সুনামগঞ্জ থেকে ফেরার পথে বিরতিহীন বাসের খিড়কি দিয়ে রাস্তাপাশে-বসা বাজারের একজন মাছবিক্রেতার থালের দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠতে হলো। চমকটা আর-কোনো কারণে নয়, অনেক-অনেক-অনেকদিন পর প্রায়-গল্প-হয়ে-ওঠা একজাতের মাছ দেখে এই হৃদচঞ্চলতা আচমকা।
মাছটাকে আমরা বলি রানীমাছ। রয়েল-বেঙ্গল-টাইগারের ন্যায় ডোরাকাটা মাছ। সাইজে তা-বলে ব্যাঘ্রসদৃশ নয়, একেবারেই ছোট, এই ধরা যাক মাঝারি ট্যাংরার মতন অনেকটা। বা অনেকটা ওরকমই, কিংবা বাংলালিংক ফোনকোম্প্যানির থিম্যাটিক লোগো-ব্যাকগ্রাউন্ডের মতোই, ঠিক বুঝাইতে পারতেসি না আপনাদেরে এর গায়ের রং বা স্বাস্থ্যের ধরনধারনটা। কার্পুমাছের মতো সোনাবর্ণা গাত্রে ছাইরঙা ডোরা।
রানীমাছ কেন বলত লোকে? আগের দিনের সিনেমায় দেখা যাবে রানী বা জঙ্গলরাজের মহীষী বা ডাকু নারীরা একধরন বাঘছালে-বানানো পরিচ্ছদ অঙ্গে পেঁচিয়ে আছেন, তাতে যেমন খোলতাই হতো তাদের শরীরী রূপ, তেমনি ফুটে উঠত চরিত্রের দার্ঢ্য ও আভিজাত্য। এই মাছটাও তেমনি। ছোট আকারের হলে কী হবে, নয়ননন্দন রূপশোভা তার। প্রায় দেড়যুগ বাদে দেখলাম রানীমাছের মুখ।
ভরা-চাঙারি মাছ নিয়ে বসে আছে বিক্রেতা। অধুনা লুপ্ত হলেও আমাদের ছেলেবেলায় এই মাছ পাওয়া যাইত অঢেল। এমনকি কিনতেও হতো না আলাদাভাবে, বরং কেনা মাছের সঙ্গে এক্সট্রা কিছু খুচরো গুড়াগাড়া মাছ দিত বিক্রেতা, ফাও হিসেবে পাওয়া যেত মাঝেমধ্যে এই রানীমৎস্য। তেমনি পাওয়া যেত চান্দুমাছ, এই মাছটিও আজকাল আর ওষুধের জন্যও খুঁজে পাওয়া ভার। বিরলদৃশ্য হয়ে উঠেছে একই বিত্তশ্রেণির কাকিয়া বা কাইক্ক্যা, আর পটকামাছ না-খেলেও থলে আনলোড করার সময় মা-চাচিকে দেখেছি একগাদা পেটফোলা পটকা বিরক্তগজগজ মেজাজে বেছে আলাদা করছেন। সচরাচর পটকা আমরা বালকবালিকারা ঠুশঠুশ ফুটাতাম অথবা বাড়িতে-কাজ-করতেন-যিনি সেই রাশিদার-মা তার বাসায় নিয়ে যেতেন। ওরা অন্য অঞ্চলের লোক, ওরা পটকামাছ খেতেন, অনেক প্ররোচিত করতেন রাশিদার-মা আমার আম্মা-চাচিকে পটকা খাওনের জন্য। খুব নাকি জিভরোচক খেতে!

সে-যাকগে, কেনা তো হতোই সিজনে, রানীমাছ, এমনকি দিব্যি একপদ আলাদা তরকারি হয়ে যেত ফাও-হিসেবে-পাওয়া রানীমাছে। বড়ি বানিয়ে — এর আগে অবশ্য শিলনোড়ায় পিষেবেটে নিতে হতো মিহিমতো — ঝোলতরকারি রান্না হতো চান্দুমাছের, খাসা স্বোয়াদ! রানীরও সোনালি সুরুয়া হতো মোস্ট-অফ-দি-টাইম, অনুভব করা যায় কিন্তু দেখা যায় না এমন সুচতীক্ষ্ণ ঝাল সহযোগে, কদাচ আমসত্ব তথা আমশি দিয়ে চোকা বা যাকে বলে ট্যাঙ্গা — সিলেটিরা টক স্বাদের কোনোকিছুকে বলে চোকা বা ট্যাঙ্গা।
হায়! এতকিছু কোন ফাঁকে যে গেল হারিয়ে! এত মাছ এত গাছ এত পাখি এত বাতাস এত খোলামেলা জলপ্রান্তরঘাসজমি… কোথায় যে গেল এরা! হারিয়ে তো যায় বুঝলাম, হারিয়ে যায়টা কই? ফিরবে না আবার একবার? ফিরিবে না এ-জীবনে আর, একটিবার! ফিরে কি আসে না তারা, হারায়া যায় যারা? নাকি ফিরবে, রানীমাছের মতো? হঠাৎ চমকে দিয়ে দেখা দেবে বাসট্রেনটেম্পোট্যাক্সিবিমানজানালায়!
ফিরবে কি তারা, আমার মৃত আত্মীয়রা? ফিরবে কি দিবাকর, ভাইয়ের মতো বন্ধু আমার, ফিরিবে রূপক? একবার, আহা, একবার শুধু ফের, এই রানীমাছের মতো ওরা এসে দেখা দিয়ে চলে যাক আড়ালে আবার।
— জাহেদ আহমদ / এপ্রিল ১৪, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ
- আমাদের গ্রামের নাম আমাদের নদীর || কাজল দাস - November 19, 2025
- লোককবি মনির নূরী ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 19, 2025
- উপন্যাসে শহুরে জীবনের ক্লান্তি ও বিপন্নতার বোধ || হারুন আহমেদ - November 16, 2025

COMMENTS