জনাকীর্ণ ও যানবাহনাকীর্ণ নগরীর একটা প্লাজা। নানাবিধ দোকানপাটের পসরা প্লাজাটারে ব্যাস্ত করিয়া রাখে টুয়েন্টিফোর আওয়ার্স ইন্টু সেভেন। জনাপাঁচেকের একটা গ্রুপ মোটামুটি নিয়মিত সমস্ত দিনের শেষে গেহে ফেরার আগে একচোট আড্ডা মারে প্যাঁচানো সিঁড়ির প্রান্তে ব্যাপ্ত রোয়াকে থ্যাবড়া মেরে বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, বেশিক্ষণ বসে থেকে পায়ে ঝিঁঝি ধরে এলে কেউ উঠে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে তেষ্টা পেয়েছে বলে চা-চুরট পান-সেবনের বাসনা ব্যক্ত করে। প্লাজার সংলগ্ন কামারপট্টির ভিতরে একটা ছাপড়া চায়ের ঘুপচি। নিয়মিত গুলতানির এই গ্রুপ সেইখানে টিব্যাগের চা খায়, বিস্কুট ও কলা খায়, অলটাইম ডিমগন্ধের রেডিমেইড কেইক খায়, কেউ ডার্বি চুরটের সঙ্গে নেয় ভিজাপাত্তির জর্দামারা পানতাম্বুল, আর করে সেমিনার। দুনিয়ার অর্থকরী বিষয়াদি বাদ দিয়া খালি বিনর্থ বাগাড়ম্বর।
গ্রুপে কেউ রাবীন্দ্রিক, কেউ রবীন্দ্রবিরোধী, কেউ দুনিয়ার বেবাক বিষয়েই বীতশ্রদ্ধ অথবা ভক্তিগদগদও কোনোদিন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে এই গ্রুপটা আড্ডা মারতে পারে বটে! ম্যারাথন আড্ডা কোনো-কোনোদিন, বিশেষত উইকেন্ডে, মধ্যরজনী পর্যন্ত চলে। সেদিন চলছিল প্রায় ম্যারাথন আড্ডাই বলা চলে। কেষ্ট নিয়া কথা উঠেছিল, জন্মাষ্টমীর বিবিধ অনুষ্ঠান উদযাপনের প্রাকরাইতের সেমিনার এইটা। খানিকটা আড্ডাসারসংক্ষেপ এই নিবন্ধে গেঁথে তোলা যায় কি না চেষ্টা করে দেখতে পারি। কিন্তু আগেই বলে রাখি যে এইখানে মোটেও ধর্মকথা আশা করা যাবে না, চাপান-উতর বলতে যা বোঝায় সেভাবেই নিবন্ধ দলিলায়িত।
উপস্থিত গ্রুপে একজন সহসা খাপ্পা হয়ে গেলেন কৃষ্ণের এত পসার দেখে। এবং ফস করে বিরক্তি প্রকাশও করে ফেললেন। উনি এমনিতে নিপাট ভালোমানুষ, গতরস্বাস্থ্যে দেখতে গোসাঁইহৃষ্ট হলেও উনি কিন্তু অব্রাহ্মণ, সজ্জন কায়স্থ, অতীব রবীন্দ্রসাংস্কৃতিক, মঞ্চনাট্যের প্র্যাক্টিসিং কর্মক। উনি রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের গানের সঙ্গে প্রেমপর্বের গান মিলাইতে নারাজ। যদি কেউ অনবধানবশত পূজার গান গেয়ে ফেলে প্রেমগানরূপে, উনার চাড্ডা যায় বিগড়ে। সেইটা আরেক গল্প। জন্মাষ্টমী সামনে রেখে সেদিনের আড্ডায় তারে পাকড়াও করে এককথা-দুইকথায় আড্ডা তালগাছের মতো উঁচাইতে থাকে। সেই আড্ডার সংলাপগুলো বোধগম্য সম্পাদনাপূর্বক এই নিবন্ধে গৃহীত হয়েছে মাত্র। কোনো সমীক্ষা বা প্রাইমারি কি সেকন্ডারি রিসার্চ করা হয় নাই প্রতিপাদ্য সম্পর্কে। আর-পাঁচদিনের ন্যায় এই দিনেও আড্ডা ছিল উরাধুরা ডায়লগনির্ভর, শুধু তফাৎ এইটাই যে এদিনের ডায়লগ ছিল ধর্মানুষঙ্গিক, জন্মাষ্টমীলগ্নে একটু কৃষ্ণনামের মধ্য দিয়ে নেকি কামানো হলো, আবার ভক্তি থেকে মুক্ত একটা আলাপের চেষ্টাও হলো। সংলাপ ইন দি নেইম অফ লর্ড শ্রীকৃষ্ণ।
লোকে যে কেষ্টঠাকুরকে ভগবান মনে করে, এইটা ভাই ঠিক না। তা ভাবতেই পারেন যে কানাই ইজ অ্যা বিগশট প্লেয়ার, অ্যা সিগ্নিফিক্যান্ট অ্যাক্টর, খেইড় তিনি খেলতে এবং খেলাইতেও পারেন অনেক, কুরুক্ষেত্রে বলুন বা রাস্তাঘাটে হেথায়-হোথায়, খেড়োয়াল হইলেন বলেই কি উনি ভগবান হয়ে গেলেন নাকি? ফিৎনাটা লাগাইবার পিছনে আপনাদের মতো কবিসাহিত্যিকরা দায়ী। দিনে দিনে যে-ক্যারেক্টারটা গড়ে উঠেছে, এখন যেই বিশাল ফিগার কালিয়ারে দেখেন আপনারা, তা তো মূল পুরাণে অ্যাভেইল করেন না আপনি, ব্যাপারটার শুরু বৈষ্ণবযুগে। বেশিদিন আগের কথা তো নয়। বৈষ্ণব কবিসাহিত্যিকেরা আজকের এই বিপুলা গালগল্পের কৃষ্ণ পয়দা করেছেন, বুঝলেন?
তা ভাই বুঝলাম, যদিও অত ডিপে যেয়ে খোঁড়াখুঁড়ি তো করতে পারব না, ধরে নিচ্ছি যে আপনার কথাই ঠিক। মূল কেন, নকল পুরাণও তো পড়ে দেখি নাই আমরা, অত ধৈর্য নাই, বিদ্যাশিক্ষায় বেদজ্ঞও নই। কিন্তু বৈষ্ণবরা কাল্পনিক কৃষ্ণ বানিয়ে এত বড় করে তুলতে পারল কেমন করে, এইটাই ভাবায়। মানে, ইম্যাজিনেশনেরও তো একটা ভিত্তি থাকে। একেবারেই ভিত্তিহীন কল্পনা আল্লার দুনিয়ায় নাই বোধহয়। এবং ভেবে দেখুন, বৈষ্ণবিজম কিন্তু খুব বেশিদিনের মামলা না। আজকে সবচেয়ে অ্যালাইভ ভগবান বলুন বা অবতার বলুন, লোকমানসে ইম্প্যাক্টের দিক থেকে, লর্ড কৃষ্ণই, স্বীকার করবেন না?
না, তা বলছি না। আপনি মহাভারতেও দেখবেন যে কৃষ্ণ হচ্ছেন অবতার। বৈষ্ণব অবতার অবশ্য। ভগবান বিষ্ণুর অবতার। স্বয়ং ভগবান নন। উনার নামের আভিধানিক বা ব্যবহারিক অর্থ দোহন করলে দেখতে পাবেন কথা সত্যি। কৃষ্ণ ইজ নট অ্যা সুপ্রিম লর্ড। অনেককিছুই তিনি করছেন দেখতে পাই, কিন্তু সুপ্রিমেইসি উনার হাতে তো নাই, দি আল্টিমেইট সুপ্রিমেইসি ইজ্ আউট দ্যায়ার, তাই না? আচ্ছা, আসেন দেখি ‘কৃষ্ণ’ শব্দের অর্থটুকু লক্ষ করি। কৃষ্ণ মানে ভগবান নয়, কৃষ্ণ সবসময় মানুষ। কৃষ্ণ মানে যে/যিনি কর্ষণ করতে পারে/পারেন। কৃষ্ণ মানে ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষ। কৃষ্ণ হচ্ছে এমন পুরুষ যে ক্ষেত্র বুঝে কর্ষণ করতে সক্ষম, বুনতে পারে বীজ, অন্যদিকে দেখেন বীজের আরেকটা মানেও কিন্তু ওই কৃষ্ণ, অর্থাৎ বিন্দু। সুধীর চক্রবর্তী পড়ে এইগুলা জানা। তা, সুধীরবাবু কি নিজের পকেট থেকে এইগুলা ঝাড়ছেন? না, তা তো নয়। দেহাতি মানুষের সঙ্গ করেই কিন্তু সুধীরের ইন্টার্প্রিটেশনগুলো গড়া। তাইলে ক্ষেত্র কে? ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষ তো বপনের জন্য ক্ষেত্র চাইবে, ক্ষেত্র কে? ক্ষেত্র এইখানে রাধা। দ্যাটস্ দ্য অর্থ, তাৎপর্য, অফ রাধাকৃষ্ণ কন্সেপ্ট। পুরা ব্যাপারটাই রিপ্রোডাক্টিভ হেলথের লগে জড়িত। প্রজননের পার্থিব প্রয়োজনেই কৃষ্ণ, ও/অথবা রাধা, বুঝলেন?
বুঝেছি কি না তা তো দুইশব্দে বলতে পারব না। তারপরও কথাবার্তা চালাইবার দরকার ফুরায় না। আপনে এত গোস্বা কেন বুঝতেসি না খালি। শ্রীকৃষ্ণ যদি দি লর্ড সাব্যস্ত হন বর্তমান ধর্ম-উদাসীন পাব্লিকের কাছে, তাইলে সমস্যাটা কোথায়? তারও আগে ফায়সালা দরকার আরেকটা ব্যাপার, সেইটা এ-ই যে, ধরেন বিষ্ণুর অবতার কি করে বিষ্ণুর চেয়ে জ্যান্ত হয়ে দেখা দেন জনপদে? এছাড়া ব্রহ্মা বলেন বিষ্ণু বলেন মহেশ্বর বলেন কেউই কিন্তু লোকমনে এত স্পষ্ট নন যতটা কৃষ্ণ। হাউ কাম?
হ্যাঁ, এই তো লাইনে আইবেন, আসেন। দেখেন, অবতার শব্দটায় পাচ্ছেন অবতরণ করা, মানে ভগবান অবতরণ করেন, উড়োজাহাজে বা স্পেসশিপে তো নয়, ভগবান অবতরণ করেন মানুষগতরে, মানবাবয়বে, মানুষের রূপ ধরে। এইখানে বিষ্ণু অবতরণ করেছেন কৃষ্ণরূপে। এইভাবে যুগে যুগে ভগবান অবতরণ করেন মানুষেরই ফিজিক্যাল শেইপে, মানুষমোড়কে, মানুষের রূপ ধরে মানুষেরই ভিড়ে। এবং অবতার হচ্ছেন ভগবানের কাজ-সহজ-করা, মানে মেশিন মনে করেন, তার মধ্য দিয়া ভগবান কার্যসিদ্ধি ঘটান। চৈতন্য বলেন, গৌর নিতাই, নিত্যানন্দ, অদ্বয় প্রমুখ কতশত অবতারের আনাগোনা ধরাধামে! এখনও তো, সনাতন ধর্মের মতানুসারে, অবতারের আগমন অব্যাহত।
অবতার কি তাইলে ইংরেজিতে যেইটারে বলে প্রোফেট, দূত, গডের বার্তাবাহক, তা?
না, তা নয়। আংরেজি তো অত জানি না। সাধারণ সেন্সে যেইটা মনে হয় যে স্রেফ বার্তাবহনের লাইগাই অ্যাভাটারের দুনিয়ায় আগমন নয়। ইন দ্যাট সেন্স মনুষ্য মাত্রেই কিন্তু দূত, প্রতিনিধি, বার্তাবহনকারী, ফ্রম দ্য অলমাইটি। কিন্তু অবতার তো অন্য জিনিশ।
বুঝছি বুঝছি। কিন্তু স্বীকার তো করছেনই যে কৃষ্ণজিকে ভগবান সম্বোধনে সমস্যা নাই। আদমের সুরতে তিনি তো স্যুপ্রিম লর্ডই, তাই না? আপনিই যেহেতু বলতেসেন যে ভগবান স্বয়ং অবতরণ করেন কৃষ্ণরূপ মনুষ্যের প্রক্রিয়ায়, দিস্ ইজ্ দ্য প্রক্রিয়া অফ হিজ্ অ্যারাইভ্যাল অন্ আর্থ, সো? ভগবানই তো, নো?
ধুর মিয়া! আপনার লগে বেফায়দা আলাপ করা। যাইগিয়া। আমার বউত্তা বাকি আছে বাজারাট করা। কাইলকু জন্মাষ্টমী, ঘুম থাকি সকাল সকাল উঠতে অইব।
প্রতিবেদনকারী : মিল্টন মৃধা
(চলবে)
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS