বহুপরিচয় ছাপিয়ে সংগীতজীবী পরিচয়টাই সঞ্জীব চৌধুরীর ক্ষেত্রে শেষমেশ মুখ্য। যদিও সঞ্জীব ছিলেন একাধারে গায়ক, গানলেখক, গীতিকার, সুরকার, লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিকর্মক; এইসব পরিচয়ের যে-কোনো একটাতেই তিনি নিবিষ্ট হতে পারতেন, সফলও হতেন সন্দেহাতীত, সঞ্জীব শেষমেশ সংগীতজীবী হিশেবেই পরিচিতি পেয়েছেন দেশজোড়া। গানেই জীবনের যন্ত্রণা বুনেছেন, যুগযন্ত্রণা আর জীবনস্ফূর্তি প্রকাশ করেছেন গানে গানে, খুঁজেছেন উপশম যাপনযাতনার।
সঞ্জীব ছিলেন নব্বইয়ের দশকে আবির্ভূত বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড দলছুটের প্রধান কণ্ঠ, দলছুটসখা বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গেই ছিল তার আমৃত্যু সাংগীতিক জুটি। সঞ্জীবের জীবদ্দশায় দলছুটের ব্যানারে চারটা অ্যালবাম বেরিয়েছিল মোটমাট। প্রত্যেকটা অ্যালবামেই লিখেছেন, সুরারোপ করেছেন, কণ্ঠ দিয়েছেন সঞ্জীব চৌধুরী। সঞ্জীবের প্রত্যেকটা কাজেই সিগ্নেচার খুঁজে পেত শ্রোতারা, যার ফলে অভিষেকের পরেই তিনি দ্রুত শ্রোতাগ্রাহ্য হতে থাকেন। শেষ দিন অব্দি এই ফ্যানবেইস অটুট ছিল।
সঞ্জীবের ছিল গভীর মদির কণ্ঠস্বর ও অনন্য গায়নশৈলী বা গায়কী। লিরিক্যাল জিনিয়াস হিশেবে এই শিল্পী বাংলা মিউজিক হিস্ট্রিতে স্মরণীয় রইবেন। দলছুটের চারটা অ্যালবামের প্রথমটা ‘আহ্’ এবং শেষটা ‘জোছনাবিহার’। চারটা অ্যালবামের প্রত্যেকটাই হিট চার্টে এসেছিল মুক্তির পরে। ‘স্বপ্নবাজি’ শীর্ষক সঞ্জীবের একক একটা অ্যালবামও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়াও মুষ্টিমেয় কয়েকটি মিক্সড অ্যালবামে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে সঞ্জীবের কয়েকটা গান আছে।
এরশাদের স্বৈরাচারী সময়ে একটা আন্দোলন ফুঁসে উঠেছিল। নব্বইয়ের শেষভাগের ঘটনা। আন্দোলনের ফলে এরশাদের দুঃশাসন দূর হয়। এরশাদবিরোধী এই আন্দোলনে অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে সঞ্জীব চৌধুরী ছিলেন শুরু থেকে শেষ অব্দি শামিল। তখন সঞ্জীবদের শিক্ষার্থীজীবন মধ্যপথে এবং সঞ্জীব ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পদচারণক্ষেত্রে পরিচিত মুখ। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই আউটস্ট্যান্ডিং ছাত্র সঞ্জীবের বিদ্যায়তনিক অধ্যয়ন-পড়াশোনা গানে এবং আন্দোলনে এই সময়টায় ব্যাহত হতে দেখা যায়।
বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট বিভাগের অধীন হবিগঞ্জ জেলায় বানিয়াচং উপজেলার একটা গ্রামে সঞ্জীব চৌধুরীর জন্ম ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজমে গ্র্যাজুয়েশন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই তিনি বামধারায় সাংগঠনিক সংশ্লিষ্ট তরুণযুবাদেরে গান শেখাতেন এবং গণজাগরণী বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের নেতৃত্ব দিতেন গানে কবিতায় বক্তৃতায়। এরশাদফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিবাদী ব্যুলেটিন বেরোত সবখানেই সঞ্জীবের কবিতা থাকত। সবার কাছেই তিনি ছিলেন সঞ্জীবদা ডাকে আদরণীয়। ‘শঙ্খচিল’ নামে একটা ব্যান্ডও ফর্ম করেছিলেন ওইসময়।
মাঝনব্বইয়ের দিকে সঞ্জীব চৌধুরী ও বাপ্পা মজুমদার মিলে ব্যান্ড ‘দলছুট’ গড়ে তোলেন। ১৯৯৬ শেষভাগে দলছুটের ডেব্যু হয় ‘আহ্’ অ্যালবাম রিলিজের মাধ্যমে। দেশের জাতীয় টেলিভিশনে ‘শাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে আউলা বাতাস খেলে’ গানটা টেলিকাস্ট হবার পরে ব্যান্ডের পয়লা অ্যালবামের কাটতি বেড়ে যায় ভীষণভাবে। এরপর দলছুটের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘হৃদয়পুর’ রিলিজ পায় ২০০০ সালে। এইটা ব্যান্ডের সর্বাধিক সাক্সেসফ্যুল অ্যালবাম সাব্যস্ত করা যায় কিছু সূচকের ভিত্তিতে। অবশ্যই কমার্শিয়্যাল সাক্সেস। শৈল্পিক সাক্সেসের মেজার করা ডিফিকাল্ট। দ্বিতীয় অ্যালবামে শাহ আবদুল করিমের ‘গাড়ি চলে না’ গানটা ছাড়াও সঞ্জীবের গলায় ‘আমি তোমাকেই বলে দেবো’ অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপরের অ্যালবাম, দলছুটের থার্ড, ‘আকাশচুরি’ বেরোয় ২০০২ সালে। ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ’ গানটা অ্যালবামের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান সন্দেহহীন। সঞ্জীবের সোলো ‘স্বপ্নবাজি’ বেরোয় ২০০৫ সালে। এরপরে শেষ অ্যালবাম ‘জোছনাবিহার’ বেরোয় ২০০৭ সালে সঞ্জীবের আকস্মিক মৃত্যুর মাসখানেক আগে।
অ্যালবাম এরপরেও সম্ভবত বেরিয়েছে ১/২টা। বাপ্পা মজুমদার ব্যান্ডটাকে এখনও ধরে রেখেছেন নানান লাইনআপে। স্টেজশোগুলা বাপ্পা দলছুটের ব্যানার নিয়া অ্যাপিয়ার করেন দেখতে পাই। কিন্তু দলছুটের সেই স্পার্কটা আর নাই, সেই ধকটা নাই, ছিল যা সঞ্জীবের সময়। স্বাভাবিকই বলা যায়। সঞ্জীব ছিলেন দলছুটের প্রাণ, কথাটা বাপ্পাই স্বীকার করেছেন অকুণ্ঠ অনেক জায়গায়। আরও কিছু কাজে সঞ্জীব চৌধুরীর কন্ট্রিবিউশন ছড়িয়েছিটিয়ে আছে, যেমন এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে অভিনেতা হাসান মাসুদের গোটা বারো গানের একটা অ্যালবাম পুরাটাই সঞ্জীবের কম্পোজিশন। তেমনি ‘ব্যাচেলার’ সিনেমায় সঞ্জীবের সুর ও গলা আমরা পেয়েছি, বিটিভির বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণাগানের বেশকিছুতে সঞ্জীবের কন্ট্রিবিউশন লভ্য।
সঞ্জীব চৌধুরী ছিলেন বামরাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েইট পড়ার সময় থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েইট অধ্যয়নের সময়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সেন্ট্রাল কমিটির কালচারাল সেক্রেটারি ছিলেন। পরিণত বয়সে ক্যারিয়ার করেছিলেন সাংবাদিকতা। জার্নালিজমে উচ্চতর পড়াশোনা করেছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। দেশের আধুনিক সাংবাদিকতায় তার অবদান রয়েছে, এইটা সাংবাদিক মহলের অনেকেই স্বীকার করেন। ‘দৈনিক আজকের কাগজ’ পত্রিকার মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা শুরু হয়। এরপরে ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’ হয় তার কাজের ক্ষেত্র। এইসময় সঞ্জীব হয়ে ওঠেন নতুন ধারার একজন ফিচাররাইটার। ভোরের কাগজের বিনোদনসাপ্তাহিক ‘মেলা’ পাতার বিভাগীয় সম্পাদক সঞ্জীব বিনোদনসাংবাদিকতায় নয়া ট্রেন্ড তৈরি করেন। একই কাগজের ‘ইষ্টিকুটুম’ ও ‘পাঠকফোরাম’ পাতাদ্বয়েরও সম্পাদনায় তিনি নয়া পথের দিশা দেখান। কিছুদিন তিনি ‘যায় যায় দিন’ পত্রিকায় কাজ করেন। পত্রিকার সঙ্গে পাঠকগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সঞ্জীবের স্ট্র্যাটেজি এখনও অব্যর্থ পথিকৃৎ। প্রচুর কর্মশালা চালানোর মাধ্যমে দেশের সাংবাদিকতায় তরুণদের গড়ে তোলার কাজে সঞ্জীবের অবদান অনস্বীকার্য।
সঞ্জীব চৌধুরীর স্ত্রী প্রজ্ঞা নাসরিন শিল্পী। তাদের একটি কন্যাসন্তান কিংবদন্তি।
মাত্র ৪২ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর সঞ্জীব চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। তখন সিডরের আঘাত নিয়ে দেশ তটস্থ ছিল। সঞ্জীব যে-রাতে দেহ রাখলেন সেই রাতে সিডরতাণ্ডব চলছিল সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চলে। ব্রেইন হ্যামারেইজ হয়েছিল সঞ্জীবের। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে দিন-তিনেক থেকে বিদায় নেন বাংলা গানের এই ধূমকেতুমানুষটি। বাংলাদেশের গানের সমুজদারেরা আজও সঞ্জীবকে স্মরণ করেন প্রতিবছর নভেম্বরে এবং ডিসেম্বরে সঞ্জীবের যথাক্রমে মৃত্যু ও জন্মদিনে। দেশের প্রায় প্রত্যেকটা জেলায় সঞ্জীবস্মরণে স্বতঃস্ফূর্ত অনুষ্ঠান হয়। এতেই শিল্পীর প্রভাব প্রতীয়মান হয় কতটা ব্যাপকতাবিস্তারী। মৃত্যুর একযুগ অতিক্রান্ত হলেও ক্ষণজন্মা এই শিল্পী-সংগীতকারটিকে এদেশের মানুষ ভোলে নাই।
লেখা / মিল্টন মৃধা
… …
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS