ব্যক্তিগত ফরিদা পারভীন

ব্যক্তিগত ফরিদা পারভীন

শেয়ার করুন:

পরবর্তী জীবনে লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে খ্যাতি লাভ করলেও ফরিদা পারভীন আমার ও সমপ্রজন্মের আমাদের প্যারেন্টদের কাছে তার লাস্ট এই লালনব্র্যান্ডিঙের আগে থেকেই বিখ্যাত। বরং ওই আগের খ্যাতিটাই অনেক লম্বা টাইমের। ফরিদা পারভীনের লালনশিল্পীর পরিচয় আমাদের চোখের সামনেই তৈয়ার হতে দেখেছি। মৃত্যুর পরে এখন লক্ষ করছি সবাই তাকে এক ধরনের নিবেদিতা লালনশিল্পী হিশেবে গ্রেইড করছেন। ফরিদার ইন্তেকালের পরে এই কয়দিনে যেসব প্রিন্ট ও ভিশ্যুয়াল দেখলাম তাতে মনে হলো উনার লালনশিল্পী পরিচয়ের আগের লম্বা টাইমটাকে যেন উপেক্ষাই করা হচ্ছে।

এইখানেই নিবন্ধটা প্যারাগ্রাফ ভাঙল। ফরিদা পারভীনের লালনশিল্পী হবার আগের শিল্পীজীবনটা আমার কাছে বেশি হৃদয়াকর্ষক মনে হয়। কেন মনে হয়, স্বেচ্ছায় সেই ইম্প্রেশন সেই বুঝবাজগুলা বাক্যে ধরা যায় কি না ট্রাই করে দেখি। বিশেষ ফরমায়েশ নাই কারো পক্ষ থেকে, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই লিখতে লেগেছি। মৃত্যুর পরেই খিয়াল করলাম, ফরিদা পারভীন নামটা শুনে একনিঃশ্বাসে আমি তিনটা গান স্মরণ করি। তিনটা। পাঁচ নয়, সাত নয়, তিন। উদ্দেশ্যের কোনো প্রণোদনা এখানে, সত্যি বলছি, নাই। নিছক তুলনা বা প্রতিতুলনা দিয়া আমি ঠিক বুঝাতে পারব না আগের টাইমটা আমার কাছে কেন মনে হয় বেশি ইম্প্যাক্টফ্যুল পরের টাইমের চেয়ে।

এর আগে বলি, তিনটা গান বলতে যে-তিনটা আমি নিঃশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করি, কোন সেই তিন ফরিদা পারভীন। কোনো ক্রম না ধরে, সেই গানগুলো হচ্ছে, ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদীতটে’, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে / প্রেমের কী স্বাদ আছে বলো’। ওই-ই। তিনের আগে এবং পরে আছে আরও অনেক। ফরিদাফ্যান যারা, তাদের জন্য বলছি, আমার ব্যক্তিগত ফরিদা পারভীন আঁকতে বলা হলে এই তিনেই আঁকব আমি। তিনটা গানই প্রিয়, শুধু আমার নয়, আমাদের পরিবারের সকলের। ফরিদা পারভীন বললেই প্রথমে এই তিন গান, পরে লালন ও অন্যান্য পরিচয়।

আমাদের গানশ্রবণের আর্লি টাইমের পুরাটা আবর্তিত হয়েছে বেতারের বরাতে, টেলিভিশন তথা সবেধন নীলমণি বিটিভির সুবাদেও। তবে, স্টেরিয়ো প্লেয়ারের ঘরে ঘরে পত্তনি ঘটতে শুরু করেছে এই সময়টায়। ফিতার ক্যাসেট আর টেপ রেকর্ডার। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পছন্দের নিরিখে ক্যাসেট কপি করিয়ে এনে সেইসময় চল ছিল শোনার। আমরা এমনকি বিটিভির সংগীতানুষ্ঠান চলন্ত অবস্থায় টেপের রেকর্ডিং বাটন টিপে বেছে বেছে গান তুলে রাখতে পারতাম। এমন আনাড়ি কপির সাউন্ড কোয়ালিটি নিম্নমানের হলেও কথা মুখস্থ করার জন্য ওইটুকু যথেষ্ট হতো। মুখস্থ গান গাইতে গাইতে সেই জীবনের দীর্ঘ পথ চলেছি আমরা।

আমাদের পারিবারিক ফরিদা পারভীন হিশেবে ক্যাসেটে কপি করা গানগুলার ভিতর ওই তিন তো ছিলই, সঙ্গে ছিল অনুরূপ কিছু ভক্তিভাবমূলক গান। অনেক পরে জেনেছি ফরিদা পারভীনের ভক্তিভাবমূলক গানগুলার মধ্যে বেশকিছু ছিল ফকির লালনের গান। ধরা যাক, ফরিদার কণ্ঠে ‘মিলন হবে কতদিনে / আমার মনের মানুষের সনে’ গানটা আমরা যখন দেদার শুনতেসি তখন ওইটা যে লালন সাঁইয়ের গান এই সেন্স আমাদের ভিতর ছিল না। যার ফলে গানটাকে ভক্তিবিভূতিমূলকতা ছাড়া প্র্যাক্টিক্যাল ডেইলি লাইফের প্রেমবিরহের জায়গায় রেখে শোনার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু ভক্তিমূলকতা যুক্ত হয়েছে পরে, একটু ডাঙ্গর হবার পরে।

গ্রেইডিং বলি কি ব্র্যান্ডিং, একবার হয়ে যাবার পরে একটা আর্ট তার অশেষ অর্থান্তরের অলৌকিক সম্ভাবনাটা হারায়া ফেলে বলে আমার মনে হয়। আর্টের সুরক্ষাকল্পে গ্রেইডিং/ব্র্যান্ডিং সাময়িক সুবিধা দিলেও পরিণামে আর্ট সংকুচিত হতে থাকে। এই বিপদ সমস্ত গ্রেইডেড/ব্র্যান্ডেড আর্টেরই রয়েছে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত গ্রহণেচ্ছা হ্রাস পায় দামি জিনিশের বেলায়। জিনিশ যত দামি যত সেক্লুডেড স্বতন্ত্র হবে, সর্বসাধারণের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা মার খাবে। একসময় সেই জিনিশ বিশেষ বিশিষ্টদের গলাধঃকরণ করা ছাড়া আর-সকলের অভিগম্যতা তাতে কমে যাবে। এই দশা রবীন্দ্রনাথের নজরুলের গানের ক্ষেত্রে যেমন ঘটতে দেখেছি, লালনগানের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটছে দেখে চলেছি।

কিন্তু ফরিদা পারভীন যখন থেকে লালনগান গাইতে শুরু করেছেন, যখন থেকে ক্যাসেটে সেইসব গান আমরা শুনছি, মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে লালনগান গাওয়াটাকে একটা ক্লাস কালচারে নিয়ে গেছেন শুধু তার ভক্তিস্নিগ্ধ জোরেলা গাওয়া দিয়ে। ফরিদা পারভীন লালনপদের কণ্ঠবাহিত পরিবেশনার ক্ষেত্রে এমন একটা ভাব উপহার দিয়েছেন, মনে হয় এ যেন শুধু কণ্ঠশিল্পীর বা শ্রোতার নয়, এ যেন আবহমানের ভেলায় চেপে আসা এক অনন্য সর্বমানবিক সম্পদ। ফরিদা পারভীনের আগের লালনগাওয়া আর ফরিদা পারভীন নামক অভিজ্ঞতা লাভের পরের লালনগাওয়া, আমার মনে হয় গায়ক ও শ্রোতা মাত্রই স্বীকার করবেন, এক নয়, এক থাকতে পারে না।

ফরিদা পারভীনের লালনব্র্যান্ডিং হয় নাইন্টিসে এসে। এর আগেই তিনি বিখ্যাত আমাদের মায়েদের জেনারেশনের কাছে, তার ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে’ এবং ‘মল্লিকাদি’ দিয়ে। এই দুই গানের আবেদন আশির দশকের বাংলাদেশের নারীদের কাছে ব্যাপক। কতটা ব্যাপক, কোন দিক দিয়ে ব্যাপক, জরিপ নাই কিন্তু বলা যাবে চেষ্টা করলে। এর পরের সময়ের ফরিদা পারভীনের লালনপদনির্ভর গানও আমাদের আম্মারা পারিবারিক টেলিভিশনে হতবাক বিস্ময়ে দেখে গেছেন। সঙ্গে আমরাও। উনার গাওয়া ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়’, ‘দ্যাখ না মন ঝকমারি এই দুনিয়াদারি’, ‘ক্ষম ক্ষম ক্ষম অপরাধ’, ‘জাত গেল জাত গেল বলে এ কী আজব কারখানা’ গানগুলা আম্মাদের ভালো লাগত। আর, ওই, তিনের এক, তারপরের চতুর্থটি, ‘মিলন হবে কতদিনে’ গানটা।

ক্যাসেটে আমরা তখন নুসরাত ফতে আলি খান আর আব্দা পার্ভিন শুনছিলাম, একসময় এর পাশে এসে বসেন ফরিদা পারভীন, স্বমহিমায় আবিষ্ট করে রাখেন তার শ্রোতাদের। বহুলাংশে এইটা হয়েছে তার লালনগান গাইবার পর থেকে। নিজের গলা ও গায়কী তিষ্ঠ হয় পারভীনের লালনপদে এসেই। রীতিমতো দীক্ষা নেয়া লালনশিল্পী হিশেবে নিজেকে বেড়ে উঠতে দিলেন তিনি। দীক্ষিত কণ্ঠশিল্পীদের এর আগে আমরা জানতাম রবীন্দ্রনাথের বা নজরুলের গানের তরফদারি করেন। ফরিদা পারভীন এই বিবেচনায় লালনের গানের তরফদার নন যে তিনি অমুখ আখড়ার অমুক গুরুজির সিলসিলা মান্য করেন, ফরিদার সিলসিলা আমার মনে হয় তিনি নিজের হিম্মতে নিজের কল্পনাপ্রতিভা খাটিয়ে তৈরি করে নিয়েছেন। তার বেঞ্চমার্ক তিনি নিজে।

ক্যারিয়ারের সুস্পষ্ট তিনটা ফেইজের শেষে এসে তিনি থিতু হয়েছেন লালনের পদে। এর আগে তিনি ইন জেনারেল বাংলা আধুনিক গানের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। কণ্ঠে স্বমহিমায় ভাস্বর তিনি তখনই। নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি লালনের পদাবলি কণ্ঠচর্চার সময়টায় সেই সময়কার কাগজের খবরও হয়েছেন। আবু জাফরের কথায় কম্পোজিশনে সেই ফরিদা পারভীন স্বতন্ত্র মহিমায় স্মরণীয় হবেন, শুধু লালন শ্রাইনের ডিসাইপল নয়। বাংলাদেশের সংগীতের অঙ্গনে সেলেব্রিটি হিশেবেই তিনি শিফট করেছিলেন লালনের গানের রীতিমতো সাধনায়। সিদ্ধও হয়েছিলেন। চূড়ায় ছিলেন দীর্ঘসময় নিজের সিদ্ধির। ফরিদার ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবনেরও ছায়াপাত এই শিফটিঙে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। সেই টাইমের নিউজপেপারের সুবাদে এসব খবর আমাদেরও কানে এসেছে।

সেই সময় পর্যন্ত, মনে রাখতে হবে, পার্বতী বা আরও যারা বাউল জন্রায় বিখ্যাত তাদের আবির্ভাব হয় নাই। তিনি, ফরিদা পারভীন, নিজে একটা আলগ স্কুল অফ থট হয়ে উঠেছেন ক্রমশ মধ্যবিত্তের লালন শ্রবণের ধারায়। একটা সময় এমন গিয়েছে যে, হিম্মতি মিউজিশিয়্যানদের মধ্যে ফিরোজা বেগম যেমন নজরুলগানে এক্সিলেন্সের নজির, যেমন সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা ব্যানার্জি ঠাকুরগানে, তেমনি লালনগানে ফরিদা পারভীন। নুসরাত ফতে আলি খান বা আব্দা পার্ভিনের মতো সুফিকালাম গায়কদের শোনার সময় আমাদের যেমন ঐশ্বরিক অভিজ্ঞতা হয়, কেবল গলার আওয়াজের কারণেই মনে হয় এই আওয়াজ এই নিবেদন এই ডিভৌশন অন্য জগতের অন্য মর্তবার, ফরিদা পারভীনের লালন রেন্ডিশন শোনার সময় এক্স্যাক্ট তা-ই হয়।

তা সত্ত্বেও, তবু, ফরিদা পারভীন বলতে আমি, ব্যক্তিগতভাবে, সেই তিনটা গানের কথাই ফিরায়া আনব, শুরুতে যেই তিনটা গানের উল্লেখ করেছিলাম। ওইটা আউট অফ দ্য বক্স একটা ব্যক্তিত্ব। মল্লিকাদি, নিন্দার কাঁটা আর এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে, দুইহাজারতিন থেকে দুইহাজারসাত অব্দি টাইমফ্রেইমে, এক হাওরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজের সূত্রে প্রাইমারি ইশকুলগুলায় ভিজিট করতে হতো আমায়। এক বৃহস্পতিবার পড়ন্ত দুপুরবেলায় তেমনই এক ইশকুলের অদূর দিয়া পারাইবার সময় কানে এসে পশে এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদীতটের গান। এই মিলন। এই বিরহ। এই সংকট। সাঁকোর তলায় খাল, খালের পারে বাঁশের ঝাড়, তারপরে এক মস্ত মাঠ, মাঠের শেষেই ইশকুল। সপ্তাহান্তে সাংস্কৃতিক শিক্ষায় গাইছিল স্কুলশিক্ষার্থীরা। সমবেত। সে যে কী ইম্প্যাক্ট! কুড়ি কুড়ি বছরের পরেও স্কুলের সংস্কৃতিশিখনক্লাসে এই গান এই শিল্পী কীভাবে ক্রিয়াশীল, বাঁশঝাড়ের চিপায় খাড়ায়া আবছা আওয়াজের ওই বৃন্দকণ্ঠ শুনছিলাম আর ভাবছিলাম। এই স্মৃতিরও এরই মধ্যে এককুড়ি বছর পেরিয়ে গেছে।

সেই ফরিদা পারভীন চলে গেলেন, দুইহাজারপঁচিশে, সেপ্টেম্বরের তেরো তারিখে। বেহেস্ত নসিব হোক তাঁর।

জাহেদ আহমদ ২০২৫


জাহেদ আহমদ রচনারাশি
গানপারে ফরিদা পারভীন

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you