সুচের ফোঁড়ে নকশিকাঁথা || সুমনকুমার দাশ

সুচের ফোঁড়ে নকশিকাঁথা || সুমনকুমার দাশ

বৈশাখ পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠ। এরপর আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস মিলে বর্ষাকাল। তবে ঋতুচক্রের এ নিয়মের আগেই এখন বৈশাখের শেষ সময়ে কিংবা জ্যৈষ্ঠের শুরুতেই পানিতে থইথই করতে থাকে হাওরাঞ্চল। বর্ষায় হাওরাঞ্চলের গ্রামীণ নারীদের কোনও কাজ থাকে না। অনেকটা অলস সময় কাটান। সে সময়টাতে পাড়াপড়শি মিলে সুই-সুতা নিয়ে বসে পড়েন নকশিকাঁথা তৈরি করতে। সুচের ফোঁড়ে দুধসাদা কাপড়ে প্রস্তুতকৃত কাঁথায় তোলেন ঠাকুমা-দিদিমাদের কাছ থেকে ঐতিহ্য-পরম্পরায় শেখা অভিনব ও দর্শনীয় কারুকাজ। এভাবেই নকশিকাঁথার বিকাশ। কেবল হাওর এলাকা নয়, দেশের অন্য অঞ্চলের গ্রামীণ নারীদের এখনও অবসর সময়টুকু নকশিকাঁথা সেলাই করেই কেটে যায়।

নকশিকাঁথার ঐতিহ্য কতটা প্রাচীন তা নিশ্চিত না হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলমান সংস্কৃতিতে এখনও বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। পল্লিকবি জসীমউদ্দীন তাঁর ‘ধানখেত’ কাব্যগ্রন্থে ‘পল্লীবর্ষা’ শীর্ষক কবিতায় যথার্থই লিখেছেন — ‘কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপন খানি, / তারে ভাষা দেয় দীঘল সুতার মায়াবী আখর টানি।’ পরম মমতায় ঐতিহ্যকে এখনও আগলে ধরে রয়েছেন অক্ষরজ্ঞানহীন স্বশিক্ষিত গ্রামীণ নারীরা। তাঁরা কেবল চোখের ঠাহরে এবড়ো-খেবড়ো অক্ষরে ভুল বানানে কাঁথায় লিখে ফেলছেন মনের সব অব্যক্ত কথা। লোকশিল্পের এ বড় অদ্ভুত বিকাশ!

ভেতরে পুরোনো-ছেঁড়া শাড়ি আর ওপরে শক্ত-ভালোগোছের কাপড়ের কয়েক ফেরতা দিয়ে স্তর সাজিয়ে সেলাই করে কাঁথা তৈরি করা হয়। সুচের অসামান্য শিল্পশৈলীতে কাঁথা হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের প্রতীক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রাবন্ধিক লীনা চাকী তাঁর ‘আরশিনগর’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শুরুর কোনও ইতিহাস নেই, কিন্তু কাঁথা ছড়িয়ে আছে দুই বাংলা জুড়ে। ক্রমে তার সঙ্গে জুড়ে গেছে মহিলাদের উজাড়-করে-দেওয়া আহ্লাদ। একটা দেখনসই কাঁথা সেই পরিবারের মহিলাদের অহংকার। বেপাড়ার মানুষ তাকে দেখতে আসত। পাত্রপক্ষের সামনে কন্যার সুচিশিল্পের নমুনা বিয়ে উতরে দিত।’

গ্রামীণ নারীদের সুই-সুতার সমন্বয়ে মোহনীয় কারুকাজের নকশিকাঁথা লোকজ শিল্প হিসেবে সুপরিচিত। ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যময় আচারগত সংস্কৃতিতে এই শিল্পের মূল্যবান ঐতিহ্য ও প্রাণবন্ত বিকাশ অনন্য মাত্রায় উদ্ভাসিত। নকশিকাঁথায় সুচের ফোঁড়ে নারীরা সচরাচর গাছপালা, জীবজন্তু ও প্রবাদ-প্রবচন সহ ধর্মীয় দেবদেবীর নকশা করে থাকেন। রাধাকৃষ্ণ, লাঙল-জোয়াল কাঁধে কৃষক, নৃত্যরত রমণী ও প্রেমরত নারী-পুরুষ নকশিকাঁথার অন্যতম চরিত্র। এর বাইরে বাঘ, সিংহ, হরিণ, হাতি, মাছ, হাঁস, ময়ূরও নানা রঙের সুতায় নিপুণ দক্ষতায় নকশার বাহারি উপস্থাপনা দেখা যায়।

নকশিকাঁথায় জীবজন্তু ও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির পাশাপাশি রাজপরিবার ও দরবারের চিত্র স্থান পায়। ধর্মীয় কাহিনির মধ্যে মুসলমানের কারবালার বিষাদঘন প্রান্তর এবং হিন্দুর দেবদেবীর চিত্র সুচের ফোঁড়ে ফুটিয়ে তোলেন। গ্রামীণ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার একটা পরিচয়ও নকশিকাঁথায় পাওয়া যায়। নকশিকাঁথা ছাড়া তাঁরা বালিশ ও চেয়ারের কভার, কুশন, টেবিলঢাকনি, রুমাল, কাপড়ের পাখা এবং শার্ট, পাঞ্জাবি ও শাড়িতে সুই-সুতায় নিজেদের নিপুণ দক্ষতার পরিচয় রাখছেন। কিশোরগঞ্জের লোকসংগ্রাহক মোহাম্মদ সাইদুর তো এসব নকশিকাঁথা সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন।

‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ গ্রন্থে গবেষক গোলাম মুরশিদ নকশিকাঁথা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আগে এই কাঁথা তৈরি করতেন গ্রামের মহিলারা — মনের আনন্দে, সৃজনশীলতার টানে। কিন্তু এখন শহরের লোকেদের বসার ঘর সাজানোর জন্যে এ কাঁথা ব্যবহৃত হয় বলে নকশিকাঁথা একটা বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। যাতে দ্রুত তা তৈরি করা যায় এবং যাতে তা দেখতেও আকর্ষণীয় হয়, তার জন্যে এখন কাঁথার উপকরণ এবং সেলাই করার সুতো — উভয়ই বদলে গেছে। যেহেতু নকশা করার পারদর্শিতা সবার নেই, সেজন্যে নকশা করার জন্যে বিশেষজ্ঞও আছেন। অর্থাৎ আগে নকশিকাঁথায় সাধারণ মহিলাদের যে-স্বতঃস্ফূর্ত সৃজনশীলতা লক্ষ করা যেত, এখন তা হারিয়ে গেছে।’

বিশ্বায়নের বদৌলতে ক্রমাগত বদলাচ্ছে সমাজ ও সভ্যতা। সেই বদলে যাওয়ার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামীণ পরিমণ্ডলেও। একেবারেই যে বদলে যাচ্ছে, তাও কিন্তু নয়। এখনও পরম মমতায় মা তাঁর সদ্যজাত শিশুর জন্য সেলাই করছেন নকশিকাঁথা। এখনও পল্লিবধূ সুচের ফোঁড়ে জীবনের প্রথম প্রেমকে মনে রেখে না-বলা কথাগুলো সুই-সুতাবদ্ধ করছেন। নকশিকাঁথার পরতে পরতে লিখছেন — ‘ভুলো না আমায়’, ‘মায়ের দোয়া’, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এবং ‘ভালোবাসি তোমায়’ শব্দবদ্ধগুলো।

পল্লিকবি জসীমউদ্দীন তো সে-রকম এক কাহিনি নিয়েই লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যটি। কাহিনির নায়ক রূপাই আর নায়িকা সাজুর জীবনের বিয়োগান্তক কাহিনিই গ্রন্থটির বিষয়বস্তু। গ্রাম্য কোন্দলের জের ধরে রূপাই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর নিজ জীবনের কাহিনি নকশিকাঁথায় সুইয়ের ফোঁড়ে লিখতে থাকেন রোগে-আক্রান্ত সাজু। যেদিন তাঁর নকশিকাঁথা সেলাই শেষ হয়, ওইদিনই সাজু মারা যান। মারা যাওয়ার আগে সাজু প্রতিবেশীদের বলে যান — তাঁর সেলাইকৃত নকশিকাঁথাটি যেন কবরের ওপর রেখে দেওয়া হয়। জসীমউদ্দীন তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন — ‘আঁকিল কাঁথায়, আলুথালু বেশে চাহিয়া কৃষাণ নারী, / দেখিছে — তাহার স্বামী তারে জনমের মত ছাড়ি।’

বর্তমানে নকশিকাঁথা বাণিজ্যিকভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে। গ্রামীণ শৌখিন নারীদের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমে আসছে। শহুরে সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে অনেকেই কাঁথা তৈরিতে বিমুখ হয়ে পড়ছেন। তবে নীরবে-নিভৃতে হাওরের বিভিন্ন গ্রামে এখনও সুচের ফোঁড়ে গ্রামীণ অশিক্ষিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী কাঁথার ঐতিহ্য আগলে ধরে রেখেছেন। কোনও আত্মীয় কিংবা অতিথিরা সেই বাড়িতে হাজির হলে রাতের বেলা শরীরে ওম পেতে বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা নকশায় সমৃদ্ধ কাঁথাটি পরম মমতায় তাঁদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। সেই নারীদের কল্যাণে নকশিকাঁথা এখনও বাঙালির লোকশিল্পের প্রাণময়তার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you