১৯৮৮ সাল। ’৯০-এর স্বৈরাচার হঠাও আন্দোলন তখন থেকে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পত্রপত্রিকায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ও তার মন্ত্রীপরিষদের সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে রঙ্গ-ব্যঙ্গ কার্টুন ছাপা হচ্ছে দৈনিক। প্রেসিডেন্ট ও তার মন্ত্রী-এমপিদের কোট-টাই পরা ক্ষীণ দেহে স্থূল পেট সহ নানা ভঙ্গিমায় আঁকা কার্টুনগুলি তখন ছিল পাঠকদের প্রধান আকর্ষণ। বেশকিছু পত্রিকায় কার্টুন সিরিজও ছাপা হতো। আমি এসব কার্টুনের ছিলাম খুবই ভক্ত।
ছাত্রজীবনে দেয়ালপত্রিকা তৈরি করা ছিল আমার খুব পছন্দের কাজ। আমি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কার্টুন থেকে ধারণা নিয়ে দেয়ালপত্রিকায় রূপ দিতাম। সহপাঠীগণ আমার আঁকাআঁকি ও কাজের খুব তারিফ করত।
ছবি আঁকার নেশা ছিল আমার শিশুকাল থেকেই। যতদূর মনে পড়ে, একদিন পাশের বাড়ির একটি ঘরের মাটির বেড়ায় আমি আমের নরম সাদা বিচি দিয়ে ফুল, পাতা, পাখি, গাছ, নদী এঁকে নকশিকাঁথা বানিয়ে ফেলি। তা দেখে ঘরের মালিকের কী বকাঝকা! এ নিয়ে বেশ কথার গন্ডগোল বেঁধে যায়। আমার ঠাম্মা তখন ঘরওয়ালিকে খুশি করতে পূর্বের ন্যায় ঘরের বেড়াটি লেপে-মুছে পরিপার্টি করে দেন।
আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি, তখন গাঁয়ে কিংবা ময়ালে বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার ডাক পড়ত। একবার তো পাশের গাঁয়ের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি (শহরআলী চাচা) যিনি আমার বাবার খুব আপনজন, তিনি আমাকে ডাকলেন। বিষয় হলো, তিনি ১০০ হাত লম্বা একটি টিনের ঘর তৈরি করেছেন। তাতে ছবি আঁকতে হবে। ঘরের সামনের চৌকাঠে খুব সুন্দর করে ছবি আঁকার ফ্রেম তৈরি করে রেখেছেন। এখন প্রত্যেকটা ফ্রেমে আমাকে ছবি আঁকতে হবে। কারণ তিনি জানেন আমি ছবি আঁকতে পারি। তাই আমিও কোনোরকম পূর্ব-অভিজ্ঞতা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা ছাড়াই সিন্থেটিক রং দিয়ে ছবি আঁকা শুরু করলাম। তখন ছিল বর্ষাকাল। মানুষের তেমন কোনো কাজকর্ম নাই। তাই আমার ছবি আঁকাকে কেন্দ্র করে মানুষের ভিড় জমে যেত প্রতিদিন।
কোথায় কি আঁকতে হবে তা নিয়ে নানা জনের নানা পরামর্শ। কেউ কেউ আমার মুখপানে চেয়ে কত যে তারিফ করেছে তার অন্ত নেই। দুই-একজন ছবির দিকে তাকিয়ে অবাক ভঙ্গিমায় বলে, “মা গো! কেমনে ছাপ্পা বানায়! ছেরাডা-দু সাংঘাতিক! স্বাত্তক মায়ের স্বাত্তক পুত!”
টিনের ঘরের সামনের চৌকাঠে খোপে খোপে আঁকা হয়—জন্মনিবন্ধন পদ্ধতি, সুখী পরিবার, শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির বিজ্ঞাপন, বাল্যশিক্ষা পাঠ, জাতীয় পাখি, জাতীয় মাছ, জাতীয় পশু, কৃষকের ধানকাটা উৎসব, গরুর গাড়ি, পালতোলা নৌকা আরও কত কি! স্পেশালি আঁকা হয়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি।
দীর্ঘ একমাস ছবি আঁকার পর শহরআলী চাচার ঘরের সামনের চৌকাঠ হয়ে ওঠে ছবির দেয়াল। আশেপাশের মানুষ আসে তার সৌন্দর্য দেখতে। কেননা অজপাড়াগাঁয়ে এমন কর্ম এর আগে কখনো হয়নি। এটাই ছিল মানুষের মাঝে আগ্রহের মূল কারণ।
তবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি আঁকা নিয়ে আমার অনেক ‘বিদ্রোহী’ অভিজ্ঞতা আছে, যা অজপাড়াগাঁয়ে শহরআলী চাচার বাড়িতে ছিল না।

সম্ভবত ২০০২/’০৩ সাল হবে। সিলেটের জালালাবাদ অ্যাকাডেমি অ্যান্ড ফ্রি ক্যাডেট কলেজে আমি শিক্ষকতা করি। অ্যাকাডেমি ভবনের একটি হলরুমে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দুটি ছবি আঁকি। বেশ বড় আকারের ছবি। সর্বসাধারণ ও ছাত্রছাত্রীরা ছবির বেশ তারিফ করে। কিন্তু একসময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি নিয়ে শুরু হয় আপত্তি। অ্যাকাডেমির পরিচালক আব্দুল ওয়াহিদ খান সাহেবের কাছে আপত্তি আসে। ধুতি পরিহিত অবস্থায় নজরুলের ছবি আঁকা যাবে না। অবশ্য ছবি দুটিই ক্যালেন্ডার থেকে সিলেক্ট করে দিয়েছিলেন পরিচালক মহোদয় নিজে। আমি কেবল এঁকেছিলাম মাত্র। যা-ই হোক, এক পর্যায়ে ছবি মুছে ফেলার নির্দেশ আসে। পরিচালক আব্দুল ওয়াহিদ খান বিষয়টি মনেপ্রাণে মেনে নিতে না পারলেও আমাকে ছবির নিচের অংশ মুছে ফেলে হাফ ছবি তৈরি করার অনুরোধ জানান। আমি সম্মানের সাথে মুছে ফেলার বিষয়টি উনার উপর দায়িত্ব দিয়ে চাকুরি ছেড়ে আসি। পরে জানতে পারি পরিচালক মহোদয় হলরুমটি দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন।
যা-ই হোক, এবার শুরুর আলোচনায় ফিরে আসি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশ উত্তাল। আমি বাড়িতে আসি। সময় যাচ্ছিল না আমার। তাই আন্দোলনের বিশেষ কিছু পটভূমি আর্টপেপারে কার্টুন এঁকে এবং বিষয়বস্তু লিখিত বর্ণনা করে আমাদের বড়ঘরের সামনের চৌকাঠে দেয়ালপত্রিকার মতো আটটি অংশে ধারাবাহিকভাবে টানিয়ে দেই, যার বিষয়বস্তু ছিল স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি। এর মধ্যে একটি বিশেষ ছবি ছিল ‘মুক্তি’ নামে। হাতে-পায়ে শরীরে বাঁধা শিকল ছিঁড়ে মুক্ত হতে চাওয়া একজন যোদ্ধার প্রতিকৃতি। ময়ালের মানুষজন খুব কৌতূহল নিয়ে দেখতে আসে এ-দেয়ালিকা। দেখে কেউ কেউ রাজনৈতিক ভয়ের কথাও বলে। একদিন এলাকার এক বড়ভাই স্বদেশদা বিষয়টি জানতে পেরে দেখতে আসেন এবং উপস্থিত সকলকে ছবিগুলোর মাহাত্ম্য বুঝিয়ে বলেন। মানুষ অবাক হয়ে তা শোনে। শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে পাশের গাঁয়ের এক মহিলা স্বদেশদাকে বলে ওঠেন, “এইডা আমরার ছাপ্পা বানাউরা বেডা, যেনতেন বেডা না!” আমাকে নিয়ে উনার গর্ব করা মুখটি আজও ভুলতে পারিনি। আমার ইচ্ছে ছিল ছবি আঁকার ছাত্র হব। কিন্তু পরিবারের সিদ্ধান্তের কারণে সুযোগ পেয়েও তা আর হলো না।
ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে পড়াকালীন অবস্থায় জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় কিছুদিন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হলেও তা আর কন্টিনিউ হয়নি। এখন যতটুকু আঁকাআঁকি করি কেবল ভালোলাগার নেশা থেকেই। তবে কোথাও ছবি আঁকার কর্মশালা কিংবা প্রদর্শনীর খবর পেলে সবকিছু ফেলে এখনো ছুটে যাই।
গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, নক্ষত্রগুহা আর্টখানার আয়োজনে, সুরমা মার্কেট (দ্বিতীয় তলা) সিলেটে উদবোধন হয়ে গেল সত্যজিৎ (চক্রবর্তী) রাজন-এর দ্বিতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনী। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘দ্য ক্রনিকলস্ ফোরটোল্ড’/‘প্রাকভবিষ্যের পদাবলি’। উদবোধনী দিনে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী হ্যারল্ড রশীদ, শামসুল বাসিত শেরো, স্থপতি রাজন দাশ সহ আরও অনেকে।
প্রদর্শনীর মেয়াদ ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
প্রদর্শনীর সংবাদটি আমি শুনতে পাই ছোটভাই বিমান তালুকদারের কাছ থেকে। মূলত আমার আগ্রহের বিষয় বলেই বিমান আমাকে প্রদর্শনীর সংবাদটি জানায়। আমিও অন্যথা না করে ছুটে যাই প্রদর্শনীতে ছবি দেখতে। সঙ্গে নিয়ে যাই আমার ছোটছেলে জয়দীপ সহ ভাতিজা উল্লাস, আয়ান ও ভাতিজি রিয়ানাকে। তাছাড়া বিমান এবং ফয়েজও ছিল। সন্ধ্যা ৭টার পরপর পৌঁছাই প্রদর্শনীগৃহে। সিলেটের সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় মাল্টি বিজনেস পরিবেশে এমন শৈল্পিক আয়োজন যেন আমার কাছে শিল্পীর একাগ্রতা ও ভিন্নতা প্রকাশের বিপ্লবী উদ্যোগ মনে হলো। এ যেন টাইটানিক ডুবে যাওয়ার সময় ভায়োলিনবাদকের জেগে ওঠার সাহস। প্রদর্শনীর স্থান এবং পরিবেশটাই যেন শিকল ভাঙার বার্তা দিলো আমাকে। এ যেন ক্যানভাসহীন আরেক ছবি, যা চোখের আলোয় দেখা যায় না। তাই আমার মনে হয়েছে পাথরে ফুল ফোটানোর মতো এমন কর্ম কেবল একজন শিল্পীর দ্বারাই সম্ভব।

শিল্পী সত্যজিৎ রাজন আমার পূর্বপরিচিত। তিনি ভালো ছবি আঁকেন জানি। কিন্তু তিনি যে ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননি তা আমার জানা ছিল না। বিষয়টি আমি যখন জানতে পারি তখন তার ছবি আঁকা ও তাকে নিয়ে আমার কৌতূহল বেড়ে যায় মূলত লেবাসপরা এই শহরে একজন শিল্পীর লেবাসহীন শক্তি দেখে। আরও অবাক হলাম গ্যালারির বারান্দায় একটি টুলে বসে দর্শকের আনাগোনা উপলব্ধি করার নিরহঙ্কার মৌনশক্তি দেখে।
প্রদর্শনীতে মোট ৩৪টি ছবি আমি দেখতে পাই। একেবারেই জাঁকজমকহীন পরিবেশ। সত্য আড়ালের যেন কোনো ভনিতা নেই। কোনোরকম প্রচুরতারও অহঙ্কার নেই। যতটুকু আছে ছবির ঐশ্বর্য। জল, অ্যাক্রেলিক ও মিশ্র রঙ সহ নানা আকারের ক্যানভাসে আঁকা। সবমিলিয়ে সত্যজিৎ রাজনের চিত্রপ্রদর্শনীর বিষয়টা আমার কাছে ভিন্ন মনে হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, আমি তার মাঝে তথাকথিত গোত্রহীন একজন শিল্পীকে পেয়েছি যিনি গোত্রপ্রথা ভেঙে সহজিয়া শিল্পী। যিনি তথাকথিত গোত্রেরও আদি। তাই আমি শিল্পীর আত্মায় আত্মা রেখে আরো নিবিড়ভাবে কথা বলি।
তিনি বলেন, “শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দ্বারা শিল্পের মূল জায়গা ছোঁয়া যায় না। যদি ভাব, আত্মার শক্তি ও মনের একান্ত চাওয়া না থাকে। আমরা যেহেতু প্রকৃতির অংশ তাই প্রকৃতিকে চিনতে পারলেই মূল লক্ষ্যে পৌঁছা যায়।”
কথা বলার একপর্যায়ে জানতে পারি তিনি ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় সম্মান সমেত স্নাতক ডিগ্রিধারী হয়েও স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পী হিসেবেই ধ্যানমগ্ন আছেন । তাই আমার মনে প্রশ্ন জাগে, তারও নিশ্চয়ই ছাপ্পা বানানোর ইতিহাস আছে!
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সত্যজিৎ রাজন এক্সিবিশন প্রতিবেদন
সজলকান্তি সরকার রচনারাশি
- ছাপ্পা বানাউরা বেডা || সজলকান্তি সরকার - September 11, 2025
- আমার গল্পগুরুগণ || সজলকান্তি সরকার - September 2, 2025
- চন্দ্রাবতী মাসিমার জন্মদিন ও জীবনাবসান || সজলকান্তি সরকার - August 28, 2025

COMMENTS