শিল্পের ইন্টারপ্রিটেশন কিভাবে হয় শ্রোতা, দর্শক বা ভোক্তার কাছে? কাল ঢাকা ফোক ফেস্টে গিয়ে একটা উন্মত্ত, প্রমত্ত, উদ্বেলিত প্রশ্ন হিসাবে ধরা দিলো আমার কাছে । বাসুদেবের গান আমি আগেই শুনেছি। বিশেষত তার গায়কীনির্ভর কণ্ঠস্বরের অসাধারণ একটা আবেদন আছে। তিনি বহুল পরিচিত গানগুলোই গান। তার নিজের কোনো গান থাকতে পারে হয়তো, তবে তা আমার জানা নেই। তার অধিকাংশ গান আপনি অন্য শিল্পীদের কণ্ঠে শুনেছেন, কিন্তু বাসুদেবের গলার জোরে তা অনন্য, নতুন ঠেকবে, তাঁর নতুন স্বর আপনাকে মনে রাখতে হবে, মাথার মধ্যে গুনগুন করবে।
বাসুদেব দাস (Basudeb Das) মনে হয় আসামের শিল্পী। বাংলা বাউল গানের যে উচ্চারণরীতি, রং, ঢং, আনন্দ – তাতে কুষ্টিয়ার লালনের প্রাধান্য আছে। কলকাতার আধুনিক বাউলদের জবরদস্তির একটা অভ্যস্ততা আমাদের গোল গোল ছোট ছোট কানের ভেতর তৈরি হয়েছে। প্রচারে অভ্যাস। বাসুদেবের নিজস্ব ভঙ্গিমায় ও উচ্চারণে গাওয়া অনেক পরিচিত গান অদ্ভূত রকমের নতুন লাগে। ভালো লাগে। তাই আমার বাসুদেবকে ভালো লাগে কারণ প্রমিত বাউল-উচ্চারণ বলতে আমরা যা জানি তিনি তার বাইরের, অন্তত শুনতে আমার কাছে।
কালি দাশগুপ্তের লেখা বাসুদেবের গাওয়া “চল মিনি আসাম যাব, দেশে বড় দুখ রে” এই গান যতবার শুনি ততবারই আমার রক্ত হিম হয়ে যায়। ব্রিটিশদের আসামে চা-শিল্প বিকাশের যে করুণ ইতিহাস তার পুরোটা এই গানে আছে। এই উপমহাদেশের নতুন দাস তৈরির প্রক্রিয়া ও নতুন দাসদের জীবনের চূড়ান্ত ব্যথার সংগীতরূপ এই গান। সেই সময়টা বোঝার জন্য এই গান যথেষ্ট। আসাম উন্নয়নের ২০০ পাতার ইতিহাস পড়ে যা পাবেন তা পাঁচমিনিটেই এই গানের মধ্যে পেয়ে যাবেন। তীব্র ব্যথা আর হাহাকারমুখর গান। যতবার শুনি ততবার ভাবি, এই গান আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে মানুষ কীভাবে মানুষকে ব্যবহার করতে পারে মাত্র উৎপাদনের কাঁচামাল হিসাবে। আমরা যেনে ভুলে না যাই আমাদের নিপীড়ন নিরন্নের প্রতি। চা-শ্রমিকরা আজও দাসের বাইরে কিছু না। এই দাসমানুষ তৈরির ইতিহাস আমাদের ভুললে চলবে না।
কিন্তু বাসুদেব যখন গান শুরু করলে ‘চল মিনি আসাম যাব’ কাল ঢাকার মঞ্চে, দেখলাম জনগণ নেচে উঠল, ঘাড়ে ঘাড়, হাতে হাত, সে কী হুল্লোড়! সারা ময়দান তাদের আনন্দের পদাঘাতে ধুলোয় ঢেকে দিতে চাইল চারপাশ। হায়, দু:খের ইতিহাস ঢাকার স্টেডিয়ামে আনন্দ হয়ে ঝলমল করে ওঠে। “সরদার বুলে কাম কাম, বাবু বুলে ধরি আন – / সরদার বুলে কাম কাম, বাবু বুলে ধরি আন – / সাহিব বুলে লিব পিঠের চাম!” এই চামড়া-ওঠা মানুষগুলোকে নাগরিক চোখ দিয়ে দেখা তো দূরের কথা, অনুভবও করতে পারে নাই।
তো, শিল্পে উদ্দেশ্য ও তার ফলাফল দূরবর্তী। এমন একটা শোকগীতিতেও জনগণ আনন্দে মেতে উঠতে পারে? পারে। আমার মনে হয়, এক মৃত্যু-উপত্যকায় দাঁড়িয়ে নিজের মরে-যাওয়াটাকে উদযাপন করছি ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে। এটা এক অনুভূতিহীন মৃত নগর, চিন্তাশক্তিহীন। আমি আনন্দের বিপক্ষে না। মানুষের জীবনে আনন্দ আসুক। কিন্তু জনগণ যখন জানে না আনন্দ কী এবং কোনটা – তখনই তৈরি হয় যুক্তিহীন শুধু আনন্দপ্রত্যাশী সমাজ। হত্যার মধ্যেও আনন্দ জেগে উঠতে পারে। অপরকে নিপীড়নের মধ্যে, ঠকানোর মধ্যে, পিষে ফেলার মধ্যে আনন্দ জেগে উঠতে পারে।
শিল্পের উদ্দেশ্যের পাঁচ পয়সা দাম নাই নৃত্যপটিয়সী জনজীবনে।
শিল্পের উদ্দেশ্য কী? শিল্পের ইন্টারপ্রিটেশন কিভাবে হয় শ্রোতা, দর্শক বা ভোক্তার কাছে, – আমি বুঝছি না কিছুই?
… …
- কায়মাসুদ : মাসুদ খানের জড়সাধনা || মৃদুল মাহবুব - February 15, 2020
- মুখোমুখি গুন্টার গ্রাস || মৃদুল মাহবুব - January 6, 2020
- হেমিংওয়ে, তোমার চিঠি এসেছে || মৃদুল মাহবুব - December 15, 2019
COMMENTS