ভালোবাসা নিয়ে আসি আজ আমি মেঘে মেঘে সারাক্ষণ
রাত জেগে বড়জোর এই পাতাটি ভরে প্রার্থনা করা যায়। প্রার্থনা, যাতে এই সুপর্ণা শীতকালটা ভালো কাটে মানুষের। অনাগত কিন্তু অবশ্যই আসবে যে-শীতগুলো, বর্ষাগুলো, শরৎ ও বসন্তগুলো, যেন কাটে সুন্দর ও সাবলীল। দুঃখ থাকবে, দৈন্য থাকবে, কান্না ও কারুণ্য থাকবে, তবু আনন্দ ও আমোদ যেন থাকে পাশাপাশি। যেন মানুষের মর্মে কোনো হিংসা না-থাকে, যেন ঘৃণার উল্টোপিঠে প্রতিদিন মুখ দেখে মানুষ, যেন সহজ লোকের ন্যায় দেখিবারে পায় ত্রিভুবনের তরিতমগুলো। যতই আসুক বিপদাপদ, অগ্ন্যুৎপাত ও ভূকম্পন, সবই যেন অচিরে সরেও যায়। এই দোয়া, প্রার্থনা, এই প্রেয়ার করি। সমস্ত কলুষ, সকল ম্লানিমা, সর্বঈর্ষা ও অসূয়া ভুলে যেয়ে মাছের মতন পারে সাঁতরাতে যেন জীবনের অগাধ জলে — সে — মীনমুখ সে-মানুষটি। যেন তার সকল সঙ্কট সমাধা হয় ঠিক সময়মতন, সমস্ত আততি মকুব হয় এক-লহমায়। যেন তার তরী গিয়ে ভেড়ে তীরে উপদ্রবহীন। যেন তার চোখের পলকে চলে আসে সামনে যে-কোনো অথৈ ক্ষণে জাহাজমাস্তুল। যেন সে না-পায় ভয় কোনো দুর্বিপাকে। যেন সে যেতে পারে আরও ভালো কাজবাজ করে। যেন সে লিখতে পারে ভালো লেখা আরও — কয়েকটা পাখিনোট, খরগোশের স্ট্যাটাস আর তার বাড়ির পুশিবিড়ালটার অভিমানে-ফোলা গালে ব্লাশিং স্মাইল ফুটাতে কিছু জরুরি ইমোটিকন; … এইসবই কাফি, এরচেয়ে একচুল বেশি কিছুই নেই ডিভ্যাস্ট্যাইটিং অ্যাকাডেমিক কোনো ডিস্কোর্সে, বহুবিজ্ঞাপিত কোনো মনীষীও নন ততোধিক মহান কিছু। ভর না-করতে পারে যেন কোনো নস্ত্রাদামাস বা এরিক ফন দানিকেন কি আল্লামা শাফি তার ওপর, যেন তার বাক্যাবলি শাসন না-করে কোনো ফ্রয়েড-লাকাঁ-দারিদা বা আদ্দিকালের রদ্দি ম্যাক্লুহান-ম্যাকিয়াভিলি। যেন তার দিনগুলো হয় সৃষ্টি ও শান্তিশীল, মধু ও মাধুর্যে মুখর। যেন তার কাছের মানুষেরা তারে রাখে কাছে কাছে। যে তারে দুঃখ দিয়েছে, যারা তারে পুড়িয়েছে পৃথক পাবকে, ব্যবহারজীর্ণ হাড়ের মালার মতো ফেলে রেখে চলে গেছে যে, নেভায়েছে যারা তার বিশ্বাসের আগুন — সে ও তাহারা যেন তার কাছে এসে চায় বিনীতজানু করজোড়ে ক্ষমা। পায় যেন ক্ষমা তারা তার কাছে এসে চিরকাল। আর তার হাতিশাল থেকে হাতিগুলো, আস্তাবল থেকে তার ঘোড়া, যেন তার আগামী দিনের ভার বহনে স্বেচ্ছায় সম্মত হয়। যেন সে না-কাঁদে আর, কোনোকিছু না-ঘটে যেন জীবনে তার কাঁদার, কিছুতেই চোখে যেন তার নাহি আসে জল। যেন তার জলের মতো স্বচ্ছ নয়নে খেলা করে আলো চিরদিন। চান্নিপসর যেন তার কাটে চিরকাল। এই-ই তো, অলমোস্ট, উইশ ইটার্ন্যাল।
২
মঙ্গল ঝরুক জীবনভর, তোমাদের আমাদের তাহাদের সকলের দুনিয়ায়, মঙ্গল ঝরুক জগতের সর্বজীবের প্রাণে। মঙ্গল ঝরুক রাশি রাশি ভারা ভারা মানুষের মানুষীর মনে। নিদারুণ কর্কট, অতিকায় মিষ্টি মেষ, বিপুলা বৃশ্চিক, সহাস্য সিংহ ও প্রাণান্ত পর্যুদস্ত মিথুন সকলের মনে মঙ্গল ঝরুক তরল-কঠিন-বায়বীয় সর্বাবস্থায়। নিখাদ মঙ্গল হোক, সহস্র মাইল শান্তিকল্যাণ হোক প্রতিটি দিন মানুষের। সুপুরিবনের সমাহিত স্বস্তি বিরাজ করুক সর্বপ্রহর। অনাগত অচেনা দিনগুলো অপলক চেনা-চেনা হয়ে ধরা দিক মানুষের হাতে, এঁচোড়ে-পাকনা আর বাছুরের বৃহতের হাতে, শৈশবের মতো কৈশোরের মতো ছেলেবেলার মতো ঘনিষ্ঠ ও চেনা চেনা। গান হয়ে ফেরে যেন বিস্মৃতিবিক্ষত গতস্পৃহ উল্লাস ও খুশিদিনগুলো। যেন হাসি হয়ে, বাঁশঝাড়ে পাতাঝরা হাওয়ার বাঁশি হয়ে, শারদাকাশ হয়ে, শীতের শিশিরভরা সব্জিখামার হয়ে, বর্ষাবিলের হাঁস হয়ে ফেরে দিনগুলো। অচেনা আগত দিনগুলো সহজিয়া সুরে যেন অভিজ্ঞতার অন্তর্গত হয় মানুষের। সমস্ত নক্ষত্র এসে বিষাদগ্রস্ত মেয়েটির নাকের-চিবুকের কাছে জড়ো হয় যেন। ঝলমলিয়া ওঠে যেন তার সমূহ সত্তা, মর্মরিয়া ওঠে যেন দুঃখরাতের গান, অচিরাৎ ঘটে যেন তার দুঃখশোকের সকল অবসান। এই সুরভিত সুন্দর, এই অনিন্দ্য অকলুষ অবয়ব যেন অটুট থাকে, যেন অনাবিল থাকে চিরদিন। যেন না-হারায় কোনোদিন এই নিরবধি হাসি, এই অপরূপ বিষাদ, এই ক্রন্দন-থেমে-থাকা মুখের মিরর। বেঁচে থাকো, কলমিলতার ফুল, তুমুল তুখোড়ভাবে বেঁচে থাকো। প্রথম দেখার সেই জারুলফুলের ঝুলন্ত লতা, ভাটিয়ালি-উত্তাল সেই বৃষ্টিবিলোল দুপুর, অবিকল থাকো।
৩
ক্রমাগত বুড়িয়ে যাচ্ছি ও বুড়িয়েই যাব প্রতিদিন, বুড়িয়ে যাওয়াই নিস্তারহীন নিয়তি জীবনের, তোমরা থাকো তরুণ পল্লবভরা রাস্তাপার্শ্বের হে সার সার শিশুগাছগুলো! মনে রেখো না আগের জন্মের জঙ্গক্ষত, শকূনিকৌটিল্য, গতজন্মের দাহস্মৃতিগুলো। ভুলে যাও, অবিলম্বে ঝেড়ে ফেলো মন থেকে সমস্ত, ভুলে যাও সমুদয় ভুল পদপাত। তোমাকে যে দুঃখ দিয়েছে তাকে রেখো না মনে, তুমি যারে দুঃখ দিয়েছ মনে রাখো তারে। যে এসে চলে গেছে, যে এসে যন্ত্রণাপানিতে তোমায় গলাঅব্দি ডুবিয়ে রেখে চলে গেছে দূরে, তারে আজি ভুলে যাওয়া চাই। মন থেকে মুছে ফেলা চাই আখের ছিঁবড়ে বোধগুলো, পরিত্যক্ত দিন ও রাতের পর্যুদস্ত দশা, ফেরানো চাই মনে ফের আখের গুড় আর খেজুরের রস। নইলে নিশ্চয়ই, নিশ্চিতভাবেই, বঞ্চিত হবে জীবনের অভাবিত বৈভব থেকে। জীবন তোমাকে যা যা দিতে চায়, মনে রেখো, তুমি সিকিভাগও তা নিতে পারো নাই। জীবন অপেক্ষা করছে, তুমি হাত বাড়াবে কখন তার পানে। জীবন অসহ্য এক মাধুর্যের নাম, একে ঠিকঠাক বুঝে ওঠা চাই। জীবন তো আর কেবল নমঃ নমঃ যাপনের নয়, কিড়িমিড়িদন্ত কোনোমতে কাটানোর নয়, জীবন তো উপভোগের। জীবনের ভোগ থেকে, জীবনের উপভোগ থেকে, দূরে সরে থাকা অমার্জনীয় অপরাধ। জীবন সকলের প্রতি সমান সদয় নয়, এইটা ডাহা মিথ্যা বুলি যে জীবন সবার জন্য সমান দয়াদাক্ষিণ্যভরা, জীবন তার প্রতিই কেবল সদয় যে জীবনের প্রতি সদয় ও সৎ থাকে, সচেষ্ট ও সঙ্গপ্রীতিপূর্ণ থাকে। জীবন হোক সূর্যালোকে সয়লাব, সকলের, চন্দ্রালোকে চনমনে মৃদুমন্দ সুবাতাসবহ। সুন্দর ও সম্পন্ন হোক সংসার সবার।
- এপিগ্র্যাফ : প্রেয়ার হল ব্যান্ডের একটা গানপঙক্তি
লেখা / জাহেদ আহমদ নভেম্বর ২০১৩
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS