গার্হস্থ্য দুর্গা : কৃষিময়ালে দুর্গাপূজা ও হালযাত্রা || সজলকান্তি সরকার

গার্হস্থ্য দুর্গা : কৃষিময়ালে দুর্গাপূজা ও হালযাত্রা || সজলকান্তি সরকার

শুধু শাস্ত্র নয় — লোকপুরাণ (Myth), লোককথা (Folk Talk) ও কিংবদন্তি (Legend) সমন্বয়ে আজকের বিষয়ের আলোকপাত; যেখানে সভ্যতার ঊষালগ্নে ‘মিথ’, প্রাগিতিহাসের পালা শেষে ‘টেল’ এবং সভ্যতার উন্নত স্তরে ‘লিজেন্ড’-এর আবির্ভাব। তাই লোকজীবনে ‘শাস্ত্র’ আর ‘পার্যা’-র দখল নিয়ে রীতিমতো দ্বন্দ্ব চলে। পার্যা লোকাচার-আশ্রিত। কথায় আছে, ‘শাস্ত্রের চেয়ে পার্যা বড়’। অনেক সময় লোককথার দ্বন্দ্বে রম্য বিষয়েরও অবতারণা হয়। তবুও পণ্ডিতগণ বলেছেন এসব ‘কথা’-র দ্বন্দ্বেও শুভ পরিণতি রয়েছে। তাই শুরুতে আমার বিনীত কৈফিয়ত, এ-ধরনের লেখায় সমস্ত কথা বা শেষ কথা প্রকাশ করা যায় না।

দক্ষরাজা-মেনকা দম্পতির কন্যা দুর্গা। ময়ালে তাঁকে গৌরী, পার্বতী, উমা, সংকটতারিনী, বিপদনাশিনী, ভবানী ইত্যাদি ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। তিনি মর্ত্যের ভগবান কৈলাসবাসী শিবের পত্নী। তিনি শক্তিরূপে পূজিত হন। মূলত মর্ত্যের কল্যাণে সভ্যতার যুগে দেবী দুর্গার পূজা শুরু হয়। ব্রত অপেক্ষা পূজা রাজসিক ও অধিক ব্যয়বহুল বলে তৎকালে স্বল্প আয়ের মানুষ খুব বেশি করতে পারতো না। তাছাড়া শাস্ত্রীয় পূজায় সরাসরি চাওয়াপাওয়া ও দেবদেবীর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির বিষয়টি ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের মাধ্যমে নানা বিধি-বিধানে সম্পন্ন হয় বলে ধর্মভীরুতা তো আছেই; আছে পাপ-পুণ্যের ব্যপার, ফলে পূজারী হওয়া একসময় সহজ ছিল না।

কালক্রমে বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের নির্দিষ্ট আখড়াবাড়িতে কেবল দুর্গাপূজা হতো। ময়ালের সকলেই তাতে অংশগ্রহণ করতেন। আশেপাশে গাঁয়ের লোকজন বিশেষ করে মহিলাগণ পাতামনৌকা চড়ে ডপকি-করতাল বাজিয়ে গীত গাইতে গাইতে পূজামণ্ডপে আসতেন। গীতে-গানে পূজামণ্ডপ শারদউৎসবে রূপ নিতো। পরবর্তীতে অনেকগুলো গ্রাম একত্র হয়েও দুর্গাপূজা করে। তখন গ্রামভিত্তিক ‘বারোয়ারী’ পূজাকে কেন্দ্র করে প্রতিমা তৈরির প্রতিযোগিতা, পূজার অর্ঘ্য সংগ্রহ, মন্দিরস্থাপন ও গীত-গান সহ যাত্রাগানের মহড়া চলত। ধর্মীয় অনুভূতি আর সামাজিক নিয়মে নানা লোকাচারে মহা আনন্দে পালিত হতো পূজার দিন-ক্ষণ। বিশ্বাস আর ভক্তিতে পরস্পরের বিভেদ ভুলে গিয়ে সকলেই এক মণ্ডপে পূজা দিতো। পূজায় এসব লোকাচারঘনিষ্ঠতা এখন নেই বললেই চলে। বর্তমানে সর্বজনীন দুর্গাপূজা অনেক কম। গোষ্ঠীভিত্তিক ও পারিবারিক পূজা বেশি।

তবে পূজা এবং ব্রত এক নয়। ‘বৃ’ ধাতু থেকে ব্রত শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ মঙ্গল লাভের নিয়মনীতি এবং সংযম অনুষ্ঠান। ব্রতের রীতিনীতি অনার্যদের। বেদ বিহিত শাস্ত্রানুষ্ঠানের অনেক পূর্বে থেকেই সমাজে ব্রত প্রচলিত। তাতে বৈদিকপূর্ব প্রাগার্য অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়িয় সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ‘কিছু কামনা করে যে-অনুষ্ঠান সমাজে চলে আসছে তাকেই বলি ব্রত’। তাঁর মতে ব্রত দুই ভাগে বিভক্ত। শাস্ত্রীয় ব্রত এবং মেয়েলী ব্রত। মেয়েলী ব্রতকে আবার দুই ভাগে ভাগ করেছেন তিনি। কুমারীব্রত ও নারীব্রত। শাস্ত্রবহির্ভূত ব্রত লৌকিক ব্রত। লৌকিক ব্রত আদি। আচারনির্ভর এই ব্রতে নারীদের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে। ঐশ্বরিক শক্তিকে তুষ্ট করার সাধনপদ্ধতি বা রীতিনীতিই ব্রতের আচার। পরবর্তিতে শাস্ত্রীয় ব্রত চালু হয়, যেখানে নারী পুরুষের সমান অধিকার আছে।

তৎকালে কৃষিনির্ভর মানুষের কাছেও লৌকিক ব্রতই ছিল আসল কথা। ঘরে-বাইরে, হাটে-মাঠে, নদীর ঘাটে, রণে-বনে-জঙ্গলে, ক্ষেতে-খামারে অসংখ্য লোকদেবদেবীর ব্রত হয়ে থাকে। যেমন — ষষ্ঠীর ব্রত, সুমতির ব্রত, রূপসী ব্রত, সুবচনির ব্রত, সিঁদল নাটাইর ব্রত, বাঘের ব্রত, মঙ্গলচণ্ডির ব্রত, বিপদনাশিনীর ব্রত, বুড়াবুড়ির ব্রত, ঝটপট ঠাকুরের ব্রত, কর্মাদি ঠাকুরের ব্রত, গাছের ব্রত, গঙ্গাব্রত, সূর্যব্রত, ব্রহ্মাব্রত, ধর্মব্রত ইত্যাদি ইত্যাদি।

ব্রত শুধু কোনো ব্যক্তিবিশেষের ধর্মীয় বিষয় না। আদি অনার্যদের ব্রতে কোনো ব্রাহ্মণ পণ্ডিত লাগে নাই। লৌকিকব্রতে মন্ত্র নেই। তবে পূজায় মন্ত্র আছে, তাতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত লাগে। পূজা ব্যক্তিবিশেষের হয় এবং পূজনীয়র কাছে কিছু চাওয়া হয়। পূজায় সৃষ্টিকর্তার কাছে ব্রাহ্মণের মাধ্যমে একান্ত কিছু চাওয়া যায়। তাই পরবর্তিতে সামাজিক বিভিন্ন বৈষম্যের প্রেক্ষিতে ধনবান মানুষ লৌকিকব্রত ত্যাগ করে শাস্ত্রীয় ব্রত ও পূজায় আগ্রহী হয়। তাই দেবতাপূজা আর্য গোষ্ঠীর।  বিভিন্ন দলীয় লৌকিকব্রতও একসময় পূজায় পরিণত হয়। যেমন — বৃক্ষপূজা, গঙ্গাপূজা,  ব্রহ্মাপূজা, শিব (মহাদেব) পূজা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে দলীয় বিপদনাশিনীব্রতই হয়তবা দুর্গাপূজা যা ব্রতের মতোই দলীয় বা সর্বজনীন। একসময় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বর্ণবৈষম্যের উর্ধ্বে থেকে ব্রতের মাধ্যমে ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলত, খুঁজত সকল মুক্তির পথ। তাছাড়া দলগতভাবে নামসংকীর্তন, হরিলুট, রামমঙ্গল ও মনসামঙ্গল সহ নানা মাধ্যমে তারা পরমব্রহ্মকে অনুসরণ করত। ফলে এই সময়টিতে বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে বর্ণবৈষম্য তেমনভাবে প্রকটিত হয়নি। তখন নির্দিষ্ট মন্দিরে নির্দিষ্ট দেবদেবীর পূজা খুব বেশি ছিল না। তারা মন্দির নয়, সৃষ্টির সবকিছুতেই ঈশ্বরের স্বরূপ খুঁজতো। ব্রাহ্মণ ধরে ঈশ্বর লাভের পথ তাদের মাথায় ছিল না। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে ভাটিময়ালে ব্রাহ্মণদের বসবাসও ছিল কম। গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে পূজার ছলে, ‘ওঁ… চং… স্বাহা…’ বলে পেট চালানোর ব্যাপারও ছিল না। তাই হাওরবাসী বসতঘরের একটি খুঁটিকে (পালা) কেন্দ্র করে বিভিন্ন মতে বিভিন্ন পথে শক্তির উপাসনা করত। ঘরের এই খুঁটিটি ‘মধুমপালা’ নামে পরিচিত। যাকে কেন্দ্র করেই পালন হতো পারিবারিক মাঙ্গলিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। মূলত ঘরের মধুমপালা বা দণ্ডটি হচ্ছে শিবের প্রতীক আর যেখানে (মাটিতে) পুঁতে দাঁড় করানো হয় সেই ভূমি হচ্ছে শিবপত্নী দেবী গৌরীর প্রতীক। তাই শঙ্খঘণ্টা বাজিয়ে মধুমপালার গায়ে ফুলচন্দন সহ সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে ব্রতের মাধ্যমে দেবদেবীকে অনুসরণ করত তারা। বর্তমানে তা আর নেই। শাস্ত্রীয় নিয়মে বাড়ি বাড়ি ঠাকুরঘর। বাড়ি বাড়ি মন্দির। হৃদয়ে নয়, বাড়ির স্থাবরের সীমানায় ঠাকুর বা মন্দির প্রতিষ্ঠা করাই এখন অনেকের চাওয়া।

মানব ছাড়া দেবদেবীকে কে-ইবা স্বীকৃতি দেয়! তাই মর্ত্যে মানবজাতির মধ্যে দেবদেবীদের পূজা পাওয়ার এত আকুলিবিকুলি। শিব মর্ত্যে অনার্য সম্প্রদায়ের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। নিম্নবর্গের মানুষেরা বিশেষ করে বাগদি, বাউড়ি, ডোম, মুচি, মেথর, শব্দকর, পাশুপত সম্প্রদায় ও নন্দী ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত শিবের জীবনযাপনের সঙ্গী। তারাই মর্ত্যের পরাক্রমশালী বীর। আর শিব মর্ত্যের ভগবান। তাই দেবদেবীগণ শিবকে অবলম্বন করেই মর্ত্যে পূজা নিতে আসেন। কৃষিব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত ষাঁড় শিবের বাহন। তিনি কৃষিজীবীদের দেবতা। তাই পার্বতী কৃষিমৌসুমে মর্ত্যে পিত্রালয়ে নাইয়র আসেন এবং পূজিত হন।

মর্ত্যে বিশেষ করে কৃষিনির্ভর অঞ্চলে পূজা বলতে কালীপূজা, মনসা বা পদ্মাপূজা ও গঙ্গাপূজা, গবিন্দের পূজা, জগতধাত্রীর পূজা, জগন্নাথের পূজা, চড়কদেবতার পূজা, জামাইষষ্ঠি পূজা, বুড়াই-বুড়ির পূজা, বনদুর্গার পূজা, দুর্গাদেবীর পূজা, কার্তিকের পূজা, লক্ষ্মীদেবীর পূজা ও সরস্বতী পূজা ইত্যাদির প্রচলন বেশি ঘটে। শুধু তা-ই নয়, স্বপ্নযোগেও অনেক পূজার প্রচলন হয়েছে বলে লোকমুখে কথিত আছে।

কৃষিনির্ভর হাওরাঞ্চলে কথিত আছে মর্ত্যে দেবীদের বাবার বাড়ি। তাই দেবীদের নাইয়র এনে পূজার মাধ্যমে সন্তুষ্টি বিধান ও মঙ্গল প্রার্থনাই পূজার মূল প্রাপ্যতা। এক্ষেত্রে দেবদেবীর মর্ত্যে আসার বারোমাসী নাইয়র গীত ‘মহলা’ রীতি প্রচলিত আছে। যে-কোনো দেবদেবীর আগমনে মহলা রীতিতে এই গীত সময়, বিষয় ও প্রযোজ্যতা বিবেচনা সাপেক্ষে পরিবর্তন করেও গাওয়া হয়। এ-ধরনের গীতের রীতিকে ‘মহলা’ রীতি বলে।

নাইয়র গীত :
দিশা — কান্দে মেনকা দুলালী গো নাইয়রও বিলাসে।।
গৌরী — আইল কার্তিক মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — কার্তিক মাসে গৌরী গো কার্তিকেরও পূজা।।
গৌরী — আইল অগ্রহায়ণ মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — অগ্রহায়ণ মাসে গৌরী গো লক্ষ্মীদেবীর পূজা।।
গৌরী — আইল পৌষ মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — পৌষ মাসে গৌরী গো বনদুর্গার পূজা।।
গৌরী — আইল মাঘ মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — মাঘ মাসে গৌরী গো সরস্বতীর পূজা।।
গৌরী — আইল ফাল্গুন মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — ফাল্গুন মাসে গৌরী গো গবিন্দের পূজা।।
গৌরী — আইল চইত মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — চইত মাসে গৌরী গো চড়ক দেবতার পূজা।।
গৌরী — আইল বৈশাখ মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — বৈশাখ মাসে গৌরী গো জগতধাত্রীর পূজা।।
গৌরী — আইল জ্যৈষ্ঠ মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — জ্যৈষ্ঠ মাসে গৌরী গো জামাইষষ্ঠি পূজা।।
গৌরী — আইল আষাঢ় মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — আষাঢ় মাসে গৌরী গো জগন্নাথের পূজা।।
গৌরী — আইল শ্রাবণ মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা — শ্রাবণ মাসে গৌরী গো পদ্মা দেবীর পূজা।।
গৌরী — আইল ভাদ্র মাস গো বাবা না নিলা নাইয়র

বাবা
ভাদ্র মাসে গৌরী গো বুড়াই-বুড়ির পূজা
আশ্বিন মাসেতে গৌরী শরতেরও কালে
সেই সময় আইবা নাইয়র কাশ ফুলেফুলে।। (মহলা)

শুধু তা-ই নয়, পূজার আয়োজনকে কেন্দ্র করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানান দলীয় আচার ও গীত প্রচলিত আছে। ফলে গীত গেয়ে পূজারীগণ শ্মশানবাসী শিবপত্নী দুর্গাদেবীর আগমনের প্রস্তুতির বিষয়টি দলীয়ভাবে প্রকাশ করতো। স্বামী শিবের গৃহ থেকে বিদায় নিয়ে দুর্গাদেবীর বাবার বাড়িতে নাইয়র আসার লাচারি গীতও গাওয়া হয় মুখ্যাদ্দ্যিয়া রীতিতে। মনে হতো গীতনিরা যেন দেবী দুর্গার সাক্ষাৎ বিষয়াবলি উপলব্ধি করে গীত গাইছে। এ-নিয়ে হাওরাঞ্চলে দেবী বাবার বাড়িতে নাইয়র আসার একটি গীত বিশেষভাবে প্রচলিত আছে —

দুর্গা :
চল রে শ্মশানবাসী, মায়েরে দেখিয়া আসি
আমার মা যে জনমদুঃখিনী রে শ্মশানবাসী।।

শিব :
তুমি যে যাইবা গো গৌরী বাবার বাড়ি নাইয়রে
সন্ধ্যা অইলে ঘৃতের বাতি কে জ্বালাইব মণ্ডপ ঘরে।।

দুর্গা :
জয়া ও বিজয়া দাসী থইয়া যাইব গৃহেতে
সন্ধ্যা অইলে ঘৃতের বাতি জ্বালাইবে মণ্ডপেতে।।

শিব :
যাও যাও ও গৌরী বাবার বাড়ি নাইয়রে
কার্তিক গণেশ দুই শিশু থইয়া যাইও কুঠিরে।।

দুর্গা :
ভাং খাও ধুতুরা খাও শিব মুখে পাকনা দাড়ি
কোলের শিশু গৃহে থইয়া কে যায় বাপের বাড়ি।।

শিব :
যাও যাও ও গৌরী বাবার বাড়ি নাইয়রে
কার্তিক গণেশ দুই শিশু লইয়া যাও সঙ্গে করে।।

একসময় ভাটির ময়ালে এভাবে দেবীর আগমনের বিধিবৃত্তান্ত গীতে-গানে জানান দিয়েই তাঁকে মর্ত্যে আনা হতো। এ-প্রসঙ্গে আমার মা বললেন, “লোকালয় দেবীদুর্গার পিত্রালয়। তাই কৃষিজীবনাচারের কথা চিন্তা করে প্রতি বছরেই দেবী দুর্গা বসন্তে নয়, শরৎকালেই নাইয়র আসেন। আর দেবীর সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত তে-রাত্র নাইয়র শেষে স্বামীগৃহে ফিরে যাওয়ার আয়োজনই বিজয়া দশমী বা যাত্রাদশমী। কারণ, শিবের আদেশ ছিল —

সপ্তমীতে যাইও গৌরী অষ্টমীতে থাকিও
নবমীতে পূজা লইয়া দশমীতে আসিও।

যদিওবা ষষ্ঠীতেও বেলতলায় বেলষষ্ঠীপূজা হয় যা মূলত দেবী আগমনের আনুষ্ঠানিকতা। মূলত পূজার সর্বজনীনতা ও সকলের সম্পৃক্ততা ধরে রেখে আগে থেকেই পূজাকে কেন্দ্র করে শুরু হতো নানা লোকাচার অনুষ্ঠান। ব্রাহ্মণ এবং মন্ত্র পূজার মূল হলেও তার আশপাশ থাকতো লোকাচারেই পরিপূর্ণ।”

মায়ের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতায় আরও জানতে পারি, ভাটির ময়ালে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা মুখ্যাদ্যিয়া গীতের প্রচলন আছে। দেবীর নাইয়র নিয়ে আছে দিনক্ষণ ঠিক করার বারোমাসী গীত। এসব গীত থেকে পূজার বিধিবিধান সম্পর্কে যেমন অনুধাবন করা যায় তেমনি শিবগৃহে কেমন ছিলেন গৌরী তা-ও জানা যায়। দেবী দুর্গা নাইয়র আসিলে মা মেনকা যখন কুশল-মঙ্গল জিজ্ঞাস করেন —

মেনকার জিজ্ঞাসা :
আমার প্রাণের গৌরী উমাধন
বল গো শুনি কুশল-মঙ্গল বিবরণ।।

গীতে দিশা হিশেবে মা মেনকার জিজ্ঞাসাটি প্রতি পঙ্গতি শেষে গাওয়া হয় আর গৌরী বারেবারে তার উত্তর দেন —

১.
দুর্গা :
ভাঙা এক্কান ডেঘরুয়া মাগো এই না শিবের ঘর
চাইর কিনারে নাইগো বেরা ছানি নাই উপর।।

রোদ্র অইলে তাপ লাগে বৃষ্টি অইলে ঝড়ে
বিল্বপত্র মাথায় দিয়া থাকি শিবের ঘরে।।

বারোখানি ঢেকি শিবের চৌদ্দখানি কোলা
রাইতে দিনে কুট্টিয়া ভাঙি জডাভাংগের গোলা।।

ভাং খায় ধুতুরা খায় মাগো মুখে পাখনা দাড়ি
আমি কিছু কইলে মাগে দেখায় বেতের বারি।।

কার্তিক গনেশ দুইটি শিশু ক্ষুধায়ও কাতরি
ক্ষুধার বেলায় ভাত মিলে না ঘুমে গড়াগড়ি।।

২.
মেনকার জিজ্ঞাসা :
আসিয়া জিজ্ঞাসে রানী কও গো উমা মঙ্গলধ্বনি
শিবে তরে কেমন ভালোবাসে গো মা তারিণী।।

দুর্গা :
বাবা হইলা মহারাজ, করইন তিনি দেবকাজ
দিলা বিয়া ভিখারির ঘরে গো মা জননী।।

ঘুম হইতে উঠিয়া বুড়া, খায় দেখি ভাঙের গুরা
তবে বুড়া ভিক্ষার ছলে যায় গো মা জননী।।

কুচুনি নগরে যায়, সারাদিন কাটাইয়া আয়
আমি থাকি পন্থপানে চাইয়া গো মা জননী।।

ভিক্ষা হইতে আইলে বুড়া, আনে কিছু ক্ষুদখুরা
তবে আমি রান্দিতে চুলায় যাই গো মা জননী।।

খাইতে আসে শিব সদাই, তাঁর সাথে আশি ভাই
আমি তাতে কি দিয়া পুসাই গো মা জননী।।

গাঙের পাড়ের কচু-লতি, অলবনে শাক রাধি
আমি তারে পেটের ক্ষুধায় খাই গো মা জননী।।

মেনকার উপদেশ :
পতি নিন্দা করা পাপ, পতি নিন্দা মহাপাপ
পতি নিন্দা কইর না বলি গো মা তারিণী।।

শত কষ্টেও স্বামীগৃহ স্বর্গসম, এটি বাঙালী নারীর বিশ্বাস; যা গৌরী নিজে আচড়িয়ে শিখিয়েছেন।

যদিও নাইয়রি বিদায়ের কাতরতায় প্রমাণ হয় পিতৃগৃহই সুখের নিবাস। বাপের বাড়ির সুখ ছেড়ে কোনো নারী অতি সহজে স্বামীর বাড়ি যেতে চায় না। যা দেবী দুর্গার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। যার ফলে দশমীর দিন ছল করে শিব নিজে এসে গৌরীকে  খৈলাসে নিয়েছেন। নারদমণি ডুমুর বাজিয়ে শিবের এ ছলবার্তা মা মেনকাকে জানিয়েছেন। এ নিয়েও নানা গীত প্রচলিত আছে ভাটির ময়ালে।

দিশা :
চিত্রবটের তলে, নারদে ডাকিয়া বলে
শিব আইলা গৌরী নিবার ছলে।।

মঙ্গলযাত্রা গীত :
মেনকা কান্দে শুনিয়া ডুমুরের ধ্বনি
যাছে মায়ে ও গৌরী খাও স্বরননী।।

গিরিরাজ কান্দে শুনিয়া ডুমুরের ধ্বনি
মঙ্গলযাত্রা করে গো গিরিরাজ নন্দিনী।।

আরিপরি কান্দে শুনিয়া ডুমুরের ধ্বনি
মঙ্গলযাত্রা করে গো গিরিরাজ নন্দিনী।।

পশু-পক্কি কান্দে শুনিয়া ডুমুরের ধ্বনি
মঙ্গলযাত্রা করে গো গিরিরাজ নন্দিণী…।। (মহলা)

দশমীতে মা মেনকা দেবীকে স্বরননী খাওয়াইয়ে শুভক্ষণে যাত্রামঙ্গলক্রিয়াদি সমাপন করেন। দেবী যাত্রামঙ্গল শেষে বিসর্জনকে কেন্দ্র করেও আছে নানা গীত —

বিসর্জন গীত :
মাকে ভাসাইয়া জলে কি ধন লইয়া যাইব ঘরে
ঘরে গিয়া মা বলিয়া ডাকিবো কাহারে।।

গণেশকে ভাসাইয়া জলে কি ধন লইয়া যাইব ঘরে
ঘরে গিয়া গনেশ বলিয়া ডাকিবো কাহারে।।

কার্তিককে ভাসাইয়া জলে কি ধন লইয়া যাইব ঘরে
ঘরে গিয়া কার্তিক বলিয়া ডাকিবো কাহারে।।

লক্ষ্মীকে ভাসাইয়া জলে কি ধন লইয়া যাইব ঘরে
ঘরে গিয়া লক্ষ্মী বলিয়া ডাকিবো কাহারে।।

সরস্বতীকে ভাসাইয়া জলে কি ধন লইয়া যাইব ঘরে
ঘরে গিয়া সরস্বতী বলিয়া ডাকিবো কাহারে…।। (মহলা)

তাছাড়াও দেবী দুর্গার নাইয়র শেষে স্বামীগৃহে যাত্রাকালের দেবীর আক্ষেপের নানা ‘মুখ্যাদ্যিয়া’ গীতও ভাটিময়ালে প্রচলিত আছে।

দুর্গার আক্ষেপগীত :
সোনার নাও সেনার বৈঠা ঝুমকে উঠে পানি
ধীরে ধীরে বাও বাইছা মায়ের কান্দন শুনি।।

সোনার নাও সেনার বৈঠা ঝুমকে উঠে পানি
ধীরে ধীরে বাও বাইছা বাবার কান্দন শুনি।।

সোনার নাও সেনার বৈঠা ঝুমকে উঠে পানি
ধীরে ধীরে বাও বাইছা পড়শি’র কান্দন শুনি…।। (মহলা)

তাছাড়া দশমীতে দেবীযাত্রাকে কেন্দ্র করে কৃষিনির্ভর ভাটির গিরস্তময়ালে হালযাত্রারও প্রচলন আছে। যাত্রাদশমী শুভদিন। তাই এই দিন থেকে গিরস্তঘরে কৃষিকাজের নিমিত্তে গিরস্ত, কামলা ও রাখালগণ তাদের পেশাভিত্তিক কাজের শুভ সূচনা করে থাকে। এই দিন থেকে গিরস্তগণ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কৃষিকাজ শুরু করেন। জমিনে বছরের প্রথম হালচাষ শুরু হয়। বীজ রোপন হয়। প্রতিটি সনাতনী গিরস্তের ঘরে ঘরে কৃষি উপকরণ গরু, লাঙ্গল, জোয়াল, মই, কোদাল, খুন্তি, দড়ি, কাড়া ইত্যাদি দিয়ে লোকাচারভিত্তিক হালযাত্রার প্রচলন এখনও আছে। এ আচার-অনুষ্ঠানে প্রতিটি কৃষি-উপকরণ ভালো করে ধুয়ে মুছে তাতে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। সিঁদুর শুভ-র প্রতীক। উর্বরতার প্রতীক। মার্কারি বা পারদ ও রজঃগুণসম্পন্ন রক্তিমবর্ণ এই সিঁদুর বন্ধ্যাত্ব দূর করে। সিঁদুর দিয়ে ধরে নেওয়া হয় ধরিত্রী এই দিন থেকে রজঃস্বলা হওয়ার প্রস্তুতি নেয়। মাটি মাতৃত্বের প্রস্তুতি নেয়। ফলনের কাল আসে। জমিনে ফসল ফলানোর সময় শুরু হয়। ভাটির জনমনে বিশ্বাস শরতের এ-শুভক্ষণে দুর্গার আগমনের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে গিরস্ত পিতাকে কৃষিকাজে সহায়তা করা। যদিও কোনও কোনও বছর আশ্বিনমাস মলমাস হওয়ায় দেবী কার্তিকে আসেন। তারও যৌক্তিকতা আছে।

কৃষিজীবনাচারের এ-কারণেই ভাটির গিরস্ত-ময়ালে রাম চন্দ্রের অকালে দেবীপূজার রীতিনীতির প্রচলন কম। তিনি বসন্তকালে এ-শক্তির আরাধনা করেছিলেন ভিন্ন কারণে। ফলে স্বর্গপ্রাপ্তি কিংবা শুধু শত্রুনাশে নয় সর্বমঙ্গলের দেবী গিরস্তের মেয়ে দুর্গার আগমনে রবিশস্যাদিরও বিশেষ পরিকল্পনা হয়ে থাকে। পূজাকে কেন্দ্র করে ফসলের বীজ বিনিময় ও বিতরণ হয়। প্রচলিত রাখিবন্ধন তার প্রমাণ। কেননা, জনশ্রুতি আছে, আদিকালে নবপুর (ভিন্ন ভিন্ন নয়টি স্থান) থেকে নানা ধরনের শস্যবীজ ও মাটি নিয়ে গিরস্তগণ পূজায় আসতেন (এখন শুধু মাটির প্রচলন আছে)। একে-অন্যের মধ্যে মাটি, বীজ বিনিময় ও বিতরণ হতো। চাষপদ্ধতি শিখানো হতো। মাটির ধরন ও উর্বরতা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া হতো। বীজ থেকে চারা গজানোর পদ্ধতি, চারা রোপনের সময়কাল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হতো। ফলে অঞ্চল ভেদে ‘কালাই’ চাষীগণ যেমন ‘খেসারি’ চাষেরও সুযোগ পেতেন। তেমনি মাটির উর্বরতা বিবেচনায় উপযোগী ফসল ফলানোর ধারণা পেতেন। মূলত তারাই ছিলেন তৎকালের কৃষিবিদ বা কৃষিবিজ্ঞানী। এভাবেই নানা শস্যে ধন-ধান্যে-পুষ্পে ভরে ওঠে আমাদের এ-বসুন্ধরা। আর এ-লক্ষ্যে দশমীতে দেবীযাত্রাকালে পণ্ডিতগণের পরামর্শমতে আগত ভক্তগণ (কৃষক) হলুদ মিশ্রিত কাপড়ে বীজ সংরক্ষণ করে পুঁটুলি বেঁধে বাড়ি ফিরতেন। হলুদ জীবাণুনাশক, তাই বীজকে ভালো রাখতে এ-নিয়মের প্রচলন।

গিরস্ত বধুগণ কৃষিউপকরণ ধুয়ে মুছে হালযাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আর গিরস্তগণ চাষ দিয়ে জমিন তৈরি করে। মা দুর্গার আশীর্বাদস্বরূপ এই বীজ নষ্ট হওয়ার পূর্বেই জমিনে রোপন হয়। বর্তমানে বিবর্তনের ফলে এ-শস্যপুঁটুলি বা দেবীর আশীর্বাদ শুধু কিছু সরিষাদানা সহ আনুষাঙ্গিকতা সেরে হলুদ ফিতাকাপড়ে গিঁট দিয়ে হাতে-হাতে বছরব্যাপী পরিধানের প্রচলন শুরু হয়। ‘ফসলের জন্য দেবীর আশীর্বাদের বীজ এখন জমিনের পরিবর্তে মানবের হাতে হাতে শোভা পাচ্ছে’। আক্ষেপের সাথে এমন কথাগুলো ভাটির ময়ালে প্রবীণদের মুখে আজও শোনা যায়।


সজলকান্তি সরকার রচনারাশি
গানপারে দুর্গাপূজা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you