রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় লোকটিকে চোখে পড়ে। সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একমনে চা পান করছেন। প্রথমে এতটা গুরুত্ব দেইনি। কিছুক্ষণ পর একই পথে ফেরার সময় যখন একতারার সুর কানে এল, তখন পেছন ফিরে দেখি আগের-দেখা সেই লোকটি। চোখ বন্ধ করে গান গাইছেন একমনে। গানের কলিগুলোও বেশ —‘আমার মনের দুঃখ কই না গো সখি’। অপূর্ব কণ্ঠের এই গান শুনে রিকশা থেকে নেমে লোকটির কাছে গিয়ে চুপচাপ বসলাম। কিন্তু সেদিকে তাঁর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। একমনে তিনি গেয়েই চলছেন :
ওরে কী আগুন জ্বালাইয়া দিলো গো
দয়াল/মুর্শিদ/সখি আমায় অন্তরায়॥ওরে অন্তরে তুষের আগুন জ্বলছে সদায়
জল দিলে নিভে না আগুন করি কী উপায়॥ওরে কী আগুন লাগাইছে আমার কলিজায়
কান্দে বাউল ছুরত আলী ভাণ্ডারির আশায়॥না জানি হবে কি গতি সরকাতের আশায়
কী আগুন জ্বালাইয়া দিলো আমার অন্তরায়॥
ততক্ষণে, গান গাওয়ার ফাঁকে, চোখ মেলে লোকটি বার-কয়েকবার আমার দিকে তাকালেন। আর আমি এরই মধ্যে লক্ষ করলাম তাঁর আঙুলের নখ যেন গাঢ় আবির রাঙা। এই রঙ ভেদ করেও নখের ভেতরের কালো ময়লা স্পষ্ট দেখা যায়। তেলচিটকে ছেঁড়া পোশাক থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। আর কাঁধে ঝুলছে বিশালাকৃতির একটি ঝুলি। সেই ঝুলিতে ছোট ছোট কতকগুলো একতারা। পরে জানতে পারি — এসব বিক্রি করেই তাঁর সংসার চলে। আর একতারাগুলো তিনি নিজেই তৈরি করেন। এসব একতারা তৈরি শেষে এগুলোর সৌন্দর্য বাড়াতে আবির রঙ মাখিয়েছেন। সে-কারণেই হাতের আঙুলেও গাঢ় হয়ে লেগে রয়েছে।
এতক্ষণ যাঁর কথা হচ্ছিল, তিনি হচ্ছেন মোহাম্মদ ছুরত আলী। নিজের নামের পেছনে নিজেই ‘ভাণ্ডারি’ উপাধি লাগিয়েছেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার ঘুনই গ্রামে। তবে চল্লিশ বছর ধরে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি গ্রামের একটি ভাড়া মেসবাড়িতে বসবাস করছেন। গ্রামের বাড়িতে স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তান। সুযোগ পেলেই তাদের দেখতে বাড়িতে চলে যান।
ছুরত আলী গান শেষ করে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে আমার উদ্দেশে বললেন, ‘বাবা রে, গানটা কি আফনার ভালা লাগছে?’ তাঁর কথা শুনে আমি চমকে উঠি। কোনও ধরনের পূর্বপরিচয় ছাড়া অপরিচিত একজন মানুষ কীভাবে এত সহজে আপন করে নিতে পারেন, সেটাই ভাবছি। পরক্ষণে দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে চমকে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আফনে হয়তো ভাবছেন, — চেনা নাই জানা নাই, এরপরও আমি কইতাছি গানটা ভালা লাগছেনি? এইটা ব্যাপার না। এই গানের টানেই তো আফনে এখানে আইছেন, বসছেন। এই গানে-গানেই তো আমার জীবনযৌবন গেছে। গানের শান্তি বড় শান্তি রে বাবা!’
আচমকা আমার মুখ দিয়ে বের হয়, ‘কতটুকু পড়াশোনা করেছেন চাচা?’ প্রশ্ন শুনে তিনি যেন থতমত খেয়ে যান। পরক্ষণেই বললেন, ‘আমি অশিক্ষিত মানুষ। পড়াশোনা নাই। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি আর একতারা বেচি। এই একতারা বেচতে বেচতে কত কত মানুষের সঙ্গে দেখা। সেই দেখা থেকে শেখা। কত মানুষ কত ধরনের! এই মানুষরে কিছুটা শিখতে পারলেই তো অনেক শেখা হইয়া যায়।’ এভাবে কথায় কথায় সামান্য সময়ে আমাকে মুগ্ধ করে ফেলেন ছুরত আলী ভাণ্ডারি। বুঝতে পারি — তাঁর জ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিক মাপকাঠিতে বিবেচনা করাটা আমার মোটেই ঠিক হয়নি। প্রকৃতি থেকে যে-জ্ঞান তিনি আহরণ করেছেন, সেটা আমাদের মতো ‘তথাকথিত শিক্ষিত’ মানুষেরা কোনোদিনই অর্জন করতে পারেননি।
দিনটি ছিল ২০১১ সালের ৪ জুলাই দুপুরবেলা। সেদিন ছুরত আলীর সঙ্গে তাঁর গান-দেহতত্ত্ব-মানুষ-সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে কত কত কথা হয়েছিল! তিনি কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, একতারা বিক্রি করার সময় মানুষের অনুরোধে তাঁকে দু-একটা গান গেয়ে শোনাতে হয়। তখন তিনি আরকুম শাহ, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ সহ অনেক বাউল-গীতিকারদের লেখা গান গেয়ে শোনান। মাঝে মধ্যে নিজের লেখা গানও গেয়ে থাকেন।
ছুরত আলী বলেছিলেন, ‘যখন মনে হয়েছে তখন গান বেঁধেছি। লেখাপড়া জানি না। মনে মনে গান বান্ধি। সব মিলাইয়া ৪০/৫০টি গান অইব। যতগুলো গান বাঁধছি সবগুলা গান আমার মুখস্থ। কোনও গানই খাতায়টাতায় লেখা নাই। আমি মরলেই সব গানও মরে যাবে। কেউ এই গানগুলার খবরও নিবে না। এই লাইনে টাকা নাই, পয়সা নাই। তবে তা নিয়া আমার আফসোসও নাই, টাকা ইনকামের চিন্তাও করি না। একতারা বেইচা যা পাই তা দিয়া একবেলা ডাল-ভাত খাইতে পারলেই হইল। চল্লিশ বছর ধইরা এই পেশাত্ আছি। প্রত্যেকদিন ২০-২৫টা একতারা বেচতাম পারি। একেকটা একতারার দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা। সেইটা বাদ দেন। আসল কথা হইল — মনের টানে গান গাই। মনের টানেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি।’
গল্পে গল্পে বেলা বাড়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। ছুরত আলী আমার অনুরোধে আরও কয়েকটি গান গেয়ে শোনান। সবগুলো গানই দেহতত্ত্ব পর্যায়ের। একসময় মনে হলো তিনি আর কথা বলতে তেমন-একটা ইচ্ছুক নন। বারবার বলছিলেন, ‘যাই, পেটেরও ধান্ধা আছে। ইখানও বইয়া থাকলে তো কাম অইব না। আরেক রাস্তা ধরি।’
আমি চা পানের নিমন্ত্রণ জানাতেই ছুরত আলী সহাস্য রাজি হলেন। তাঁকে নিয়ে ফুটপাতের একটি খোলা টঙ্ দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা খেলাম। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়েছে। তিনি চায়ের মধ্যে পাউরুটি ভিজিয়ে খেলেন। খাওয়ার ভঙ্গিটাও ভারি সুন্দর। চা পান করতে করতেই আমার একটি ভিজিটিং কার্ড তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি, ‘এই কার্ডটা রাখেন। মন চাইলে আমার অফিসে আইসেন। এখানে আমার মোবাইল নম্বর ও অফিসের ঠিকানা আছে।’ উত্তরে তিনি শুধু বললেন, ‘বাবা রে, আমি পাগল কিছিমের মানুষ। কার্ডটার্ড হারাইয়া ফালাইমু। এইটা আপনার কাছেই থাকুক। দেখবেন একদিন ঠিকই ঘুরতে ঘুরতে আফনার লগে দেখা অই যাইব।’
কথা শেষ করেই যাওয়ার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বিদায়ের আগে বললেন, ‘আব্বা, যদি রাজি থাকেন তাইলে একটা বিড়ি খাইতাম চাই।’আমি সম্মতি জানালে তিনি দোকানির কাছ থেকে একটা বিড়ি চেয়ে নিলেন। এরপর আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেলেন। আমি শুধু তাঁর চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS