমান। ইতিহাস-সময়-সমাজ-অর্থনীতিকে মাঙ্গলিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতোই তিনি তথাকথিত পোশাকী অফিসার ছিলেন না। আমলা হয়েও ছিলেন প্র্যাগম্যাটিস্ট চিন্তক, খাঁটি বুদ্ধিজীবী।
সময়ের ধারাপাতনির্ভর ভাবগম্ভীর সিরিয়াস বিষয়ও তাঁর অনন্য মনন ও সরসতায় নান্দনিক হয়েছে। তথ্য, তত্ত্ব, অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতায় ঠাসা ছিল তাঁর লেখা। জীবনজাত, অভিজ্ঞতানির্ভর চিন্তা প্রকাশ করতে এসে তাঁর লেখালেখিতে কোনো বাহুল্য কিংবা অকারণ রোমান্টিকতা ছিল না। চিন্তার সর্বাংশে সততা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের উত্তরাধিকারকেই ধারণ করে গেছেন।
পাণ্ডিত্যের গরিমায় অনেকের লেখা পড়া যায় না। অর্থনীতি ও সমাজিক বিজ্ঞানের জটিল-জটিল থিয়োরিও লোকগল্প ও অভিজ্ঞতার সহজতায় লিখতে পারঙ্গম ছিলেন। তাঁর লেখা শেষ না করে ওঠা যায় না।
অবসরোত্তর বিষণ্ণতায় না থেকে শক্তিমান লেখকের মতো অকপটে সত্য লিখে গেছেন। সতেরো-আঠারোটি গ্রন্থের জন্যই বাংলার সারস্বত সমাজে বেঁচে থাকবে আকবর আলি খানের লেখা।
বাঙালি ঠিকভাবে আত্মজীবনী লিখতে পারেন না। আত্মজীবনী লিখতে এসেই বাঙালি নিজেকে নায়ক ও বীরে পরিণত করে। সেই বাঙালির রক্ত ধারণ করেও ‘পুরনো সেই দিনের কথা’-র মতো একটি আত্মজীবনী লিখেছেন। সহজ কথনে সেখানে তিনি সময় ও নিজের জীবনকে হাজির করেছেন। লেখা পড়লেই লেখকের সততা টের পাওয়া যায়। গ্রন্থটি সম্পর্কে লেখক বলেছেন — “পুরানো সেই দিনের কথা বইতে ১৫টি অধ্যায় আছে। এতে আমার মা-বাবার কথা ছাড়াও পারিবারিক ঠিকুজি, বংশপরম্পরা আছে। বিশেষ করে আমার জীবনের ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বর্ণনা আছে। কেবলমাত্র এই আত্মজীবনী পড়ে আমার ও বাংলাদেশের গতিপথ বোঝা যাবে না। পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী পর্ব শুরু হবে ১৯৭৩ সাল থেকে। যা হবে পুরানো সেই দিনের কথার দ্বিতীয় খণ্ড।” আমরা আকবর আলি খানের সেই দ্বিতীয় খণ্ড আত্মজীবনী প্রকাশের ও পড়ার অপেক্ষায় আছি।
বিদায় হে, মহৎ ধীমান! শ্রদ্ধা জানবেন।
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS