যে জাহাজের শিরোনাম নেই || খান রুহুল রুবেল  

যে জাহাজের শিরোনাম নেই || খান রুহুল রুবেল  

২০০৪ এর কোনো-একদিন। দিন মনে নেই, ঋতুকাল মনে আছে; কেননা, আমি যখন যখন বাস থেকে বিহ্বল মাছের চোখ নিয়ে এ-শহরে পা রাখলাম, তখন ভেজা রাস্তার আকাশগঙ্গা থেকে গলিত নক্ষত্রের লাভায় আমার প্যান্ট মাখামাখি হয়ে গেল — শহুরে কাদার আস্বাদ। এসবে আমার চোখ ছিল না যদিও, কেননা বিহ্বল মাছ কাদায় বিভ্রান্ত হয় না, আমার সুতি ঢোলা মফস্বলী প্যান্ট বহুবার মহিষের চেতনা নিয়ে কাদায় ডুবেছে পূর্ববর্তী শতাব্দীতেও। আর, আরও বড় কারণ, শহরের “সুগোল তিমির পিচ্ছিল পেট” আমাকে গিলে নিয়েছে ততক্ষণে, আপাদমস্তক। অতএব, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের এই পাড়ে, শহরে তখন বর্ষা।

ফার্মগেটে থাকি, কিছুকাল পরে ঠাঁই হয় সরকারি বিজ্ঞান কলেজ ছাত্রাবাসে। মেশিনের ঘর্ঘর, বাসের চিৎকার, দালানের উচ্চাভিলাষ, ঘরে-ফেরা মেঘদল, রোদে-পোড়া হাঁস, মৌমাছির বমি, রেশমের ডাস্টবিন, গতি, সড়কদুর্ঘটনা, মহল্লার মাস্তান, ছিনতাই, মৃত্যু, পার্কের পতিতা — এসব পকেটে নিয়ে ক্লান্ত অপরাহ্নে মায়াময় হয়ে ওঠে ফার্মগেট। অথচ ঠিক তার ভেতরেই দুর্মর দেয়ালের ওপাশে আমাদের ছাত্রাবাসে এসব কিছু নেই, সেখানে তখনও উপনিবেশ গড়ে রেখেছে মফস্বল, মেহগনির নিরঙ্কুশ রাজত্ব, ঘাস, ডোবা আর পরাজিত ফড়িঙের প্রদেশ। আমাদের তিনতলা ছাত্রাবাস জুড়ে কলেজের নীল শার্ট আকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওড়ে। পাশের মসজিদ থেকে আজান, আর হলিক্রসের গির্জা থেকে সন্ধ্যার ঘণ্টাধ্বনি একসাথে ভেসে আসে সন্ধ্যায়। আমরা বিষণ্ণ হই, ক্রমাগত বিষণ্ণ হই; — শুনেছি দেয়ালের ওপাশে হলিক্রসের মেয়েরা আমাদের পছন্দ করে না, তাদের নাগরিক চুলে নক্ষত্রপুঞ্জের বাতাস, সুবাসিত ইস্পাতের উজ্জ্বলতা, আর আমরা গরিব সরকারি কলেজের মফস্বলী ছেলেদের দল, শিংমাছ ও ঘোলা নদীজলের অনিবার্য ঘ্রাণই যাদের আকণ্ঠ নিয়তি।

তবুও এই উপনিবেশেও সাম্রাজ্যের বাসনা নিয়ে প্রযুক্তি ঢুকে পড়ে। দেশের বাজারে মোবাইল ফোন, ডিজিটাল মিউজিক প্লেয়ার সবে ছড়িয়ে পড়ছে একে একে। আমাদের মধ্যে দু-একজন যারা পয়সাওয়ালা লোকেদের ছেলে তারা ঝাঁ-চকচকে ফোন কিনে আনে, এখনকার মতো এতকিছু করা যেত না সেসব ফোনে, কথা বলা যেত, দু-একটা মান্ধাতা আমলের গেইম খেলা যেত। আমাদের যাদের মোবাইল ফোন নেই তারা ওদের কাছ থেকে ধার করে গেইম খেলতাম। যাদের আরও টাকা আছে, তারা আরও দামি ফোন কিনে আনে, সেগুলোতে দেখা-যায়-না-প্রায়-এরকম ঘোলা ছবি তোলা যায়, কয়েকটা গান রেখে শোনা যায়। কেউ কেউ ডিজিটাল মিউজিক প্লেয়ার কিনে আনে, সঙ্গে সাউন্ডবক্স, যেটা ছাত্রাবাসে নিষিদ্ধ। যদিও শিউলি ফুটছে, দূর মফস্বলে ফেটে যাচ্ছে দুর্বিনীত কার্পাশ, আর ঋতুবদল হচ্ছে পৃথিবীতে, কিন্তু আমাদের তখন  শুধু গান শোনার মৌসুম।

মধ্যরাত্রিতে পড়াশোনা-করা ভালো ছেলেরা যখন ঘুমাতে যাচ্ছে, তখন পড়াশোনা-না-করা আমাদের কয়েকজনের শুরু হয় কোমল উৎসব, যেন রাতের শুরু। নিচের ঘাসজমির ওপর আমাদের শাদা বাড়ির হল্, লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি! নেকড়েজীবন না-পাবার দুঃখে কুকুরের ক্রন্দন ভেসে আসে, নিয়ে আসে রাতের বাতাস। সিটি কর্পোরেশনের লোক টহল দিয়ে কিছুদিন পর পর কুকুরদের খুন করে তাদের শরীর মালগাড়ির ওপর ছুঁড়ে মারে একে একে, তারপর নিয়ে যায়, কোথায় নিয়ে যায়? এই নিয়ে বিবাদ চলে আমাদের, কেউ কেউ ঠিক মধ্যরাত্রে এসব অশরীরী কুকুরের গোঙানি শোনে বলে জানা যায়, অশরীরী কুকুর দেখার জন্য পড়াশোনা-না-করা ছেলেদের দল তিনতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াই, সামনের ছায়া-ছায়া সব মহানগরিক দালান ভেদ করে ঠাণ্ডা বাতাস আসে, সুদূর সমুদ্র থেকে তার যাত্রা আমাদের শার্টে এসে ডুবে যায়, তিনতলার বারান্দাকে আমাদের কাছে জাহাজ বলে মনে হয়। এরকম কোনো-এক দিনে, যেহেতু ঋতুকাল মনে থাকলে দিনক্ষণ মনে থাকে না আমাদের, আমাদের বারান্দায় এই গানটুকু শোনা যায় —

“জাহাজীর কাছে ভীষণ সত্য সেই,
পথটাই যাওয়া, এর আর কোনো ফিরে আসা নেই”

আমি একটু কান পাতি, এরকম গান শোনা হয়নি তো, নাকি হয়েছে? ওপারের দালানগুলোর জানালায় জাহাজের বাতির মতো আলো, চকিত ডলফিনের মতো সেখানে উঁকি দেয় দিঘল অঙ্গের কোনো কিশোরীর শরীর, ইলিক্ট্রিক পাখার কারসাজিতে তাদের চুল অবিরাম অবিরাম ওড়ে, যদিও সেসব দৃশ্যের প্রতি আমি সমর্পিত কিন্তু আমি টুপটাপ করে গানের মধ্যে ঢুকে পড়ি —

“ঝরে চুন-সুরকি, শরীরের দেয়াল
তবু সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে, অনেক উঠেও থেমে,
শেষ ছাদটায় দেখি নীল,
এরই মাঝে নকশা, সাদা আলোর সাদা শঙ্খচিল”

গায়কী আমাদের পরিচিত নয়,  মন্ত্রোচ্চারণের মতো একঘেয়ে ভঙ্গি, পুনরাবৃত্ত; গান নয়, যেন বর্ণনা, আমাদের বর্ণনা, আমাদের তেতলা জাহাজের বর্ণনা! তার সাথে একটা নতুন ধরনের বাজনা, ঠিক ব্যান্ডগুলোর বাজনা নয়।

দু-হাজার চার/পাঁচের সেসব দিনে আমরা অনেকগুলো মফস্বল সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের ঢোলা প্যান্ট, বেঢপ জামায় লেগে ছিল জেমসের মাস্তানি, আইয়ুব বাচ্চুর, আজম খানের উল্লাস, কারো কারো পকেটে সোলস আর মাইলস। কিছুটা পেছনে ফেলে আসা টিনের ঘরগুলোর দেয়ালে পোস্টারের চৌকোণ সন্ত্রাস। আমাদের মধ্যে আগে থেকেই যারা শহরে ছিল তারা ইংরেজি গান শুনত। আমরা ইংরেজি গান বুঝতাম না, যদিও পরীক্ষায় ইংরজিতে ওদের থেকে অনেক সময় বেশি মার্কস পেতাম। আর যারা কবিতা লিখব বলে ঠিক করেছিলাম রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গান আমাদের আঙুলে আর বোতামে লেগে ছিল, ঠোঁটে ছিল সুমন চট্টোপাধ্যায় আর অঞ্জন দত্ত। আমি নিজে ভুপেন হাজারিকা শুনতাম খুব। পুরনো হিন্দি গান আর বাংলা সিনেমার গান আমাদের ক্যালেন্ডারের মতো পরিচিত স্বাভাবিক, আমরা ক্যাল্কুলাস্ করতাম, আপেক্ষিকতত্ত্ব শিখতাম, ক্লাসপরীক্ষার আগের রাতে নিশ্চিত ফেল্ জেনে আমরা পড়া-না-করার-দল বারান্দায় আসতাম, ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী, ইতিহাসে যা নেই, তিনতলার বারান্দা  ছিল আমাদের রাজধানী।

বাংলা গান রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী, আবার রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানের এক আততায়ীও, কেননা রবীন্দ্রঋতু অন্তর্ধানের বহু-বহুদিন পরেও বাংলা গানের গীতিকারদের হাতে লেগেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, পুরনো বাংলা সিনেমার গান আমাদের সেই সাক্ষ্যই দেবে, রবীন্দ্রনাথের গড়া নৈতিকতা, সমর্পণ, আমি  ও তুমির সেতু, কোমলতা, নম্রতা, বিরহ, আদিখ্যেতারা বহুকাল বাংলাগানের একনিষ্ঠ চারিত্র্য হয়ে ছিল। কিছু গণসংগীত ও লোকগানের কথা ছিল আলাদা, তারা চিরকাল ঐকিক, শরিকিবিহীন, নিহিত ধান, নদী, বাতাসের মতো সার্বভৌম। মাঝারিবিত্তের যে-দুনিয়া, ভদ্রলোকী নাগরিক পথ, সেখানে আমাদের কানে প্রথম বিপ্লব ছিল সুমন চট্টোপাধ্যায়। আধুনিক নগর আর বাংলা কবিতাকে তিনি গানের ভিতর শিংমাছের মতো সহাস্যে ঢুকিয়ে দিলেন, কিন্তু আমাদের কাছে, অর্থাৎ দু-হাজার-চারে কাজটি করেছিল শিরোনামহীন। সুমন ছিল একা, শিরোনামহীন  ছিল দল, সুমনের অস্ত্র ছিল গিটার, শিরোনামহীনের রাইফেল ছিল সরোদ। এই পুরনো ভারতীয় বাজনায়, শহরের প্রত্যকটি শব্দকে আমাদের মফস্বলে রূপান্তরিত করে দিত, কেন জানি না, সরোদের সমস্ত রহস্য আমার জানা নেই, আলী আকবর খাঁ হয়তো কিছুটা জানেন।

আমরা তখন শৈশবের মূল্য বোঝা শিখে গেছি, কেননা একটু একটু করে ক্যাল্কুলাস আর সরল ছন্দিত স্পন্দন প্রতিদিন আমাদের বড় করে তোলে, আমরা  মাথা দুলে দুলে গাই —

“আমার শৈশবের মতো দামি, আমার কান্না-জড়ানো গান,
মাথা-উঁচু সেইন্ট গ্রেগরি আমার, সময়ের টানে ম্লান।
আমার পরিচিত লাস্ট বাস, আমার ভাঙাচোরা নিঃশ্বাস,
ব্রাদার চার্লসের চুইংগাম, আমার রক্ত আমার ঘাম।
আমার লাস্ট বাসে বাড়ি ফেরা, মাথা তুলবার তাড়া,
আমার জাহাজের পাটাতন, ছেঁড়া নোঙর, ছেঁড়া মন।”

দুপুরে ক্লাস শেষে আমরা বেরিয়ে পড়ি, শুনি শাহবাগের কাছে এক বাড়িতে ফোটে নয়নতারা ফুল, হেঁটে হেঁটে আমরা শাহবাগ যাই, কোনো-কোনোদিন সাধু গ্রেগরির আস্তানার পাশে ঘোরাফেরা করি, গ্রিনরোডের ঘুপচি জ্যাম আর অসুস্থ চেহারার ওষুধের দোকানের পাশে দুটো লাল আর সাদা ঝকমকে বাড়ি দেখে ইন্দ্রপুরী বলে মনে হয়, তাদের সিংহদরজার ওপাশে সুখী কুকুরের অব্যর্থ দৌড় ইঙ্গিতে শোনা যায়, কিন্তু দেখতে পাওয়া যায় না, কেননা বাড়ির দেয়াল খুব উঁচু, আমাদের সীমাবদ্ধ চোখ তারাসঙ্কুল আকাশ পর্যন্ত পৌঁছালেও বড়লোকদের বাড়ির শরীর পর্যন্ত পৌঁছয় না, কিছুটা আভাসে মেলে। নীলক্ষেত যাওয়ার হলে, ও-দুই বাড়ির সামনে আমরা কেউ কেউ ঘুরে বেড়াই কিছুক্ষণ, যদি কোনোদিন আলিবাবার আশ্চর্য মন্ত্রবলে সিংদুয়ার খুলে যায় তো বাড়িটা কেমন, দেখব। আমাদের কেউ কেউ ঘোষণা দেয় তার যখন শেরশাহের মতো টাকা হবে, ইচ্ছে হলে তখন এরকম বাড়ি বানানোর কথা  ভাববে। আমার এসব মনে হয় না, আমি জানি আমার ভুবন এ-বাড়ির দিকে নয়, আমাদের ভুবন অন্য কোথাও, কেননা আমরা শিরোনামহীন গাই —

“পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, শুকনো দালান
দোকানের নাম, তারপর, আমাদের ভুবনে স্বাগতম
ঝরে বৃষ্টি কারো ভুবনে, তবু নিয়ন সাইনে স্বাগতম
‘আমাদের’,  তারপর —  ‘ভুবনে’,
তারপর — ‘স্বাগতম’।
বুঝতে কিছু সময় লাগে সেই স্বাগতমটাই ইচ্ছে,
সস্তায় কারা বিক্রি করে দিচ্ছে।”

এভাবে বছর গড়ায়, আমরা বড় হতে হতে ছোট হতে থাকি, আমাদের সর্বশেষ কৈশোর উড়ে যায়, আর শিরোনামহীন   আমাদের কানের সুড়ঙ্গ বদলে দিতে থাকে, শিরোনামহীন   তখন আমাদের গান, আমাদের রিংটোন, আমাদের ফুটপাথ, দুর্বৃত্ত সব দালানের শহরে শিরোনামহীন   একটু একটু করে আমাদের রক্তে শহর ঢুকিয়ে দিতে থাকে, রৌদ্রের নাবিকী আর উদাত্ত ভাসান মিশিয়ে দিতে থাকে, আমরা অসুখে সুখগ্রস্ত হই। আমরা যারা কবি হব বলে কিছুটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাদের হাতে তখন নানা রকম বাংলা কবিতা, সম্রাট জীবনানন্দ দাশের পৃথিবীতে কত মন্ত্রী, অমাত্য, রাজা-উজির, সেনাপতি। আমরা সবাইকে পড়ি। আর মনে হয় কবিতা গান হতে পারে, যেমন রবীন্দ্রনাথ করেছিল, আধুনিক কবিতা থেকেও গান হতে পারে, যেমন সুমন চট্টোপাধ্যায় করেছিল, আর আমাদের শহরে সেটা এনেছিল শিরোমানহীন  । (এ-প্রসঙ্গে অবশ্যই মেঘদলের নাম আসবে, এবং এর কয়েক বছর পরে আমরা মেঘদল   সম্পর্কে জানব, আর সেটা আরেক অধ্যায়, যদিও মেঘদল  অ্যালবাম করেছিল দু-হাজার-চারেই, কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক, আমাদের মেঘদল   সম্পর্কে জানাশোনা ছিল না ঠিক তখন, মেঘদল  … আশ্চর্য মেঘদল  )

এভাবে প্রসঙ্গে-অপ্রসঙ্গে হাওয়া বয়ে যেতে থাকে, নীলক্ষেত থেকে কার্ল মার্ক্স আর নিউমার্কেট থেকে আপেক্ষিকতত্ত্ব ও মহাবিশ্ব নিয়ে বই কিনি। হেঁটে হেঁটে নীলক্ষেত পেরিয়ে হলে ফিরি, রাস্তায় খুব দুপুর জেগে ওঠে —

“রোদ উঠে গেছে তোমাদের নগরীতে
আলো এসে থেমে গেছে তোমাদের জানালায়
তুমি চেয়ে আছো তাই
আমি পথে হেঁটে যাই
হেঁটে হেঁটে বহুদূর বহুদূর যেতে চাই।”

শিরোনামহীন  আমাদের জানায়, এইসব জানালায় যদিও উৎসব, তবু এরই মাঝে আমাদের হেঁটে যাওয়া দরকার। নির্বাচনী পরীক্ষা যত আসে, আর অকৃতকার্য হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে আমাদের, ৩৩ না-পাবার শঙ্কায় আমরা বিষণ্নতর হই, শক্তি থেকে ধার করে শিরোনামহীন  আমাদের বিষণ্ণতর করে —

“হয় না আর এমন তো হয় না
নদীর বুকে বৃষ্টি ঝরে, পাহাড় তারে সয় না”

তবু কিভাবে কিভাবে জানি আমরা এক-আধটু ক্যাল্কুলাস শিখে ফেলি, টেস্ট পরীক্ষায় পাশ হয়ে যায়, তাই কেউ কেউ গেয়ে ফেলে —

“অলস দুপুর
ক্লান্ত নূপুর,
স্বপ্ন দেখায় তারায় তারায়।।”

আমাদের সর্বশেষ কৈশোর ধ্বংস করে দিয়ে ঘোলাটে হয়ে আসে চুনকাম, ছাত্রাবাসে আমাদের মেয়াদ শেষ হয়ে আসে, তখনও আমরা জানি না, আমাদের অনেকের ঢাকাবাসের সময়ও শেষ হয়ে এসেছে, দুই-হাজার-ছয়ে ঘটছে এসব, তখন আমাদের সর্বশেষ পতনের আগে, দ্বিতীয়বার এবং পুনরায় এ-শহরে শিরোনামহীন,  এবার ‘ইচ্ছেঘুড়ি’। সর্বশেষ হাওয়ার কাছে আমাদের আর্তরব —

“এই হাওয়ায় ওড়াও তুমি, তোমার যত ইচ্ছেঘুড়ি”

তখনও আমাদের পড়ন্ত বিকেল আর ক্যাফেটেরিয়ার গল্প শুরু হয়নি, এক বর্ষা দিয়ে শুরু হলেও আরেক এবং অপর এক বর্ষা চলে এসেছে, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে কালীদাস পড়তে গিয়ে আরক্ত হয়ে ওঠে রক্ত, আর শিরোনামহীন  আমাদের সরোদের ক্রন্দনে বর্ষার বার্তা জানায় —

“বরষা মানে না
ঝরছে জলধারা
জানি না, জানি না — কাটবে কি ঘনঘটা॥
অনুনয় মানে না
অবারিত মনকথা,
জানি না, জানি না — থামবে কি ঘনঘটা॥
নিরিঝর গগনে, অপলক চেয়ে রই
বিস্মৃত কবিতা, আনকা পবনে —
মেঘলা কবেকার স্মৃতিময় বাতায়ন
বলে যায় ‘তোমায় অনব ভালোবাসি’॥
দিপীকা সায়রে, অনিমেষ চেয়ে রই
মিথিলা বরষা, অলোক দহনে —
মেঘলা কবেকার স্মৃতিময় বাতায়ন
বলে যায় ‘তোমায় অনব ভালোবাসি’॥
বরষা মানে না
ঝরছে জলধারা …”

আর বৃষ্টি শেষে জানালা ও দুরান্তের জানালায় বৃষ্টির মৃতদেহ — তার ওপাশে দেয়াল, শহরের দেয়াল, আমাদের মফস্বলকে খুন করা দেয়াল, দেয়ালের ওপর পাখি —

“একা পাখি বসে আছে শহুরে দেয়ালে
শিস দিয়ে গান গায় ধূসর খেয়ালে
ফেলে-যাওয়া আনমনা শিস, এই শহরের সব রাস্তায়
ধোঁয়াটে বাতাসে, নালিশ রেখে যায়॥”

এইসব ভবঘুরে ঝড় আর বৃষ্টির দিন, লাল নীল গল্প ও লড়াইয়ের খরগোশের শেষে আমাদের তেতলা সেই জাহাজে আমাদের সময় ফুরিয়ে আসে, একটা কালো ব্যাগ, কিছু বই আর মাছের বিভ্রান্তি নিয়ে যে-ছেলেরা একদিন সামান্য শৈশব, অনেকটা কৈশোর আর খানিকটা বড়-হওয়া হাতে নিয়ে শহরে ঢুকেছিলাম, একটা তেতলা জাহাজ আমাদের বড় করে ফেলেছে। বহুদিন শহরে শহরে হেঁটে হেঁটে আমাদের শরীরে কী দারুণ ক্ষুরধার ইস্পাতের গন্ধ পাওয়া যায়! তেতলা জাহাজ থেকে আমরা যখন নেমে আসি, তখনও জানি না আমাদের পরবর্তী সমুদ্র কোথায়, তবে এটুকু জানি জাহাজের পর আরও-সব জাহাজই আমাদের নাবিকী, পথ মানে অনেক অনেক জাহাজ, জীবনের মানে হলো জাহাজবদল। এসব করে পরস্পরের কাছে বিদায় নিয়ে আমরা পথে নামি, শিরোনামহীন   গাইতে থাকে আমাদের কোনো কোনো বন্ধু —

“জাহাজীর কাছে ভীষণ সত্য সেই,
পথটাই যাওয়া, এর আর কোনো ফিরে আসা নেই”

শিশির নিহত করে, শহরে তখন নিঃশব্দে ঢুকে পড়ছে শরতের কামান …


‘লাল জীপের ডায়েরী’ ওয়েবপত্রে লেখাটা আগে একবার ছাপা হয়, আজ থেকে বছর চারেক আগে, ২০১৫ নাগাদ। লেখকের অনুমতি নিয়া গানপারে পুনরাপ্লোড করা গেল। উল্লেখ্য, সঞ্চালনালুপ্ত লালজিপচালক অর্পণ দেব ও বিজয় আহমেদ একটা গানসংখ্যা করেছিলেন ওই বছরের মাঝামাঝি। কিন্তু অনলাইনে একসময় অ্যাক্টিভ হলেও পত্রিকাটা আজ আর শেয়ার ইত্যাদি করা যায় না। কাজেই জিপচালকদের যোগসাজশে বেশকিছু রচনা সংশ্লিষ্ট রচয়িতার সম্মতি নিয়া গানপারে অ্যাভেইলেবল রাখবার একটা এফোর্টের অংশ এই রিপ্রিন্টটা।  —  গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you