কোথায় সেই খেলনা ঘোড়া, মাটির পাখি, নষ্ট ঘড়ি, সাপ?
বুকের ভেতর একলা পাখি; সেই পাখিটার ঘুম। একটা পাখি চক্রাকারে ওড়ে …
এ যেন এক স্বপ্ন। স্বপ্নে এক ঘোরলাগা ছবি। জ্বলতে-থাকা নিঃসঙ্গ টেবিলল্যাম্প।
“নেভা নেভা আলো, যতবার জ্বালো
ঝড়ো হাওয়া লেগে তার শিখা নিভে যাবে
যত দূরে, দূরে, দূরে যাবে বন্ধু!”
হয়তো এই গানটিই সারারাত জাগিয়ে রেখেছিল। হাওয়া বইছিল তখন। ধাক্কা মারছিল জানলার কাচে। দুর্বল-হয়ে-পড়া সাইক্লোন শেষবারের মতো পাড়ি দিচ্ছিল লন্ডনের আকাশ। তখন হয়তো কোনও-এক অনুষঙ্গে গত ফেব্রুয়ারির শেষ রাতটির কথা আমার মনে পড়ে যাবে, যেদিন জানলার কাছে সন্তর্পণে তুষার ঝরছিল।
গান কিংবা নস্টালজিয়াই হয়তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। সে-রাতে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে, কিংবা নির্ঘুম থাকতে চেয়ে শুনছিলাম মহীনের ঘোড়াগুলি কিংবা কবীর সুমন, ইউটিউবে। পাগলা হাওয়া বলছিল নাশপাতি ও আঙুরলতার কথা।
মেঘদলের ‘এসো আমার শহরে’ গানের কথার মতো ‘পৃথিবীর বিষণ্ণ ধুলোয়’ মিশে গেলেন রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু। শিল্পীর জীবনাবসান হলো। ফেইসবুকে বন্ধুদের শেয়ার-করা লিঙ্কগুলো দেখতে দেখতে তাঁর কিছু গানের কথা মনে পড়ছিল, গত এক দশক ধরে যে-গানগুলো আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। তার গানের পথ ধরে একা হেঁটে গেছি আমার ফেলে-আসা স্টেশনে, টার্মিনালে, হাসপাতালে, চৌরাস্তায়, চৌহাট্টায়, আম্বরখানায়, মনে মনে; কুন্ডেরাকথিত ‘বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই’ করতে করতে। আজ মৃত্যুদিনে কিছু গান যেন বেদনা হয়ে বুকের গভীর থেকে নেমে আসছিল। গানগুলি টুকরো টুকরো স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। কত কত মুখ, কত মুখের আশ্চর্য বেদনা।
মনে পড়ছিল, ‘স্বপ্ন’ অ্যালবামটির কথা; যার একটি গান আমার খুবই প্রিয় হতে পেরেছিল —
“জনপদ এখন ঘুমিয়ে পড়েছে, বাতাসে তোমার স্মৃতি
আকাশে আমার বেদনা জমেছে যেটুকু লুকিয়ে রাখি
দুঃখিনী এই রাতে হায়, বিষাদ ছুঁয়েছে আমায়”
যে-অনন্ত বিষাদকে তিনি গানে গানে গেয়েছেন, আমরা অনেকেই হয়তো সেই বিষাদকে যাপন করি, একা একা; করি বলেই তাঁর কয়েকটি গান আমরা বহুদিন গেয়ে যাব।
“পাখিরা কাঁদে সন্ধাতারা ডুবে গেলে”, কিংবা — “পরিত্যক্ত ডায়রিতে পড়ে আছে একশটা গান, যেন ধুলোমাখা টেবিলে বিষণ্ণ খেয়ালে একশটা রাত্রি, একশটা স্বপ্ন’ — এই গানগুলিও তেমন। আমাদের শুধু বিষণ্ণ করে। আক্রান্ত করে। খোলা জানালা দিয়ে তারাভরা আকাশ দেখতে বাধ্য করে।
‘ফেরারী মন’ আনপ্লাগড অ্যালবামটির কথা মনে পড়ছে। গানগুলোয় গিটার-বেহালার মিলনে সুরের যে ঘোরলাগা মূর্ছনা তৈরি হয়েছিল, তা তুলনাহীন। এলআরবির গানের যারা সত্যিকার শ্রোতা, তাদের পক্ষে আনপ্লাগড ‘ফেরারী মন’ সংকলনের গানগুলির কথা ভুলে যাওয়া অসম্ভব। যা-কিছু সুর আমাদের বুকের ভেতরে থাকে, হয়তো মাটির ভেতরেও, জন্ম-জন্মান্তরের সেই সুর কেউ কেউ বেহালায়-গিটারে প্রকাশ করেন, যারা শিল্পী, ‘ফেরারী মন’-এর সেই গানটি, “শেষ চিঠি কেন এমন চিঠি হয়” বহুদিন পরও শুনতে ভালো লাগে, গানটি যেন কোনোভাবেই পুরনো হয় না। টুটুল গেয়েছিলেন গানটি। ‘ফেরারী মন’-এর “এখন অনেক রাত”, “রূপালি গিটার”, “চল বদলে যাই”-এর পাশাপাশি “বাংলাদেশ”, “মাধবী”, “পেনশন”, “গতকাল রাতে”, “স্মৃতি নিয়ে” এবং “ফেরারী মন” আমাদের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার অংশ।
এই লেখাটি লিখতে লিখতে তারকোভস্কির ‘নস্টালজিয়া’ ছবির কিছু সংলাপ মনে পড়ছিল —
We must go back to the origins of life without mudding the water
What kind of a world is this …
if it is a madman who tells you:
be ashamed of yourselves!
And now, music! …
We must go back to the origins of life without mudding the water …
কিন্তু ঠিক কীভাবে পৌঁছব জীবনের উৎসভূমিতে? বুড়ো আন্দ্রেই কি সত্যিকার উন্মাদ? ভাবতে পারি না।
আমি আর মায়ের মাঝখানে আজ কয়েকহাজার মাইলের দূরত্ব। মা। উৎসভূমি গো। জন্ম দিতে গিয়ে নিকষ কালোরাত্রি তোমার চিৎকারে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছিল … আজ, উত্তাল তরঙ্গ পেরিয়ে ভূমি থেকে ভূমিতে ছুটে চলেছে শরণার্থীর দল। মা, এই দেখো, আজ নতজানু, জন্মদুয়ারের কাছে। তোমার পবিত্র রক্তে আমার পুনর্জন্ম হোক।
কালো আলখাল্লায় মুখ ঢেকে মৃত্যু শুধু আলো নেভায়, আলো জ্বালায়। দাবার ঘুঁটিগুলি; রাজা, মন্ত্রী, হাতি, ঘোড়া, নৌকো … এককোণে সব এলোমেলো পড়ে আছে। এসো দূত, করুণাময় ঈশ্বরের কথা বলো। বলো আমাদের হৃদয়ের শূন্যতা হলো আয়না। কিন্তু ঈশ্বর তো আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। নীরব থাকেন। অন্ধকারে থাকেন। আন্তোনিয়াস ব্লখ, তোমার জন্য ম্যাগনোলিয়া, ক্রিসেন্থিমাম। তোমার হারিয়ে-যাওয়া ঘড়িটি খুঁজে পেয়েছ? মৃত্যু এসেছে দাবা খেলতে। প্রস্তুত থাকো। দেখো, নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি কেমন ছড়িয়ে পড়ছি শব্দরাশির ওপর!
কত অদ্ভুতভাবেই-না বেঁচে থাকি আমরা একেকটি জায়গায়; পুরোনো শ্যাওলা, ঝুলকালি, মাকড়শার জাল, ছেঁড়া ফটোগ্রাফ; ভাঙাপুতুল, থ্যাঁতলানো ফুল; কোথাও কোনও গাছের পাতায় শত বছরের ছাপ, কোথাও প্রাগৈতিহাসিক পাথর, কোথাও গন্ধরাজ, কোথাও উইনচেস্টার স্ট্রিট, ভায়োলেট অ্যাভিনিউ; কোথাও থাকে এক অদ্ভুত মানুষ যে চোখ বন্ধ করলেই বেজে ওঠে বুকের ভিতরের বেহালা! কোথাও এক নদী, বুকে যার শ্যাওলা ও নুড়ি!
উইনচেস্টার স্ট্রিটে একদল যুবক সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গান গেয়ে ওঠে —
I see trees of green, red roses too
I see them bloom for me and you
And I think to myself what a wonderful world
I see skies of blue and clouds of white
The bright blessed day, the dark sacred night
And I think to myself what a wonderful world
The colors of the rainbow so pretty in the sky
Are also on the faces of people going by
I see friends shaking hands saying how do you do …
অদ্ভুত অন্ধকার এক রাত, স্ট্রিটলাইটগুলি যে-রাতের বুকে মাথা পেতে দিয়েছে। একাকী উইনচেস্টার স্ট্রিট ধরে চুরুট টানতে টানতে হেঁটে আসছেন লুইস আর্মস্ট্রং! বিস্ময়কর রাত তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে …
Yes, I think to myself
What a wonderful world …
গান থেমে গেলে চরাচর নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তখন কান পাতলেও কিছু শোনা যায় না। যেন পৃথিবী গভীর দুঃখে ডুবে গেছে। তখন আমরাই নিঃসঙ্গ! একা মানুষ। তখন আমরা হয়তো ছুটে চলেছি দূরে কোথাও; একটু পরেই নেমে পড়ব এমন এক স্টেশনে, যেখানে হয়তো আমিই একমাত্র আগন্তুক, আর কেউ নেই। হয়তো সে-স্টেশনের নাম ওয়েস্ট ড্রাইটন, হেইজ এন্ড হার্লিংটন, কিংবা ইলিং ব্রডওয়ে। চরাচর নিস্তব্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্ত শহর। ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্ত মানুষ। তখন আমার হয়তো মনে পড়ে যাবে তাঁর একটি গান —
“একদিন ঘুমভাঙা শহরে, মায়াবী সন্ধ্যায়
চাঁদজাগা এক রাতে —
একটি কিশোর ছেলে একাকী স্বপ্ন দেখে
হাসি আর গানে সুখের ছবি আঁকে …”
(ঘুমভাঙা শহরে)
কিন্তু তাঁর বেশিরভাগ গানই তো ভালো লাগেনি। অপচয় মনে হয়েছে। ‘ঘুমন্ত শহরে’ অ্যালবামের গানগুলোই প্রথম শুনেছিলাম। ক্যাসেটের এপাশ-ওপাশ মিলিয়ে ১২টি গান ছিল। ১১টি গানই ভালো লাগেনি। আবার এ-কথাও মনে হয়েছে — একজীবনে বাঁচার জন্য খুব বেশি গানের দরকার হয় না। আর পৃথিবীতে এত সুর এত এত গান! আমার শুধু বাংলা গানেই চলে না, পাখির গানও শুনতে হয়।
ঘুমন্ত শহরের পর বেশকিছু মিক্সড অ্যালবাম বের হয়েছিল। শক্তি। শেষ দেখা। এখনও দু’চোখে বন্যা। স্রোত। ঘৃণা। ক্ষমা। বাজনা। পিয়ানো। মেয়ে। স্টার্স। নীরবতা। দাগ। ওরা ১১ জন। আকাশনীলা। আলোড়ন। মিলেনিয়াম। ধুন। অপরিচিতা। নেই তুমি। দেয়াল। কেউ সুখী নয়। ‘শক্তি’ অ্যালবামটিতে তাঁর “পালাতে চাই” নামে একটি গান ছিল। তখনও ভালো লাগেনি, কখনও ভালো লাগেনি। কিন্তু জেমসের গাওয়া গানটি মনে গেঁথে যায় ঠিকই, গানটি এতদিন পরও শুনতে ইচ্ছে করে —
“এই শহরের কত শত অট্টালিকার ফাঁকে
আমার জানালা ভরে ছবি হয়ে ঝুলছে আকাশ
আমি আর একফালি নিষ্পাপ চাঁদ
সারারাত কথা বলে হয়েছি উদাস …”
প্রথম যেদিন সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনি, জীবনে প্রবল এক বদল আসে; শ্রীমঙ্গল থেকে কিনে আনি ‘রোদ্দুরের গান’। বুকের ভেতর থেকে বের-হয়ে-আসা কথাই যেন গানে গানে গেয়ে গেলেন সুমন। গানের অদ্ভুত নেশা ধরে গেল। এমন গানও হয়! রোদের গান, ক্লান্ত প্রজাপতি, পটে আঁকা শান্ত নদী, আর রেডিওতে হঠাৎ একটা পুরনো গান!
ততদিনে সুমনে সমর্পিত হয়েছি; ততদিনে আমিও বদলে গেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। বুকের ভেতর গানের যে মায়া নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলাম, সেই মায়াও ভেতরে ভেতরে দিনে দিনে শিকড় ছড়িয়েছে।
আশিকুজ্জামান টুলুর সুর ও সংগীতে, ‘স্টার্স’ মিক্সড অ্যালবামে, আর্ক ব্যান্ডের হাসানের কণ্ঠে —
“ভুলে গেছি কবে, এক জোছনারাতে
আধো আলোতে আর আঁধারে,
[…]
তুমি আমার সুরে সুরে,
আছো হৃদ’ জুড়ে; …”
কিংবা, ‘ধুন’ অ্যালবামের —
“দূরে বহুদূরে গাঙচিল
উড়ে উড়ে কাকে খুঁজে বেড়ায়?
অসীম শূন্যতায় যেখানে আকাশ নীল” …
বিদেশী গানের নকল কিংবা অনুবাদ যা-ই হোক, ভালো লেগে গেল। দিনেরাতে শুনছি। তখন দলছুটের গানগুলিও হাতে এল। ক্যাসেটে। সুমন তো চিরসঙ্গী। পেয়ে গেছি কফিল আহমেদের ‘পাখির ডানায় দারুণ শক্তি গরুর চোখে মায়া’, মৌসুমী ভৌমিকের ‘স্বপ্ন দেখব বলে’, বাংলা ব্যান্ডের ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’।
চাইম ব্যান্ডের খালিদের গানটিও কখন জানি মাঝে মাঝে শুনতে ইচ্ছা করে —
“তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা
আমি তোমাকে গড়ি ভেঙেচুরে শতবার
রয়েছ তুমি বহুদুরে
আমাকে রেখে ছলনায়
এ হৃদয় ভেঙে গেলে জানো কি তা
লাগে না লাগে না জোড়া …”
রেনেসাঁর একটি গানের কথা উল্লেখ করতেই হবে —
“শুকনো মাঠে ফুল ফোটানো
সারাবেলার খেলা
শূন্যতার মাঝে গড়ি
বিনিসুতোর মালা
বুকের মাঝে ভালোবাসা
থাকবে জীবনময় —
হৃদয়, কাদামাটির কোনও মূর্তি নয়” …
সোলস-এর কয়েকটি গানও তখন খুব ভালো লেগে যায়, তাদের একটি —
“ঝিনুক-শামুকে ভরা বালুচরে
ঢেউয়ের সাথে নেচেছি
রঙিন স্বপ্নে গাঁথা স্মৃতির মালা
সৈকতে ফেলে এসেছি।
ওরে ছুটে চল্ ফিরে সেই সাগরতীরে
ওরে খুঁজে নেই চলো ফেলে-আসা মুক্তো-হীরে।”
দ্বিতীয় গানটি —
“চোখেরই দৃষ্টি যেন মনেরই গীতিকবিতা
বুকের ভালোবাসা যেথায় রয়েছে গাঁথা
আমি তো সেই কবিতা পড়েছি
মনে মনে সুর দিয়েছি
কেউ জানে না”
সোলস-এর তৃতীয় যে-গানটি আমাদের প্রজন্মকে আক্রান্ত করতে পেরেছিল, তার শিরোনাম — ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’।
চাইম ব্যান্ডের কিছু গানও তখন ঘুরেফিরে শুনছি, বিশেষ করে ‘কীর্তনখোলা’ —
“এই নদীতে সাঁতার কাইটা বড় হইসি আমি,
এই নদীতে আমার মায়ে কলসিত নিসে পানি
আমার দিদিমা আইসা প্রতিদিন ভোরে
থাল-বাটি ধুইয়া গেছে এই নদীর কিনারে —
দশ বছর পর বিদেশ থনে ফিরা আইসা দেহি
হগলই বদলাইয়া গেছে, নদী আমার যেমন ছিল তেমনই আছে!”
বড় বেশি নস্টালজিক করে ফেলে এই গান। দূর প্রবাসে বসে, অবিরাম কাজের ক্লান্তিতে যখন আমাদের মন ফেলে-আসা দেশের কথা ভাবে, তখন এই গানগুলো বড় বেশি আশ্রয় দেয়।
জেমস্ এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আমাদের জীবনে তার একক এবং তার ব্যান্ডদল ফিলিংস-এর ভূমিকা ব্যাপক। ‘নগরবাউল’ অ্যালবামের বেশ কয়েকখানি গান আমাদের উল্লসিত করেছে, শূন্যতা ভরিয়ে দিয়েছে, মুখর করেছে। “মান্নান মিয়ার তিতাশ মলম”, “হারাগাছের নূরজাহান”, “তারায় তারায়”, “আমি এক নগরবাউল”, “যাত্রা”, “তবে বন্ধু নৌকা ভিড়াও” — এই গানগুলো ভুলবার নয়। “তারায় তারায়”, আর “নগরবাউল” — এই গানগুলি তো বাংলাদেশের ব্যান্ডগানের ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। তারপর, ‘লেইস ফিতা লেইস’। এই অ্যালবামেও মনে রাখবার মতো কয়েকটি গান ছিল, বিশেষ করে “পথের বাপই বাপ রে মনা পথের মা-ই মা” আর “সিনায় সিনায় লাগে টান” গানদুটি যুগসৃষ্টিকারী; “সেলাই দিদিমণি” আর “নাগর আলি” গানদুটিও অসাধারণ।
‘শেষ দেখা’ অ্যালবামে পাওয়া গেল অসাধারণ একটি গান। গানটি তুমুল আলোড়িত করল। গানটি, জেমসের গাওয়া, ‘এই গানই শেষ গান’ —
“নীরবে অভিমানে নিভৃতে
করছ তিলে তিলে নিজেকে শেষ,
কেন বলো পৃথিবীতে কেউ কারো নয়
হয়ে গেছে ভালোবাসা নিঃশেষ।
বন্ধু ভেঙে ফেলো এই কারাগার
খুলে দাও সে-হৃদয় প্রণয়ের দ্বার
হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা
হতেও পারে এই গানই শেষ গান”
‘শেষ দেখা’-য় এলআরবির ‘শেষ দেখা’ গানটি আমাকে স্পর্শ করেনি, কিন্তু এই গানের —
“ছিঁড়ে গেছে গিটারের তার
বাজবে না সুর তাতে আর
আমার সমাধির ’পর
আমি চাই না তোমার উপহার” —
কথাগুলি ক্যাম্পাসজীবনে বারবার গেয়েছি, সিগারেটে তীব্র টান দিতে দিতে, বহু যুবককে গাইতেও শুনেছি।
‘এখনও দু-চোখে বন্যা’ অ্যালবামে জেমসের গাওয়া ‘মা’ গানটি তো কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। মার সঙ্গে অ্যালবামে হাসানের ‘প্রশ্ন’, খালিদের ‘কোনো কারণেই’ গানদুটিও ভালো লেগেছিল।
কিন্তু বাচ্চু যেন ততদিনে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছেন। তাকে ম্রিয়মাণ লাগছে। তার গান ভালো লাগছে না। গান হচ্ছে না। একের পর এক ফালতু গান তার ভাণ্ডারে জমা পড়ছে, অথচ জীবনভর মিউজিকে ব্যস্ত থাকছেন!
‘ক্যাপসুল ৫০০ এমজি’ নামে একটি অ্যালবাম কিনেছিলাম, একপিঠে এলআরবি, অন্যপিঠে নগরবাউল (তৎকালীন ফিলিংস); সেই সংকলনের ‘নীল বেদনায়’ (নীল বেদনায় ঘিরে রয়েছে আমায় / দূর অতীতের স্বপ্নগুলি কাঁদায়) নামে একটি গান ছিল। বহুবার শুনেছি এই গান। বহুবার নিজেকে ফিরে পেতে চেয়েছি। ‘নীল বেদনা’ ঠিক যেন গান নয়, গানের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে হারানো সময়কে অনুভব করতে চাওয়ার মতো একটাকিছু ঘটতে থাকত ভেতরে ভেতরে। এখনও কি লন্ডনের পিক্যাডেলি সার্কাস কিংবা ওয়াটারলুর ভিড়ে হঠাৎ চিৎকার করে গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে না, এই গানটি? করে তো।
ক্যাপসুলের পর বের হলো ‘স্ক্রুড্রাইভার্স’; এ-অ্যালবামের সাইড এ-র এলআরবির গাওয়া কয়টা গান মনে থেকেছে? ভালো লেগেছে? আমি দুম করে বলে দেবো — একটিও না; বরং জেমসের গানগুলিই অসাধারণ হয়েছে। ‘বাংলার লাঠিয়াল’, ‘মধ্যরাতের ডাকপিয়ন’, ‘যে পথে পথিক নেই’, ‘বেদুইন’, ‘ব্যাবিলন’ শিরোনামের গানগুলোর কথা কীভাবে ভোলা যায়! ফিরে শুনতে ইচ্ছে হয়েছে। এখন আবার সেই গানের কাছে ফিরতে পারলে ভালো হতো —
“একগ্লাস জোছনা আর একগ্লাস অন্ধকার হাতে,
যে পথে পথিক নেই, বসে আছি সেই পথে” …
‘ক্যাপসুল ৫০০ এমজি’-র ‘হাসতে দেখো’ গানটি মোটামুটি। ভেবে দেখেছি, বাচ্চুর অনেকখানিই আমার ভালো লাগেনি। তার গিটার কতটা গ্রেট তাও বুঝিনি, উলটো বিরক্ত হয়েছি। বিপুল আবর্জনা দেখে এক সময় তার গান আর শুনতে চাইনি। আজ ‘জলের গান’ যেভাবে আমাকে সমৃদ্ধ রৌদ্রের অভিজ্ঞতা দেয়, তা তিনি দিতে পারেননি, তার সেই প্রজ্ঞাটি ছিল না হয়তো। কিংবা, মহীনের ঘোড়াদের গানগুলির আমাদের যাপনের অংশ হতে পারার যে ক্ষমতা থাকে, কিংবা ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘ভূমি’ এসব ব্যান্ডদলের, সেখানে এক ‘রূপালি গিটার’ বা ‘ফেরারী মন’ তার কতটা পূরণ করতে পারে? ফিডব্যাকের গানও ভাল লাগেনি কোনোদিন। ব্যাপারটি দুঃখজনক। চেষ্টা করেও পারিনি। মেকী গান মনে হয়েছে। মাইলসের একটিমাত্র গান ভালো লেগেছিল। ‘পিয়াসী মন’। শিরোনামহীনের ‘হয় না এমন তো এমন না’ গানটিকে গানের চেয়েও বেশি কিছু মনে হয়। বারবার শোনার পরও পুরনো হয় না। মেঘদলের গান টানে না। সিরিয়াসনেসের চর্বিতচর্বণ। গানকে শেষ পর্যন্ত গান হতে হবে, গান কখনোই ভার্জিনিয়া উলফের ‘বাতিঘর’ উপন্যাসের পৃষ্ঠা নয় হে মেঘদল।
যে-আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবীর সুমনের একটিমাত্র গান শুনেই কাটিয়ে দিতে পারি, যে-আমি কফিলের প্রতিটি গান শুনে ভেঙে পড়তে পড়তে দাঁড়াবার শক্তি খুঁজে পাই, সেই আমি তো বাচ্চুর গানে আশ্রয় পাই না। কিন্তু এলআরবির ‘ঘুমন্ত শহরে’ গানটি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। হয়তো তখন ভয়াবহ একাকিত্ব এসে গ্রাস করতে চায়। বাসস্টপে শেষ বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সিগারেট জ্বলে ওঠে ঠোঁটে, ধোঁয়া ছেড়ে খুব চিৎকার করে গাইতে ইচ্ছে করে —
“ঘুমন্ত শহরে রূপালি রাতে
স্বপ্নের নীল চাদর বিছিয়ে
কষ্টের শীতল আবরণ জড়িয়ে
আমি আছি আছি তোমার স্মৃতিতে
ভালোবাসার সরল বাঁধন ছিঁড়ে
চলে গেছ এই হৃদয়টাকে ভেঙে
তুমি-আমি একই শহরে
তবুও একাকী ভিন্ন গ্রহে
মনে পড়ে সেই নিয়নজ্বলা রাতে
অনন্ত প্রেম দিয়েছি উজাড় করে
নিঃসঙ্গ নিশিপথিক পেছনে ফেলে
পথে হেঁটেছি বাঁধা দুটি হাতে
দূর আঁধারের ভালোবাসায় হারাতে
ছুটেছিলাম সেই রূপালি রাতে
এই রাতে সব প্রেম হারিয়েছি অকারণে
নিশিব্যস্ত মানুষ হয়েছি কেমনে
[…]
দরজার চৌকাঠকে পিঁড়ি বানিয়ে
বিনিদ্র জেগে আছি এই রূপালি রাতে।”
এই গানের প্রতিটি শব্দে আমার স্মৃতি জমেছে। সেই স্মৃতিতে মিশে গেছে ট্রেনের শান্টিঙের ধাতব শব্দ। ফলে, তার মৃত্যুর দিনটিতে, ১৮ অক্টোবর ২০১৮, সারাদিন শুধু একটি গানই শুনেছি। ঘুমন্ত শহরে। কেমন অদ্ভুত ছড়ানো সুর গানটিতে। আমার শোনা আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠের প্রথম গান।
স্টেশনে ঘণ্টা বেজেছে। আমাদের নিতে আসছে ছেলেবেলার ট্রেন। কুশিয়ারা এক্সপ্রেস। হুইশ্যল বাজিয়ে, আমাদের সচকিত করে দিয়ে দাঁড়িয়েছে শমশেরনগর স্টেশনে। ‘বিষণ্ণ ধুলোয়’ ভরে গেছে চারপাশ। জনপদ ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতাসে তোমার স্মৃতি। স্মৃতিতে ফেব্রুয়ারির শেষ রাতটির কথা! সে-রাতে পূর্ণিমা ছিল না। জানলার কাচে তুষার ঝরছিল, নৈঃশব্দ্যে।
এক টেলিভিশনসাক্ষাৎকারে বাচ্চুকে বলতে শুনি —
“দ্য মোমেন্ট আই টেইক মাই গিটার, দ্য মোমেন্ট মাই ক্রাউড ইজ হ্যাপি, আমিও হ্যাপি; ওরা ওদের মতো, আমি আমার মতো। ওরা আনন্দ করছে, আমিও আনন্দ করছি; ওরা ধুলোবালি ওড়াচ্ছে, আমি ওড়াচ্ছি; বাট, হঠাৎ করে দেখি, ফিল করি যে, হ্যাঁ, উই আর টুগেদার। এই ম্যাজিকটা ঠিক কোত্থেকে আসে আমি জানি না।”
আমরাও জানি না; হয়তো সে-দেশে ঘুমন্ত শহরের গানগুলি সব মিথ, হয়তো সে-জাদুর দেশেই আছে আমাদের সব-হারিয়ে-ফেলা খেলনা ঘোড়া, মাটির পাখি, নষ্ট ঘড়ি, সাপ!
… …
- ঘুমন্ত শহরের গানগুলো || এমদাদ রহমান - November 13, 2018
COMMENTS