কোথাও কোনো চিহ্ন না রেখে হিসহিস করে গড়িয়ে যাওয়া সাপের মতো এই যে শীত চলে যাওয়ার ব্যাপারটা, এটা আমার কাছে খুবই উপভোগ্য। কিন্ত চারপাশে যাপিত জীবনের এত আর্তনাদ আর শশব্যস্ততা যে পাশে একটি জ্যান্ত মানুষ আত্মাহুতি দিলেও আমাদের কাছে তা অনুভূত হয় না। ফলে আমাদের এত সময় কোথায় শীতের বয়ে চলা বা বসন্তের আগমন উপলব্ধি করবার!
আমি খুবই ঋতুকামী প্রকৃতির মানুষ। খুব স্থির আর মনোযোগী হয়ে ঋতুচক্রের আবর্তনটা ফিল করি। প্রেমে পড়ার মতো আমি ঋতুতে পড়ি। স্নাত হই। আপ্লুত হই। প্লাবিত আর পল্লবিত হই। আমুদে হই। থির থির করে বয়ে চলি ঋতুর ভেতর দিয়ে। যদিও ঋতুযাপনে আমি শীতের প্রতি এজন্য বেশি টান অনুভব করি।
পথের পাঁচালীতে সত্যজিৎ রায় যেভাবে বর্ষার আগমনী দেখিয়েছিলেন — বড়শির টোপ ফেলে বসে থাকা টেঁকো লোকটির মাথার উপরে বৃষ্টির ফোঁটা যেভাবে পড়ে বা রোদে শুকোতে দেয়া কাপড় যেভাবে একটানে দড়ি থেকে নামিয়ে ঘরে নিয়ে যায়, তারচেয়েও আরো সূক্ষ্মভাবে আমি ঋতুর আবর্তনটা নিজের মাঝে উপলব্ধি করি।
আর আমাদের শরীরের সাথে তো ঋতুচক্রের যোগ খুবই সক্রিয় এবং ঘনিষ্ঠ। শুধুমাত্র রোদের উত্তাপ, বর্ষার স্যাঁতস্যাঁতে মাঠঘাট আর শীতের কাঁপুনি দিয়ে অন্যান্য সকল প্রাণিই এটা বুঝতে পারে। কিন্তু মানুষ বোঝে অন্য কিছু দিয়ে। ভাব দিয়ে। বিরহ দিয়ে। অভিজ্ঞতালব্ধ সময়রেখা দিয়ে। সেজন্য আমাদের প্রেম ও কামে ঋতুর উপস্তিতি খুব প্রবল।
আমি প্রচন্ড শীত-অবসেসড আর প্রবল জীবনানন্দমুখী হবার পরেও পরে কালীদাসের মেঘদূত খুব পছন্দ করি। এটার অন্যতম কারণ রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত যক্ষের মেঘের ভেতর দিয়ে বার্তা প্রদানের অপূর্ব আখ্যান। প্রিয়ার কাছে গিয়ে বিরহী প্রেমিক যক্ষের নিবেদন পৌঁছে দেয়ার এই যে আকুতি আর তার জন্য মেঘের সাথে সংলাপ এই অসামান্য অনুভূতি তো কেবল মানুষই পেরেছে। নমস্য মহাকবি কালিদাস পেরেছেন।
মধ্যযুগের কৃষ্ণকীর্ত্তনে যে অনেক ধরনের অভিসারের কথা বলা হয়েছে এই সবই প্রেমিকপ্রেমিকার ঋতু-উপযোগী মিলিত হবার উপলক্ষ্য মাত্র। ছয় ধরনের অভিসার উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে; তার মাঝে বিস্মিত হবার মতো বিষয় হলো : কুয়াশাভিসার নামেও এক প্রকারের অভিসার রাখা হয়েছে।
আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো কোনো ঋতুকেই তার বন্দনা থেকে বাদ দেননি। তার বর্ষামঙ্গল, ফাগুন-সম্ভাষণ তো বাঙালির প্রেমপিরিতির ভাষ্য হয়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে।
আমার প্রিয় জীবনানন্দ দাশ তো শীত আর হেমন্ত দেখে এই বিপন্ন পৃথিবীতে আরো বেশি বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিলেন। যার ফলে আমাদের অবসরের গানে আর কিছু সাথে থাকুক আর না থাকুক উটের গ্রীবার মতো জানালার পাশে উঁকি দিয়ে জীবনানন্দ সাথে থাকেন। মরে-যাওয়া মানুষের মন আর পৃথিবীতে কীভাবে হৃদয় বাঁচে তা পরখ করে দেখতেই সারাজীবন উন্মুখ ছিলেন এই কবি। আর তা ব্যক্ত করে গেছেন কোনো-এক বিশেষ ঋতুর প্রতি তার অবসেশন দেখিয়ে।
আমার কাছে তাই মনে হয় মানুষের শরীর হলো এক প্রকার ঋতুর প্রস্রবণ। যার রোদে ছায়া লাগে। বর্ষায় মাথার উপরে ছাদ লাগে। শীতে উষ্ণতা লাগে। আর প্রেম বা কামে লাগে শিহরণ। নারীর শরীরে যেমন প্রেমের আগুন আর কামের আগমন দিয়ে পৌঁছে যায় সৃষ্টির মহাবার্তা; আমাদের শরীরের ভেতরে শীত এভাবে সারাবছর ধরেই জন্মায়। এজন্য আমাদের শরীর হলো ঋতুবতী শরীর। আমাদের মন তাই সর্বদাই ঋতুকামী; সে আমরা বুঝতে পারি বা না-ই পারি!
১০.০২.২০২৩
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS