বহুশত বছরের পুরানো ধর্মীয় শ্রেণিব্যবস্থা পৃথিবীর এই প্রান্তের হিন্দু সমাজে দারুণভাবে প্রকট। পশ্চিমবঙ্গে যে-কারোর দুর্গাপূজায় পৌরহিত্যের অধিকার আছে। এমনকি মহিলাদেরও। শুধু পূজার বিধিসংশ্লিষ্ট জ্ঞান সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে হবে। ধর্মীয় শ্রেণিব্যবস্থার এই বিচিত্র নিয়মে আমরা বাইরে, আর আমার ব্রাহ্মণ বন্ধুরা অনায়াসেই মন্দিরের ভিতরে ঢোকার ছাড়পত্র পেত! বড়দের ফাঁকি দিয়ে ফল-প্রসাদ নিতে হলে তাদের অনুরোধ, প্রতিশ্রুতি, তোষামোদি সহ অনেককিছুই করতে হতো। এখনকার দিনে ঠাকুরঘরে অব্রাহ্মণদের আটকানো না গেলেও প্রসাদের রান্নাঘরে আজো কুলিনদের আধিপত্য। মা নাকি আমাদের হাতে খান না! এটাও পাল্টাবে কোনো-একদিন, যেমন পাল্টেছে কলকাতায়।
এত অমিলের পরও সব মিল হয়ে যায় সন্ধ্যার আরতিতে। ঢাক-ঢোল-ধোপ-ধোয়া-শঙ্খ সমেত মায়ের উদ্দেশ্যে বিশেষ নাচ! সব মিলিয়ে যে-মোহ সৃষ্টি হয়, তা যাদু ছড়ায় সবখানে। অপার্থিব আনন্দে মন ভেসে যেতে চায় আর তার জন্যই এত অপেক্ষা, এত শ্রম।
দিন যায় দিনের নিয়মে তবু দশমী আসলে বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয় মাত্রই তো শুরু হলো! নিয়ম ভাঙার শত চেষ্টা করি কিন্তু শেষমেশ নিয়মেই থাকি। শুরু হয় ভাসানপর্ব। বিসর্জনের আগে কলাবউ বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়ে আনা হয়। বাড়ির লোকেরা ঘরের কন্যা দুর্গাকে কলাবউয়ের মাধ্যমে বিদায় জানায় ধান-দূর্বা সমেত। কলাগাছ দিয়ে সাজানো কলাবউ মাদুর্গার পরিবারের একজন রূপক সদস্য। যিনি প্রকৃতি অংশ। পুরো দুর্গাপূজায় যিনি সবার নজরের বাইরে, তিনিই শেষবেলায় কলাবউ থেকে প্রতিমা হয়ে ওঠেন। প্রতিমা পাড়া ঘুরে আবার মন্দিরে আসলে বিসর্জনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ট্রাকে, ভ্যানে মূর্তি সহ শোভাযাত্রা করে নদী বা পুকুরে বিসর্জনপর্ব শেষ হয়। বিসর্জনের আগে সিঁদুর খেলা, রং খেলা পরে কাদা দিয়ে মাটি পিচ্ছিল করে নারকেলের জন্য কুস্তি ইত্যাদি ভাসানের অন্যতম অনুসঙ্গ। ভাসানের পর জল-কাদা-রঙ গায়ে মেখে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেফিরে নেচেগেয়ে নগরকীর্তন, এ যেন উৎসবের শেষ আনন্দটুকুও শুষে নেওয়ার চেষ্টা।
রাতে বিদায়ী প্রার্থনাতে আবার মিলিত হই অদ্ভুত চেহারায়। ভাসানে রঙ ও দীর্ঘ ক্লান্তি লম্বা স্নানসাবানেও ধোয়া যায়নি। প্রার্থনা পরবর্তী শান্তিজল ও শান্তিবন্ধন গ্রহণ শেষে প্রণাম ও আলিঙ্গন। অনেকটা ঈদের নামাজের পর কোলাকুলির মতো। মিল খুঁজলে অনেক মিল, অমিল খুঁজলেও তা-ই। প্রশ্ন হলো আমি খুঁজব কী — মিল, না অমিল?
পূজা আসবে মূর্তি ভাঙা হবে, আমরা প্রতিবাদ করব, পূজা করব। আবার ভাঙা হবে, আবার প্রতি… চলবে। তারপরেও আমরা এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করব, আয়োজনে ঘাম ঝরাব, প্রতিবাদে প্রতিরোধে ভাঙা মূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে যাব। এ উৎসবে ধর্ম আর সংস্কৃতি যে মিলেমিশে একাকার!
নবমীর ভাবনা
মনোজ দাস রচনারাশি
গানপারে দুর্গাপূজা
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS